একজন সাধারণ মানুষ তার কর্মের সুবাদে এই সমাজ ও পৃথিবীতে যে অনন্য দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করতে পারে, তার জ্বলন্ত উদাহরণ সালুমারাদা থিম্মাক্কা। প্রকৃতিপ্রেমিক এই নারীর কোনো শিক্ষাগত যোগ্যতা নেই। কিন্তু স্বশিক্ষিত মানুষ হিসেবে তিনি জানেন, প্রকৃতির মাঝেই খুঁজেই পাওয়া যায় জীবনের প্রতি ভালোবাসা। সমাজের মানুষ অবহেলা করলেও প্রকৃতি দু'হাত ভরে তাকে ভালোবেসেছে। কর্নাটকের গুব্বি তালুকের বাসিন্দা থিম্মাক্কা এক অসহায় দরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন।
শৈশবে স্কুলে যাওয়ার সুযোগ পাননি। ছোটবেলা থেকেই ফসলের মাঠে শ্রমিক হিসেবে কাজ করতে শুরু করেন। ২০ বছর বয়সে পাশের গ্রামের মাগাদি তালুকের হালিকাল গ্রামের বাসিন্দা বেকাল চিক্কাইয়ার সাথে তার বিয়ে হয়। চিক্কাইয়ার ছিলেন দিনমজুর। খুবই গোবেচারা আর সহজ-সরল। কথা বলতে গেলে তোতলাতেন। পরিবারে ছিল না স্বচ্ছলতা। এমন অনেক দিন গেছে, পানি পান করেই থিম্মাক্কাকে দিনযাপন করতে হয়েছে। এই দুঃখ-কষ্টের মাঝেও স্বামী ও পরিবারের প্রতি তার অকুণ্ঠ ভালোবাসা ছিল। সংসারের অভাব মেটানোর জন্য স্বামী-স্ত্রী দুজনেই মাঠে কাজ করতেন।
এভাবে তাদের বিবাহিত জীবনের ২৫ বছর কেটে গেলো। কিন্তু তারা ছিলেন সন্তানহীন। এত বছরেও থিম্মাক্কার গর্ভে কোনো সন্তান জন্ম না নেয়ায় সমাজের লোকেরা তাদেরকে প্রতিনিয়ত উপহাস ও অবজ্ঞা করতে থাকে। সমাজ থেকে তাদেরকে একঘরে করে দেয়া হলো। এমন কঠিন পরিস্থিতিতেও থিম্মাক্কা ছায়ার মতো তার স্বামীর পাশে ছিলেন। সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে স্বামী-স্ত্রীর দিনগুলো কাটছিল বেশ একাকী, নিঃসঙ্গ।
তখন থিমাক্কা আর চিক্কাইয়া দুজনে সিদ্ধান্ত নিলেন, তারা গাছ লাগাবেন। সন্তানের মতো তাদের প্রতিপালন করবেন। পরিবার পরিজন ও সমাজ থেকে দূরে সরে গিয়ে এ যেন প্রকৃতির মাঝেই নিজেদের সান্ত্বনা খোঁজার অপার চেষ্টা। আর এভাবেই তারা সমাজের বঞ্চনা আর অপমানের জবাব দিতে চান। কিন্তু গাছের চারা পাবেন কোথায়? চারা কেনার পয়সা তো নেই। তাই দুজনে ঠিক করলেন, পথের আনাচে-কানাচে অবহেলায় জন্ম নেয়া বটগাছের চারা তুলে এনে লাগাবেন।
এবার চিন্তা- চারাগুলো লাগাবেন কোথায়? গাছ লাগানোর মতো তাদের তো নিজস্ব কোনো জমি নেই। সিদ্ধান্ত নিলেন, কর্ণাটকের কুদুর এবং হালিকালের মধ্যকার মহাসড়কের দু'পাশে তারা গাছের চারা লাগাবেন। যে-ই ভাবা, সে-ই কাজ।
প্রথম বছর কষ্ট করে দশটি বটের চারা জোগাড় করে তা রাস্তার ধারে রোপন করলেন। দ্বিতীয় বছরে ১৫টি, তৃতীয় বছরে ২০টি বটগাছের চারা লাগালেন। একসময় এই সন্তানদের যত্নআত্তি করার জন্য চিক্কাইয়া দিনমজুরের কাজ ছেড়ে দেন। থিম্মাক্কা সারাদিন ফসলের মাঠে কাজ করে যা রোজগার করতেন, তা দিয়েই দুজনের সংসার চলতো। কাজ সেরে বাড়ি ফিরে এসেই থিম্মাক্কা স্বামীর সাথে সন্তানদের দেখভালে নেমে পড়তেন।
নিত্য অভাবের মধ্যেও এই দম্পতি থেমে থাকেননি। নিত্য নিয়ম করে গাছগুলোকে প্রতিপালন করে গেছেন। অপত্য স্নেহে গাছগুলোকে ভালবেসে বড় করে তুলেছেন। প্রতিদিন খুব ভোরে উঠে আশেপাশের পুকুর থেকে জল তুলে নিয়ে দীর্ঘ চার কিলোমিটার রাস্তায় লাগানো গাছগুলোতে স্বামী-স্ত্রী দুজনে জল দিতেন, নিড়ানী দিতেন, আগাছা পরিষ্কার করতেন। পশুপাখি যাতে গাছের কোনো ক্ষতি করতে না পারে, তার জন্য প্রতিটি গাছে বেড়া লাগানোর ব্যবস্থা করতেন।
১৯৯১ সালে চিক্কাইয়া মারা যাওয়ার পর থিম্মাক্কা একা হাতে নিজের এবং তার গাছেদের দায়িত্ব তুলে নেন। কী রোদ, কী বৃষ্টি কিংবা চরম শীতেও থেমে থাকেনি তার এই কাজ। গাছের প্রতি তার এই ভালোবাসা একসময় গ্রামবাসীদের মধ্যে প্রভাব বিস্তার করতে থাকে। তার কাজকে সম্মান জানিয়ে গ্রামবাসীরা তাকে ‘সালুমারাদা’ বলে ডাকতে শুরু করেন। কন্নড় ভাষায় যার অর্থ ‘গাছেদের সারি’।
সময়ের সাথে সাথে হালিকাল থেকে কুদুর পর্যন্ত প্রায় ৩০০টি গাছের চারা লাগিয়ে সন্তানের মতো বড় করে তোলেন থিম্মাক্কা। বিশ্ববাসী তাকে এক মহান পরিবেশবিদ হিসেবে চিনতে শুরু করে।
বোটানিক্যাল সার্ভের এক তথ্যমতে, থিমাক্কা ৬৫ বছর ধরে যে গাছগুলো লাগিয়েছেন, তার প্রতিটি গাছের বাণিজ্যিক মূল্য কোটি টাকার উপর। চাইলে এই সব গাছ বিক্রি করে বিপুল পরিমাণ অর্থ উপার্জন করতে পারতেন থিম্মাক্কা। কিন্তু তার সে চিন্তা নেই। অর্থের প্রতি তার কোনো মোহ নেই। তিনি তার রোপনকৃত সব গাছ রাষ্ট্রকে দান করেছেন, বিনিময়ে চাননি কিছুই।
সিএনএনকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে থিম্মাক্কা তার জীবন সম্পর্কে জানান,
“এটা আমার ভাগ্য যে আমার কোনো সন্তান নেই। এ কারণেই আমি আর আমার স্বামী মিলে গাছ লাগানোর এবং তাদের বড় করে তোলার সিদ্ধান্ত নিই। তাদেরকে আমাদের সন্তানের মতো করেই দেখাশোনা করতাম। তারাই আমাদের জীবনের আশীর্বাদ।”
নারী শক্তির এক বড় দৃষ্টান্ত হয়ে রয়েছেন ১০৫ বছরের বৃদ্ধা থিম্মাক্কা। ২০১৬ সালে বিবিসির এক জরিপে বিশ্বের ১০০ জন প্রভাবশালী নারীর মধ্যে স্থান করে নিয়েছেন তিনি। বিবিসির সবর্শেষ এক জরিপে জানা যায়, গত ৮০ বছরে তিনি প্রায় ৮০,০০০ গাছের চারা রোপন করেছেন এবং তাদের মধ্যে ৪০০টি রয়েছে তার সন্তানতুল্য বটবৃক্ষ।
এই মহিয়সী নারী বিভিন্ন পর্যায় থেকে সম্মানিত হয়েছেন বারবার। ২০১৫ সালে তার জীবনী নিয়ে প্রকাশিত হয় ‘সালুমারাদা সর্দারনী’। তার জীবনের নানা সত্যি ঘটনা নিয়ে লেখক ইন্দিরামা বেলুর বইটি রচনা করেন। ১৯৯৬ সালে পরিবেশ রক্ষায় তার অসাধারণ ভূমিকার জন্য থিম্মাক্কাকে ‘জাতীয় নাগরিক সম্মান’ এ ভূষিত করা হয়। ১৯৯৭ সালে তাকে ‘ইন্দিরা প্রিয়দর্শিনী বৃক্ষমিত্র’ পদকে সম্মানিত করা হয়। এছাড়া নিজ রাজ্য, দেশ এবং দেশের বাইরে আন্তর্জাতিক স্তরেও তিনি বহু পুরস্কার পেয়েছেন। ২০১৯ সালে ভারতের সর্বোচ্চ নাগরিক সম্মান ‘পদ্মশ্রী’ পদকে ভূষিত হন এই গুণী ব্যক্তি।
২০১৪-১৫ এবং ২০১৫-১৬ সালে কর্ণাটক সরকার ‘সালুমারদা থিমাক্কা ছায়া পরিকল্পনা' তহবিল ঘোষণা করে। এই তহবিলের মাধ্যমে রাজ্যের নানা প্রান্তে, গাছ লাগানোকে ব্যাপকভাবে উৎসাহিত করার পরিকল্পনা নেয়া হয়। সমাজ ও পরিবেশের প্রতি থিম্মাক্কার অসাধারণ কর্মোদ্যোগের কথা স্থান পেয়েছে ভারতীয় স্কুল-কলেজের পাঠ্যবইয়ে।
এই জীবনে তিনি অনেক কিছুই পেয়েছেন। জীবনের প্রতি মুহূর্তে ছোট ছোট কত অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন, তার ইয়ত্তা নেই। ১০৬ বছর বয়সেও তার বিশ্রাম নেয়ার কোনো পরিকল্পনা নেই। এখনও গাছ লাগিয়েই যাচ্ছেন এই নারী। এখনও তিনি স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসেন এবং সেই স্বপ্ন সম্পাদনের জন্য নিরন্তর তার চেষ্টা চালিয়ে যান।
যে গ্রামের মানুষেরা একদিন তাকে এবং তার স্বামীকে দূরে সরিয়ে দিয়েছিল, তাদের জন্য কিছু করার জন্য প্রতিনিয়ত চিন্তা করেন। সালুমারাদা থিম্মাক্কার এখন একমাত্র স্বপ্ন, তার অঞ্চলের গরীব-দুঃখীদের জন্য একটি হাসপাতাল নির্মাণ করার, যেখানে সর্বনিম্ন ফি দিয়ে তারা সর্বোত্তম চিকিৎসা সেবা পেতে পারেন। এই স্বপ্ন নিয়েই তিনি এখন প্রতিদিন ঘুমাতে যান। তিনি আশাবাদী, মৃত্যুর আগে তার এই স্বপ্ন বাস্তবায়িত হবে।
পথচারীদের কাছে গ্রাম হালিকাল থেকে কুদুর পর্যন্ত প্রায় চার কিলোমিটার পথ জুড়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা ছায়াময় সুবিশাল গাছগুলো যেন থিম্মাক্কার ভালোবাসারই এক অনন্য নিদর্শন হয়ে রয়েছে। বর্তমানে কর্ণাটক রাজ্য সরকার থিম্মাক্কার লাগানো গাছগুলোর দেখাশোনার সমস্ত দায়িত্ব নিয়েছে। এ প্রসঙ্গে থিম্মাক্কা এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন,
“তার সন্তানদের তিনি নিজে প্রতিপালন করতে পারলেই খুশি হতেন। কারণ এই জীবনে কখনোই তিনি এবং তার স্বামী কারও সাহায্য চাননি।”
থিম্মাক্কার গাছ লাগানোর এই নিঃস্বার্থ প্রচেষ্টা অনেককেই উদ্বুদ্ধ করেছে। তার এই কাজকে এগিয়ে নেয়ার জন্য প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে ‘সালুমারাদা থিম্মাক্কা ইন্টারন্যাশনাল ফাউন্ডেশন’। এটি একটি পরিবেশ সংরক্ষণকারী প্রতিষ্ঠান। পরিবেশ সংরক্ষণের পাশাপাশি এই সংগঠন স্কুল নির্মাণের মাধ্যমে গ্রামের শিশুদের শিক্ষার ব্যবস্থা করে। যেসব এলাকায় স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছানোর সুুযোগ নেই, সেখানে প্রয়োজনে স্বাস্থসেবা প্রদানেও এই সংগঠন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে।
হয়তো কালের নিয়মে থিম্মাক্কা একদিন মারা যাবেন। কিন্তু তার সন্তানস্নেহে পালিত গাছগুলো বেঁচে থাকবে আরও কয়েকশ' বছর তার স্মৃতি ও ভালোবাসা নিয়ে। সেসব গাছের ডালপালায় আশ্রয় নেবে পাখিরা, সেখান গড়ে তুলবে তাদের সংসার, পরিশ্রান্ত পথচলতি পথিকরা ক্ষণিকের বিশ্রামের জন্য গাছের ছায়াতলে আশ্রয় নেবেন, আর এভাবেই সবার মাঝে বেঁচে থাকবে এই বৃক্ষমাতার কর্মজীবনের কথা।
থিম্মাক্কা বর্তমান প্রজন্মের কাছে এক অনুপ্রেরণার নাম। তার মতো এমন শক্তির উৎসের কাছে তাই তরুণ প্রজন্মকে বারবার তাই মাথা নোয়াতে হয়। তিনি কোনো তথাকথিত পরিবেশবিদ নন। ছোট এক গ্রামে খুবই সাধারণ জীবনযাপন করা আটপৌরে এক নারী। কিন্তু কাজের মধ্যে দিয়ে তিনি নিজেকে এক অন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। তার মতো এমন জীবনীশক্তি ক'জনারই বা আছে! পরিবেশের প্রতি তার এই দৃঢ় সঙ্কল্প এবং পরিবেশ সুরক্ষায় তার এই নিরবচ্ছিন্ন কর্মযজ্ঞ আগামী প্রজন্মের জন্য এক অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।
This is a bengali article. This is story about Saalumarada Thimmakka- who is known as a mother of trees. She planted over 8000 trees in her 65 years including over 400 banyan trees which have earned her the name ‘Saalumarada Thimmakka’ which means ‘a row of trees’ in Kannada. All the sources are hyperlinked into the article.
Featured Image: mycarmesi.com