১৯২৫ সালের দিকে হঠাৎ করে সরগরম হয়ে উঠলো শিকাগোর অপরাধ জগত। বেশ কয়েক বছর ধরে পুলিশের ব্যর্থতায় এই অঞ্চলে শক্তভাবে ঘাঁটি গড়ে তুলেছে বেশ কয়েকটি মাফিয়া দল। কিন্তু এরা সরাসরি একে অপরের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়নি বহু বছর ধরে। এই অলিখিত শান্তিচুক্তির অবসান ঘটলো সে বছর। জর্জ মরানের সন্ত্রাসীরা সেবার শিকাগোর শীর্ষ মাফিয়া টরিওর উপর আক্রমণ করে বসলো। আক্রমণের সিদ্ধান্ত যতটা না ভয়াবহ ছিল, তার চেয়ে ভয়াবহ হচ্ছে, সন্ত্রাসীরা টরিওকে হত্যা করতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হলো। আর এরকম ঘটনা মানেই দীর্ঘমেয়াদি মাফিয়া সংঘর্ষের পূর্বাভাস। তাই শিকাগোর পথেঘাটে বিরাজ করছে টান টান উত্তেজনা।
পরিস্থিতি যখন এই, তখন সবার উত্তেজনায় জল ঢেলে দিলো স্বয়ং টরিও। প্রাণনাশের চেষ্টায় তিনি বড্ড ঘাবড়ে গেছেন। এ যাত্রায় নাহয় বেঁচে গেলেন, পরেরবার বেঁচে থাকবেন কি না সেটা কে বলতে পারে? তিনি তার মাফিয়া জীবনে ইতি টেনে ইতালি পালিয়ে গেলেন। যাওয়ার আগে শিকাগোর অপরাধ মসনদে বসিয়ে গেলেন ২৬ বছর বয়সী এক ছোকরাকে। যার নাম আলফোনসো কাপোন। নামটা শুনে অনেকের ভ্রু কুঁচকে গেলো। হাতেগোনা কয়েকটি বিচ্ছিন্ন সংঘর্ষ ছাড়া এই ছোকরার নাম আর কোথাও ওঠেনি বলে। অনেকে আড্ডার ছলে তার যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন করে বসলো। এই ছোকরা কী এমন করে বসলো যে তাকে একেবারে পালের গোদা বানিয়ে ফেলতে হবে? তার উপর পাতি মাস্তানদের মতো তার ডান গালে রয়েছে কাটাদাগ। অনেকে বোকা টরিওর সিদ্ধান্ত নিয়ে ঠাট্টা করতে থাকলো। ‘গেলো গেলো, এবার টরিও গ্যাং-এর ঐশ্বর্য সব জলে গেলো’ বলে ব্যাঙ্গও করা বাদ দিলো না। কিন্তু সেই আড্ডাবাজদের সেদিনের ঠাট্টার জবাব ধীরে ধীরে আলফোনসো ঠিকই দিয়েছিলেন। ক্ষমতার ছড়ি ঘুরিয়ে খেয়াল খুশিমতো কিন্তু সতর্কতার সাথে বিচরণ করেছেন অপরাধ জগতে। তিনি এতটাই চালাক ছিলেন যে, শেষপর্যন্ত বাঘা বাঘা ফেডারেল এজেন্টরাও তার কর ফাঁকি ব্যতিরেকে অন্য কোনো অপরাধের প্রমাণ যোগাড় করতে পারেননি। আর এভাবে তিনি বনে গেছেন মাফিয়া সংস্কৃতির এক প্রবাদ পুরুষ।
ব্রুকলিনের শিশুসন্ত্রাস
আলফোনসো কাপোনের জন্ম ১৮৯৯ সালে নিউ ইয়র্কের ব্রুকলিন শহরে। সদ্য ইতালি থেকে এসে আটলান্টিকের এপাড়ে নতুন স্বপ্ন দেখতে শুরু করা গ্যাব্রিয়েলে এবং তেরেসিনা কাপোনের চতুর্থ সন্তান ছিলেন তিনি। কিন্তু তাদের এই স্বপ্ন অতিদ্রুত অর্থের অভাবে দুঃস্বপ্নে রূপান্তরিত হয়। খেয়ে না খেয়ে কোনোমতে দিন গুজরান করতো কাপোন পরিবারের সদস্যরা। কাপোনের বাবা মফস্বলে একটি নাপিতের দোকান খুলেছিলেন। কিন্তু সেখানে কামাই আশানুরূপ হচ্ছিলো না। তার মা ঘরে বসে দর্জির কাজ করে সংসারে বাড়তি আয়ের যোগান দিতেন। এমন পরিবারে বেড়ে ওঠা কাপোন ছোট থেকে মেধাবী হিসেবে পরিচিত হতে থাকেন। তার স্কুলের ফলাফলও বেশ ভালো ছিল। সবাই যখন ভাবছিলো, এই ছেলে বড় হয়ে পণ্ডিত গোছের কিছু একটা হবে, তখনই সে স্কুলের এক শিক্ষককে মারধোর করে হুলুস্থুল বাঁধিয়ে দিলেন। তিনি তখন মাত্র ১৪ বছর বয়সের কিশোর। পড়াশোনা করছিলেন ক্লাস সিক্সে। এই অপরাধে তাকে স্কুল থেকে বিতাড়িত করা হয়। এরপর আর লেখাপড়া করেননি তিনি। পথে পথে ঘুরেছেন আর মাস্তানি করেছেন। স্কুলে হকি খেলার সুবাধে লাঠি চালানোর কায়দা রপ্ত করেছিলেন তিনি। দ্রুত তিনি বিভিন্ন কিশোর গ্যাংয়ের নজর কাড়তে সক্ষম হন।
সাউথ ব্রুকলিন রিপারস আর ফোরটি থিভস জুনিয়র নামক দুটি গ্যাংয়ের সক্রিয় সদস্য ছিলেন তিনি। এদের আগ্রাসনে ব্রুকলিনের ছেলে-বুড়ো কেউ শান্তিতে রাস্তায় বের হতে পারতো না। রাস্তায় চোখ-কান খোলা রেখে চলাফেরা না করলে যেকোনো মুহূর্তে এদের খপ্পরে পড়ে সর্বস্ব হারাবেন নিশ্চিত বলে দেওয়া যেত।
জনি টরিওর সংস্পর্শে
যে টরিওর হাত ধরে আল কাপোনের মাফিয়া জগতে অনুপ্রবেশ, এবার তার সাথে পরিচিত হবার পালা। জনি টরিও যখন নিউ ইয়র্কে জুয়া খেলার ব্যবসা করতেন, তখন তিনি আল কাপোনের প্রতিবেশী ছিলেন। সেখান থেকে তাদের দুজনের পরিচয়। টরিও আল কাপোনকে দিয়ে টুকটাক কাজ করিয়ে নিতেন। এর ফলে তাদের মধ্যে কিছুটা ঘনিষ্ঠতা তৈরি হয়। টরিও যখন কিছুটা পয়সার মুখ দেখা শুরু করেন, তখন তিনি নিউ ইয়র্কের পাট চুকিয়ে শিকাগো পাড়ি জমান। সেটা ১৯০৯ সালের গল্প। অর্থাৎ, তখনও আল কাপোন স্কুলে পড়তেন। এরপর আল কাপোনের জীবনের গল্প অভিনব মোড় নিলো। মেধাবী থেকে মাস্তান হয়ে ওঠা আল কাপোন ১৯১৭ সালে টরিওর সাথে পুনরায় এক হন কনি দ্বীপে। সেখানে টরিওর সুপারিশে মাফিয়া বস ফ্র্যাঙ্কি ইয়েল তার বিখ্যাত হার্ভার্ড ইনে আল কাপোনকে মদ পরিবেশকের চাকরি প্রদান করেন।
শুরুটা চমৎকার ছিল। ভালো আয় উপার্জনও হচ্ছিলো। কিন্তু একদিন বেশ অপ্রীতিকর কিছু ঘটে গেলো। তিনি সুরিখানায় আসা এক মেয়ের দিকে কিছু অশ্লীল মন্তব্য করে বসেন, যেটা তার উপস্থিত ভাই ভালো চোখে দেখেননি। স্বাভাবিকভাবে তিনি নেশার ঘোরে আল কাপোনকে আক্রমণ করে বসেন। শুরু হয়ে যায় ধ্বস্তাধস্তি। একপর্যায়ে মেয়ের ভাই ধারালো ছুরি দিয়ে কাপোনের ঘাড় বরাবর আঘাত করে বসে। কিন্তু নেশার প্রভাবে তার নিশানা ভুল হয় এবং সেই ছুরি গিয়ে আল কাপোনের গালে জখম করে বসে। এই ঘটনার পর আল কাপোনের গালে চিরদিনের জন্য লম্বা কালো দাগ বসে যায়। মদ পরিবেশক আল কাপোনকে সবাই সেদিন থেকে ‘গালকাটা’ বা ‘স্কারফেস’ নামে ডাকতে থাকে। মজার ব্যাপার হলো, সুপরিচিত ডাক নাম হলেও তিনি কোনোদিন এই নামকে ভালোভাবে গ্রহণ করতে পারেননি। তার সহকর্মীরা তাই তাকে ‘বিগ আল’ বলে ডাকতো।
টরিও-কাপোন জুটির উত্থান
আল কাপোন যখন টরিওর সাথে শিকাগোতে মিলিত হন, তখন শিকাগোর অপরাধ কর্তা ছিলেন বিগ জিম কলোসিমো। কলোসিমোর অধীনে তখন শিকাগো শহরের শত শত পতিতালয়, জুয়াঘর পরিচালিত হতো। আর সংবিধানের অষ্টাদশ সংশোধনী অনুযায়ী তখন অ্যালকোহল জাতীয় পানীয় উৎপাদন, বিতরণ এবং বাজারজাতকরণ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ছিল। সেজন্য কলোসিমোর অধীনে কোনো সুরিখানা ছিল না। কিন্তু নিষিদ্ধ জিনিস বাজারজাত করলে স্বাভাবিকের তুলনায় কয়েকগুণ বেশি লাভ করা সম্ভব। তাই টরিও বারবার কলোসিমোকে সুরিখানা খোলার আহ্বান জানাতেন। কলোসিমো সে কথা কানে তুলতেন না। আল কাপোন যে বছর শিকাগো আসেন, সে বছর কলোসিমো আততায়ীর গুলিতে নিহত হন। এখন পর্যন্ত কলোসিমো হত্যার দায়ে কাউকে গ্রেফতার করা হয়নি। অনেকের ধারণা, এটি টরিও-কাপোন জুটির কাজ। কলোসিমোর মৃত্যুর মাধ্যমে শিকাগোতে উত্থান ঘটে টরিও-কাপোন জুটির।
কলোসিমোর স্থলাভিষিক্ত হয়ে তিনি শিকাগোতে মদ চোরাচালানের ব্যবসা শুরু করেন। আর এই কাজে আল কাপোন তার প্রখর বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে পুলিশের চোখ ফাঁকি দিতে সক্ষম হন। তার দক্ষতা তাকে টরিওর প্রধান সহচরে উত্তীর্ণ হতে সহায়তা করে। পথে পথে ঘুরে বেড়ানো আল কাপোনের পকেট ধীরে ধীরে পয়সার ঝনঝনানিতে মুখর হয়ে ওঠে। আর সেই পয়সা তিনি ওড়াতে থাকেন মদ্যপ অবস্থায় রাত কাটিয়ে। অসতর্ক আল কাপোন মদ্যপ অবস্থায় গাড়ি চালাতে গিয়ে একবার এক ট্যাক্সিকে ধাক্কা দিয়ে দূর্ঘটনায় ঘটিয়ে ফেলেন। তৎক্ষণাৎ পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে। এটি ছিল তার মাফিয়া জীবনের প্রথম জেল খাটা। অবশ্য সেটা দীর্ঘায়িত হয়নি। একদিন পর টরিও তার ক্ষমতা প্রয়োগের মাধ্যমে স্বয়ং মেয়রের হস্তক্ষেপে আল কাপোনের মুক্তি নিশ্চিত করেন।
এই ঘটনা আল কাপোনের জীবনে বেশ বড় পরিবর্তন আনে। তিনি এরপর থেকে বেশ সতর্ক হয়ে ওঠেন। প্রতিটি পদক্ষেপ মেপে মেপে ফেলতেন। এতকিছুর মাঝেও আল কাপোন তার পারিবারিক জীবনে অবহেলা করেননি। শিকাগো আসার আগেই বিয়ে করেছিলেন। মাফিয়া জগতে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর এবার স্ত্রী সন্তানদের শিকাগো নিয়ে আসেন। সবকিছু ঠিকঠাক চলছিলো। কিন্তু ১৯২৩ সালের মেয়র নির্বাচনে টরিও সমর্থিত মেয়রের ভরডুবি হয়। শহরে নতুন মেয়রের আগমনের পর পরই ধরপাকড় অভিযান শুরু হয়। অনিরাপদ শিকাগো থেকে আল কাপোন এবং টরিও সিসারো নামক একটি মফস্বলে পালিয়ে যান। সেখানে নতুন করে ব্যবসা শুরু করেন। কিন্তু যেখানে বাঘের ভয়, সেখানে সন্ধ্যা হয়। ১৯২৪ সালে সিসারোতেও মেয়র নির্বাচন ঘনিয়ে আসলো। টরিও-কাপোন এবার বেশ সতর্ক। কোনোভাবেই তাদের সমর্থনের বাইরে কাউকে নির্বাচিত হতে দেওয়া যাবে না। তাই নির্বাচনের দিন তারা গুপ্তহত্যা শুরু করে। এমনকি বিরুদ্ধ পক্ষের অনেক ভোটারকে উন্মুক্ত রাজপথে গুলি করে হত্যা করার অভিযোগও পাওয়া গেছে। নির্বাচনের দিন এত বড় যজ্ঞের অভিযোগ পাওয়া মাত্র শিকাগো থেকে বিশেষ পুলিশ স্কোয়াড পাঠানো হয়। সিসারোতে পুলিশ-টরিও গ্যাংয়ের বন্দুক যুদ্ধে আল কাপোনের ভাই ফ্রাঙ্ক নিহত হন। এভাবে শিকাগোজুড়ে বিশৃঙ্খলা এবং ত্রাস ছড়িয়ে দেয় টরিও গ্যাং।
এবার আল কাপোনের পালা
টরিও গ্যাংয়ের দাপটে শিকাগোর পরিস্থিতি গরম হয়ে উঠে। ধীরে ধীরে সবকিছু এদের হস্তগত হয়ে পড়ছে দেখে বিপক্ষ গ্যাংয়ের কর্তারা টরিওকে দৃশ্যপট থেকে সরিয়ে দেয়ার পরিকল্পনা করতে থাকে। এদের হোতা ছিলেন জর্জ মরান। কিন্তু সেবার তারা টরিওকে হত্যা করতে ব্যর্থ হন। পরিকল্পনা ভেস্তে গেলেও তাদের উদ্দেশ্য সফল হয়। টরিও তার প্রাণ বাঁচাতে সবকিছু আল কাপোনের হাতে তুলে দিয়ে ইতালিতে ফিরে যান। যাওয়ার আগে আল কাপোনকে উপদেশ দিয়ে যান যেন নীরবে ব্যবসার কাজ চালিয়ে যায়। আল কাপোন তার এই উপদেশ কতটুকু মূল্যায়ন করেছে সেটা বিচারের ভার আপনাদের হাতেই তুলে দেওয়া হলো।
ক্ষমতা লাভের পর পর তিনি মফস্বল ছেড়ে উঠে আসেন শিকাগোর সবচেয়ে দামি হোটেল মেট্রোপোলে। তিনি চোরাচালানের পরিধি কয়েকগুণ বিস্তৃত করেন এবং বেশ বিলাসি জীবনযাপন করা শুরু করেন। এককথায়, টাকা ওড়াতে পছন্দ করতেন তিনি।
তবে একটা কথা সবসময় মাথায় রাখতে হবে, আল কাপোন যতই উড়নচণ্ডীর মতো জীবনযাপন করুক না কেন, তিনি সবসময় সতর্ক থাকতেন। তিনি তার ব্যয়ের পুরো অর্থ নগদ পরিশোধ করতেন যেন পুলিশ পিছু নিতে না পারে। বার্ষিক প্রায় ১০ কোটি টাকার মতো লেনদেন হতো তার চোরাচালানের মাধ্যমে, যেটা বর্তমান হিসেবে প্রায় কয়েকশত কোটির ঘরে গিয়ে ঠেকবে। দেশজুড়ে যখন অর্থনৈতিক মন্দা চলছিলো, তখন তিনি বেশ কিছু লঙ্গরখানা খুলে বসেন। সেখানে বিনামূল্যে স্যুপ বিতরণ করা হতো। এধরনের কর্মকাণ্ড তাকে সাধারণ মানুষের নিকট অনেকটা ‘ফেরেশতা’ গোছের মানুষে পরিণত করে। একদিকে উদারতার দৃষ্টান্ত স্থাপন চলছে, আর অন্যদিকে একযোগে বিরুদ্ধ গ্যাং সদস্যদের হত্যা করছিলেন আল কাপোন। হয়তো হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে ঢাল হিসেবে দান-খয়রাতকে বেছে নিয়েছিলেন তিনি। আল কাপোন অবশ্য দাবি করতেন তিনি জনগণের খাদেম। তিনি বলতেন,
“কুক কাউন্টির ৯০ শতাংশ মানুষ মদ পান করেন। তারা জুয়া খেলতে ভালোবাসেন। আমার যদি কোনো অপরাধ থাকে, তবে সেটা হবে এই সংখ্যাগরিষ্ঠদের খেদমত করা।”
সেন্ট ভ্যালেন্টাইনস ডে এবং অন্যান্য
আল কাপোন গ্যাং ছিল শিকাগোর ত্রাসের নাম। টরিওর প্রস্থানের পর যখন সবাই ভেবেছিল, এবার বুঝি পরিস্থিতি কিছুটা ঠাণ্ডা হবে, তখনই আল কাপোন সিসারোতে এক ভয়ংকর হত্যাকাণ্ড সঙ্ঘটিত করেন। সেবার মোট তিনজনকে গুলি করে হত্যা করা হয় যাদের মধ্যে একজন বিচারক ছিলেন। এই বিচারক ইতোপূর্বে এক হত্যা মামলায় আল কাপোনকে দোষী সাব্যস্ত করার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু ব্যর্থ হন। যার পরিণতি হলো সিসারোতে গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃত্যুর মাধ্যমে। আর বরাবরের মতো, এবারও কোনো সাক্ষী প্রমাণ না থাকায় আল কাপোন বেঁচে যান। বারবার কাপোন বেঁচে যাওয়ায় পুলিশরাও বিরক্ত হয়ে উঠলো। তারা রাতদিন আল কাপোনের ব্যবসার চালান ভণ্ডুল করে দেওয়ার পায়তারা করতো। এর কারণে তার ব্যবসায় কিছুটা লোকসান হয়ে যায়। উপায় না দেখে তিনি পুলিশদের সাথে সন্ধি স্থাপন করলেন। কথা দিলেন, শহরে আর হত্যাকাণ্ড ঘটাবেন না। বিনিময়ে তার ব্যবসার চালান ছেড়ে দেওয়া হোক। কিন্তু দুই মাস যেতে না যেতেই ফের শিকাগোর রাজপথ রঙিন হয়ে গেলো কাপোন বিরোধীদের রক্তে।
১৯২৯ এর দিকে তার ব্যবসায় বাঁধা হয়ে দাঁড়ালো দীর্ঘদিনের শত্রু জর্জ মরান। মরানের সাথে বহু হিসাব-নিকাশ জমা হয়ে ছিল কাপোনের। এবার সেই হিসাব একবারে চুকিয়ে দেয়ার পালা এসেছে। আল কাপোন এবার পাল্টা পরিকল্পনা করলেন জর্জ মরানকে সরিয়ে দেয়ার। আল কাপোন তার প্রধান ঘাতক ‘মেশিন গান’ জ্যাককে ডেকে পাঠান। জ্যাক তার সাঙ্গোপাঙ্গ এবং বিখ্যাত মেশিন গান নিয়ে মরান গ্যাংয়ের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েন ভ্যালেন্টাইনস ডে’র দিন। এক পুলিশ অফিসারের ছদ্মবেশ ধরে তিনি ব্রাশ ফায়ার হত্যা করেন মরানের বিশ্বস্ত সাত সহচরকে। জর্জ মরান আগেই বিপদের গন্ধ পেয়ে সে যাত্রায় পালিয়ে বেঁচে যান। এই কুখ্যাত হত্যাকাণ্ড শিকাগোসহ পুরো দেশ কাঁপিয়ে দেয়। স্বাভাবিকভাবে সবাই আল কাপোনকে দায়ী করে। কিন্তু চতুর আল কাপোন এবারও আগে থেকে প্রস্তুত ছিলেন। কোনো প্রমাণ মিললো না। কেউ সাক্ষ্য দিলো না। এত বড় হত্যাকাণ্ডের পরেও বেঁচে যাওয়ায় সরকার আল কাপোনকে ‘জনগণের এক নম্বর শত্রু’ হিসেবে ঘোষণা করেন। আর এই হত্যাকাণ্ড ইতিহাসে সেন্ট ভ্যালেন্টাইনস ডে হত্যাকাণ্ড নামে পরিচিত।
দৃশ্যপটে এফবিআই
আল কাপোন যখন জাতীয় ইস্যুতে পরিণত হন, তখন তাকে নিয়ে অনুসন্ধানে নেমে পড়ে এফবিআই। ব্যুরোর বাঘা বাঘা অফিসাররা কাপোনের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করে তার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন। মামলার শুনানির দিন ধার্য করা হয় ১৯২৯ সালের ১২ মার্চ। কিন্তু আল কাপোন সেদিন আদালতে হাজিরা দিলেন না। তার অনুপস্থিতি স্বাভাবিকভাবে প্রশাসনকে রাগিয়ে তুললো। আল কাপোনের উকিল পরিস্থিতি সামাল দিতে কাপোনের অসুস্থতার সনদপত্র যোগাড় করে শুনানির দিন ২০ তারিখ পর্যন্ত পিছিয়ে দেন। ব্যুরোর অফিসাররা তদন্ত করে জানতে পারলেন, আল কাপোন আদালতের শুনানি ফাঁকি দিয়ে মায়ামিতে ঘোড়দৌড় উপভোগ করছিলেন এবং তিনি বেশ বহাল তবীয়তে ছিলেন।
যথাসময়ে তিনি শুনানিতে উপস্থিত হন এবং ২৭ মার্চ তাকে আদালত অবমাননার দায়ে আদালতের বাইরে গ্রেফতার করা হয়। এর আগে আল কাপোন এবং তার দেহরক্ষী ফিলাডেলফিয়াতে অবৈধ অস্ত্রসহ গ্রেফতার হয়েছিলেন। প্রথমবার জামিন নিলেও দ্বিতীয়বার তাকে এক বছর করে দুই মামলায় কারাদণ্ড প্রদান করা হয়। মাফিয়া বস হওয়ার পর আল কাপোন প্রথমবারের মতো জেলের গরাদের পেছনে বন্দি হন। যদিও সেটা মাত্র এক বছরের জন্য।
আল কাপোনের ‘আকিলিস হিল’
এফবিআই যতই আল কাপোনকে ধরার চেষ্টা করছিলো, ততই সেয়ানা হয়ে উঠছিলেন তিনি। তিনি যেন ব্যুরোর কর্মকর্তাদের বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন, ‘তুমি চলো ডালে ডালে, আমি চলি পাতায় পাতায়’। ব্যুরোর কর্মকর্তারাও বারবার ব্যর্থ হয়ে চিন্তা করলেন, ভিন্ন পন্থায় আল কাপোনকে ঘায়েল করতে হবে। তারা এতদিন বিভিন্ন হত্যাকাণ্ডের সাথে আল কাপোনের সংযুক্তি প্রমাণের তালে ছিলেন। এবার তারা আল কাপোনের আয়ের উৎস, কর ফাঁকিসহ অর্থ সম্পর্কিত বিভিন্ন অপরাধের দিকে নজরদারি করা শুরু করলেন। পর্যাপ্ত তথ্য সংগ্রহের পর ব্যুরো থেকে আল কাপোনসহ র্যালফ বোটলস কাপোন, জ্যাক গুজিক, ফ্র্যাঙ্ক নিতির মতো দুর্ধ্বর্ষ মাফিয়া ডনদের নামে মামলা ঠুকে দেওয়া হয়।
আল কাপোন এবার যেন ফাঁদে পড়ে গেলেন। তিনি নিজের দোষ স্বীকার করে আদালতে আত্মসমর্পণের সিদ্ধান্ত নিলেন। কিন্তু পাল্টা শর্ত জুড়ে দিলেন যে, তাকে আড়াই বছরের বেশি কারাদণ্ড দেয়া যাবে না। প্রধান বিচারপতি কাপোনের এই দাবি হেসে উড়িয়ে দেন। সেই সাথে তিনি নিজেও আত্মসমর্পণ করতে অপারগতা প্রকাশ করেন। তাই নিয়ম অনুযায়ী শুরু হয় আল কাপোনের বিচারকার্য। ব্যুরো কর্তৃক আল কাপোনের বিরুদ্ধে সব ধরনের প্রমাণ প্রস্তুত ছিল। কিন্তু তারপরেও আল কাপোন বেশ নিশ্চিন্ত চিত্তে বিচারকার্যে অংশ নিচ্ছিলেন। বিষয়টি অনেকের নিকট অদ্ভুত লাগলো। শেষপর্যন্ত অনুসন্ধান করতে বেরিয়ে আসলো যে, আল কাপোন ইতোমধ্যে বিচারক বোর্ডের সবাইকে ঘুষ প্রদান করেছেন। প্রধান বিচারপতি আল কাপোনের রায়ের জন্য নতুন বিচারক বোর্ডের অনুমোদন প্রদান করেন। ১৯৩১ সালের ১৮ অক্টোবর আল কাপোনকে কর ফাঁকির মামলায় দোষী সাব্যস্ত করা হয়। এক্ষেত্রে সাধারণত আসামির সর্বোচ্চ তিন বছরের কারা প্রদান করা হয়। কিন্তু আল কাপোনকে বিচারপতি ১১ বছরের কারাদণ্ড প্রদান করেন। সেই সাথে ৫৭ হাজার ডলার পর্যন্ত জরিমানা প্রদান করেন। আনুসাঙ্গিক বিষয়াদি যোগ করে এই অর্থ প্রায় ২ লক্ষ ডলারের কাছাকাছি গিয়ে পৌঁছায়।
শেষ বেলা
অর্থ অনর্থের মূল- এই কথাটি আলফোনসো কাপোন ওরফে বিগ আলের জন্য অক্ষরে অক্ষরে সত্য প্রতিপন্ন হলো। আইনের হাতে ধরা পড়ে আল কাপোনের পরবর্তী গন্তব্য হলো আটলান্টার কারাগারে। এখানে প্রায় দু’বছর পর্যন্ত কারাভোগের পর এক রক্ষীকে ঘুষ দিতে গিয়ে ধরা পড়েন। এই অর্থ পুনরায় তার সর্বনাশ ডেকে আনলো। তাকে আলকাত্রাজের উচ্চ নিরাপত্তাবেষ্টিত দ্বীপ কারাগারে প্রেরণ করা হয়। আলকাত্রাজে যাওয়ার পর আল কাপোন যেন হঠাৎ করে হারিয়ে যান দৃশ্যপট থেকে। শিকাগোর অপরাধ জগতে ততদিনে নতুন কর্তার আবির্ভাব ঘটেছে। আল কাপোনের প্রতিপত্তি আর তেমন টিকলো না।
দিনে দিনে স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটে থাকে তার। তরুণ বয়সে একবার তিনি সিফিলিসে আক্রান্ত হয়েছিলেন। সেই পুরাতন রোগ নিউরোসিফিলিসের রূপ ধরে তাকে ফের আক্রমণ করলো। শারীরিক এবং মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন প্রাক্তন মাফিয়া বস। তাকে জরুরি ভিত্তিতে মাত্র সাড়ে ছয় বছর পর কারামুক্তি প্রদান করে বাল্টিমোরের এক মানসিক হাসপাতালে প্রেরণ করা হয়। কিন্তু তার স্বাস্থ্যের কোনো উন্নতি হয়নি। তিন বছর চিকিৎসা প্রদানের পর তাকে দিয়ে মায়ামিতে স্ত্রীর নিকট পাঠিয়ে দেয়া হয়। জীবনের শেষ সময়টুকু তিনি স্ত্রীর সাথে কাটিয়ে দেন। ১৯৪৭ সালের ১৫ জানুয়ারি হৃদক্রিয়া বন্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করেন ‘পাবলিক এনিমি নাম্বার ওয়ান’ আল কাপোন।
আল কাপোনের মৃত্যুর পর বড় বড় পত্রিকায় ফিচার ছাপানো হলো। বিখ্যাত নিউ ইয়র্ক টাইমসের শিরোনামে লেখা হলো, “এক দুঃস্বপ্নের অবসান”। এই জীবন বৃত্তান্তের বাইরেও আল কাপোন নিয়ে বিভিন্ন তথ্য রয়েছে যা জানতে পারলে তার সম্পর্কে পাঠকদের ধারণা আরেকটু পরিষ্কার হবে। সুপ্রিয় পাঠক, চলুন সেসব তথ্যে এক নজর চোখ বুলিয়ে নেওয়া যাক:
- আল কাপোনের বুলেট প্রুফ গাড়ি সরকার কর্তৃক বাজেয়াপ্ত ঘোষণা করা হয়েছিল, যা পরবর্তীতে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি রুজভেল্ট ব্যবহার করেছিলেন।
আল কাপোনের গাড়ি; Image Source: Wonderland - কাপোন তার পরিকল্পনায় নিহত হওয়া মানুষদের শেষকৃত্যে পরিবারের নিকট দামি ফুল এবং উপহার সামগ্রী প্রেরণ করতেন। এটি অনেকটাই আল কাপোনের স্বাক্ষরের মতো কাজ করতো।
- আল কাপোনের পোশাক-পরিচ্ছদের ধরনের প্রশংসা করেছিলেন বিখ্যাত লেখক ডেল কার্নেগি। তার মতে, সফল ব্যবসায়ীদের পোশাক এমনটাই হওয়া উচিত।
- আল কাপোনকে আলকাত্রাজে পাঠানোর আরেকটি উদ্দেশ্য ছিল নতুন উদ্বোধন হওয়া কারাগারের বিজ্ঞাপন হিসেবে তুলে ধরা।
- কারাগারে আল কাপোন একটি রক ব্যাণ্ডের হয়ে বাঞ্জো এবং গিটার বাজাতেন।
- নিষিদ্ধ হলেও শিকাগোর সবাই মদ পান করতে পছন্দ করতেন। এজন্য মদ পছন্দ করা বিচারপতিরা তাকে সাজা দেওয়ার ক্ষেত্রে সহানুভূতি দেখাতো বলে মনে করেন অনেকে।
- ‘দ্য আনটাচেবলস’ সিনেমায় আল কাপোনের চরিত্রে অভিনয় করেন বিখ্যাত অভিনেতা রবার্ট ডি নিরো। তবে সিনেমায় বর্ণিত এলিয়ট নেসের ভূমিকা অনেকটাই অতিরঞ্জিত ছিল।
দ্য আনটাচেবলস সিনেমায় আল কাপোন চরিত্রে রবার্ট ডি নিরো; Image Source: IMDB
আল কাপোনের অপরাধ জগতকে সবাই ঘৃণা করতো এবং করবে। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, ১৯৩৩ সালে যখন অ্যালকোহল জাতীয় পানীয়ের উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়েছিল, তখন অনেকেই আল কাপোনের উপর সহানুভূতি প্রকাশ করেছিলেন। তবে যাই হোক না কেন, আল কাপোনের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের কোনো সহানুভূতি হতে পারে। এখন পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে আল কাপোন সবচেয়ে কুখ্যাত মাফিয়া বস হিসেবে পরিচিত রয়েছেন।
অপরাধজগত সম্পর্কে আরও জানতে পড়ুন এই বইগুলো
১) Crime Scene Forensics: A Scientific Method Approach
২) সাইবার ক্রাইম প্রযুক্তির ঝুঁকি ও নিরাপত্তা
৩) 50 Crime Murder Mysteries and Detective Stories
This is a Bangla article about Chicago Mob boss Al capone.
All the references are hyperlinked.
Feature Image: Get Wallpapers.