Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

আল ফারাবি: যিনি স্বপ্ন দেখতেন পুণ্যময় শহরের

ইসলামের স্বর্ণযুগে মুসলিমদের নিকট সক্রেটিস, প্লেটো আর অ্যারিস্টটলদের দর্শন অনুবাদের মাধ্যমে যারা পরিচয় করে দিয়েছিলেন, আবু নাসের মুহাম্মদ ইবনে মুহাম্মদ আল ফারাবি তাদের মধ্যে অগ্রগণ্য একজন। মুসলিম দার্শনিকদের মধ্যে তার ছিল ভীষণ প্রভাব। বিশেষ করে ইবনে সিনা তার কাজ দ্বারা ব্যাপকভাবে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। তিনি একজন বিখ্যাত ভাষাবিদ ছিলেন যিনি গ্রীক আর ল্যাটিন থেকে অনেক কিছুই অনুবাদ করে মুসলিমদের জ্ঞানচর্চার পথ সুগম করেছিলেন। অন্যদিকে আলকেমি, যুক্তিশাস্ত্র, দর্শন, পদার্থবিজ্ঞান এবং মনোবিজ্ঞানেও রয়েছে আল ফারাবির অবদান।

আল ফারাবি (৮৭২-৯৫০ খ্রিস্টাব্দ); source: Online Islamic Store

আবু নাসের আল ফারাবি ৮৭২ খ্রিস্টাব্দে খোরাসানের ফারাব শহরে জন্মগ্রহণ করেন, যা বর্তমানে আফগানিস্তানের অন্তর্গত। তিনি নিজের কোনো আত্মজীবনী লিখে যাননি এবং কোনো ইতিহাসবিদও তা পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে সংরক্ষণ করেননি। ফলে তার ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে খুব কম তথ্যই রয়েছে আমাদের হাতে। কিন্তু তার দর্শনের ক্ষেত্র বিশাল। মেটাফিজিক্সের জগতে তাকে ইসলামিক ‘নিওপ্লেটোনিজম’ এর জনক বলা হয়। প্লেটোনিজম বা প্লেটোর দর্শন দ্বারা উদ্বুদ্ধ আল ফারাবি অন্ধভাবে প্লেটোর অনুকরণ করেননি। তার বিখ্যাত গ্রন্থ ‘আল মদিনা আল ফাদিলা’ এর প্রমাণ। এই গ্রন্থ একদিকে যেমন আল ফারাবির প্লেটোনিক দর্শন প্রতিষ্ঠা করে, অন্যদিকে এটিও প্রমাণ করে যে তিনি গোঁড়া প্লেটোনিক নন। বরং তার দর্শন প্লেটোনিক দর্শনেরই একটি আমূল বদলে যাওয়া রূপ, যাকে বলা হচ্ছে নিওপ্লেটোনিজম।

আল মদিনা আল ফাদিলার একটি সপ্তদশ শতকের কপি; source: Online Islamic Store

মধ্যযুগের দার্শনিকগণ, কী মুসলিম কী খ্রিস্টান, সকলেই নিজের ধর্ম দ্বারা ভীষণভাবে প্রভাবিত ছিলেন। সহজ করে বলতে গেলে তাদের নিকট দর্শন মানেই ছিল ধর্মীয় দর্শন। কিন্তু আল ফারাবি এই ধারণা থেকে বেরিয়ে আসেন। তিনি ধর্ম আর দর্শনের মাঝে তফাৎ স্পষ্ট করেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, সৃষ্টিকর্তা মানুষকে ‘আশরাফুল মাখলুকাত’ করেছেন জ্ঞান-বুদ্ধিতে উৎকর্ষ সাধনের জন্যই। অন্যদিকে মুসলিম দার্শনিকদের মধ্যে রাজনীতি অনীহার যে রোগ ছিল তা থেকেও মুক্ত ছিলেন আল ফারাবি। তিনি বেশ রাজনৈতিক সচেতন ছিলেন এবং রাজনৈতিক দর্শন নিয়েও কাজ করেছেন। মুসলিম সমাজের একেবারে প্রথম দিককার মনিষীদের মধ্যে আল ফারাবি একজন, যিনি জ্ঞানার্জনের জন্য খ্রিস্টান মিশনারি কিংবা ভারতবর্ষের আর্য বা হিন্দুদের সাথে অনেক সময় কাটিয়েছেন।

আল ফারাবির জন্মস্থান; source: muslim philosopher

আল ফারাবি সম্পর্কে পাওয়া অধিকাংশ তথ্যই (তার কাজ বাদে) হয় জনশ্রুতি, নয় নিছক ধারণা। তাই তার ব্যক্তিগত জীবন সম্বন্ধে আলোচনা করবার তেমন কোনোকিছু নেই। তিনি তার জীবনে অনেক ভ্রমণ করেছিলেন এবং সে অনুযায়ী বহু অভিজ্ঞতাও সঞ্চয় করেন। তার মিশর ও সিরিয়া ভ্রমণের ব্যাপারে ইতিহাসবিদগণ নিশ্চিত। এসব ভ্রমণ থেকে সঞ্চিত অভিজ্ঞতাকে পুঁজি করেই এত বড় দার্শনিক হয়েছিলেন আল ফারাবি। মিশর ভ্রমণ শেষে ফারাবি খোরাসান ফিরে না গিয়ে দামেস্কে চলে যান। তার শেষ জীবন দামেস্কেই কাটে এবং এখানেই ৯৫০ কিংবা ৯৫১ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন তিনি।

আল ফারাবির শিক্ষাজীবন সম্পর্কে জানা যায় তিনি যুক্তিশাস্ত্র, চিকিৎসাশাস্ত্র এবং সামাজিক বিজ্ঞান অধ্যয়ন করেছিলেন। এর পাশাপাশি ক্লাসিক্যাল দর্শনশাস্ত্রও অধ্যয়ন করেন। নিজের একটি লেখায় ফারাবি উল্লেখ করেন, অ্যারিস্টটলের ‘প্রায়োর অ্যানালাইসিস’ এবং ‘পোস্টেরিয়র অ্যানালাইসিস’ তার খুবই পছন্দের বিষয় ছিল। তিনি এই শিক্ষা গ্রহণ করেন ইউহানা হাইলান নামক একজন খ্রিস্টান ধর্মযাজকের নিকট। এ সময় তিনি বাগদাদে অবস্থান করছিলেন এবং তার বিখ্যাত বই ‘আল মদিনা আল ফাদিলা’ লেখা শুরু করেন। তবে লেখার কাজ সমাপ্ত করেছিলেন দামেস্কে গিয়ে। এরপরই তিনি মিশর ভ্রমণে যান। এর মাঝে তিনি আলেপ্পোতেও ভ্রমণ করেছিলেন বলে দৃঢ় প্রমাণ পাওয়া যায় ইতিহাসে।

আল ফারাবির নিওপ্লেটোনিজম; source: muslimheritage.com

আল ফারাবি একজন উর্বর লেখক ছিলেন, যার লেখার প্রধান দিক ছিল নিওপ্লেটোনিজম এবং লেখার স্টাইল ছিল অ্যারিস্টটলীয়। তার একটি ভালো দিক ছিল এই যে তিনি নিজ দর্শন প্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে অসংখ্য দার্শনিক এবং তাদের দর্শনের কথা আলোচনা করেছেন। অন্যদিকে তার লেখা রাজনৈতিক ট্রিটিগুলো মধ্যযুগের সবচেয়ে প্রভাবশালী ইহুদি দার্শনিক ম্যামোনাইডসকেও প্রভাবিত করেছিল। তিনি আল ফারাবিকে মুসলিমদের মধ্যে প্রথম যুক্তিবাদী বলে আখ্যায়িত করেছেন। আল ফারাবি মূলত প্রাচীনকালের আলেকজান্দ্রিয়ায় মানুষ জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার যে ধারা তৈরি করেছিল সে ধারাই আবার আরবে ফিরিয়ে আনতে চেয়েছিলেন। এক্ষেত্রে বলতেই হয়, তিনি সফল ছিলেন। তার কাজ এবং দর্শন মুসলিমদেরকে এতটাই প্রভাবিত করেছিল যে তাকে দর্শনের ‘সেকেন্ড মাস্টার’ বা ‘দ্বিতীয় শিক্ষক’ খেতাব দেয়া হয়। উল্লেখ্য, তখন দর্শনের প্রথম শিক্ষক বলা হতো অ্যারিস্টটলকে আর তার পরেই দেয়া হয় আল ফারাবির স্থান!

কসমোলজি বা সৃষ্টিতত্ত্ব নিয়ে আল ফারাবি গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছেন। তার সৃষ্টিতত্ত্ব বিষয়ক চিন্তাভাবনা গড়ে উঠেছিল তিনটি বিষয়ের উপর- অ্যারিস্টটলিয়ান মেটাফিজিক্স, গ্রীক দার্শনিক প্লোটিনিয়াসের সৃষ্টিতত্ত্ব বিষয়ক দর্শন এবং টলেমির জোতির্বিজ্ঞান। তার মহাবিশ্বের মডেল হচ্ছে কতগুলো সমকেন্দ্রিক বৃত্তের সমাহার। একেবারে বাইরের বৃত্তে বা চক্রে রয়েছে স্থায়ী তারকাসমূহ, শনি, শুক্র, মঙ্গল, বৃহস্প্রতি, বুধ এবং সবশেষে চাঁদ। আর এগুলোর একেবারে কেন্দ্রে রয়েছে পার্থিব জগত। প্রতিটি চক্র একেকটি স্বর্গীয় বা অপার্থিব বস্তুর ডোমেইনের প্রতিনিধিত্ব করে। আর এগুলোই পার্থিব জগতের সাথে সৃষ্টিকর্তার যোগাযোগ স্থাপন করে। এই তত্ত্ব এক অর্থে টলেমির ভূকেন্দ্রিক তত্ত্বেরই পরিবর্তিত রূপ।

আল ফারাবির সৌরজগতের মডেল অনেকটাই টলেমির এই মডেলের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল; source: commons.wikimedia.org

আল ফারাবির রাজনৈতিক দর্শনের মূলে রয়েছে সামষ্টিক সুখ। তার মতে রাজনৈতিক নেতাকে হতে হবে সকলের চেয়ে উৎকৃষ্ট চরিত্রের এবং তার প্রতিটি কাজের চূড়ান্ত উদ্দেশ্য একটাই হবে আর তা হচ্ছে জনগণের সুখ। তিনি সমাজের আকারভেদে তিন প্রকারের সমাজ চিহ্নিত করেছেন যেগুলো তার মতে যথাযথ সমাজ। তিনি একটি আদর্শ সমাজকে কল্পনা করেছেন ‘ভার্চুয়াস সিটি’ বা পুণ্যের শহর হিসেবে। এই পুণ্য নগরের তুলনা করা চলে একটি স্বাস্থ্যবান মানবদেহের সাথে। বিপরীতক্রমে আল ফারাবি আবার চার রকম খারাপ শহরের বর্ণনা করেছেন- ‘করাপ্ট সিটি’ বা দুর্নীতিগ্রস্ত শহর, ‘ডিসল্যুট সিটি’ বা চরিত্রহীন শহর, ‘টার্নকোট সিটি’ বা স্বমতত্যাগী শহর এবং ‘স্ট্র্যায়িং সিটি’ বা বিপথগামী শহর। তিনি বিভিন্ন শহরের উদাহরণ টেনে দেখিয়েছেন যে এরূপ শহর কোনোটিই শেষতক টিকে থাকতে পারেনি।

আল ফারাবির ভার্চুয়াস বা পুণ্য নগরীর প্রধান উৎস হচ্ছে পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতে একটি সুখী সমাজ গড়ে তোলার ধারণা। তার মতে সহযোগিতাই শান্তি। তিনি সমগ্র পৃথিবীকে পুণ্যময় করার স্বপ্ন দেখতেন। আর তার এই স্বপ্নের বাস্তবায়ন কেবল তখনই সম্ভব হবে, যখন বিশ্বব্যাপী রাষ্ট্রগুলো পরস্পরের সাথে একটি সহযোগী সম্পর্ক গড়ে তুলবে। তিনি প্রাচীন গ্রীসের দৃষ্টান্তগুলো অনুসরণ করে বলেন যে, সে রাষ্ট্রেই সর্বোচ্চ শান্তি বিরাজমান, যে রাষ্ট্রের রয়েছে একতা। আবার মানুষ হচ্ছে বিশ্বজগতে সকল সৃষ্টির মধ্যে অনন্য। কারণ তারা পার্থিব আর অপার্থিব উভয় জগতের অস্তিত্ব বুঝতে পারে। মানুষের দেহ একটি জড় কাঠামোই শুধু নয়, এর আছে অদেখা আর অদৃশ্য জগত অনুভব করার ক্ষমতা।

আল ফারাবির সামগ্রিক দর্শন বিষয়ক গ্রন্থ; source: amazon.com

আল ফারাবি দর্শনকে প্রাত্যহিক জীবনে কাজে লাগানোর উপর গুরুত্বারোপ করেন। তার ব্যবহারিক দর্শন সম্পূর্ণই প্লেটোর রিপাবলিকের উপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তার মতে দর্শনের দুটি দিক রয়েছে, তাত্ত্বিক এবং ব্যবহারিক। যে সকল দার্শনিক নিজের পাণ্ডিত্য বাস্তব জীবনে সাধনা করতে পারেন না, ফারাবি তাদেরকে ভণ্ড বলে আখ্যায়িত করেছেন। সমাজকে প্রকৃত শান্তির দিকে ধাবিত করতে দার্শনিকদের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি বলে মনে করেন তিনি। দার্শনিকরাই পারেন সাধারণ মানুষ, যাদের জ্ঞানের গভীরে প্রবেশের সুযোগ হয়নি, তাদেরকে সঠিক পথে পরিচালিত করতে। তার মতে দার্শনিক হচ্ছেন সমাজের চিকিৎসক। একজন চিকিৎসকের যেমন মানবদেহ সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান থাকে, একজন দার্শনিকেরও তার সমাজ সম্পর্কে বিস্তর জানাশোনা থাকা চাই। তবেই তিনি সমাজের ‘চিকিৎসা’ করতে পারবেন।

যুক্তিশাস্ত্রে আল ফারাবি অ্যারিস্টটলীয় পন্থা অবলম্বন করলেও তিনি অ্যারিস্টটলের বাইরে গিয়েও অনেক কিছু আলোচনা করেছেন। তিনি ‘কন্ডিশনাল সিলোজিজম’ বা শর্তাধীন অনুমান এবং ‘অ্যানালজিক্যাল ইন্টারফিয়ারেন্স’ বা সাদৃশ্যমূলক হস্তক্ষেপ (যুক্তিশাস্ত্রের কিছু পদ্ধতি) নিয়ে বিস্তর গবেষণা করেন। তিনি অ্যারিস্টটলের কাজের উপর বেশ কিছু টীকাও লেখেন। আদর্শ রাষ্ট্রের নেতার ক্ষেত্রে প্লেটো যেমন ‘ফিলসফার কিং’ এর কথা বলেছিলেন, ফারাবি এখানে ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে ইমাম বা ধর্মীয় নেতার কথা বলেছেন। তার মতে একজন ইমামই সকল ভালো-মন্দের পার্থক্য সঠিকরূপে বুঝতে পারেন এবং রাষ্ট্র সঠিকভাবে পরিচালনা করতে সক্ষম হবেন। তিনি হযরত মুহাম্মদ (সা) এর সময়ের মদিনা শহরকে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ পণ্য নগরের উদাহরণ হিসেবে অভিহিত করেছেন।

  • কিতাব আল মুসিকি আল কবির (দ্য গ্রেট বুক অব মিউজিক)
  • আল মদিনা আল ফাদিলা (দ্য ভার্চুয়াস সিটি)
  • কিতাব ইহসা আল উলুম (দ্য ইন্ট্রোডাকশন টু নলেজ)
  • কিতাব ইহসা আল ইকাআত (ক্লাসিফিকেশন অব রিদমস)

উপরোক্ত গ্রন্থগুলো হচ্ছে আল ফারাবির শ্রেষ্ঠ কাজ যেগুলো আজ অবধি টিকে আছে। আল ফারাবির কাজগুলো যদিও অনেকটাই প্লেটো, অ্যারিস্টটল এবং টলেমির উপর নির্ভরশীল, তথাপি তিনি জ্ঞানচর্চার একটি ধারা শুরু করে দিয়েছিলেন। সে ধারা বজায় রেখেই পরবর্তীতে মুসলিমরা জ্ঞানচর্চায় এগিয়ে আসে এবং নিজস্ব চিন্তা-ভাবনায় নিজেদেরকে সমৃদ্ধ করে। তাই আল ফারাবির অবদান শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন আজকের দার্শনিক ও দর্শনপ্রেমীরা।

ফিচার ইমেজ- outlookafghanistan.net

Related Articles