চীনের মাও সে তুং, ভিয়েতনামের হো চি মিন, কিংবা কিউবার চে গুয়েভারার নাম আমরা সবাই জানি। কিন্তু আমরা অনেকেই জানি না, বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে মরক্কোর রিফ অঞ্চলে এমন একজন বিপ্লবী নেতা ছিলেন, যার গেরিলা যুদ্ধের কৌশল এবং সাফল্য অনুপ্রাণিত করেছিল এই তিন নেতাকেই! অনেকেই তাকে আধুনিক গেরিলাযুদ্ধের জনক হিসেবে অভিহিত করে থাকে। তার নাম মোহাম্মদ বিন আব্দুল করিম আল-খাত্তাবি।
কে এই খাত্তাবি?
খাত্তাবির জন্ম ১৮৮২ সালে মরক্কোর উত্তরে রিফ অঞ্চলের আজদির শহরের এক বার্বার (Berber) তথা আমাজিঘ আদিবাসী পরিবারে। তার বাবা আব্দুল করিম ছিলেন রিফ অঞ্চলের অন্যতম বৃহৎ এবং প্রভাবশালী আমাজিঘ গোত্র আইত ওয়ারিয়াগালের অত্যন্ত সম্মানিত একজন কাজি। বাবার উৎসাহে খাত্তাবি প্রথমে স্থানীয় মাদ্রাসায় কুরআন এবং আরবি ভাষার উপর পড়াশোনা করেন। পরবর্তীতে তিনি এবং তার ভাই কয়েক বছর স্প্যানিশ স্কুলেও পড়াশোনা করেন। এরপর তার ভাই মাইনিং ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পড়াশোনার জন্য মাদ্রিদে চলে যান, অন্যদিকে খাত্তাবি ফেজের বিখ্যাত কারাউইন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে আরবি এবং ইসলামি আইনশাস্ত্রের ওপর পড়াশোনা সম্পন্ন করেন।
সে সময় মরক্কোর অংশবিশেষ ছিল ঔপনিবেশিক স্প্যানিয়ার্ডদের নিয়ন্ত্রণে। পড়াশোনা শেষ করে খাত্তাবি প্রথমে স্প্যানিয়ার্ডদের নিয়ন্ত্রণে থাকা মেলিলা এলাকায় গিয়ে বসবাস শুরু করেন। সেখানে তিনি শিক্ষক এবং অনুবাদক হিসেবে চাকরিজীবন শরু করেন। তিনি স্প্যানিশ পত্রিকা এল তেলিগ্রামা দেল রিফের হয়ে কয়েক বছর সাংবাদিক এবং কলামিস্ট হিসেবে চাকরি করেন। মেলিলার স্প্যানিশ মিলিটারি প্রশাসনের অধীনে তিনি কিছুদিন অনুবাদক এবং সেক্রেটারি হিসেবেও চাকরি করেন। তার ধর্মীয় এবং শিক্ষাগত যোগ্যতা বুঝতে পেরে ১৯১৫ সালে তারা তাকে মেলিলার কাজি হিসেবে নিয়োগ করে।
প্রথম জীবনে খাত্তাবি এবং তার বাবা স্প্যানিয়ার্ডদের সাথে ঝামেলায় না গিয়ে তাদের সহায়তা নিয়ে নিজেদের অবস্থার উন্নতি ঘটানোর চেষ্টা করেছিলেন। তারা স্প্যানিশ মাইনিং কোম্পানীগুলোকে সাহায্য করেছিলেন এই আশায় যে, এতে রিফের জনগণও ব্যবসায়িকভাবে লাভবান হবে এবং আর্থিকভাবে স্বচ্ছলতার মুখ দেখবে। তাদের সহায়তার প্রতিদান হিসেবে স্প্যানিশ প্রশাসন খাত্তাবির বাবাকে ক্রস অফ মিলিটারি মেরিট পুরস্কারে ভূষিত করে এবং তার জন্য মাসিক ৫০ পেসেতা ভাতা বরাদ্দ করে।
খাত্তাবির উপনিবেশবিরোধী সংগ্রাম
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকেই খাত্তাবি এবং তার বাবার কাছে ধীরে ধীরে স্পেনের ঔপনিবেশিক শাসনের প্রকৃত দিকগুলো ফুটে উঠতে শুরু করে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় খাত্তাবি তুরস্কের পক্ষে তার অবস্থান প্রকাশ করলে এবং স্প্যানিশ শাসনকে ইসলামবিরোধী হিসেবে আখ্যায়িত করলে তার সকল সুযোগ-সুবিধা বাতিল করে উপনিবেশবিরোধী ষড়যন্ত্রের অভিযোগে তাকে আটক করা হয়। দীর্ঘ ১১ মাস আটক করে তার বাবার উপর চাপ সৃষ্টি করে তাকে স্প্যানিয়ার্ডদের সাথে কাজ করতে বাধ্য করা হয়।
বিশ্বযুদ্ধ শেষে খাত্তাবি আজদিরে নিজ শহরে ফিরে যান। ততদিনে স্প্যানিয়ার্ডদের দখলদারিত্ব তাদের শহর পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিল। তারা স্থানীয় জনগণের উপর অত্যাধিক কর আরোপ করছিল, তাদের জায়গা-জমি দখল করে নিচ্ছিল এবং কিছু সুবিধাভোগী গোত্রপ্রধানকে ঘুষ দিয়ে সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা আদায় করে নিচ্ছিল। খাত্তাবি, তার ভাই এবং বাবা নিজেদের অঞ্চলকে স্প্যানিয়ার্ডদের দখলদারিত্ব থেকে মুক্ত করার সিদ্ধান্ত নেন। স্বাধীন রিফ প্রজাতন্ত্র গড়ে তোলার লক্ষ্যে তারা স্থানীয় গোত্রগুলোর সাথে যোগাযোগ করেন এবং সংঘবদ্ধ হতে শুরু করেন।
১৯২০ সালে খাত্তাবির বাবার মৃত্যু হলে খাত্তাবি এলাকার নেতা হিসেবে আবির্ভূত হন। শত শত বছর ধরেই তাদের পরিবার ছিল রিফের সবচেয়ে সম্মানিত পরিবারগুলোর মধ্যে একটি। যুগ যুগ ধরে তারা পুরুষানুক্রমে কাজি হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন। সে হিসেবে এমনিতেই স্থানীয় সমাজে তাদের বিশাল প্রভাব ছিল। সেই সাথে যুক্ত হয়েছিল ঔপনিবেশিক ফরাসি এবং স্প্যানিয়ার্ডদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ জনগণের স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা এবং খাত্তাবির অসামান্য মেধা, যোগ্য নেতৃত্ব, বলিষ্ঠ কন্ঠস্বর এবং মানুষকে প্রভাবিত করার অকল্পনীয় দক্ষতা। অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই তিনি স্প্যানিয়ার্ডদেরকে রিফ থেকে উচ্ছেদ করার লক্ষ্যে রিফের বিচ্ছিন্ন গোত্রগুলোকে নিয়ে একটি সশস্ত্র গেরিলাদল তৈরি করে ফেলেন।
খাত্তাবির রিফ বিদ্রোহ এবং আনুয়াল যুদ্ধ
খাত্তাবির নেতৃত্বে শুরু হওয়া রিফ বিদ্রোহে প্রথম বড় ধরনের জয় আসে ১৯২১ সালের জুন মাসে। সে সময় মাওলায়ে আহমেদ আর-রাইসুনি নামে স্থানীয় এক গোত্রপ্রধানের দুর্ধর্ষ গেরিলাবাহিনীকে ধ্বংস করার লক্ষ্যে স্প্যনিশ বাহিনী রিফের কাছাকাছি এসে উপস্থিত হয়। খাত্তাবি স্প্যানিশ বাহিনীর প্রধান জেনারেল ম্যানুয়েল ফার্নান্দেজ সিলভেস্ত্রেকে হুঁশিয়ার করে দেন, তার বাহিনী যদি নদী পার হয়ে রিফে প্রবেশ করে, তাহলে তার পরিণতি ভয়াবহ হবে। সিলভাস্ত্রে হেসেই খাত্তাবির হুমকি উড়িয়ে দেন।
জেনারেল সিলভাস্ত্র ছিলেন স্পেনের রাজা ত্রয়োদশ আলফঁনসোর ঘনিষ্ঠ বন্ধু। যুদ্ধযাত্রা শুরুর আগে তিনি ঘোষণা দিয়েছিলেন, মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই তিনি খাত্তাবির বাহিনীকে পুরোপুরি ধ্বংস করে দিবেন। এরপর খাত্তাবির বাড়িতে প্রবেশ করে সেখানে চা পান করবেন। কিন্তু তার সে অভিযান স্থায়ী হয়েছিল কয়েক সপ্তাহ পর্যন্ত। চা পান তো দূরের কথা, খাত্তাবির বাহিনীর গেরিলা আক্রমণে তার বিশাল বাহিনী যখন ধরাশায়ী, তখন পান করার মতো পানিও তাদের ছিল না। অনেককেই নিজেদের মূত্র পান করে তৃষ্ণা মেটাতে হয়েছিল।
জুন মাসের শেষের দিকে সিলভাস্ত্রের বাহিনীর সাথে খাত্তাবির রিফিয়ান গেরিলাদের প্রথম সংঘর্ষ শুরু হয়। প্রথম দিনেই গেরিলাদের আক্রমণে স্প্যানিয়ার্ডদের ৩০০ সৈন্যের মধ্যে ১৭৯ জন নিহত হয়। বাকিরা কোনো রকমে প্রাণ বাঁচিয়ে ফিরে যায়। পরবর্তী দিনগুলোতে অনেকগুলো ছোট ছোট যুদ্ধ সংগঠিত হয়, কিন্তু অধিকাংশ যুদ্ধেই স্প্যানিয়ার্ডরা খাত্তাবির গেরিলা বাহিনীর কাছে পর্যুদস্ত হয়। সিলভাস্ত্রে সর্বশক্তি নিয়োগ করার সিদ্ধান্ত নেন। খাত্তাবিকে পরাজিত করার জন্য তিনি ৬০,০০০ সৈন্যের এক বিশাল বাহিনী জড়ো করেন। এর বিপরীতে খাত্তাবির সৈন্যসংখ্যা ছিল মাত্র তিন থেকে চার হাজার।
১৯২১ সালের ২২ই জুলাই সংঘটিত হয় রিফ বিদ্রোহের সবচেয়ে বড় এবং সবচেয়ে স্মরণীয় যুদ্ধ, যা ব্যাটেল অফ আনুয়াল নামে পরিচিত। পাঁচ দিন বিচ্ছিন্ন সংঘর্ষের পর সেদিন ৩,০০০ রিফি গেরিলা একযোগে স্প্যানিশ বাহিনীর উপর চূড়ান্ত আক্রমণ করে। মাত্র একরাতের মধ্যে স্প্যানিশ পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যায়। তাদের ১৬,০০০ থেকে ২২,০০০ এর মতো সৈন্য নিহত হয়। দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে পালিয়ে যাওয়ার সময় তারা পেছনে ফেলে যায় অন্তত ১৫টি কামান, ৪০০টি মেশিনগান, ২৫,০০০ রাইফেল, ২,০০০ ঘোড়া এবং অন্তত ৭০০ বন্দী। আর এই জয় অর্জিত হয় মাত্র ৮০০ রিফি গেরিলার প্রাণের বিনিময়ে!
আনুয়াল যুদ্ধ ছিল যেকোনো ঔপনিবেশিক শক্তির জন্য এক বিশাল পরাজয়। জেনারেল সিলভাস্ত্রে নিজে যুদ্ধক্ষেত্রে আত্মহত্যা করেছিলেন বলে ধারণা করা হয়। নিজেদের পরাজয়ের গ্লানি মুছে ফেলার জন্য স্প্যানিশ বাহিনী ফরাসি বাহিনীর সাথে মিলে মরক্কোতে সর্বশক্তি নিয়োগ করে। তারা ১৯১৯ সালের ভার্সেই চুক্তি ভঙ্গ করে রিফের জনগোষ্ঠীর উপর রাসায়নিক অস্ত্র প্রয়োগ করতে শুরু করে। শেষপর্যন্ত ১৯২৬ সালের ২৬ মে প্রায় আড়াই লাখ ঔপনিবেশিক বাহিনীর বিশাল অভিযানের মুখে খাত্তাবি পরাজয় স্বীকার করে নিতে বাধ্য হন। তিনি ফরাসি বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেন। ফরাসিরা খাত্তাবিকে লা রিইউনিয়ন দ্বীপে নির্বাসন দেয়। ১৯৪৭ সালে সেখান থেকে পালিয়ে তিনি মিসরে গিয়ে আশ্রয় নেন। এরপর সেখানেই ১৯৬৩ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
আনুয়াল যুদ্ধের এবং খাত্তাবির প্রভাব
খাত্তাবির আত্মসমর্পণের পরপরই রিফ বিদ্রোহ স্তিমিত হয়ে পড়েছিল। কিন্তু তার আগেই তিনি শুধু মরক্কো না, সমগ্র উত্তর আফ্রিকার শোষিত জনগণের মধ্যে ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহে অনুপ্রেরণা সৃষ্টি করে গিয়েছিলেন। আনুয়াল যুদ্ধে খাত্তাবির বিজয়ের প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী। ঐ যুদ্ধে অপমানজনক পরাজয় স্প্যানিশ সেনাবাহিনীর মধ্যে ব্যাপক অসন্তোষ এবং হতাশার সৃষ্টি করে। তারই ধারাবাহিকতায় ১৯২৩ সালে মিগুয়েল প্রিমো দে রিভেরার সামরিক অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়, যা পরবর্তী ১৩ বছর পর্যন্ত স্থায়ী হয়। তার দুঃশাসন স্পেনে অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক বিপর্যয় নিয়ে আসে এবং পরবর্তীতে স্পেনকে দীর্ঘস্থায়ী গৃহযুদ্ধের দিকে ঠেলে দেয়।
মোহাম্মদ বিন আব্দুল করিম আল-খাত্তাবি নিজে শেষপর্যন্ত ঔপনিবেশিক শক্তির বিশাল বাহিনী এবং অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্রের কাছে পরাজিত হলেও তিনি দেখিয়ে গিয়েছিলেন কীভাবে গেরিলাযুদ্ধের মাধ্যমে হালকা অস্ত্রশস্ত্র দিয়েও বিশাল বাহিনীকে পরাজিত করা যায়। তার গেরিলা যুদ্ধের অসামান্য সাফল্য এবং কৌশল যুগ যুগ ধরে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিপ্লবী যোদ্ধাদেরকে অনুপ্রাণিত করে এসেছে।
কিউবার বিপ্লবী নেতা চে গুয়েভারাও খাত্তাবির গেরিলা কৌশল দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন বলে ধারণা করা হয়। গুয়েভারার সামরিক প্রশিক্ষক আলবার্তো বাইয়ো রিফ বিদ্রোহের সময় খাত্তাবির বিরুদ্ধে লড়াই করতে গিয়ে তার কৌশলগুলোর সাথে পরিচিত হয়েছিলেন। পরবর্তীতে তিনি গুয়েভারাকে সেসব কৌশলের উপর প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন। গুয়েভারা যখন ১৯৫৯ সালে মিসর সফরে গিয়েছিলেন, তখন তিনি খাত্তাবির সাথে সাক্ষাৎ করে তার লড়াইয়ের পেছনে খাত্তাবির অনুপ্রেরণার কথা স্বীকার করেছিলেন বলেও অনেক ইতিহাসবিদ দাবি করে থাকেন।
খাত্তাবির রণকৌশল অনুপ্রাণিত করেছিল ভিয়েতনামের হো চি মিন এবং চীনের মাও সে তুংকেও। ১৯৭১ সালে ফিলিস্তিনি মুক্তিকামী সংগঠন ফাতাহ’র কয়েকজন নেতা যখন চীনের বিপ্লবী নেতা মাও সে তুংয়ের সাথে সাক্ষাৎ করতে গিয়েছিলেন, তখন মাও সে তুং তাদেরকে বলেছিলেন, “আপনারা আমার কাছে এসেছেন মানুষের স্বাধীনতা যুদ্ধ সম্পর্কে আমার কথা শোনার জন্য, কিন্তু আপনাদের নিজেদেরই সাম্প্রতিক ইতিহাসে আব্দুল করিম নামে এমন একজন নেতা আছেন, যিনি হচ্ছেন অনুপ্রেরণার সবচেয়ে বড় উৎসগুলোর মধ্যে একটি। তার সংগ্রামের ইতিহাস থেকেই আমি শিখেছি জনগণের স্বাধীনতা যুদ্ধ আসলে কী!”
মাও সে তুং কথাটা ১৯৭১ সালে বললেও এটা এখনও সত্য। আমরা দেশ-বিদেশের অনেক সফল সামরিক নেতার, বিপ্লবী নেতার নামই জানি, তাদের আন্দোলনের ইতিহাস পড়ে মুগ্ধ হই। কিন্তু মাত্র এক রাতের মধ্যে স্পেনের বিশাল বাহিনীকে ধ্বংস করে দেওয়া এই “রিফের সিংহ” সম্পর্কে আমরা খুব কমই আলোচনা করি।
This article is in Bangla language. It's about the legendary Moroccan guerilla fighter and leader, Mohammed Bin Abdel Karim Al-Khattabi, who defeated the Spanish Colonial Army in the Battle of Annual. All the references are hyperlinked inside.
Featured Image: camping-aourir.com