Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

দিগ্বিজয়ী আলেকজান্ডার: রাজপুত্রের উত্থান (পর্ব ১)

রাজা খুব দ্রুত মারা গেলেন, তার সাদা আলখাল্লা রক্তে ভিজে লাল হয়ে উঠেছে। রাজকন্যার রাজকীয় বিবাহ অনুষ্ঠানের আনন্দ-মধুর পরিবেশ সহসাই রূপ নিয়েছে গভীর শোক আর আর্তনাদে। পসানিয়াস, রাজার দেহরক্ষীদের অন্যতম সদস্য হঠাৎ করেই আলখাল্লার ভেতর থেকে ছুরি বের করে রাজার বুকে বিঁধে দিয়েই দৌড় দিয়েছিলো বাগানের দিকে, ঘোড়ায় ওঠার জন্য। কিন্তু তার আগেই প্রিয় রাজার আততায়ীকেও পরপারে পাঠিয়ে দিলো রাজরক্ষীরা। দ্বিতীয় ফিলিপ মারা গেলেন যেভাবে জীবন কাটিয়েছিলেন সেভাবেই: রক্তরঞ্জিত পথ আর চারপাশের চক্রান্তের মধ্য দিয়ে। 

খ্রিস্টপূর্ব ৩৫৯ অব্দ থেকে ৩৩৬ অব্দ পর্যন্ত ২৩ বছরের রাজত্বে ফিলিপ মেসিডনকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন অঞ্চলের অন্যতম প্রভাবশালী রাষ্ট্রে। প্রতিবেশী বর্বর আদিবাসীদের আক্রমণে পর্যুদস্ত আর গ্রিক রাজ্যগুলোর অভ্যন্তরীণ কোন্দলে মেসিডনের অবস্থা ছিল শোচনীয়। যুদ্ধ, সামরিক চুক্তি আর বিয়ের মাধ্যমে ফিলিপ তার প্রতিদ্বন্দ্বী রাজ্যগুলোকে এক জায়গায় করেছেন, ঢেলে সাজিয়েছেন পুরো মেসিডোনিয়ান সেনাবাহিনীকে। কিন্তু হঠাৎ তার এই অপ্রত্যাশিত মৃত্যুর ফলে মেসিডনকে মুখ থুবড়ে পড়তে হয়নি। যোগ্য উত্তরাধিকার হিসেবেই মাত্র ২০ বছর বয়সে মেসিডন সাম্রাজ্যের হাল ধরলেন তৃতীয় আলেকজান্ডার আর ছেলেকে ঠিক সেভাবেই প্রস্তুত করে গিয়েছিলেন ফিলিপ।

তার ঠিক ৯ বছর আগের কথা। আলেকজান্ডার তখন সবেমাত্র কৈশোরে পা দিয়েছেন। তাকে সাথে নিয়েই থেসালির এক ঘোড়া ব্যবসায়ীর সাথে দেখা করতে গেলেন রাজা। উদ্দেশ্য রাজ আস্তাবলের জন্য অসাধারণ কিছু ঘোড়া কেনা। থেসালির সেই ব্যবসায়ী একটি সেরা ঘোড়া এনেছিলেন, নাম বুকেফ্যালাস (ষাঁড়ের মাথা)। এই দুরন্ত শক্তিশালী ঘোড়াকে বাগ মানাতে পারছে না রাজার কোনো সৈন্যই!

“এত ভালো একটা ঘোড়াকে এভাবে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে! এরকম অনভিজ্ঞ আর দুর্বল লোক থাকলে এরকমই হয়,” পেছন থেকে চিৎকার করে উঠলেন যুবরাজ।
“বড়দের সমালোচনা করার মতো তুমি কে? তোমার কি মনে হয় তুমি তাদের চেয়ে ঘোড়া সম্পর্কে ভালো জানো?” ফিলিপ তার ছেলেকে ধমকের সুরে বললেন।
“হ্যাঁ, আমার মনে হয় আমি তাদের চেয়ে ভালো ঘোড়া সামলাতে পারবো,” যুবরাজ আলেকজান্ডার উত্তর দিলেন।

রাজা আর তার সভাসদেরা একে অপরের দিকে তাকালেন। তৎকালীন সেরা ঘোড়সওয়ার হিসেবে মেসিডনের সৈন্যরা এমনিতেই সুপরিচিত ছিলেন।

– আচ্ছা, তুমি যদি ব্যর্থ হও, তাহলে তোমার শাস্তি কী হবে?
– ব্যর্থ হলে এই ঘোড়ার দাম আমি নিজে দেবো।

ফিলিপ আলেকজান্ডারকে অনুমতি দিলেন। যুবরাজ বুকেফ্যালাসের দিকে এগিয়ে গেলেন। দড়ি ধরে ঘোড়াটিকে অন্যদিকে ঘুরিয়ে দিলেন। আগেই লক্ষ্য করেছিলেন ঘোড়া মাঠে নিজের ছায়া দেখেই লাফিয়ে উঠছে। চোখের সামনে নিজের ছায়া নাচানাচি করতে না দেখে বুকেফ্যালাস শান্ত হয়ে এলো। তারপর শান্ত স্বরে ঘোড়ার দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করতে করতে উপরে উঠে গেলেন আলেকজান্ডার। হ্যাঁচকা টান মেরে যুবরাজকে ছুঁড়ে ফেলে দিতে চাইলো ঘোড়া, কিন্তু শক্ত হয়ে বসে রইলেন আলেকজান্ডার। ঘোড়ার মুখ ছায়ার উল্টোদিকে রেখে ধীরে ধীরে শান্ত করতে থাকলেন তিনি, আর সামান্য দৌড়ঝাঁপ করতেই ঘোড়া আলেকজান্ডারের পোষ মেনে গেলো ঘোড়াটি।

বিখ্যাত ইতিহাসবিদ প্লুটার্ক আলেকজান্ডারের জীবনের এই অসাধারণ মুহূর্ত লিপিবদ্ধ করেছেন। তার মুখ থেকেই শোনা যায়, আলেকজান্ডার যখন বুকেফ্যালাসকে নিয়ে ফিলিপের সামনে দাঁড়ালেন, ফিলিপের মুখ বেয়ে তখন আনন্দাশ্রু ঝরে পড়ছে।

“পুত্র, তুমি অন্য কোনো রাজ্য খুঁজে নাও। মেসিডন তোমার জন্য একটু বেশিই ছোট!”

বুকেফ্যালাস শুধু আলেকজান্ডারের প্রথম বিজয় ছিল না, বরং পরবর্তী ১৮ বছর আলেকজান্ডারের যোগ্য সাথী হিসেবে মেসিডোনিয়া থেকে ভারত পর্যন্ত দাবড়ে বেড়িয়েছে কুচকুচে কালো এই প্রাণীটি।

বুকেফ্যালাসকে পোষ মানাচ্ছেন আলেকজান্ডার; Image Source: Ancient World Leaders

দেবতার বংশধর

বর্তমান আলবেনিয়ার এপিরাস সাম্রাজ্যের রাজকুমারী ছিলেন আলেকজান্ডারের মা অলিম্পিয়াস। অলিম্পিয়াস আর ফিলিপের মধ্যে বেশ ভালো সম্পর্ক থাকলেও ফিলিপের একাধিক বিয়ে মেনে নিতে পারেননি তিনি। আলেকজান্ডার জন্ম হওয়ার দুই বছরের মধ্যেই ফিলিপ অন্য নারীদের সাথে সম্পর্কে জড়াতে থাকলেন। এতে রেগে যান অলিম্পিয়াস, আলেকজান্ডারকে নিজের দিকে টেনে নিতে থাকেন তিনি। ফিলিপের প্রতি রাগের কারণে তিনি আলেকজান্ডারকে বলতে লাগলেন ফিলিপ তার আসল বাবা নয়, বরং কোনো একজন গ্রিক দেবতা তার আসল বাবা।

এমন কথাও শোনা যায় যে, ফিলিপ গ্রিক বীর হারকিউলিসের বংশধর, অন্যদিকে অলিম্পিয়াস হলেন ট্রোজান যুদ্ধের বীর অ্যাকিলিসের বংশধর। তবে আলেকজান্ডার সম্ভবত গ্রিকদের উপর প্রভাব বিস্তার করার জন্য এ গুজব ছড়িয়েছিলেন। তবে যা-ই হোক না কেন, গ্রিকদের কাছে একজন দেবতার মতোই সম্মান পেতেন আলেকজান্ডার। গ্রিসের বাইরের একমাত্র ব্যক্তি হিসেবে হয়তো তাকে নিয়েই গর্ববোধ করতো প্রাচীন গ্রিকরা।

আলেকজান্ডারের বেড়ে ওঠা মেসিডোনিয়ার রাজধানী পেল্লা শহরে। গ্রিকদের কাছে পেল্লা ছিল একটি বর্বর শহর। অ্যাথেন্স, থিবস কিংবা করিন্থের মতো কোনো জৌলুসই ছিল না এখানে। বরং একে তুলনা করা যায় স্পার্টার সাথে, স্পার্টানদের রাজধানী, যারা আরাম আয়েশকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিলো। রাজা ফিলিপ, রানী অলিম্পিয়াস কিংবা রাজপুত্র আলেকজান্ডার, তিনজনই জানতেন গ্রিকরা মেসিডোনিয়াকে অবজ্ঞা করে। অ্যাথেনিয়ান, থিবান এমনকি স্পার্টানদের কাছে মেসিডন হলো একটা বুনো আর অসভ্য শহর, শুধুমাত্র ঘোড়সওয়ার আর মেষপালকরাই এখানে থাকতে পারে।

এদিকে পারিবারিক ঝামেলার কারণে আলেকজান্ডার মেসিডোনিয়ার সৈন্যদের মধ্যেই নিজের প্রিয় জায়গা খুঁজে পেলেন। ছোটবেলা থেকেই সৈন্যদের প্রিয় হিসেবে বেড়ে উঠেছিলেন তিনি। ফিলিপকে সৈন্যরা সম্মান করতেন তার দূরদর্শিতার জন্য, তার নেতৃত্বের জন্য, কিন্তু আলেকজান্ডারকে ভালোবাসতেন তার সাধারণ জীবনযাপনের জন্য। সৈন্যদের জীবনের সাথে ওতপ্রোতভাবে মিশে গিয়েছিলেন আলেকজান্ডার, সৈন্যরাও তাকে ভালোবাসতেন নিজেদের মতো করে।

ছাত্রের যোগ্য শিক্ষক

বুকেফ্যালাসকে পেল্লায় নিয়ে আসার কিছুদিন পরই ফিলিপ তার ছেলের জন্য একজন গৃহশিক্ষক খুঁজে বের করলেন। নতুন এই গৃহশিক্ষকের নাম অ্যারিস্টটল, মাউন্ট আথোসের পাদদেশে জন্মগ্রহণ করা এই গ্রিক বেড়ে উঠেছেন অ্যাথেন্সে, প্লেটোর ছাত্র হিসেবে। অ্যারিস্টটলের সাথে মেসিডন রাজ্যের আগে থেকেই সম্পর্ক ছিল। অ্যারিস্টটলের বাবা নিকোম্যাকাস ছিলেন ফিলিপের বাবা রাজা অ্যামিনটাসের চিকিৎসক।

অ্যারিস্টটলও রাজি হলেন রাজপুত্রের শিক্ষার ভার নিতে। একজন ভবিষ্যৎ শাসককে গড়ে তোলার জন্য এটি বেশ বড় একটি সুযোগ। তবে অ্যারিস্টটলের প্রাথমিক শর্ত ছিল স্ট্যাগিরা শহর পুনরায় গড়ে তুলে তার অধিবাসীদের ফিরিয়ে আনা, যা ফিলিপ ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেছিলেন। খ্রিস্টপূর্ব ৩৪৪ অব্দের কোনো এক সময়ে পেল্লায় তার জিনিসপত্র নিয়ে হাজির হলেন অ্যারিস্টটল। এদিকে ফিলিপ চেয়েছিলেন আলেকজান্ডারকে তার মায়ের কাছ থেকে দূরে রাখতে। তাই পেল্লা থেকে এক দিন যাওয়া-আসার দূরত্ব সমান মিয়েজা শহরে আলাদা একটি স্কুল তৈরি করে দিলেন।

অ্যারিস্টটল আলেকজান্ডারকে ঠিক কী শিখিয়েছিলেন কিংবা কীভাবে শিখিয়েছিলেন তার কোনো রেকর্ড পাওয়া যায়নি। এটা দুর্ভাগ্যজনক যে, আলেকজান্ডারের শিক্ষা এবং তাকে একজন দিগ্বিজয়ী হিসেবে গড়ে তোলার পিছনে অ্যারিস্টটলের অবদান সম্পর্কে কোনো পরিষ্কার ধারণা পাওয়া যায়নি। তবে অ্যারিস্টটলের জ্ঞান আর অর্জনের দিকে তাকিয়ে কিছুটা অনুমান করে নেওয়া সম্ভব।

পর্যবেক্ষণ ক্ষমতার দিক থেকে অ্যারিস্টটল তখনই নিজেকে একজন পণ্ডিত হিসেবে প্রমাণ করেছিলেন। ভূগোল আর ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের সংস্কৃতি সম্পর্কেও বেশ ভালো ধারণা ছিল তার। তাই ধারণা করা যায়, আলেকজান্ডারের শিক্ষার বিষয়গুলোর মধ্যেও এই দুটো অন্যতম প্রধান ছিল। অ্যারিস্টটল আলেকজান্ডারকে উৎসর্গ করে দুটি বই লিখেছিলেন: Monarchy এবং On Colonies । দুটি বইয়েই অ্যারিস্টটল দেখিয়েছেন একজন মধ্যবয়সী শিক্ষকের সাথে একজন তরুণ রাজপুত্রের সম্পর্ক কেমন হওয়া উচিত, কীভাবে এই সম্পর্ক আরো গভীর করা যায়। পরবর্তী কয়েক বছরে অ্যারিস্টটল তার ছাত্রকে উদ্দেশ্য করে একটি বিশাল চিঠিও লিখেছিলেন কীভাবে ভালো বক্তা হওয়া যায় তা নিয়ে। অ্যারিস্টটল তার ছাত্রের উদ্দেশ্যে লিখেছিলেন,

“তুমি যদি অন্যদের চেয়ে বেশি প্রভাবশালী হতে চাও, তাহলে পোশাকের চেয়ে বাগ্মিতা আরো ভালোভাবে রপ্ত করো। কারণ শরীরের ভাষা রপ্ত করার চেয়ে মনের ভাষা রপ্ত করা আরো বেশি গুরুত্বপূর্ণ।”

আলেকজান্ডারও অ্যারিস্টটলের যোগ্য শিষ্য হিসেবে তার দেওয়া শিক্ষা রপ্ত করে নিয়েছিলেন। নিজ সেনাবাহিনীর কাছে আলেকজান্ডারের গ্রহণযোগ্যতা ছিল তৎকালীন অন্য যেকোনো রাজা কিংবা সম্রাটের চেয়ে বেশি। সৈন্যদের মানসিকতা আলেকজান্ডার যতটা ভালোভাবে বুঝতে পারতেন, অন্য কেউ তার খণ্ডাংশও হয়তো পারতেন না। এর সুফলও আলেকজান্ডার পেয়েছিলেন ভালোভাবে, যুদ্ধের ময়দানে আলেকজান্ডারের জন্য জীবন দিতে কার্পণ্যবোধ করতো না মেসিডন বাহিনী।  

বালক আলেকজান্ডারকে শিক্ষাদান; Image Source: Ancient World Leaders

আলেকজান্ডারের শিক্ষাজীবনে হঠাৎ বাধা পড়লো ৪ বছর পর, তবে তা অ্যারিস্টটলের জন্য নয়। রাজা ফিলিপ মেসিডনের উত্তরে গিয়েছিলেন শত্রুদের শায়েস্তা করার জন্য। তার অনুপস্থিতিতে ১৬ বছর বয়সী আলেকজান্ডারকে রাজ্যের হাল ধরতে হয়। ফিলিপ অভিযান থেকে ফিরে আসার পর দেখতে পেলেন দক্ষিণের গ্রিকরা তার বিরুদ্ধে একজোট হচ্ছে।

ফিলিপের বাহিনীর মূল শক্তি ছিল পদাতিক ফ্যালানক্স (Phalanx)। শত্রুর আক্রমণ ঠেকাতে তারা মুহূর্তেই তাদের ঢালগুলো একত্র করে একটি বিশাল নিশ্ছিদ্র ঢালের পাহাড় তৈরি করে ফেলতে পারতো। আর সুযোগ পেলেই তাদের বিশাল ১৬ ফুট বর্শাগুলো দিয়ে শত্রুর শরীর ফুটো করে ফেলতো। আর ফ্যালানক্সদের ঠিক পেছনেই থাকতো অশ্বারোহী বাহিনী।

‘দ্য কিংস কম্প্যানিয়ন্স’ নামে পরিচিত এই বাহিনী হঠাৎ করে উদিত হয়ে ঝটিকা আক্রমণ করে, আবার ফ্যালানক্সদের ঢালের আড়ালে লুকিয়ে পড়ে। এই দুই দুর্ধর্ষ বাহিনী ফিলিপের আদেশ মতো যেকোনো পরিস্থিতিতে মানিয়ে নিতে পারতো এবং যুদ্ধের ময়দানের সেনাপতি ফিলিপেরও যেকোনো পরিস্থিতিতে সৈন্যদের সেরাটুকু বের করে নিয়ে আসার ক্ষমতা ছিল।

ফিলিপ আলেকজান্ডারকে সাথে নিয়ে অ্যাথেন্স আর থিবস বাহিনীর মুখোমুখি হলেন ক্যারোনিয়াতে, সময়টা তখন খ্রিস্টপূর্ব ৩৩৮ অব্দ, আলেকজান্ডারের বয়স ১৮। ক্যারোনিয়ার যুদ্ধ প্রায় অমীমাংসিতই থেকে যাচ্ছিল, যতক্ষণ না রাজপুত্র আলেকজান্ডার তার ‘কিংস কম্প্যানিয়ন্স’দেরকে নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে যুদ্ধে জয় এনে দিলেন। ‘দ্য স্যাক্রেড ব্যান্ড অফ থিবস’, ৩৩০ জনের দুর্ধর্ষ এক যোদ্ধাদল ইতিহাসের পাতায় মুহূর্তের মধ্যে হারিয়ে গেল তরুণ আলেকজান্ডারের মুখোমুখি হয়ে। ফিলিপ যুদ্ধে জিতে গেলেন, পুরো গ্রিসে শুধুমাত্র স্পার্টাই বাকি ছিল তার অধীনস্ত রাজ্যের বাইরে।

মেসিডনের ফ্যালানক্স বাহিনী; Image Source: megustalahistoriadeprimero.blogspot.com

ক্যারোনিয়ার যুদ্ধের এক বছরের মাথায় ফিলিপ সিদ্ধান্ত নিলেন আরেকজনকে স্ত্রী হিসেবে রাজপ্রাসাদে তুলবেন। কিন্তু এদিকে রানী অলিম্পিয়াস রেগে গেলেন, সিদ্ধান্ত নিলেন নতুন রানী ক্লিওপেট্রার উপর প্রতিশোধ নিবেন। ক্লিওপেট্রা নামটি মেসিডনে নতুন কিছু ছিল না, বরং মিশরের বিখ্যাত রানী ক্লিওপেট্রার অনেক আগে থেকেই ক্লিওপেট্রা নামটি মেসিডনে প্রচলিত ছিল। মূলত মিশরের ‘সার্পেন্ট অব দ্য নাইল’ ছিলেন আলেকজান্ডারের বাহিনীর একজন অন্যতম সেরা সেনাপতির বংশধর!

শুধু এই বিয়েই নয়, ফিলিপ সিদ্ধান্ত নিলেন তার মেয়ের সাথে (এর নামও ক্লিওপেট্রা) যে আলেকজান্ডারের চেয়ে দুই বছরের ছোট, অলিম্পিয়াসের ভাই ‘আলেকজান্ডার অফ এপিরাস’কে বিয়ে দেবেন! মামা-ভাগ্নীর এই বিয়ে শুধু অজাচারই নয়, বরং এতে রাজপরিবারে অলিম্পিয়াসের জায়গাও নড়বড়ে হয়ে যাবে। পানি যেন বেশিদূর না গড়ায় তাই অলিম্পিয়াস একজন শিষ্যকে ঘুষ দিয়ে বিয়ের অনুষ্ঠানেই নিজের স্বামীকে খুন করালেন, অন্যদিকে সতীন ক্লিওপেট্রাকেও মেরে ফেললেন বিষ খাইয়ে!

ফিলিপ মারা গেলেন, রাজ্যের কর্তৃত্বের ভার পড়লো ২০ বছর বয়সী আলেকজান্ডারের ঘাড়ে। পিতার হত্যাকারীকে সাথে সাথেই মেরে ফেলেছিলো রক্ষীরা, তা-ই তার আর করার কিছু ছিল না। বাবা ফিলিপ আর দ্বিতীয় স্ত্রী ক্লিওপেট্রাকে সমাহিত করা হলো এইগিরাতে, মেসিডনের একসময়ের রাজধানী ছিল এ শহর। ১৯৭৭ সালে এই দুই সমাধি আবিষ্কৃত হয়, যা ফিলিপ ও তার স্ত্রীর সমাধি হিসেবেই প্রমাণিত হয়েছে।

তরুণ রাজার আবির্ভাব

তরুণ আলেকজান্ডার এখন রাজা, মাথার উপরে ঢাল হয়ে থাকা বাবা এবং মেসিডনের একচ্ছত্র অধিপতি ফিলিপ আর নেই। এই সুযোগে দক্ষিণের গ্রিক রাজ্যগুলো বিদ্রোহ করে বসলো। ২০ বছর বয়সী তরুণ আলেকজান্ডার কী-ই বা করতে পারবেন তাদের? মাত্র ২০ বছর আগেও থিবস ছিল গ্রিসের প্রধান সামরিক শক্তি, থিবসের জেনারেলও চাচ্ছিলেন তাদের এই পুরনো গৌরব ফিরিয়ে আনতে। তাই থিবসের নেতৃত্বেই পুনরায় একজোট হলো গ্রিক বাহিনী।

আলেকজান্ডার মেসিডনিয়ান সেনাবাহিনী নিয়ে এগিয়ে গেলেন দক্ষিণ দিকে, ঠিক যেমনভাবে ৩ বছর আগে এই পথ দিয়ে গিয়েছিলেন। থিবসবাসীর আশা-ভরসা শুধু অভিজ্ঞ ফিলিপের জায়গায় রয়েছে অনভিজ্ঞ তরুণ আলেকজান্ডার। আলেকজান্ডার থিবস অবরোধ করলেন, আর তার বাহিনী কোনোমতে থিবসের দেয়াল ভেঙে ঢুকে পড়লো শহরে। থিবস পদানত হলো আলেকজান্ডারের।

আলেকজান্ডার থিবসবাসীকে ছেড়ে দিতে পারতেন, কিন্তু পরবর্তীতে আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে ভেবে পুরো শহর ধ্বংস করে দিলেন। ৩০ হাজারেরও বেশি মানুষ তাদের ঘরবাড়ি হারিয়েছিলো, সাথে স্বাধীনতাও। তাদেরকে দাস হিসেবে বিক্রি করে দেওয়ার জন্য ধরে নিয়ে যাওয়া হলো। থিবসের একটিমাত্র বাড়ি আলেকজান্ডার ধ্বংস করতে নিষেধ করেছিলো, আর তা হলো কবি পিন্দারের, যাকে আলেকজান্ডার অনেক শ্রদ্ধা করতেন।

থিবসকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করলেন আলেকজান্ডার; Image Credit: Charles R. Stanton

থিবস ধ্বংসস্তূপে পরিণত হবার পর বাকি সব নগররাষ্ট্রগুলো আলেকজান্ডারের কাছে মাথা নত করলো। আলেকজান্ডারের পরবর্তী গন্তব্য অ্যাথেন্স, সেখানে গিয়ে দেখা করলেন তৎকালীন বিখ্যাত দার্শনিক ডায়োজিনিসের সাথে। আরাম-আয়েশ আর পার্থিব বস্তু বিবর্জিত এই দার্শনিককে রাস্তায় বসে থাকতে দেখে তার দিকে এগিয়ে গেলেন আলেকজান্ডার। জিজ্ঞাসা করলেন, “আমি আপনার জন্য কী করতে পারি?” ডায়োজেনিসের প্রত্যুত্তরও ছিল খুব দ্রুত এবং স্পষ্ট।

“একটু সরে দাঁড়াও। তুমি সূর্যটা আড়াল করে দাঁড়িয়ে আছো।”

আলেকজান্ডার চলে যেতেই তার সভাসদেরা বৃদ্ধ লোকটিকে তার মূর্খতার জন্য অবজ্ঞা করতে শুরু করলো। আলেকজান্ডারও শান্তভাবে তাদের কথার জবাব দিলেন,

“আমি যদি আলেকজান্ডার না হতাম, তবে আমি ডায়োজেনিসই হতে চাইতাম।”

ডায়োজেনিসের মুখোমুখি আলেকজান্ডার; Image Source: Ancient World Leaders

ডায়োজেনিসের সাথে দেখা হওয়ার পর আবারো পেল্লায় ফিরে গেলেন আলেকজান্ডার। এশিয়ায় গ্রিক সভ্যতার ছোঁয়া পৌঁছে দিলেও আলেকজান্ডার নিজে কখনো অ্যাথেন্সের মতো শহরে অবস্থান করে আরাম পেতেন না। পেল্লার আর মেসিডনের মতো পাহাড় আর প্রতিকূল পরিবেশেই তিনি স্বাচ্ছন্দ্যে চলাফেরা করতেন।

পেল্লায় প্রত্যাবর্তনের কয়েক মাসের মধ্যেই আলেকজান্ডার তার পরবর্তী পরিকল্পনা করে ফেললেন। বাবা ফিলিপের স্বপ্ন ছিল পারস্য সাম্রাজ্য দখল করা আর তিনি তা-ই করার পরিকল্পনা করছেন। অনেক দিন ধরেই মেসিডন এবং গ্রিসের বাইরে থাকতে হবে ভেবেই তার বাবার অন্যতম বিশ্বস্ত সেনাপতি অ্যান্টিপ্যাটারকে নিজের প্রতিনিধি হিসেবে গ্রিসে রেখে গেলেন আলেকজান্ডার। অ্যারিস্টটলের এক আত্মীয় ক্যালিস্থেনিসও আলেকজান্ডারের পরবর্তী অভিযানে শামিল হলেন। নতুন মহাদেশের ফুল আর গাছপালা নিজের প্রাক্তন শিক্ষকের কাছে পাঠিয়ে দেওয়ার প্রতিজ্ঞা করেছেন তরুণ রাজা।

তার বাহিনী নিয়ে এশিয়া মাইনরের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে ইতিহাসের পাতা ওল্টাতে থাকলেন আলেকজান্ডার। হোমার, হেরোডোটাস আর জেজোফোনের লেখায় আগেই পড়েছেন গ্রিস আর পারস্যের কয়েকশ বছরের দ্বন্দ্ব। এশিয়ার হেলেসপন্টের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন আলেকজান্ডার। এবার নিজেই ইতিহাস গড়বেন তিনি।

দ্বিতীয় পর্ব: দিগ্বিজয়ী আলেকজান্ডার: এশিয়ায় পদার্পণ

Related Articles