Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website. The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

ফুলের শক্তির আবিস্কারক অ্যালেন গিন্সবার্গ

ফুলের সৌন্দর্য আর সৌরভে বিমোহিত পৃথিবীর সব হৃদয়। আর হৃদয়ের আকুতি যারা ভাষায় তুলে ধরেন সেই কবিরা তো সেই সৃষ্টির শুরু থেকেই ফুলের বন্দনায় রত। বিশ্বের প্রাচীনতম সাহিত্যেও আছে ফুলের বন্দনা। অনাগত কালেও কবিরা ফুলের সৌন্দর্য নিয়ে কবিতা লিখবেন, গায়কেরা গাইবেন গান। গান-কবিতার এই সব আয়োজন ফুলের সৌরভ আর সৌন্দর্যের আখ্যানলিপি।

কিন্তু হঠাৎ একজন কবি ভাবলেন, ফুলকে আমি অস্ত্র করব। বুলেটের মুখোমুখি তিনি দাঁড় করালেন ফুল। আর এতেই বিশ্ব অবাক হয়ে দেখল, ভেতরে আসলে কতটা শক্তিও ধরে এতদিন লালিত্য সৌন্দর্য্যের প্রতীক বিবেচিত হয়ে আসা ফুল। এভাবেই পৃথিবীবাসীর ভাষায় ‘ফ্লাওয়ার পাওয়ার’ বা ফুলেল শক্তি নামের নতুন একটি শব্দবন্ধ যোগ হলো। ফুলের এই নব শক্তির বিষয়টি যিনি আবিস্কার করলেন তিনি আর কেউ নন, অ্যালেন গিন্সবার্গ। সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড কবিতাটির কারণে তার নামটি বাংলাদেশের স্বাধীনতার সঙ্গেও ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে।

ফ্লাওয়ার পাওয়ার মুভমেন্টের প্রতীকী ছবি হয়ে উঠেছে এটি; Source: history.com

কবি অরউইন অ্যালেন গিন্সবার্গ ছিলেন আমেরিকার প্রথম সারির একজন সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক অধিকারকর্মী। ১৯৫৫ সাল থেকে আমেরিকা ভিয়েতনাম যুদ্ধে জড়িয়ে পড়লে দেশটির রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক কর্মীরা এর বিরোধীতায় নামেন। আমেরিকাজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে ভিয়েতনাম যুদ্ধবিরোধী বিক্ষোভ। অনেকের কাছেই এই আন্দোলন হিপ্পি মুভমেন্ট নামেও পরিচিত। যুদ্ধবিরোধী এই আন্দোলন সংগ্রামে বিট প্রজন্মের কবি অ্যালেন গিন্সবার্গ ছিলেন সামনের সারির একজন। ১৯৬৫ সালে এই আন্দোলনের কর্মীরা একটি বড় সমস্যার সম্মুখীন হন। আর এই সমস্যা থেকে উত্তরণের পথ হিসেবেই কবি অ্যালেন গিন্সবার্গ সৃষ্টি করেন তার অমর শব্দবন্ধ “ফ্লাওয়ার পাওয়ার।”

ভিয়েতনাম যুদ্ধের বিরোধী আন্দোলনকারীরা ১৯৬৫ সালের ১৬ অক্টোবর ক্যালিফোর্নিয়ার বার্কলে শহর থেকে প্রায় পাঁচ হাজার লোকের এক বিশাল মিছিল নিয়ে ওকল্যান্ডে যান। এই মিছিলগুলোর বৈশিষ্ট ছিল পথে পথে তারা গান গাইতে গাইতে যেত। তখন যুদ্ধবিরোধী গানের একটি নতুন ধারাই সৃষ্টি হয়েছিল।

সেদিন আন্দোলনকারীরা গাইছিল কান্ট্রি জো অ্যান্ড ফিস ব্যান্ডের ‘আই এম ফিক্সিন টু ডাই’ গানটি। পথিমধ্যে কয়েক হাজার পুলিশ তাদের পথরোধ করে। পুলিশের বাধার মুখে আন্দোলনকারীরা সেখানে দাঁড়িয়ে গান গাইতে থাকেন। কিন্তু বিপদটা আসে পেছন দিক থেকে। ভিয়েতনাম যুদ্ধের যেমন বিরোধী পক্ষ ছিল, তেমনি ছিল কিছু পক্ষের লোকজনও। এমনি একটি উগ্রপন্থী গোষ্ঠী ছিল হেল’স অ্যাঞ্জেল গ্রুপ। কট্টর যুদ্ধবাজ এই গোষ্ঠীর লোকজন বাইকে করে চলাফেরা করত আর বিভিন্ন স্থানে মারপিট ও দাঙ্গা-হাঙ্গামা করে বেড়াত। সেদিনও এই গ্রুপটি যুদ্ধবিরোধী মিছিলের পেছনে চলে আসে এবং পেছন থেকে বিক্ষোভকারীদের গালি-গালাজ করতে থাকে। এক পর্যায়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায় এবং শুরু হয় মারপিট। পুলিশ, বিক্ষোভকারী এবং হেল’স অ্যাঞ্জেলের গুণ্ডাদের এই ত্রিমুখী লড়াইয়ে অনেকেই আঘাতপ্রাপ্ত হন। এক পুলিশ অফিসারের হাত ভেঙে যায়। এরপর সেখান থেকে চলে আসেন আন্দোলনকারীরা।

ভিয়েতনাম যুদ্ধবিরোধী আন্দোলনে পুলিশি বাধা ছবিটি ১৯৬৭ সালের ২১ অক্টোবরে তোলা; নিউইয়র্ক ডেইলি

যুদ্ধবিরোধী বিক্ষোভে দাঙ্গা-হাঙ্গামার বিষয়টি ভাবিয়ে তোলে আন্দোলনের নেতৃবৃন্দকে। বিশেষ করে হেলস অ্যাঞ্জেল গ্রুপের মারমুখি ভঙ্গিমা সবাইকে চিন্তিত করে তোলে। ওই গ্রুপটি বিক্ষোভকারীদের ২০ অক্টোবরের বিক্ষোভও মারপিট করে ভন্ডুল করে দেওয়ার ঘোষণা দেয়। এই পরিস্থিতিতে কিছু একটা বিহিত করবার ভার এসে পড়ে গিন্সবার্গের ওপর। তিনি ঔপন্যাসিক কেন কেসিকে সাথে নিয়ে হেলস অ্যাঞ্জেল গ্রুপের প্রধান সনি বার্গার এর বাড়িতে যান। সেখানে তিনি বিপদজনক এসব গুণ্ডাপাণ্ডার সঙ্গে সাহসের সঙ্গে কথা বলেন এবং তাদেরকে কৌশলে বশ করেন। তার সাহস এবং কৌশলের কারণে হেলস অ্যাঞ্জেলরা আন্দোলনে বাধা না দিতে রাজি হয়। এমনকি তারা তার সাহসের প্রশংসা করে এবং তাকে তাদের সঙ্গে বাইকে চড়াতেও রাজি হয়।

শিকাগোতে ভিয়েতনাম যুদ্ধবিরোধী বিক্ষোভে কবি অ্যালেন গিন্সবার্গ; Source: pinterest.com

কিন্তু তারপরও আন্দোলনকারীদের ভয় দূর হয়নি। তারা শঙ্কায় ছিল যদি আবারো আক্রমণ করে বসে হেলস অ্যাঞ্জেল এর বাইকাররা! আর তাই আবারো অৗালেন গিন্সবার্গকে বসতে হয়েছিল নতুন পরিকল্পনা সাজাতে। অনেক ভেবে তিনি বের করলেন এক নতুন অস্ত্র। আর সেটি হচ্ছে ফুল। ফুলের শক্তিমত্তার বিষয়টি তিনি তুলে ধরলেন তার বিখ্যাত প্রবন্ধ “হাউ টু মেক অ্যা মার্চ” এ। এখানে তিনি সারা আমেরিকার আন্দোলকারীদের পরামর্শ দিলেন, আন্দোলনে ফুলের ব্যবহার করতে হবে। তিনি সবাইকে আহ্বান জানালেন, ফুল নিয়ে রাজপথে নামুন। পুলিশ বা হেলস অ্যাঞ্জেল যারাই আন্দোলনে বাধা দিতে আসবে তাদের হাতে তুলে দিন সৌন্দর্যের প্রতীক ফুল। এছাড়াও তিনি পুলিশ সাংবাদিক এবং মিছিল দেখতে আসা জনতার জন্য ফুলের পাশাপাশি ক্যান্ডি, চকলেট, বাচ্চাদের খেলনা ইত্যাদি উপহার নিয়ে আসতে বললেন আন্দোলনকারীদের।

গিন্সবার্গের এই আহ্বানে ম্যাজিকের মতো কাজ হলো। সারা আমেরিকা জুড়ে ছড়িয়ে পড়ল এই ফুলের আন্দোলন। বিক্ষোভকারীরা শান্ত মুখে যুদ্ধবিরোধী বিক্ষোভ আর মিছিল নিয়ে রাস্তায় নামলো, আর সঙ্গে নিল ফুল। শুধু তাই নয় তাদের পরনের কাপড়-চোপড়েও ফুল জায়গা করে নিল। গাড় রঙের জমিনে বড় বড় উজ্জল ফুল ছাপানো কাপড়-চোপড় পরে রাস্তায় নেমে এলো হিপ্পি নামে পরিচিত ভিয়েতনাম যুদ্ধবিরোধী আন্দোলনকারীরা। এভাবেই জন্ম নিল “ফ্লাওয়ার পাওয়ার” আন্দোলন এবং আমেরিকার সঙ্গে সঙ্গে সারা বিশ্ব অবাক হয়ে দেখল ফুলের কী শক্তি! এই ফুলেল শক্তির আন্দোলনের প্রথম মিছিলটি বেরিয়েছিল ক্যালিফোর্নিয়ার বার্কেলে থেকে। আর সেই মিছিলে সামনে থেকে ফুল হাতে নের্তৃত্বে ছিলেন ফুলেল শক্তির আবিস্কারক কবি অ্যালেন গিন্সবার্গ।

পুলিশের প্রতি ফুল বাড়িয়ে দিচ্ছেন আন্দোলনকারীরা। ছবিটি ১৯৬৭ সালের; Source: Virginia Times

একজন কবি হিসেবে তিনি সব সময়ই ভালোর শক্তিতে আস্থা রেখেছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, পৃথিবীতে অস্ত্রের শক্তির চেয়ে মানুষের শক্তি বড়। আর তাইতো তার হাতেই সৌন্দর্যের প্রতীক ফুল হয়ে উঠল হাতিয়ার। সংগ্রামী সাংস্কৃতিক কর্মী গিন্সবার্গ সারা জীবন নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন মানুষের অধিকার আদায়ের আন্দোলনে। ১৯৫০-এর দশকের বিট প্রজন্ম এবং বিপরীত সংস্কৃতি আন্দোলনের নেতৃস্থানীয় এই কবি আমেরিকার সামরিকতন্ত্র, অর্থনৈতিক বস্তুবাদ এবং যৌন নিপীড়ন বিষয়ের জোরালোভাবে বিরোধীতা করেন। ১৯২৬ সালে আমেরিকার নিউজার্সির নিউআর্ক শহরে জন্ম নেওয়া এই কবি সর্বাধিক পরিচিত ‘হাউল’ (১৯৫৬) মহাকাব্যের জন্য। এই কাব্যে তিনি আমেরিকার পুঁজিবাদের ধ্বংসাত্মক শক্তির নিন্দা করেন। এই কবিতায় তিনি তার বিট প্রজন্মের বন্ধুদের প্রশংসা করেন এবং বস্তুবাদের ধ্বংসাত্মক শক্তিকে আক্রমণ করেন।

ফুল হাতে কবি অ্যালেন গিন্সবার্গ; Source: Poetry Foundation

যুদ্ধবিরোধী গিন্সবার্গ চুপচাপ বসে থাকেন নি বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়ও। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মার্কিন সরকার যেখানে পাকিস্তানকে সমর্থন যুগিয়েছিল, সেখানে অ্যালেন গিন্সবার্গ বাংলাদেশের পক্ষে সরব ছিলেন। কলকাতায় তার সাহিত্যিক বন্ধুদের সাথে নিয়ে তিনি যুদ্ধের ভয়াবহতার সংবাদ বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দেওয়ার সংগ্রামে নেমেছিলেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় সেপ্টেম্বর মাসে রোলিং স্টোন ব্যান্ডের কিথ রিচার্ডস কিছু টাকা তুলে দিয়েছিলেন গিন্সবার্গের হাতে। উদ্দেশ্য, বাংলাদেশে যে স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু হয়েছে, হাজার হাজার বাঙালি শরণার্থী বাংলাদেশ ছেড়ে ভারতের শরণার্থী শিবিরগুলোতে আশ্রয় নিয়েছে, অবর্ণনীয় দুর্ভোগের শিকার তারা সেখানে এসব ব্যাপার সরেজমিনে ঘুরে দেখে যুদ্ধের প্রকৃত পরিস্থিতি তুলে ধরে প্রতিবেদন লেখা।

কলকাতার রাস্তায় অ্যালেন গিন্সবার্গ; utexas.edu

পশ্চিমবঙ্গের বিখ্যাত লেখক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে সঙ্গে নিয়ে তিনি ঘুরে দেখেছিলেন শরণার্থী শিবিরে মানুষের দুর্দশার চিত্র। কবিমনকে নাড়া দিয়েছিল মানুষের সেই দুর্দশা। আর তাই তিনি লিখেছিলেন তার বিখ্যাত কবিতা সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড। আর এই কবিতার মাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামেও তিনি চিরস্মরণীয় একজন ব্যক্তিত্ব হয়ে উঠেছেন। দীর্ঘ জীবন শেষে এই সংগ্রামী কবি ১৯৯৭ সালে নিউইয়র্কে মারা যান। কিন্তু তার উদ্ভাবিত ফুলেল শক্তির যে চেতনা তা যুগে যুগে সংগ্রামী মানুষের মনে অমর হয়ে থাকবে।

Related Articles