"আমি শুধুমাত্র ভারতে আঁকতে পারি। ইউরোপ পিকাসোর, ম্যাটিস এবং ব্রাকের। কিন্তু ভারত শুধুমাত্র আমার।"
ভারত সম্পর্কে এভাবেই বলতেন ভারতীয়-হাঙ্গেরিয়ান চিত্রশিল্পী অমৃতা শের-গিল। শের-গিল, যাকে কি না আধুনিক ভারতীয় চিত্রকর্মের পথিকৃৎ বলা হয়ে থাকে, তিনি তার তুলির আঁচড়ে ক্যানভাসে ফুটিয়ে তোলেন ১৯৩০ সালের ভারতীয় নারীদের জীবনের প্রতিদিনকার কাহিনী। সেসব চিত্রের মধ্যে অধিকাংশ সময়ে উঠে আসতো সেসময়ের নারীদের একাকিত্ব ও অসহায়ত্বের চিত্র। তাঁর চিত্রকর্ম থ্রি গার্লস এ তিনজন নারীকে দেখি রঙিন কাপড় পরিহিত অবস্থায় বসে থাকতে, কিন্তু পরনের কাপড়ের রঙের ছিটেফোঁটাও তাদের চেহারায় নেই।
শের-গিলের আঁকা এসব চিত্রকর্ম বেশ আলোড়ন ফেলে চারদিকে, কেননা সেই সময়ে বেশিরভাগ চিত্রে নারীদের হাসিখুশি ও সংসারমুখী চরিত্র তুলে ধরা হতো। অমৃতা শের-গিল তাঁর রচনাশৈলী এবং নারীদের উপর উদ্ব্যক্তির কারণে ভারতের ফ্রিদা কাহলো হিসেবে পরিচিতি পেয়েছিলেন। তিনি তার বিষয়ের মাঝে একাকিত্ব এমনভাবে ফুটিয়ে তুলতেন, যেন রঙ-তুলিতে তিনি নিজের বিষণ্নতার আঁচড়ই কেটে চলছেন। এক্ষেত্রে তার বেড়ে ওঠার গল্প বেশ অনেকখানি প্রভাব রেখেছিল, কেননা তিনি দ্বৈত জগতের মধ্যে বসবাস করতেন এবং প্রায়ই নিজের আসল পরিচয় খুঁজে বেড়াতেন।
হাঙ্গেরির বুদাপেস্ট শহরে অমৃতা শের-গিল জন্ম নিয়েছিলেন ১৯১৩ সালের ৩০ জানুয়ারি। অমৃতার মা ম্যারি অ্যান্টোইনিট গটেসম্যান অপেরায় গান গাইতেন এবং ধর্মমতে তিনি একজন হাঙ্গেরিয়ান ইহুদী ছিলেন। অপরদিকে তার পিতা উমরাও সিং শের-গিল মাজিথিয়া শিখ ছিলেন। শের-গিল দুই বোনের মধ্যে বড় ছিলেন, তার ছোট বোন ইন্দিরা সুন্দরাম, সমসাময়িক শিল্পী ভিভান সুন্দরামের মা।
শের-গিলের শৈশবের বেশিরভাগ সময় কেটেছে ইউরোপেই। ১৯২১ সালে অর্থনৈতিক টানাপোড়েনের কারণে তার পরিবার উত্তর ভারতের শিমলায় স্থানান্তরিত হয়। সেখানেই আট বছর বয়সে ছবি আঁকায় প্রাতিষ্ঠানিকভাবে হাতেখড়ি হয় তার। প্রথমে মেজর হুইটমার্শের কাছ থেকে, এবং পরবর্তীতে বিভেন প্যাটম্যানের কাছে নিয়মিত দীক্ষা নিতে থাকেন তিনি। শিশুকালেই শের-গিল নিজেকে নাস্তিক দাবি করায় স্কুল থেকে বের করে দেয়া হয় তাকে। ষোল বছর বয়সে তিনি প্যারিসে চলে যান এবং শিল্পকলা নিয়ে আরও পড়াশোনা চালিয়ে যেতে থাকেন। প্রথমে ভর্তি হন আকাদেমি দে লা গ্রান্দে চাউমিরে, এবং পরে একোলে দি বুঁজা আর্টসে। বলা বাহুল্য, সেই বয়সে তিনি বেশ সাফল্য পেয়েছিলেন।
এসময় পল সেজান, আমেডিও মোডেয়ানি, পল গগ্যাঁর দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। তার বেশ কিছু ছবিতেই গগ্যাঁর রচনাশৈলীর ছাপ পাওয়া যায়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কাজ হলো 'সেল্ফ পোর্ট্রেট অ্যাজ আ তাহিতিয়ান'। এই আত্ম প্রতিকৃতিতে অমৃতাকে দেখা যায় একজন তাহিতিয়ান নারীর বেশে। অমৃতা তাঁর সাহসী সৃষ্টি দ্বারা সেসময় বেশ সাড়া ফেলে দিয়েছিলেন। বলা বাহুল্য, সেসময় নগ্ন ছবি খুব একটা প্রশংসিত ছিল না উপমহাদেশে আর সেটা যদি একজন নারী শিল্পী দ্বারা আঁকা হয়ে থাকে, সেক্ষেত্রে তো কথাই নেই! তবে এই প্রতিকূল অবস্থায়ও অমৃতা থেমে থাকেননি। তিনি তুলির আঁচড়ে সৃষ্টি করেছেন পৃথিবীর ইতিহাসে সৃষ্ট ন্যুড পেইন্টিংগুলোর মধ্যে অনন্য এক সৃষ্টি 'স্লিপিং ওম্যান' (১৯৩৩)। একদম রাখঢাকহীনভাবে অকৃত্রিমতার সাথে তিনি তার এই চিত্রকর্ম তৈরি করেছেন নিজস্ব ঢঙে।
১৯৩৩ সালে অমৃতার অঙ্কিত চিত্রকর্ম 'ইয়ং গার্লস', প্যারিস সেলুন নামে একটি বিখ্যাত চিত্র প্রদর্শনীতে স্বর্ণপদক পায়। তখন শের-গিলের বয়স মাত্র উনিশ। ছবিটি ছিল তার বোন ইন্দিরাকে নিয়ে। ইন্দিরার পরিহিত ছিল ইউরোপীয় পোশাক এবং চোখে-মুখে দৃঢ় প্রত্যয়ের ছাপ; পাশে বসা ছিল তার অর্ধনগ্ন বন্ধু, ডেনিস প্রুটঁজ, যার মুখ তার চুল দিয়ে ঢাকা ছিল। এখানে প্রথম মহিলাটি সাহসী ও দৃঢ় প্রত্যয়ী, অপরজন লুক্কায়িত এবং সংরক্ষিত। এই চিত্র হতে আঁকিয়ের ব্যক্তিত্বের দ্বৈত দিকের সন্ধান পাওয়া যায়।
ভারতে পড়ালেখা শেষ করে অমৃতা যখন ফেরত আসেন, তখন সালটা ১৯৩৪। ইউরোপে চিত্রশিল্পী হিসেবে যাত্রা শুরু করলেও অমৃতার ধারণা ছিল, ভাগ্য তার জন্য ভারতেই ভালো কিছু লিখে রেখেছে। পশ্চিম ভারতের অজান্তা গুহার দেয়ালে দেয়ালে যেসব প্রাচীন চিত্রকর্ম ছিল, তা দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন তিনি। গুহার দেয়ালে আঁকা এসব প্রতিকৃতির সাথে তিনি ইউরোপীয় ঘরানার অঙ্কনশৈলী মিশিয়ে একপ্রকার ফিউশন তৈরি করেন। তাঁর এসব সৃষ্টি ছিল সমসাময়িক অন্যান্য চিত্রশিল্পী তথা, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, আব্দুর রহমান চুগথাই, নন্দলাল ঘোষ প্রমুখের কাজ হতে সম্পূর্ণ বিপরীত। বেংগল স্কুলসহ আরও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের প্রতি তিনি কঠোর নিন্দা জানান এবং বলেন যে এসব প্রতিষ্ঠান কিছু নিয়ম দ্বারা ভারতীয় চিত্রকলাকে একটা গণ্ডিতে আবদ্ধ করতে চাইছে। সমসাময়িক ভারতীর চিত্রকরদের নিজেদের ছবিতে ব্যবহার করা অনুজ্জ্বল রঙের বিপরীতে অমৃতা ব্যবহার করতেন উজ্জ্বল ও নানা মিশ্রণের রঙ। এসবের মধ্যে দিয়ে তিনি প্রতিবাদ চালিয়ে গিয়েছিলেন।
১৯৩১ সালে অমৃতা শের-গিলের ইউসুফ আলী খানের সাথে বাগদান সম্পন্ন হয়। কিন্তু সেইসময় কথা ছড়িয়ে পড়ে যে, তিনি পরবর্তীতে তার দ্বিতীয় স্বামী (যিনি শের-গিলের দূর সম্পর্কের ভাই ছিলেন) ভিক্টর এগানের সাথে অবৈধ সম্পর্কে জড়িত ছিলেন।
শের-গিল আত্মীয়, প্রেমিক কিংবা বন্ধুদের ছবি আঁকার পাশাপাশি অনেক আত্মপ্রতিকৃতি তৈরি করেন। সেসব প্রতিকৃতিতে বেশিরভাগ সময়ই অন্তর্মুখী এবং অস্থির চিত্তের একজন নারীর চিত্র ফুটে উঠতো, যে কি না নিজের পরিচয় নিয়ে দোটানায় ভুগছে।
অমৃতা ব্যক্তিজীবনে তার যৌন সত্ত্বা নিয়ে দ্বিধান্বিত ছিলেন। তিনি সমকামী সম্পর্কের দিকে অনেকখানিই ঝুঁকেছিলেন। আঁকিয়ে ম্যারি লুইস চ্যাসানির সাথে তার খুব দ্রুত অন্তরঙ্গ সম্পর্ক তৈরি হয়, সেইসাথে কিছু শিল্প সমালোচক এবং তাঁর ভাতিজা চিত্রকর ভিভান সুন্দারামের সাথেও তার ভালো সম্পর্ক ছিল। ম্যারির সাথে সম্পর্ক নিয়ে শের-গিলের মা একপর্যায়ে তাঁকে প্রশ্ন করলে তিনি ১৯৩৪ মাকে লেখা একটি চিঠিতে ম্যারির সাথে তার অন্তরঙ্গতার কথা অস্বীকার করেন। অবশ্য শের-গিলের অনেক পুরুষের সাথেও সম্পর্ক ছিল। এর মধ্যে কয়েকজন হলেন আর্ট শিক্ষক বোরিস টেজলসকি, ভারতের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট জওহরলাল নেহেরু, ব্রিটিশ যুবক ওয়াল্টার কলিন, আকবরপুরের নবাব ইউসুফ আলী খানবা, বিখ্যাত ইংরেজ সাংবাদিক ম্যালকম মুগরিজসহ অনেকে।
ভারতে ফিরে এসে ১৯৩৭ সালে অমৃতা দক্ষিণ ভারতের পাহাড়ি এলাকাগুলোসহ অন্যান্য এলাকাগুলো ঘুরে বেড়ান। বোহেমিয়ান এই চিত্রশিল্পীর হাত ধরে তখন তৈরি হয় ভারতীয় পটভূমি দ্বারা অনুপ্রাণিত নানা ছবি। এর মধ্যে 'ভিলেজ সিন', 'থ্রি গার্লস', 'সাউথ ইন্ডিয়ান ভিলেজারস', 'ট্রাইবাল ওম্যান', 'চাইল্ড ব্রাইড', 'রেস্টিং', 'ব্রাইডস টয়লেট' অন্যতম। এ সময় তার রচনশৈলীর মধ্যে ভারতের প্রভাব অনেকটুকুই খুঁজে পাওয়া যায়।
সমাজের বিভিন্ন দায়বদ্ধতা এবং প্রথার বিরুদ্ধে অবস্থান ছিল অমৃতা শের-গিলের। বিয়েকে তিনি দেখতেন তাঁর পিতা-মাতা থেকে মুক্তির পথ হিসেবে। ১৯৩৮ সালে তিনি হাঙ্গেরিতে ফেরত যান এবং ভিক্টর এগানের সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। বাবা উমরাও সিং ছিলেন এই বিয়ের বিপক্ষে, যেহেতু শিখদের মধ্যে জ্ঞাতিভাইদের সাথে বিয়ের সম্পর্ক স্থাপনের কোনো চল নেই। কিন্তু প্রথা বিরোধী অমৃতা কিছুটা জেদের বশেই বিয়েটা করেছিলেন। বিয়ের কিছুদিন পরপরই ভিক্টর জানতে পারেন, অমৃতা সন্তানসম্ভবা। জানার সাথে সাথেই ভিক্টর নিজেই গর্ভপাতের ব্যবস্থা করেন।
হাঙ্গেরিতে এক বছর কাটানোর পর ১৯৩৯ সালে শের-গিল এবং ভিক্টর ভারতের উত্তর প্রদেশের গোরাখপুর জেলার সারায়া গ্রামে বসবাস করতে শুরু করেন। এ সময় অমৃতা নতুনভাবে ছবি আঁকার অনুপ্রেরণা খুঁজতে শুরু করেন। সতেরো শতাব্দীর দিকে নির্মিত মুঘল স্থাপত্যের গঠন ও রঙের ব্যবহার, সেইসাথে অজান্তা গুহার দেয়ালের চিত্রকর্মের ধরন- এসব কিছু থেকে তিনি তাঁর আরও বৈচিত্র্যময় ছবিগুলো সৃষ্টি করা শুরু করেন। তবে অমৃতার মানসিক অবস্থার দিন দিন অবনতি হতে থাকে। তিনি ক্রমশ বিষণ্ণতায় ডুবে যেতে থাকেন এবং মানসিক স্বাস্থ্যের সাথে সাথে তার শারীরিক অবস্থাও খারাপ হতে থাকে। এমতাবস্থায় বায়ু পরিবর্তন আবশ্যক হলে ১৯৪১ সালে স্বামী ভিক্টর অমৃতাকে নিয়ে লাহোরে স্থানান্তরিত হন। লাহোরে তার একক চিত্র প্রদর্শনীর আগে তিনি প্রচণ্ডভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন।
১৯৪১ সালের ডিসেম্বরের ৫ তারিখ অমৃতা শের-গিল মৃত্যুবরণ করেন। প্রথাবিরোধী এই চিত্রশিল্পী, যিনি তাঁর সৃষ্টি দিয়ে চারিদিকে আলোচনা-সমালোচনার মুখোমুখি হয়েছেন, আলোড়ন ফেলে দিয়েছিলেন দিকে দিকে তাঁর তুলির আঁচড়ের টানে, তিনি মাত্র ঊনত্রিশ বছর বয়সে জরায়ুর রক্তপাতজনিত কারণে মৃত্যুবরণ করেন। গর্ভপাতের চেষ্টা করায় এমনটা হয়। পরে ডাক্তার আসলেও অমৃতাকে বাঁচানো যায়নি।
অমৃতা শের-গিল আমাদের মাঝে না থাকলেও তার সৃষ্টি এখনো অক্ষয় হয়ে রয়েছে পৃথিবীর বুকে। ২০১৩ সালকে ইউনেস্কো অমৃতার শততম জন্মদিন উপলক্ষ্যে অমৃতা শের-গিলের আন্তর্জাতিক বছর হিসেবে ভূষিত করে৷ অমৃতার জীবন ও কাজ নিয়ে একটি চলচ্চিত্র নির্মাণের কথাও শোনা যাচ্ছিল ২০১৪ সালে, যাতে অমৃতার চরিত্রতে অভিনয় করার কথা ছিল ভারতীয় অভিনয়শিল্পী সোনম কাপুরের। কিন্তু চলচ্চিত্রটি আসলেই হবে কি না, সে ব্যাপারে এখনো ধোঁয়াশা রয়েছে; সোনমও এই চরিত্রে আর অভিনয় করছেন না বলে জানা যায়। সময়ের সাথে সাথে এই অসামান্য চিত্রশিল্পীর কাজ যাতে হারিয়ে না যায়, সেজন্য ভারতীয় সরকারসহ তাবৎ শিল্পমহলকে এগিয়ে আসা উচিত।
সাহসী, অনন্য, দৃঢ় সত্ত্বার অমৃতা শের-গিলের জীবন ছিল তার চিত্রকর্মগুলোর মতোই উন্মুক্ত ও স্বচ্ছ। শেষ বয়সে এসে বিষণ্ণতায় নিজেকে হারিয়ে ফেললেও নিজের উপর বরাবরই ছিল তার প্রবল বিশ্বাস। ১৯৩১ সালে লেখা আঠারো বছর বয়সী অমৃতার মাকে লেখা একটি চিঠি থেকে আমরা তার স্বীয় সত্ত্বার উপর অসীম আস্থা, দৃঢ় বিশ্বাসের কিছু নজির পাই। চিঠিতে তিনি লিখেন,
''আমার আঁকা ভালো ছবির সংখ্যা অল্প। সবাই বলছে আমি দ্রুতই সাফল্যের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি, এমনকি সেই মানুষটাও বলছে যার সমালোচনা আমার কাছে সবচেয়ে দামী- তা হলো আমি নিজে।"
This article is about one of the most iconic and expensive female artists of India in the 20th century, Amrita Sher-Gil. This article focuses on her lifestyle, work and things that worked as influences behind her creations.
Featured Image: tallengestore.com