আগেকার দিনে সঙ্গীত মানেই ছিল সাধনা। গুরুর কাছে তালিম নিয়ে রেওয়াজের মাধ্যমে চলতো একজন সঙ্গীতজ্ঞের সাধনা। তখন ছিল শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের যুগ। ওস্তাদ আলাউদ্দিন খান, ওস্তাদ বিসমিল্লাহ খান, পন্ডিত রবিশঙ্কর, ভীমসেন জোশি- তাঁদের সুরের মূর্ছনায় আবিষ্ট হয়ে যেতেন শ্রোতারা। খ্যাতি, সম্মান কোনোকিছুরই কমতি ছিল না তাঁদের। কিন্তু তাঁদের সার্থকতা যেন ভক্তদের ভালোবাসায়। সঙ্গীতানুরাগীরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতেন তাঁদের সঙ্গীতানুষ্ঠানের জন্য। তাঁরাও হয়তো ভক্তদের তৃষ্ণা নিবারণেই আনন্দ পেতেন। কিন্তু ভারতীয় উপমহাদেশে এমনই কয়েকজন মেধাবী শিল্পী ছিলেন, যারা শুধু নীরবেই সঙ্গীত সাধনা করে গিয়েছেন, যাদের অলৌকিক সুর শোনার ভাগ্য এযাবত কেবল অল্প কিছু ব্যক্তিরই হয়েছে। তাঁদের কথা বলতে গেলে সবার আগে উঠে আসে অন্নপূর্ণা দেবীর কথা।
অন্নপূর্ণা দেবী ছিলেন ভারতের অন্যতম সেরা শাস্ত্রীয় সঙ্গীতশিল্পী ওস্তাদ আলাউদ্দিন খানের কনিষ্ঠ কন্যা। তিনি ১৯২৭ সালে ভারতের বর্তমান মধ্যপ্রদেশে মাইহার রাজ্যে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর আসল নাম রোশনারা আলী। ওস্তাদ আলাউদ্দিন খান তখন মহারাজা ব্রিজনাথ সিংয়ের রাজসভার প্রধান সঙ্গীতজ্ঞ ছিলেন। মহারাজ তাঁর নাম রাখেন অন্নপূর্ণা। তাঁর চাচা ফকির আফতাবউদ্দিন খান এবং আয়েত আলী খান। দুজনেই ছিলেন তাদের নিজেদের এলাকা শিবপুরের (বর্তমানে বাংলাদেশে অবস্থিত) বিখ্যাত সঙ্গীতসাধক। তাঁর ভাই আলী আকবর খানও ভারতের ইতিহাসের অন্যতম সেরা একজন শাস্ত্রীয় সঙ্গীতশিল্পী ছিলেন।
ছোটবেলা থেকেই অন্নপূর্ণা দেবীর সঙ্গীতের প্রতি আগ্রহ ছিল অপরিসীম। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত, তাঁর তালিমপ্রাপ্ত বড় বোনের বিবাহিত জীবনে সঙ্গীতসাধনার কারণে সমস্যা সৃষ্টির কারণে বাবা ওস্তাদ আলাউদ্দিন খান তাঁকে সঙ্গীতের তালিম দিতে চাননি। তাঁকে গৃহস্থালি কাজেই আবদ্ধ রেখেছিলেন। কিন্তু অন্নপূর্ণা দেবীর সঙ্গীতের প্রতি আগ্রহ ছিল প্রচন্ড। তাই ছোটবেলা থেকেই লুকিয়ে তাঁর ভাইয়ের তালিম নেওয়া দেখতেন আর সেটি রেওয়াজ করতেন। একদিন তাঁর ভাই রেওয়াজ করছিলেন আর সেটি তিনি শুনছিলেন। একপর্যায়ে তিনি তাঁর ভাইকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, “ভাইয়া, বাবা এভাবে না, এভাবে শিখিয়েছিলেন”, বলেই নিখুঁতভাবে তাঁর বাবার সেই তালিম বাজানো শুরু করলেন। সেদিনের ঘটনা নিজের মুখে তিনি এভাবে বর্ণনা করেন, "আমি তখন সঙ্গীতে এতটাই মগ্ন হয়ে গিয়েছিলাম যে, কখন বাবা এসে আমার পেছনে এসে দাঁড়িয়েছেন আমি খেয়ালই করিনি। যখন বুঝতে পারলাম অনেক ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম, কিন্তু বাবা তখন আমাকে বকার পরিবর্তে আমাকে তাঁর ঘরে ডেকে নিলেন। তিনি সঙ্গীতের প্রতি আমার সত্যিকারের আগ্রহের কথা বুঝতে পেরেছিলেন আর আমার তালিম শুরু হয়ে গেল।"
তাঁর তালিম শুরু হয়েছিল প্রথমে ধ্রুপদী কণ্ঠসংগীতের মাধ্যমে, পরে তিনি সেতার শেখেন। একদিন তাঁর বাবা তাঁকে সুরবাহার শেখার কথা বললেন। তাঁর কথা অনুযায়ী, “তিনি বললেন, আমি তোমাকে আমার গুরুর বিদ্যা শেখাতে চাই, কারণ তোমার মধ্যে কোনো লোভ নেই। এটা শিখতে হলে অনেক ধৈর্য্য আর শান্ত মন দরকার। আমার মনে হয় তুমি আমার গুরুর এ শিক্ষাটি আয়ত্ত্ব করতে পারবে, কারণ তুমি সঙ্গীত ভালোবাসো।” তখন থেকেই শুরু হয়ে যায় তার সুরবাহার প্রশিক্ষণ।
তখন মাইহারে ওস্তাদ আলাউদ্দিন আলীর কাছে সঙ্গীতের তালিম নিতে আসেন তখনকার বিখ্যাত শাস্ত্রীয় নৃত্যশিল্পী উদয়শঙ্করের ভাই রবিশঙ্কর। অন্নপূর্ণা দেবীর বয়স তখন তের বছর। দুজনের মধ্যে একটি আকর্ষণের সৃষ্টি হয়। যদিও অন্নপূর্ণা দেবী তাদের বিয়েকে প্রেমের বিয়ে হিসেবে মানতে নারাজ, সম্বন্ধ করেই বিয়ে হয়েছিল বলেন। রবিশঙ্করের বড় ভাই উদয়শঙ্কর তার বাবার কাছে তার ভাইয়ের জন্য অন্নপূর্ণার পাণি-প্রার্থনা করেন। ১৯৪১ সালে তাদের বিয়ে হয়। অনেকেই হয়তো ভেবেছিলেন, এত গুণসম্পন্ন দুজন সঙ্গীতজ্ঞের মধ্যে বিয়ে হয়তো এক অনন্য দাম্পত্যের সৃষ্টি করবে। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি।
অনেকের মতে, অন্নপূর্ণা দেবী তাঁর স্বামী রবিশঙ্করের থেকেও বেশি মেধাবী ছিলেন। অনেক সঙ্গীত সমঝদার তাঁকে রবিশঙ্করের থেকেও অনেক বেশি এগিয়ে রাখতেন। প্রথমদিকে তাঁরা দুজন একত্রেই সঙ্গীতানুষ্ঠানে অংশ নিতেন, দেখা যেত অনুষ্ঠানের পরে রবিশঙ্করের থেকে তাঁকেই বেশি ঘিরে ধরছে লোকজন। অন্নপূর্ণা দেবীর মতে, এই ব্যাপার নিয়েই তাঁদের দাম্পত্যজীবনে টানাপোড়েন শুরু হয়েছিল। তাঁর কথায়, “দর্শকদের সামনে আমি যতবারই পারফর্ম করেছি, সকলেই আমার ভীষণ প্রশংসা করেছেন। আমি বুঝতে পারতাম, পণ্ডিতজী এটা ভালোভাবে নিতে পারছেন না। আমার দর্শকের সামনে বাজানোর খুব ইচ্ছা ছিল এমনটা নয়। তাই এটা বন্ধ করে আমার নিজের মতো রেওয়াজ করে যেতে থাকি।” যদিও এ ব্যাপারে রবিশঙ্কর ভিন্ন কথা বলেছেন। একটি সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, “বিয়ের পরে আমার সঙ্গে বাজাতে ওকে অনেক জোর করেছি। কিছু অনুষ্ঠানও করেছি আমরা, তবে এরপর থেকে সে আর একা অনুষ্ঠান করতে চাইতো না, আমার সঙ্গে বসেই বাজাতে চাইত। আমরা আলাদা হয়ে যাওয়ার পরে তো ও অনুষ্ঠান করাই ছেড়ে দিল। সে হয়তো দর্শকের সামনে যেতে চাইতো না বা বিচলিত হয়ে যেত। এটা খুব আফসোসের ব্যাপার, কারণ ও অসাধারণ একজন সুরস্রষ্টা।”
যদিও তাদের পরিচিতজনেরা অন্নপূর্ণা দেবীর অন্তর্ধানের পেছনে রবিশঙ্করের ঈর্ষাকেই দায়ী করেন। এরই মধ্যে তাদের ঘর আলো করে এলো তাদের সন্তান শুভেন্দ্র শঙ্কর। শুভেন্দ্র শঙ্কর ছোটবেলা থেকেই অসুস্থ থাকার কারণে তাদের মধ্যে দাম্পত্যকলহ শুরু হয়। কিন্তু এই কলহ চরম পর্যায়ে পৌঁছায় যখন অন্নপূর্ণা দেবী আবিষ্কার করেন নৃত্যশিল্পী কমলা শাস্ত্রীর সাথে রবিশঙ্করের পরকীয়া সম্পর্কের সৃষ্টি হয়েছে। বিষণ্ন অন্নপূর্ণা দেবী তখনই তাঁর ছেলেকে নিয়ে মাইহারে বাবার বাড়িতে চলে আসেন। পরবর্তীতে কমলা শাস্ত্রীর অন্যত্র বিয়ে হয়ে গেলে তিনি বোম্বেতে ফিরে আসেন, কিন্তু রবিশঙ্করের সাথে তাঁর সম্পর্ক আর স্বাভাবিক হয়নি। ১৯৬২ সালে তারা আলাদা হয়ে যান।
পন্ডিত রবিশঙ্করের থেকে আলাদা হওয়ার পরে তিনি বস্তুত নিভৃত জীবনযাপন শুরু করলেন। পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় সঙ্গীতানুষ্ঠান করার প্রস্তাব নাকচ থেকে শুরু করে তাঁকে দেওয়া কোনো সম্মাননা অনুষ্ঠানেও তিনি যাননি। এমনকি ইন্দিরা গান্ধীর মতো রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের সামনে সুরবাহার বাজাতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। কিন্তু তাঁর প্রতি মানুষের শ্রদ্ধা কমে যায়নি, বরং তাঁর মতো একজন ক্ষণজন্মা সঙ্গীতশিল্পীকে নানা সম্মাননায় ভূষিত করা হয়েছে। তাঁকে ১৯৭৭ সালে ভারতের সম্মানসূচক 'পদ্মভূষণ' খেতাব প্রদান করা হয়। এছাড়াও ১৯৯১ সালে নাটক একাডেমি অ্যাওয়ার্ড এবং বিশ্বভারতী থেকে ১৯৯৯ সালে সম্মানজনক দেশিকোত্তম উপাধি দেওয়া হয়। যদিও কোনো সম্মাননা বা কনসার্টে নিমন্ত্রণই তাঁকে তাঁর বদ্ধঘরের বাইরে আনতে পারেনি।
তবে তিনি বদ্ধ জীবনযাপন করলেও তাঁর সুরসাধনা থেমে যায়নি। প্রকাশ্য অনুষ্ঠানে তাঁর উপস্থিতি না থাকলেও তিনি পরবর্তীতে একজন সঙ্গীতগুরু হিসেবে শিষ্যদের তালিম দেওয়া শুরু করেন। তাঁর অসামান্য প্রতিভা আর শিক্ষকতার ছোঁয়ায় তার শিষ্যদের মধ্যে থেকে অনেক প্রতিভাবান সঙ্গীতজ্ঞ বের হয়ে আসেন। পন্ডিত নিখিল ব্যানার্জী, ওস্তাদ বাহাদুর খান, ওস্তাদ আশিষ খান, পন্ডিত হরিপ্রসাদ চৌরাশিয়ার এবং পন্ডিত নিত্যানন্দ হলদিপুরের মতো প্রতিভাবান সঙ্গীতশিল্পীরা তাঁরই শিষ্য ছিলেন। এছাড়াও তাঁর কাছে রুশি পান্ডে নামক একজন সঙ্গীত অনুরাগী তালিম নেওয়া শুরু করেন, যাকে ১৯৮২ সালে তিনি বিয়ে করেন। এর আগে ১৯৮১ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে পন্ডিত রবিশঙ্করের সাথে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটান। এর মাধ্যমে দীর্ঘদিনের টানাপোড়েনের অবসান ঘটে।
অন্নপূর্ণা দেবী একজন অসামান্য প্রতিভাবান সঙ্গীতসাধক ছিলেন। স্বয়ং আলাউদ্দিন খান তাকে মূর্তিমতী মা সরস্বতী বলে ডাকতেন। তাঁকে নিয়ে ওস্তাদ আমির খান একটি বিখ্যাত একটি কথা বলেছিলেন, “অন্নপূর্ণা দেবী ওস্তাদ আলাউদ্দিন খানের ৮০ ভাগ পেয়েছেন, যেখানে আলী আকবর পেয়েছেন ৭০ ভাগ আর রবিশঙ্কর পেয়েছেন ৪০ ভাগ।” তার ভাই আলী আকবরও একথাটির সাথে একমত পোষণ করে বলেন, “অন্নপূর্ণাকে দাঁড়িপাল্লায় একপাশে রেখে অপর পাশে রবিশঙ্কর, পান্নালাল আর আমাকে রাখলেও অন্নপূর্ণার পাল্লাই ভারী হবে।” কিন্তু এমন প্রতিভাবান সঙ্গীতশিল্পীর সুর দূর্ভাগ্যজনকভাবে হারিয়ে গেছে। তিনি কখনোই তাঁর কোনো গান রেকর্ড করেননি, তবে তাঁর বাজানো একটিমাত্র রেকর্ড আছে। তাঁদের একটি যুগলবন্দী অনুষ্ঠানে বাইরে রাখা স্পিকার থেকে সেই বাদনটি রেকর্ড করা হয়েছিল।
প্রকাশ্য অনুষ্ঠান থেকে নিজেকে সরিয়ে নেওয়ার পরে সরাসরি তাঁর বাদন তিনজন মানুষ ছাড়া কেউই শুনতে পাননি। এই ভাগ্যবান মানুষের মধ্যে রবিশঙ্কর আর রুশি পান্ডে ছাড়া আর আছেন বিটলস তারকা জর্জ হ্যারিসন। প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর বিশেষ অনুরোধে তিনি জর্জ হ্যারিসন আর সত্তর দশকের বেহালাবাদক ইয়েহুদি মেনুহিনকে শুধুমাত্র তাঁর রেওয়াজের সময় উপস্থিত থাকার অনুমতি দিয়েছিলেন, যদিও ইয়েহুদি মেনুহিন শেষমেষ বিশেষ কারণে হঠাৎ দেশে ফেরায় এই সুবর্ণ সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছিলেন। তাঁর বাড়িতে তিনি রেওয়াজ ঘরের কাছে কোনো কাজের লোককেও ঘেঁষতে দিতেন না, রেওয়াজ ঘর নিজেই পরিষ্কার করতেন। ২০১৮ সালের ১৩ অক্টোবর তিনি মৃত্যুবরণ করেন। ফলে তাঁর সাথেই তার সৃষ্ট সুরগুলো বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে।
অনেকে বলেন, অন্নপূর্ণা দেবী এবং পন্ডিত রবিশঙ্করের দাম্পত্যজীবনের ঘটনাকে উপজীব্য করেই বিখ্যাত পরিচালক ঋষিকেশ মুখোপাধ্যায় তাঁর “অভিমান” সিনেমাটি তৈরি করেছিলেন। সিনেমাটি বেশ জনপ্রিয়তাও অর্জন করে। ছবিতে দেখা যায়, বিখ্যাত এক গায়কের (অমিতাভ বচ্চন) চেয়ে তার প্রতিভাবান স্ত্রীর (জয়া ভাদুড়ী) জনপ্রিয়তা বেশি হয়ে গেলে তাদের দাম্পত্যজীবনে টানাপোড়েন শুরু হয়। সিনেমার গল্পে তারা সুখী জীবনে ফিরে গেলেও অন্নপূর্ণার প্রথম বিয়ের পরিণতি ছিল বিয়োগান্তক। শোনা যায়, অন্নপূর্ণা দেবী সংসার টিকিয়ে রাখতে জনসমক্ষে আর কখনো সুর পরিবেশন না করার শপথ নিলেও তা আর টেকেনি।
অন্নপূর্ণা দেবীর সুর না শুনতে পাওয়ায় বিশ্ববাসীর একটা আফসোস রয়েই গিয়েছে। তাঁর মতো অসামান্য প্রতিভা বিশ্বে আর কোনোদিন হয়তো আসবে না। নীরবে সঙ্গীতসাধনা করা এই সঙ্গীতশিল্পীর বিরল প্রতিভা তাই আমাদেরকে তাঁর কথাই বারবার মনে করিয়ে দিয়ে যাবে।
This is a Bengali article that discusses the life of Annapurna Devi. Necessary references have been hyperlinked below.
Feature Image: Times of India
Reference:
2. Genius and enigma of Annapurna Devi
3. Annapurna Devi: The Tragedy And Triumph Of Ravi Shankar’s First Wife