Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

আর্যভট্ট: প্রাচীন ভারতীয় গণিত ও জ্যোতির্বিজ্ঞান সাধনার অন্যতম শ্রেষ্ঠপুরুষ

আনুমানিক ৪৭৬ খ্রিষ্টাব্দ, প্রাচীন ভারতবর্ষে তখন গুপ্তযুগীয় শাসন চলমান। সেসময় পৃথিবীতে আসেন ক্ষণজন্মা এক মনীষী, যার জ্ঞানের আলোতে পরিস্ফুটিত হয়েছিল তৎকালীন গণিত ও জ্যোতির্বিজ্ঞানের বিশেষ কতক শাখা। নাম তার আর্যভট্ট। প্রাচীন শাস্ত্রগুলোতে জ্যোতির্বিজ্ঞান কিংবা গণিতের আলোচনা মানেই আর্যভট্টের নাম প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভঙ্গিতে চলে আসবে অবধারিতভাবেই। আর্যভট্ট আবিষ্কৃত বিভিন্ন গাণিতিক বিধি ও সূত্র সুপ্রাচীনকাল থেকে আজকের যুগেও ব্যবহৃত হচ্ছে।

আর্যভট্ট; Image Source: Studious Guy

জন্ম

আর্যভট্টের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে তেমন কোনো তথ্য পাওয়া যায় না। তার জন্মস্থান নিয়েও নানা মতভেদ প্রচলিত। কেউ কেউ আর্যভট্টের জন্মস্থানকে পাটলিপুত্র, আবার কেউ কুসুমপুর বলে দাবি করেন। আর্যভট্টের অন্যতম ভাষ্যকার প্রথম ভাস্করের মতে, আর্যভট্ট জন্মগ্রহণ করেন অশ্মকা নামক এক স্থানে। বর্তমানে এটি দক্ষিণ গুজরাট এবং উত্তর মহারাষ্ট্রের আশেপাশের একটি জায়গা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। তবে, অনেক গবেষক একমত হয়েছেন যে তিনি জন্ম নেন বর্তমান কেরালারই কোনো এক জায়গায়। জন্মের সময় নির্দিষ্ট করা হয়েছে তারই এক লেখা থেকে। তিনি লিখেছেন, তিন যুগপদ ও ষটযুগ অস্তকালে তার বয়স ছিল ২৩ বছর। জ্যোতিষশাস্ত্র হিসেবে গণনা করলে দেখা যায়, তিনি জন্মেছিলেন ৪৭৬ খ্রিষ্টাব্দে।

প্রাচীন ভারতের গুপ্ত সাম্রাজ্য; Image Source: Rahul Sketchbook.

শিক্ষাজীবন

বাল্যকাল থেকেই প্রচণ্ড জ্ঞানপিপাসু ছিলেন আর্যভট্ট। যেখানে শেখার উপকরণ পেতেন, সেখান থেকেই আগ্রহ ভরে শিখতেন। আর্যভট্টের অনুসন্ধিৎসু মন সারাক্ষণ খুঁজে বেড়াত বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর। তৎকালে নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের খ্যাতি ছড়িয়ে ছিল জগৎজুড়ে। কৈশোরেই কেরালা ছাড়িয়ে তিনি পা রাখেন নালন্দার চত্বরে। এজন্য তাকে বন-জঙ্গল, পাহাড়-পর্বতসহ বহু চড়াই-উতরাই পার করতে হয়েছে। ধর্মশাস্ত্র ও দর্শনের সাথে বিজ্ঞানের যোগসাজশ কোথায়, সে ব্যাপারে খ্রিষ্টীয় পঞ্চম এবং ষষ্ঠ শতাব্দীতে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যবহারিক শিক্ষাদানের ব্যবস্থা চালু ছিল।

শিল্পীর তুলিতে নালন্দা; Image Source: Art Station.

জ্যোতির্বিজ্ঞানকে বিশেষ প্রাধান্য দেওয়া হতো এখানে। বিশ্ববিদ্যালয়ের অদূরে অবস্থিত খাগোলা গ্রামে স্থাপন করা হয়েছিল এক জ্যোতির্বিদ্যার গবেষণাক্ষেত্র। মূলত, এই কেন্দ্র থেকেই আর্যভট্টের পরিপূর্ণ জ্যোতির্বিজ্ঞান শিক্ষার হাতেখড়ি। নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবার পর খুব অল্প সময়েই আর্যভট্টের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ল চারদিকে, ছাত্র ও শিক্ষক মহলে তিনি হয়ে ওঠেন অধিক জনপ্রিয়। ধীরে ধীরে তার প্রতিভার পরিস্ফুটন ঘটতে লাগল। কঠোর পরিশ্রমী ও অধ্যবসায়ী ছিলেন তিনি। তাই, নিজ গবেষণায় যে সত্য উন্মোচন করতেন, তা প্রকাশে কখনও পিছপা হননি।

আজকের দিনে নালন্দা; Image Source: Hans Joachim Aubert/Alamy Stock Photo.

কর্মজীবন

ভারতে তখন গুপ্তযুগ চলমান। সমাজে ধর্মের ব্যাপক প্রভাব বজায় ছিল তখন। শাসক হিসেবে সিংহাসনে আসীন ছিলেন সম্রাট বুদ্ধগুপ্ত। আর্যভট্টের বৈপ্লবিক ধ্যান-ধারণার কথা পৌঁছেছিল সম্রাটের কানেও। চিরাচরিত ভাবধারার খোলস ভেঙে কেউ নতুন কিছু নিয়ে হাজির হলে তাকে পড়তে হয় তোপের মুখে, সহ্য করতে হয় ভর্ৎসনা। যেমনটা আমরা দেখেছি মধ্যযুগীয় চার্চের ক্ষেত্রে। কিন্তু স্রোতের বিপরীতে গিয়ে সম্রাট বরং আর্যভট্টের উজ্জ্বল প্রজ্ঞা সমাদরেই বরণ করে নিয়েছিলেন। নিজ গবেষণালব্ধ ফলাফল জনসমক্ষে প্রকাশ করবেন আর্যভট্ট। রাজকীয় সকল আয়োজন সম্পন্ন করা হলো। ২১ শে মার্চ, ৪৯৯ খ্রিষ্টাব্দ। আর্যভট্ট বললেন,

পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘুরছে, আকৃতিতে পৃথিবী হলো গোলাকার। গোলাকার এই পৃথিবী নিজ অক্ষপথে আবর্তিত হয় বলেই দিন ঘনিয়ে রাত আসে, আবার রাত ফুরিয়ে দিনের আবির্ভাব হয়। রাহু কর্তৃক চাঁদ ও সূর্যের গ্রাসের ফলেই গ্রহণ হয়, এই কথা মনগড়া। পুরাণের এসব কাহিনি ভিত্তিহীন। সূর্যের গায়ে পৃথিবী ও চাঁদের ছায়া পড়েই সংঘটিত হয় গ্রহণ।

তৎকালে প্রচলিত প্রাচীন ব্রাহ্মণ্য মতবাদকে অস্বীকার করার সাহস দেখিয়ে নিজের বৈপ্লবিক সিদ্ধান্তকে সর্বসাধারণের কাছে ঘোষণা করেন তিনি। তিনিই দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে ঘোষণা করেন, চাঁদের নিজস্ব আলো নেই, সূর্যের আলো চাঁদে প্রতিফলিত হয় বলেই পৃথিবী থেকে চাঁদকে আলোকিত দেখায়।

শাস্ত্রের বিরুদ্ধে যাবার পরও আর্যভট্টকে কোনোপ্রকার হেয় প্রতিপন্ন করা হয়নি। উল্টো প্রবর্তিত ধারাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে, জ্যোতির্বিজ্ঞানে তিনি যুক্ত করেন সম্পূর্ণ নতুন এক ধারণার। তার গবেষণায় যারপরনাই মুগ্ধ হন সম্রাট বুদ্ধগুপ্ত। উপহারস্বরূপ সম্রাট তাকে প্রাচীনকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বময়কর্তা হিসেবে নিযুক্ত করেন। নালন্দায় আর্যভট্টের এই নিয়োগ প্রাচীন ভারতের শিক্ষাব্যবস্থা এক বিপ্লবাত্মক রূপান্তরের সূত্রপাত ঘটায়।

বুদ্ধগুপ্ত আমলের মুদ্রা; Image Source: Wikimedia Commons.

রচনাসমূহ

৪৯৯ সালের দিকে আর্যভট্ট তার বিখ্যাত গ্রন্থ ‘আর্যভাটিয়া’ রচনায় হাত দেন। তিনি গ্রন্থটি রচনা করেন পদবাচ্যের আকারে। পুরো গ্রন্থের পেছনে ঠিক কত বছর সময় ব্যয় হয়েছিল, সে সম্পর্কে কোনো ধারণা পাওয়া যায় না। কিন্তু কিছু গবেষকের অভিমত, ষষ্ঠ শতকের প্রথম দশক পর্যন্ত সময়ে গ্রন্থটি রচিত হয়েছিল। আর্যভট্ট গাণিতিক ফল ও সিদ্ধান্তগুলো অতি সংক্ষেপে লিপিবদ্ধ করতেন। এর বিশদ ব্যাখ্যা, গবেষণা পদ্ধতির আলোচনা তার রচনায় উল্লেখ নেই। ধারণা করা হয়, শিষ্যদের নিকট তিনি তা মৌখিকভাবে বিস্তারিত বর্ণনা করে যেতেন বলে তা আর লিখে রাখা হয়নি। প্রাচীন সাহিত্যে অবশ্য আর্যভট্টের অন্য যে কাজ সম্পর্কে জানা যায় সেটি ‘আর্য-সিদ্ধান্ত’। আর্য-সিদ্ধান্তের কোনো পাণ্ডুলিপি খুঁজে পাওয়া যায়নি। এর উল্লেখ পাওয়া গিয়েছে বরাহমিহির, ব্রহ্মগুপ্ত, এবং প্রথম ভাস্করের কাজে। ‘আর্যভাটিয়া’ মোট ১১৮টি স্তোত্র সমেত চারটি পদ বা অংশে বিভক্ত ছিল।

১. প্রথম পদের নাম ছিল ‘দশ গীতিকা’। এই অংশে দেখানো হয়েছে, কীভাবে শ্লোক দ্বারা সংস্কৃত বর্ণমালার সাহায্যে গণিতের বৃহৎ বৃহৎ সংখ্যা প্রকাশ করা যায়।
২. দ্বিতীয় অংশ বা পদের নাম ‘গণিত পদ’। এই পদের তেত্রিশটি শ্লোকে বর্ণনা করা হয়েছে অঙ্ক আর অঙ্কের সূত্রের কথা। এছাড়াও পাটীগণিত, বীজগণিত, সমতল ত্রিকোণমিতি, দ্বিঘাত সমীকরণ, প্রথম স্বাভাবিক n সংখ্যার বিভিন্ন ঘাতবিশিষ্ট পদসমূহের সমষ্টির আলোচনা আছে এই অংশে। এই অধ্যায়ে পাইয়ের মান হিসেবে বৃত্তের পরিধি ও ব্যাসের অনুপাতকে ৩.১৪১৬ দ্বারা সূচিত করেছেন আর্যভট্ট। তিনি লিখেছেন,

জ্ঞান সমুদ্রের অতল গভীরে বিশাল রত্নভাণ্ডার মজুত আছে। এর মধ্যে কোনোটা খাঁটি, কোনোটা মেকি। নিজ বিচার-বুদ্ধির সাহায্যে তিনি কেবলমাত্র খাঁটিগুলো সংগ্রহের চেষ্টা করেছেন।

৩. তৃতীয় অংশ হলো কালক্রিয়া। এই পদের ২৫টি শ্লোকে দেখানো হয়েছে সময়ের হিসাব।

৪. আর সর্বশেষ অংশটি হলো ‘গোলা পদ’। এর ৫০টি শ্লোকে রয়েছে গোলা তত্ত্ব বা গোলক তত্ত্ব। এতে মূলত জ্যোতির্বিদ্যা ও গোলীয় ত্রিকোণমিতি বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে।

আর্যভট্ট সবসময় প্রাচীনত্বের খোলস ভেঙে নতুন শুদ্ধ ধারণা দিতে চেয়েছেন ভারতীয়দের। সেজন্য, তিনি প্রাচীন জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও গণনাকারদের অভিমতের সাথে তাল মিলিয়েও নিজস্ব চিন্তার কথা জানিয়ে গেছেন নির্দ্বিধায়। তার এসব যুগান্তকারী গাণিতিক ও বৈজ্ঞানিক মতবাদে বাতিল হয় পুরাতন বহু সিদ্ধান্ত।

আর্যভট্ট; Image Source: The Golf Club.

আরবে আর্যভট্ট

অষ্টম শতাব্দীর পূর্বেই আরবে পৌঁছে যায় আর্যভট্টের গবেষণালব্ধ জ্ঞান। আরবের জ্ঞান-তপস্বীরা আর্যভট্টকে খুবই শ্রদ্ধার চোখে দেখতেন। তার রচনাসমূহ নতুন জোয়ার এনেছিল আরবীয় গণিত ও জ্যোতির্বিজ্ঞানে। আর্যভট্ট আরবে পরিচিত ছিলেন আরজাভর নামে। ইতিহাস প্রসিদ্ধ পণ্ডিত আল-বেরুনী ভারতের এসেছিলেন একাদশ শতকের দিকে। ভ্রমণবৃত্তান্তে তিনি আর্যভট্টের কথাও উল্লেখ করেছেন। আর্যভট্টের কোনো মূল রচনার সন্ধান পাননি তিনি। পেয়েছিলেন কতক উদ্ধৃতি, যা সংকলন করে রেখেছিলেন প্রাচীন ভারতের আরেক প্রখ্যাত মনিষী ব্রহ্মগুপ্ত। আধুনিক যুগে এসে সেগুলো দুই মলাটে আবদ্ধ হয় বিজ্ঞানী কার্নের উদ্যোগে। তিনি ১৮৭৪ সালে লেইডেন শহর থেকে আর্যভট্টের উদ্ধৃতগুলো একত্র করে ‘আর্যভাটিয়া’ গ্রন্থ প্রকাশ করেন। ১৮৭৯ সালে তা ফরাসি ভাষায় অনুবাদ করা হয়।

আর্যভাটিয়া; Image Source: Delta Book World.

আর্যভট্টের অবদান

প্রাচীন ভারতীয়দের দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় গণিত ছিল এক প্রয়োজনীয় অনুষঙ্গ। তখন কাগজ-কলম আবিষ্কার না হওয়ায় গণিতের চর্চা মানুষের মুখে মুখেই প্রচলিত ছিল। মৌখিক সেই গণিত ও জ্যোতির্বিজ্ঞানকে সুসংগঠিতভাবে লিখিত আকারে রূপ দেওয়ার প্রথম উদ্যোক্তা হলেন আর্যভট্ট।

দশমিক সংখ্যা পদ্ধতি এবং শূন্য

বর্তমান পৃথিবীতে সর্বাধিক প্রচলিত ও জনপ্রিয় হলো দশভিত্তিক সংখ্যা পদ্ধতি। এই পদ্ধতির উদ্ভব ঘটেছে দুই হাতের দশটি আঙুল গণনার উপর ভিত্তি করে।

দশমিক সংখ্যা পদ্ধতির পরিপূর্ণ ব্যবহারের প্রথম প্রমাণ মেলে আর্যভট্টের কাজে। যেহেতু আর্যভাটিয়া গ্রন্থ রচনা করা হয়েছিল পদবাচ্যে, তাই সংখ্যাকে উপস্থাপনের জন্য নিজস্ব এক পদ্ধতিরও উদ্ভাবন ঘটিয়েছিলেন তিনি। সেখানে সংখ্যাকে প্রকাশ করা হতো শব্দ দিয়ে। ব্যঞ্জনবর্ণগুলো ব্যবহার হতো বিভিন্ন অঙ্ক হিসেবে, আর স্বরবর্ণগুলোর কাজ ছিল অঙ্কের অবস্থান চিহ্নিত করে দেওয়া।

প্রাথমিকভাবে এর সাথে আজকের যুগের দশমিক সংখ্যা ব্যবস্থার সাথে পার্থক্য থাকলেও, পদ্ধতিগত দিক বিবেচনায় অনেক মিল লক্ষ্য করা যায়। তবে দশমিক পদ্ধতিকে কাজে লাগিয়েই তিনিই সর্বপ্রথম সংখ্যার বর্গমূল ও ঘনমূল নির্ণয়ের গাণিতিক প্রক্রিয়া বর্ণনা করেন। সে সময় দশমিক পদ্ধতি ব্যবহার করে পদ্ধতিগত সাধারণীকরণ নিশ্চিত করেন বলে আর্যভট্টকেই পূর্ণাঙ্গ দশমিক সংখ্যা পদ্ধতি প্রবর্তক হিসেবে ধরা হয়। দশভিত্তিক গণনা পদ্ধতির প্রধান বিষয়টি হচ্ছে শূন্যের ব্যবহার। প্রাচীন মেসোপটেমিয়া, মায়া সভ্যতায় শূন্যের ধারণা প্রচলিত থাকলেও তারা শূন্যকে অনুপস্থিতি, অভাব ও অশুভ কিছু বলে বিবেচনা করত।

শূন্যের কার্যকর ব্যবহার এবং এর আলোকে দশ-ভিত্তিক সংখ্যা পদ্ধতি আবিষ্কার ও লিপিবদ্ধ ব্যবহারের কৃতিত্ব প্রদান করা হয় আর্যভট্টকে। ৪৯৮ সালে তিনি একটি সংস্কৃত কাব্যে উল্লেখ করেছেন, “স্থানম স্থানম দশ গুণম” অর্থাৎ স্থান হতে স্থান দশগুণ, যা বর্তমানের স্থানিক দশমিক সংখ্যা পদ্ধতিকে নির্দেশ করে।

দশমিক সংখ্যা পদ্ধতির পরিপূর্ণ ব্যবহারের প্রথম প্রমাণ মেলে আর্যভট্টের কাজে; Image Source: Kirill Cherezov/Alamy Stock Photo

বীজগণিত

তিনিই সর্বপ্রথম বীজগণিতকে প্রাচীন ভারতীয়দের নিকট পরিচয় করিয়ে দেন। বীজগণিতের অনির্ণেয় সমীকরণ সমাধানের জন্য তিনি ax – by=c সূত্র আবিষ্কার করেছিলেন। পাইয়ের মানও প্রায় নির্ভুলভাবে নির্ণয় করেছিলেন আর্যভট্ট। তিনি {(৪+১০০) × ৮ + ৬২০০} ÷ ২০০০০ = ৬২৮৩২÷২০০০০ = ৩.১৪১৬, এই হিসাবে বের করেছিলেন পাইয়ের মান, আজ থেকে প্রায় দেড় হাজার বছর পূর্বেই। আজকের যুগের ডায়োফ্যান্টাইন সমীকরণেও বিশেষ অবদান আছে আর্যভট্টের। এতে একাধিক অজানা রাশি সংবলিত সমীকরণ সমাধান করার একটি উপায় বের করেন তিনি। এর নাম দেওয়া হয় ‘কুত্তক’।

পাইয়ের মানও প্রায় নির্ভুলভাবে নির্ণয় করেছিলেন আর্যভট্ট; Image Source: Wallpaper Access.

ত্রিকোণমিতি

তার জ্ঞানের ছোঁয়া পেয়েছে ত্রিকোণমিতি, পরিমিতি, বর্গমূল, ঘনমূলের মতোও গাণিতিক শাখাগুলো। আধুনিক ত্রিকোণমিতির সূচনা আর্যভট্টের হাত ধরেই। ধারণা করা হয়, সাইন ফাংশনের জন্য যুগ্ম ও অর্ধ কোণের সূত্রগুলো তিনি জানতেন। তিনি sine, cosine, versine (1-Cosx), এবং inverse sine এর ব্যাপারে কিছু ধারণা দিয়ে গিয়েছিলেন, তা পরবর্তীতে ত্রিকোণমিতি শাখাকে এগিয়ে নিয়ে গেছে বহুদূর।

এছাড়াও, তিনিই প্রথম sine এবং versine (1 − cos x) এর ৩.৭৫° পর পর ব্যবধানে ০° থেকে ৯০° পর্যন্ত নির্দিষ্ট মান তালিকাবদ্ধ করেন। মজার ব্যাপার হলো, ৪ দশমিক স্থান পর্যন্ত তার প্রাপ্ত মান একেবারে নির্ভুলভাবে পাওয়া যায়। আর্যভট্ট তার সাইন সারণিতে সরাসরি sinX এর বদলে RsinX ব্যবহার করেছেন। এখানে ‘R’ হচ্ছে একটি নির্দিষ্ট বৃত্তের ব্যাসার্ধ। আর্যভট্ট এই ‘R’ এর মান বসিয়েছিলেন ৩৪৩৮। গণিতবিদদের ধারণা, আর্যভট্ট এই হিসেব কষেছিলেন এক মিনিট পরিমাণ কোণের জন্য একক ব্যাসার্ধের বৃত্তে বৃত্তচাপের দৈর্ঘ্যকে এক একক ধরে। একটি বৃত্তের পরিধি তার কেন্দ্রে (৩৬০ × ৬০) = ২১৬০০ মিনিট কোণ ধারণ করে। সে হিসেবে বৃত্তের পরিধি হলO ২১৬০০ একক এবং ঐ বৃত্তের ব্যাসার্ধ হবে ২১৬০০÷২π। আর্যভট্ট π (পাই) এর মান বের করেছিলেন = ৩.১৪১৬, যা বসালে ব্যাসার্ধের মান আসে ৩৪৩৮।

আধুনিক ত্রিকোণমিতির সূচনা হয়েছিল আর্যভট্টের হাত ধরেই; Image Source: Wallpaper Access.

জ্যোতির্বিজ্ঞান

আমাদের এই মলয়া শীতল চিরচেনা পৃথিবী যে গোলক, এই জিনিস সর্বপ্রথম আবিষ্কার করেছিলেন আর্যভট্ট। পৃথিবী নিজ অক্ষের উপর সদা আবর্তনশীল, কীভাবে দিন ও রাত হয়, চাঁদের নিজস্ব আলো নেই, কিংবা গ্রহণের পরিপূর্ণ বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা এসেছিল আর্যভট্ট থেকেই। প্রতি বছর নিরক্ষবৃত্তকে উত্তর-দক্ষিণ মুখে পরিভ্রমণকালে সূর্য প্রতি ছয় মাস অন্তর দুটি চরম বিন্দু অতিক্রম করে। আর্যভট্ট এই দুই বিন্দুকে ‘অয়নাস্ত’ ও ‘হরিপদী বিন্দু’ বলে অভিহিত করেন। এই দুই বিন্দুতে সূর্যের গতির একটি নির্দিষ্ট দোলনকাল রয়েছে- এটাও জ্যোতির্বিজ্ঞানী আর্যভট্ট থেকে প্রাপ্ত তথ্য।

নিকোলাস কোপার্নিকাস; Image Source: Jean-Léon Huens.

তিনি আরও খেয়াল করেন, এই দুই বিন্দুতেই মূলত রাত এবং দিনের দৈর্ঘ্য সমান। আজকের দিনে যা, ২১শে মার্চ এবং ২৩শে সেপ্টেম্বর। জ্যোতির্বিজ্ঞানে ‘এপিসাইকেল’ শব্দটি উৎপ্রোতভাবে জড়িত। গ্রীক জ্যোতির্বিজ্ঞানী টলেমি এই এপিসাইকেল থিওরি নিয়ে নাড়াচাড়া করে গ্রহের গতিবিধিকে আয়ত্তে আনার চেষ্টা চালিয়েছিলেন। আর্যভট্টও ঘাঁটাঘাঁটি করেছেন এপিসাইকেল নিয়ে। তিনি গ্রহের গতিবিধি নিরীক্ষণে টলেমীর তুলনায় এপিসাইকেল নিয়ে আরও পরিষ্কার ও যুক্তিনির্ভর বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব প্রদান করেছিলেন। গ্রহের আকার ও অবস্থান গণনার জন্য তিনি জ্যামিতি ও গণিতের বহু নতুন তত্ত্ব আবিষ্কার করেছেন।

কোপারনিকাসের এক হাজার বছর আগেই তিনি সৌরজগতের সূর্যকেন্দ্রিক তত্ত্ব আবিষ্কার করে ফেলেছিলেন। গ্রহণের কারণ হিসেবে চন্দ্র ও পৃথিবীর ছায়ার কথা উল্লেখ করেন তিনি। সনাতনী জ্যোতিষ শাস্ত্রে আর্যভট্ট ‘ঔদয়িক’ ও ‘আর্ধরাত্রিক’ নামে দুটি বিকল্প গণনা পদ্ধতির প্রবর্তক। আর্যভট্টের দেওয়া জ্যোতিষীয় মতবাদ সামসময়িক জ্যোতির্বিদগণের মধ্যে গভীর ছাপ ফেলতে সক্ষম হয়েছিল। তিনি হিসেব কষে পৃথিবীর আক্ষিক গতি বের করেছিলেন। তার প্রাপ্ত হিসেবমতে, পৃথিবীর পরিধি ছিল ৩৯,৯৬৮ কিলোমিটার। সেটা সে আমলের যেকোনো পরিমাপের চেয়ে সবচেয়ে শুদ্ধ তো ছিল বটেই, বরং আজকের হিসেবের সাথেও এর ফারাক মাত্র ০.২%।

পৃথিবীর আক্ষিক গতি এবং পরিধি নির্ভুলভাবে বের করেছিলেন আর্যভট্ট; Image Source: Alamy Stock Photo.

৪৫৫ খ্রিষ্টাব্দে ধরণী থেকে চিরবিদায় নেন প্রাচীন জ্যোতির্বিজ্ঞানের এই শ্রেষ্ঠপুরুষ। পৃথিবী হারায় একজন মেধাবী মানুষের পদচারণা। প্রাচীন ভারতের শ্রেষ্ঠ এই জ্যোতির্বিজ্ঞানীকে শ্রদ্ধার্ঘ্য জানাতে ১৯৭৫ খ্রিষ্টাব্দের ১৯শে এপ্রিল উৎক্ষেপিত হওয়া ভারতের প্রথম কৃত্রিম উপগ্রহ নাম রাখা হয় ‘আর্যভট্ট’।

আর্যভট্টের শিষ্যদের মধ্যে লাটদেব, ভাস্কর, ও লগ্ন পৃথিবীতে খ্যাতিমান হতে পেরেছেন। বেদোত্তর ভারতবর্ষ জ্ঞানী-বিজ্ঞানীদের কদর করেছে যথার্থভাবে। প্রচলিত চিন্তা-চেতনার পরিবর্তে কেউ নতুন কোনো যুক্তি ও গবেষণালব্ধ ফলাফল দিয়ে কুসংস্কারের বিপক্ষে দাঁড়ালে, তা গ্রহণ করা হয়েছে সাদরে। সেজন্য, এই পৃথিবী পেয়েছে আর্যভট্ট, ব্রহ্মগুপ্ত, ভাস্করাচার্য, কণাদ, কিংবা সুশ্রুতের মতো অগ্রদূতদের। যারা প্রাচীনকালেই তাদের জ্ঞান মহিমায় পৃথিবীকে এগিয়ে নিয়ে গেছে যোজন যোজন ক্রোশ অগ্রে।

This is a bangla article about Aryabhata.

Sources:

1. Aryabhata - Britannica.
2. Aryabhata - Vedantu
3. Aryabhata - Totally History.
4. The Great Indian Mathematicians: 15 Pioneers Who Put Indian Mathematics on the World Map, Gaurav Tekriwal, India Puffin, March, 2022.
5. Mathematics in India, Kim Plofker, Princeton University Press; 1st Edition (January 18, 2009).
6. 50 Greatest Mathematicians of the World, Thakur, Rajesh Kumar, Jun 03, 2013.
7. Shukla, M. K. (2017). Contribution of Aryabhatta in world Mathematics. Anusandhaan-Vigyaan Shodh Patrika, 5(01), 178-179.
8. Sahu, C. K., & Dongargaon, R. (2021). ARYABHATT: A BEACON OF MATHEMATICS.
9. RAMA, P. (2017). INDIAN CONTRIBUTION TO MATHEMATICS IN RELATION TO ARYABHATTA AND BRAHMAGUPTA.

Related Articles