Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

বেগম রোকেয়া: বাংলার নারীদের মুক্তির কথা বলা প্রথম কণ্ঠস্বর

তখন বাংলার নারী সমাজের জন্য বিরাজমান ছিল এক অন্ধকারময় সময়। তাদের জীবনের সবচেয়ে বড় অংশ জুড়ে থাকতো একটিই শব্দ- “না”। বিশেষ করে মুসলিম নারীরা থাকতো এক কঠিন অনুশাসনের ভেতর। কেবল যে তারা বাইরে চলাফেরা করতে পারতো না তা নয়, তাদের অধিকার ছিলো না শিক্ষায়, জ্ঞানচর্চায় বা মতামত প্রদানে। কেবল পরপুরুষদের সামনে তাদের আসতে মানা ছিলো তা না, তারা নিজেদের আড়াল করতো অপরিচিত মহিলাদের সামনেও। কোনো বাইরের লোক যেন তাদের কণ্ঠস্বর না শোনে তাই তাদের রাখা হতো অন্দরমহলে। শুধু বাংলার না, সমগ্র ভারতীয় উপমহাদেশেই মেয়েদের অবস্থা ছিলো অত্যন্ত করুণ। তারপর সমাজে আস্তে আস্তে মেয়েরা এগিয়ে আসলো শিক্ষায়, সংস্কৃতিতে। সেই বন্দিদশা পার করে আজকে বাংলার নারীরা হয়েছে স্বাধীন, হয়েছে স্বকীয় সত্ত্বার অধিকারিণী।

জ্ঞানের আলোর স্পর্শে, অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতার আলোকে, ব্যক্তিস্বাধীনতায় উজ্জীবিত বাংলার কন্যারা আজ নিজেদের গৃহকোণ থেক এভারেস্টের চূড়া, শিশুর শিক্ষা থেকে দেশের ভবিষ্যত- সর্বত্র রাখছে নিজেদের প্রতিভার সাক্ষর। কিন্তু এই পথচলার শুরুটা কি আদৌ সহজ ছিলো? পশ্চাৎপদতা আর আধুনিকতার ক্রান্তিলগ্নে কোন মহৎপ্রাণের ঘাড়ে ভর দিয়ে এসেছিলো এই আলোকিত পথের সন্ধান? উপমহাদেশের, বিশেষ করে বাংলার নারীশিক্ষা ও নারী-পুরুষ সমতা প্রতিষ্ঠায় যে মহীয়সী নারীর কথা প্রথমেই আসবে তিনি এই বাংলার নারীরত্ন বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন। গত ৯ ডিসেম্বর একইসাথে ছিলো তার জন্ম ও মৃত্যুদিবস।

গুগল ডুডলে বেগম রোকেয়া; Image Source: en.dhakatribune.com

বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন, যিনি ছিলেন কবি ও সাহিত্যিক, চিন্তাবিদ, শিক্ষাবিদ, সমাজ সংস্কারক, আবার একইসাথে নারী-পুরুষের সম-অধিকারের এক বজ্রকঠিন কণ্ঠস্বর। দ্বারে দ্বারে ঘুরে তিনি বলেছেন মেয়েদের শিক্ষা, সম্মান ও মুক্তির কথা। সমাজের পিছিয়ে পড়া এই অংশের দাবীতে সোচ্চার থেকেছেন আমৃত্যু। আমাদের আজকের সমাজে নারীবাদী পাওয়া যায় ভুরি ভুরি, শয়ে শয়ে সুবিধাবাদী নারীবাদীদের ভিড়ে কদাচিৎ খুঁজে পাওয়া যায় সত্যিকারের অসহায় মেয়েদের জন্য কাজ করতে থাকা নিবেদিতপ্রাণ কর্মীকে।

বেগম রোকেয়া কিন্তু আজকের সুবিধাবাদী-সুযোগসন্ধানী নারীবাদীদের মতো ছিলেন না, তিনি ছিলেন সত্যিকারের লিঙ্গ বৈষম্যের বিরুদ্ধে সমঅধিকার প্রত্যাশী, নারী-পুরুষের সমান সম্মানের জন্য সংগ্রামী একজন মানুষ। তিনি নিজেই বলেছেন,

আমরা সমাজের অর্ধাঙ্গ, আমরা পড়িয়া থাকিলে সমাজ উঠিবে কীরূপ? কোনো ব্যক্তি এক পা বাঁধিয়া রাখিলে সে খোঁড়াইয়া খোঁড়াইয়া কতদূর চলিবে? পুরুষের স্বার্থ এবং আমাদের স্বার্থ ভিন্ন নহে। তাহাদের জীবনের উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য যাহা আমাদের লক্ষ্য তাহাই।

তার স্বাধীনচেতা ব্যক্তিসত্ত্বার আলো পরিচয় মেলে যখন আমরা পড়ি,

দেহের দুটি চক্ষুস্বরূপ, মানুষের সব রকমের কাজকর্মের প্রয়োজনেই দুটি চক্ষুর গুরুত্ব সমান।

রোকেয়া সেই কঠিন গোঁড়া সমাজে মৃত্যুর আগপর্যন্ত কঠোর পরিশ্রম করে গেছেন মেয়েদের শিক্ষার জন্য, হাজার লাঞ্ছনা-গঞ্জনা সহ্য করে গেছেন দুর্ভাগা মেয়েদের মুক্তির জন্য। কিন্তু তিনি চাইলেই পারতেন অত্যন্ত আরাম-আয়েশ আর বিলাসিতায় জীবন কাটিয়ে দিতে। পিতৃ ও মাতৃ- উভয়কুলেই তিনি ছিলেন অত্যন্ত ধনী ও প্রতাপশালী জমিদারকুলের বংশধর। ১৮৮০ সালের ৯ ডিসেম্বর বর্তমান রংপুরের পায়রাবন্দ গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম জমিদার বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন বেগম রোকেয়া। বেগম রোকেয়া নামে পরিচিত হলেও তার প্রকৃত নাম রোকেয়া খাতুন, ইংরেজিতে তিনি নামের বানান লিখতেন- ROQUIAH KHATUN। বাড়ির বড়রা আদর করে তাকে ডাকতেন ‘রুকু’ বা ‘রকু’ বলে, যা পরে অনেক ব্যক্তিগত চিঠিপত্রেও দেখতে পাওয়া যায়।

রোকেয়ার বাবার নাম জহীরুদ্দিন মোহাম্মদ আবু আলী হায়দার সাবের এবং মা রাহাতুন্নেসা সাবেরা চৌধুরানী। রোকেয়ার ছিলো আরো দুই বোন ও তিন ভাই। বাকি দুই বোনের নাম করিমুন্নেসা এবং হুমাইরা। এক ভাই আবুল আসাদ শৈশবেই মৃত্যুবরণ করলে থাকেন দুই ভাই ইব্রাহীম সাবের এবং খলিলুর রহমান আবু জাইগাম সাবের। বেগম রোকেয়া নিজের শিক্ষা, চেতনা ও জীবনে তার ভাই-বোন, বিশেষ করে বড় ভাই ইব্রাহিমের অবদানের কথা আজীবন বলে গেছেন। তাই তো ‘পদ্মরাগ’ উপন্যাসটি বড় ভাইকে উৎসর্গ করে তিনি বলে গেছেন, “দাদা! আমাকে তুমিই হাতে গড়িয়া তুলিয়াছ।

পায়রাবন্দে বেগম রোকেয়ার পৈতৃক বাড়ির চিহ্ন; Image Source: heritageinbangladesh.blogspot.com

বেগম রোকেয়ার পরিবার ছিলো তখনকার দিনের আর দশটি পরিবারের মতো রক্ষণশীল ও ধর্মভীরু। যদিও তার বাবা ছিলেন সমাজসেবক, ন্যায়পরায়ণ ও অত্যন্ত উচ্চশিক্ষিত, কিন্তু বাড়ির মেয়েদের পর্দাপ্রথার ব্যপারে ছিলেন খুবই কঠোর। তাই বাড়ির ছেলেরা পাঠশালার শিক্ষা ও পরবর্তীতে আরো স্বাধীন জ্ঞানচর্চার সুযোগ পেলেও রোকেয়া আর তার বোনেরা তা থেকে বঞ্চিতই থেকে যান। মেয়েদের কেবল আরবি ও ফারসি ভাষা শিক্ষা ও ধর্মীয় কিতাব পড়ার অধিকার ছিলো। কিন্তু জ্ঞানপিপাসু রোকেয়ার অন্তর কি কেবল তাতে সন্তুষ্ট হয়? তার তো চাই শিক্ষা ও জ্ঞানের আলোকিত সম্পূর্ণ ভুবন।

তার চাওয়া ছিলো নিজের স্বাধীন সত্ত্বার স্বীকৃতির, তা অত সামান্যতে মিটবে কেমন করে? তা-ও একবার রোকেয়ার আগ্রহে আর ভাইদের উৎসাহে মা কলকাতার এক ইংরেজ মহিলা নিয়োগ করেছিলেন মেয়ের লেখাপড়ার জন্য, কিন্তু প্রতিবেশী ও আত্মীয়দের প্রবল বাঁধার মুখে সেই আয়োজনও দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। এরপর বোনদের লেখাপড়ায় এগিয়ে আসেন বড় ভাই ইব্রাহিম সাবের নিজেই। দিনের আলোতে মেয়েদের এই জ্ঞানচর্চা তখন নিষিদ্ধ, তাই তারা বেছে নিলেন রাতের অন্ধকারকে। সকলে ঘুমিয়ে গেলে রাতে বিছানা ছেড়ে উঠে এসে প্রদীপ ও মোমবাতির আলোয় বসতেন ভাই-বোন। অন্ধকারের গন্ডি ছেড়ে শুরু হলো আলোকের পথে তাদের পথচলা। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের জ্ঞান নিতে নিতে একসময় হাতে উঠলো হরেক ছবির আর বাইরের পৃথিবীর গল্পভরা ইংরেজি বই।

মতিচূর; Image Source: picswe.com

তবে সেই জ্ঞানচর্চার গল্প সহজ ছিলো না। ভাইয়েরা পড়তেন কলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে, মাঝে মাঝে যখন ছুটিতে বাড়ি আসতেন তখন চলতো এই লুকিয়ে পড়ালেখা। তবে রোকেয়ার নিজের আগ্রহ আর চেষ্টার কারণেই অতি কম সময় ও সুযোগেও তিনি জ্ঞানের অনেকখানিই নিজের মধ্যে ধারণ করতে পেরেছিলেন।

ইংরেজি ভাষায় জ্ঞানচর্চা যদিও ভাইয়ের কারণে রোকেয়ার কাছে তুলনামূলক সহজ হয়ে উঠেছিলো, কিন্তু সহজ ছিলো না নিজের মাতৃভাষার চর্চাটাই। সম্ভ্রান্ত মুসলিমদের কাছে তখন যেন বাংলার চর্চাটাই হয়ে উঠছিলো নিষিদ্ধ, আর তাতে মেয়েদের শিক্ষাগ্রহণ তো আরো নিন্দার। কিন্তু এক্ষেত্রে রোকেয়া সাহায্য পান বড় বোন করিমুন্নেসার। টাঙ্গাইলের বিখ্যাত গজনভী জমিদার বাড়িতে বিয়ে হলেও মাত্র নয় বছরের মাথায় বিধবা হয়ে চলে আসেন কলকাতায়। দুই ছেলের মধ্যে বড় ছেলেকে বিলেত পাঠালেন লেখাপড়ার জন্য, আর ছোট ছেলের লেখাপড়ার ব্যবস্থা করলেন ঘরেই। তখন করিমুন্নেসার ছোট ছেলের চেয়ে রোকেয়া মাত্র এক বছরের বড়, তাই বড় বোন সকলের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে নিজের সন্তানের সাথে ছোট বোন রোকেয়ারও লেখাপড়ার ব্যবস্থা করেছিলেন। নিজের জীবনে বড় বোনের এই অবদানের কথা মনে করে তাই রোকেয়া বলেন,

আমি শৈশবে তোমারই স্নেহের প্রসাদে বর্ণ পরিচয় পড়িতে শিখি। অপর আত্মীয়গণ আমার উর্দু ও ফারসি পড়ায় ততো আপত্তি না করলেও বাংলা পড়ার ঘোর বিরোধী ছিলেন। একমাত্র তুমিই আমার বাংলা পড়ার অনুকূলে ছিলে। আমার বিবাহের পর, তুমিই আশঙ্কা করেছিলে যে, আমি বাংলা ভাষা একেবারে ভুলিয়া যাইব। চৌদ্দ বৎসর ভাগলপুরে থাকিয়া বঙ্গভাষায় কথাবার্তা কহিবার একটি লোক না পাইয়াও যে বঙ্গভাষা ভুলি নাই, তাহা কেবল তোমারই আশীর্বাদে।

বাঙালি নারীদের অনুপ্রেরণার অদ্বিতীয় উৎস; Image Source: worldpulse.com

বাংলা ভাষার প্রতি রোকেয়ার সহজাত গভীর মমতার প্রমাণও পাওয়া যায় তার নিজের কথায়। প্রকৃতপক্ষে পরবর্তীতে আমরা যে সাহসী, সংগ্রামী রোকেয়াকে দেখেছি তার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন হয়েছিলো তার শৈশবেই। শৈশবেই রচিত হয়েছিল তার জ্ঞানচর্চার মহাগল্পের সূচনা। শৈশবেই তিনি বুঝেছিলেন, অবরোধবাসিনী হয়ে বেঁচে থাকার যন্ত্রণা। এই কঠোর সংগ্রামী শৈশবই পরে তার জীবনের মহা অধ্যায়ের সূচনা করে। সেই মহাঅধ্যায়ের গল্প আমরা শুনবো আমাদের এই লেখার পরবর্তী অংশে।

This article is in Bangla language. It focuses on Begum Rokeya, especially on her childhood and self education. Necessary references have been hyperlinked inside the article. 

Feature Image: thedailynewnation.com

Related Articles