Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

জন এফ কেনেডি: জনগণের কাছে যিনি রূপকথার নায়ক

ব্রিটেনের সাথে যুদ্ধ করে সদ্য স্বাধীন হওয়া রাষ্ট্র থেকে বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাবান রাষ্ট্রে পরিণত হওয়া আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের ২৪৪ বছরের ইতিহাস গড়ে উঠেছে নানা ঘাত-প্রতিঘাতে। আমেরিকার এই ইতিহাস গড়ার পেছনে নেপথ্য কারিগর হিসেবে ছিলেন অসাধারণ সব রাষ্ট্রনায়ক, জর্জ ওয়াশিংটন থেকে হালের ডোনাল্ড ট্রাম্প; মোট ৪৪ জন প্রেসিডেন্ট শাসন করেছেন এই বিশাল দেশটিকে। এদের মধ্যে সেরা প্রেসিডেন্টের তালিকা করলে বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে জর্জ ওয়াশিংটন, আব্রাহাম লিংকন, ফ্রাঙ্কলিন ডি রুজভেল্ট, থিওডোর রুজভেল্ট, থমাস জেফারসন, উড্রো উইলসনের নামই আসবে। যাদের নাম নেওয়া হলো, তারা প্রত্যেকেই তাদের অসাধারণ প্রজ্ঞা ও সাহসী সব সিদ্ধান্তের মাধ্যমে আজকের এই আমেরিকাকে গড়ে তুলতে বড় ভূমিকা রেখেছেন।  

তবে আমজনতার মতামত নিলে এই অসাধারণ সব প্রেসিডেন্টের সাথে আরেকজনের নামও প্রায় সমস্বরে উচ্চারিত হয়, তিনি আমেরিকার ৩৫তম প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি। অথচ কেনেডি পুরো এক মেয়াদ পূরণ করতে পারেননি, ভিয়েতনাম যুদ্ধ কিংবা কিউবায় ফিদেল ক্যাস্ত্রোকে উৎখাত করার ব্যর্থ অভ্যুত্থানের জন্যেও তিনি ঐতিহাসকদের কাছে সমালোচিত। এছাড়া মেরিলিন মনরোর সাথে অবৈধ সম্পর্কের গুঞ্জন তো আছেই, এতকিছু সত্ত্বেও কেনেডির এই তুমুল জনপ্রিয়তার রহস্য কী? কেন মৃত্যুর ৫৭ বছর পরেও আজকের বিশ্বে তিনি সমানভাবে আলোচিত? এসব প্রশ্নের উত্তর পেতে হলে একজন জন এফ কেনেডির পুরো জীবনের গল্পটা জানতে হবে, জানতে হবে তখনকার পরিস্থিতি।

জন্ম ও প্রাথমিক জীবন

১৯১৭ সালের ২৯শে মে ম্যাসাচুয়েটসের ব্রুকলিনে এক আইরিশ আমেরিকান পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন জন ফিটজারেল্ড কেনেডি, ডাক নাম ছিল জ্যাক। অবশ্য পরে তিনি জেএফকে নামেই বেশি পরিচিত ছিলেন। তার বাবা জোসেফ প্যাট্রিক কেনেডি সিনিয়র ছিলেন একজন প্রখ্যাত ব্যবসায়ী ও রাজনীতিবিদ, মা রস কেনেডি ছিলেন একজন সমাজকর্মী। বাবা-মায়ের মোট নয় সন্তানের মাঝে কেনেডি ছিলেন দ্বিতীয় সন্তান। তখনকার সময়ে আইরিশ আমেরিকানরা নিজেদের সম্প্রদায়ের মাঝে আবদ্ধ থাকতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন, সমাজের উঁচু পদে তাদের খুব একটা দেখা যেত না। এদিক থেকে কেনেডি পরিবার ছিল ব্যতিক্রম, জোসেফ কেনেডি সবসময় বড় কিছুর স্বপ্ন দেখতেন। তার বড় ছেলে একদিন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হবে, নিজের এই স্বপ্নের কথা জোসেফ সবসময় অকপটে স্বীকার করতেন। 

শৈশবে জোসেফ প্যাট্রিক (চতুর্ভুজে চিহ্নিত) ও জন এফ কেনেডি (বৃত্তে চিহ্নিত); Image Source: Bettman Via Getty Images 

বড় ছেলে হিসেবে বাবার এই স্বপ্ন পূরণের দায়িত্বটা জোসেফ কেনেডি জুনিয়রের কাঁধেই ছিল। অন্যদিকে জন এফ কেনেডি ছোটবেলা থেকেই বিভিন্ন রোগে ভুগছিলেন, বছরের অনেকটা সময়ে তাকে কাটাতে হয়েছিল হাসপাতালেই। শারীরিক এসব প্রতিকূলতার মাঝেই কেনেডি তার পড়ালেখা চালিয়ে গেছেন, এরপর উচ্চতর শিক্ষার জন্য তিনি বেছে নিলেন হার্ভার্ড কলেজকে। ১৯৩৯ সালে হার্ভার্ডে পড়ার সময়েই তার গবেষণামূলক প্রবন্ধের জন্য তিনি ইউরোপ ভ্রমণে বের হন। খুব কাছ থেকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধপূর্ব ইউরোপকে দেখতে পেয়ে তিনি বিশ্ব রাজনীতির ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। ফলে, স্কুলজীবনে পড়ালেখায় অনিয়মিত কেনেডি বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে ডিনস লিস্টে জায়গা করে নেন।

কেনেডি তার গবেষণাগ্রন্থে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে জার্মানির ব্যাপারে ব্রিটেনের ভুল সিদ্ধান্ত ও তার ফলাফল নিয়ে আলোচনা করেন। তার এ গবেষণাপত্রটি ‘হোয়াই ইংল্যান্ড স্লেপ্ট’ নামে প্রকাশিত হয় এবং সে বছর সবচেয়ে বেশি বিক্রিত বইয়ের তালিকায় জায়গা করে নেয়।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যোগদান

১৯৪০ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যোগদানের উদ্দেশে সেনাবাহিনীতে যোগদান করার সিদ্ধান্ত নেন কেনেডি, কিন্তু পিঠে ব্যথার সেই পুরনো সমস্যার কারণে তাকে শারীরিকভাবে ‘আনফিট’ ঘোষণা করা হয়। তবে তার বাবার পূর্বপরিচিত অ্যালান কার্ক নৌবাহিনীর সাবেক পরিচালক হওয়ায় ১৯৪১ সালে তিনি সেখানে সুযোগ পেয়ে যান। যুদ্ধে তিনি অসীম সাহসিকতার পরিচয় দেন, বিশেষ করে ১৯৪৩ সালের আগস্টে নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সঙ্গীদের জীবন বাঁচানোর পুরস্কার হিসেবে তাকে ‘নেভি অ্যান্ড কর্প্স’ পুরস্কারে ভূষিত করা হয়। তবে শারীরিক অসুস্থতার কারণে ১৯৪৫ সালে নৌবাহিনী থেকে অবসর নেন কেনেডি। 

টর্পেডো বোটে নেভাল লেফটেন্যান্ট জন এফ কেনেডি; Image Source: MPI/Getty Images

এদিকে এই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে কেনেডি পরিবারের সমস্ত স্বপ্ন এলোমেলো হয়ে যায়, ১৯৪৪ সালে যুদ্ধে থাকাকালীন অবস্থায় এক বিমান দুর্ঘটনায় তার বড় ভাই জোসেফ কেনেডি জুনিয়র নিহত হন। ফলে বাবার স্বপ্ন পূরণের দায়িত্বটা দ্বিতীয় সন্তান কেনেডির কাছেই স্থানান্তরিত হয়। যুদ্ধকে খুব কাছাকাছি দেখে কেনেডি নিজেও রাজনীতির ব্যাপারে উৎসাহিত হয়েছিলেন, তাই বাবার স্বপ্নপূরণের জন্য তিনি সানন্দে কাজে লেগে যান। নিজেকে তৈরি করতে তিনি বেশ কিছুদিন সাংবাদিক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

রাজনৈতিক জীবনের শুরু

১৯৪৭ সালে ম্যাসাচুসেটস থেকে হাউজ অভ রিপ্রেজেন্টেটিভের সদস্য হওয়ার লক্ষ্যে ডেমোক্রেটিক দলের প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন জন এফ কেনেডি। নির্বাচনী খরচের পুরো টাকার যোগান এবং ছেলের নির্বাচনে সবধরনের দিকনির্দেশনা প্রদান করেন তার বাবা। নতুন প্রজন্ম থেকে একজন নেতা আসছেএই স্লোগানকে সামনে রেখে ৭৩ শতাংশ ভোট পেয়ে নির্বাচনে জয়ী হন কেনেডি। হাউজে সদস্য থাকাকালীন অবস্থাতেই আন্তর্জাতিক রাজনীতির বিভিন্ন ঘটনায় নিজেকে সক্রিয় করার চেষ্টা করেন তিনি। হাউজে ছয় বছর সদস্য থাকার পর ১৯৫২ সালে সিনেটের সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হন তিনি। পরের বছরেই জ্যাকুলিন বোভিয়ারের সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন কেনেডি।

কিছুদিন পর কেনেডির পিঠের সেই পুরনো ব্যথা আবারো মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে, ফলে বেশকিছু সময় তাকে হাসপাতালে থাকতে হয়। এই সময়টা কাজে লাগিয়ে ‘প্রোফাইলস ইন কারেজ’ নামক একটি বই লিখে জিতে নেন পুলিৎজার পুরস্কার। ১৯৫৮ সালে ম্যাসাচুসেটসের ইতিহাসে রেকর্ডসংখ্যক ভোটে জয়ী হয়ে দ্বিতীয় মেয়াদে সিনেটের সদস্য নির্বাচিত হন তিনি। এরপরেই প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের জন্য নিজেকে তৈরি করতে থাকেন কেনেডি।

১৯৬০ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন

১৯৬০ সালের ২রা জানুয়ারি, মাত্র ৪৩ বছর বয়সে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের জন্য ডেমোক্র্যাটদের প্রার্থী হওয়ার ইচ্ছা পোষণ করেন কেনেডি। বয়সে ছোট হলেও অসাধারণ বাগ্মিতা ও নিজের ক্যারিশম্যাটিক ভাবমূর্তির কারণে অনেকেই তাকে সমর্থন দিতে শুরু করেন। আগের নির্বাচনগুলোর মতো এবারো সব খরচের যোগান দিয়ে যাচ্ছিলেন কেনেডির বাবা আর ম্যানেজার হিসেবে ছিলেন জেএফকের ছোট ভাই রবার্ট এফ কেনেডি। লিন্ডন বি জনসন, অ্যাডলাই স্টিভেনসন ও হিউবার্ট হামফ্রের মতো প্রতিদ্বন্দ্বীকে হারিয়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডেমোক্র্যাটদের প্রার্থী নির্বাচিত হন কেনেডি। 

নির্বাচনী বিতর্কের মঞ্চে নিক্সন ও কেনেডি; Image Source: Pictorial Parade/Getty Images

আমেরিকার দক্ষিণাঞ্চলের ভোট নিশ্চিত করতে ভাইস প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিসেবে লিন্ডন বি জনসনকে মনোনীত করেন কেনেডি। নির্বাচনে রিপাবলিকানদের প্রার্থী হিসেবে মনোনীত হন সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন। কেনেডি আর নিক্সনের লড়াই বেশ জমে ওঠে, সেবারই প্রথমবারের মতো প্রেসিডেন্ট নির্বাচন উপলক্ষে টেলিভিশন বিতর্ক অনুষ্ঠিত হয়। পায়ে ব্যথা নিয়ে বিতর্কে আসা নিক্সনকে কিছুটা উদভ্রান্ত মনে হচ্ছিল, অন্যদিকে দারুণ সাজসজ্জা নিয়ে আসা কেনেডি শুরু থেকেই ছিলেন প্রাণবন্ত। ফলে যুক্তির লড়াইয়ে দু’জনে প্রায় সমান-সমান হলেও বাহ্যিক সজ্জার কারণে জনতার কাছে কেনেডিই বিজয়ী হিসেবে পরিগণিত হন।

নির্বাচনে কেনেডি ও নিক্সনের মধ্যে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হয়, শেষপর্যন্ত মাত্র ০.২ শতাংশ ভোট বেশি পেয়ে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে কনিষ্ঠতম প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন জন এফ কেনেডি, ইলেক্টোরাল ভোটের হিসেবে নিক্সনের ২১৯টি ভোটের বিপরীতে কেনেডি পেয়েছিলেন ৩০৩টি ভোট।

প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ গ্রহণ 

প্রেসিডেন্ট হিসেবে উদ্বোধনী বক্তৃতা দেওয়ার সময়ে কেনেডি; Image Source: George Silk/The LIFE Picture Collection via Getty Images

১৯৬১ সালের ২০ জানুয়ারি আমেরিকার ৩৫তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন জন এফ কেনেডি। উদ্বোধনী মঞ্চে দেশপ্রেম, শান্তি ও উন্নয়নকে প্রাধান্য দিয়ে কেনেডি যে বক্তৃতাটি দেন, তা বিশ্ব রাজনীতির ইতিহাসে অন্যতম শ্রেষ্ঠ বক্তৃতা হিসেবে বিবেচিত হয়। সে বক্তৃতায় দেশের উন্নয়নে সকল নাগরিককে অংশীদার হওয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেছিলেন,

এটা জিজ্ঞেস করবেন না যে দেশ আপনার জন্য কী করতে পারে, এটা জিজ্ঞেস করুন যে, আপনি আপনার দেশের জন্য কী করতে পারেন।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে দ্বন্দ্ব চলছিল, দেশের সম্মান অক্ষুণ্ণ রাখার পাশাপাশি স্নায়ুযুদ্ধে শান্তি ফিরিয়ে আনতে তিনি বলেছিলেন,

আমরা যেন কখনোই ভয় পেয়ে আলোচনায় না বসি, কিন্তু আলোচনা করতেও যেন কখনো ভয় না পাই।

সর্বোপরি সমগ্র বিশ্বের উন্নয়নে সবাইকে একসাথে কাজ করার আহ্বান জানিয়ে বলেছিলেন,

এই সবকিছু প্রথম একশো দিনে শেষ হবে না। প্রথম এক হাজার দিনেও নয়, এমনকি এই প্রশাসনের সম্পূর্ণ মেয়াদকালেও নয়, হয়তোবা আমাদের জীবদ্দশায়ও নয়। তবুও, শুরু করা যাক।

নিজের প্রারম্ভিক বক্তৃতায় এত আশার বাণী শোনানো ব্যক্তি প্রেসিডেন্ট থাকাকালীন তার দেওয়া প্রতিশ্রুতির কতখানি রাখতে পেরেছিলেন, সে ব্যাপারে আলোকপাত করা যাক।

কেনেডির পররাষ্ট্রনীতি

তৎকালীন স্নায়ুযুদ্ধের ধারা অনুযায়ী কেনেডি নিজেও সমাজতন্ত্রের প্রসারণ বন্ধ করে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন, এদিকে তার পূর্ববর্তী প্রেসিডেন্ট ডোয়াইট ডি আইজেনহাওয়ার কিউবার সমাজতান্ত্রিক সরকারকে উৎখাতের পরিকল্পনা করে রেখেছিলেন। কেনেডি ক্ষমতায় এসে পরিকল্পনাটিকে অনুমোদন দেন। কিন্তু ভাড়াটে সৈন্য দিয়ে ফিদেল ক্যাস্ত্রোকে উৎখাত করার পরিকল্পনা ব্যর্থ হয় এবং ব্যর্থ অভ্যুত্থানের দায়ে ১১৮৯ জনকে বন্দী করে কিউবার সরকার। আমেরিকার এই ব্যর্থ চেষ্টা ইতিহাসের পাতায় ‘বে অভ পিগস ইনভ্যাশন’ নামে পরিচিত। এ ব্যর্থতার কারণে প্রচণ্ড সমালোচনার সম্মুখীন হয় কেনেডি সরকার।

এদিকে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে যেকোনো ধরনের যুদ্ধ এড়িয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে তার আন্তরিকতা বেশ স্পষ্ট ছিল। তবে ১৯৬১ সালের ভিয়েনা সামিটে তৎকালীন সোভিয়েত রাষ্ট্রপ্রধান নিকিতা ক্রুশ্চেভের সাথে বার্লিন ইস্যুতে কথা বলতে গিয়ে বাকবিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়েন তিনি। এর কিছুদিন পরেই পূর্ব জার্মানি থেকে পশ্চিম জার্মানিতে যাওয়া-আসা রোধ করতে বার্লিন দেয়াল তৈরি করে সোভিয়েত মদদপুষ্ট পূর্ব জার্মানি সরকার। অবশ্য এ দেয়াল তৈরির ঘটনাকে নিজেদের বিজয় হিসেবেই আখ্যায়িত করেন কেনেডি। তবে কেনেডি যত যা-ই বলুন না কেন, এসব ঘটনার কারণে ক্ষমতার প্রথম বছরে পররাষ্ট্রনীতির দিক থেকে তিনি বেশ কোণঠাসা ছিলেন। 

ক্রুশ্চেভের সাথে এক অলিখিত লড়াইয়ে জড়িয়ে পড়েছিলেন কেনেডি;
Image Source: Hank Walker/The LIFE Picture Collection via Getty Images

অবশ্য পরের বছরেই এ ব্যর্থতা ঢাকার মোক্ষম সুযোগ পেয়ে যান তিনি। ১৯৬২ সালের ১৪ অক্টোবর, সিআইএ’র গোপন উড়োজাহাজে তোলা ছবিতে দেখা যায়, আমেরিকার দিকে তাক করে কিউবায় পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্র বসিয়েছে সোভিয়েত ইউনিয়ন। কেনেডি তখন এক উভয়সঙ্কটে পড়ে যান– যদি আমেরিকা আক্রমণাত্মক কোনো পদক্ষেপ নেয়, তবে পারমাণবিক যুদ্ধের মতো ভয়াবহ কিছু ঘটে যেতে পারে। এদিকে কিছু না করে হাত গুটিয়ে বসে থাকাটাও সম্ভব ছিল না, তেমনটা করলে আমেরিকার নিরাপত্তা ও গর্বে মারাত্মক একটি আঘাত আসত। সবমিলিয়ে আমেরিকার নিরাপত্তা মহল কিউবার ক্ষেপণাস্ত্রে আক্রমণ করার পক্ষেই সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোট দেয়।

তবে বিশ্বশান্তি ও নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে আক্রমণের পথে না নিয়ে কিউবায় সকল ধরনের মারণাস্ত্র সরবরাহ বন্ধ করার উদ্দেশ্যে একটি নৌ-অবরোধ আরোপ করার সিদ্ধান্ত নেন কেনেডি। সোভিয়েত সরকার তখন তুরস্ক ও ইতালি থেকে আমেরিকার পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্র প্রত্যাহার করার দাবি জানায়। আমেরিকার ঐ ক্ষেপণাস্ত্রগুলো এমনিতেই পুরনো হয়ে গেছিল, তাই কেনেডি সরকার স্বাচ্ছন্দ্যে এ প্রস্তাবে রাজি হয়ে যান। ফলে সোভিয়েত ইউনিয়নও কিউবা থেকে তাদের ক্ষেপণাস্ত্র সরিয়ে নেয়। বিশ্বকে এক অবশ্যম্ভাবী যুদ্ধ থেকে বাঁচানোর সাথে আমেরিকার স্বার্থরক্ষায় সক্ষম হওয়ায় কেনেডি ভূয়সী প্রশংসিত হন।

পারমাণবিক অস্ত্রের ভয়ঙ্কর রূপের ব্যাপারে কেনেডি সচেতন ছিলেন, তাই এ আগ্রাসন ঠেকানোর চিন্তা তার সবসময়েই ছিল। তারই আন্তরিক চেষ্টায় সোভিয়েত ইউনিয়ন, ব্রিটেন ও আমেরিকা– এ তিন দেশ ১৯৬৩ সালের ৫ আগস্ট সীমিত আকারে পারমাণবিক পরীক্ষা নিষিদ্ধের চুক্তিতে সাক্ষর করে। সারা বিশ্বে পারমাণবিক অস্ত্রের বিস্তার রোধে এটি ছিল একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ।

এছাড়া সমগ্র বিশ্বের উন্নতিতে আমেরিকার যুব সমাজকে যুক্ত করার ব্যাপারে কেনেডি শুরু থেকেই দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করছিলেন। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৬১ সালে তিনি ‘শান্তি বাহিনী’ নামক একটি স্বেচ্ছাসেবক দল গঠন করার প্রস্তাব কংগ্রেসে উত্থাপন করেন এবং প্রস্তাবটি গৃহীত হয়। এ প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে আমেরিকার স্বেচ্ছাসেবকরা বিশ্বের বিভিন্ন উন্নয়নশীল দেশকে সাহায্য করার জন্য এগিয়ে আসার সুযোগ পায়। প্রতিষ্ঠার পর থেকে এখন পর্যন্ত প্রায় দুই লক্ষ আমেরিকান এ প্রতিষ্ঠানে যোগদান করেছে, যারা ১৩৯টি দেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে ভূমিকা রেখেছে।  

জাতীয় নীতি

আমেরিকাকে নতুনভাবে এগিয়ে নিতে ‘নিউ ফ্রন্টিয়ার’ নামে নতুন কার্যক্রম শুরু করেন কেনেডি। সুদের হার কমিয়ে প্রবৃদ্ধির হার ত্বরান্বিত করার চেষ্টা করেন। তার আমলেই প্রথমবারের মতো আমেরিকার বার্ষিক বাজেট ১০০ বিলিয়নের ঘর স্পর্শ করে। পূর্ববর্তী প্রেসিডেন্ট আইজেনহাওয়ারের আমলে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার যেখানে ছিল ২.২৫ শতাংশ, কেনেডির আমলে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৫.৫ শতাংশে। সবচেয়ে বড় কথা, এমন দারুণ প্রবৃদ্ধি সত্ত্বেও মুদ্রাস্ফীতি ও বেকারত্বের হার অপরিবর্তিত ছিল। অর্থনৈতিকভাবে এমন সাফল্যের কারণে কেনেডির বিভিন্ন পদক্ষেপ প্রায় সর্বমহলে সমাদৃত হয়। তাছাড়া তিনি করের হার কমানোর ব্যাপারেও বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। কংগ্রেসে বিভিন্ন প্রস্তাব পাশ করানোর ক্ষেত্রে তার সাফল্যের হার ছিল ঈর্ষনীয়, শতকরা প্রায় ৮৩ ভাগ সাফল্যের হার জনগণের কাছে তার গ্রহণযোগ্যতা বাড়াতে ভূমিকা রেখেছিল। 

নাগরিক অধিকার আন্দোলন

কিংবদন্তি মার্কিন প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকনের নেতৃত্বে ১৮৬৩ সালে দাসপ্রথা রহিত হলেও আমেরিকার দক্ষিণাঞ্চলের সমাজ থেকে বৈষম্য দূর হয়নি। সমাজ থেকে এই বর্ণবাদী বৈষম্য দূর করার লক্ষ্যে মার্টিন লুথার কিং জুনিয়রের নেতৃত্বে ষাটের দশক জুড়েই আন্দোলন চলছিল, যা ‘নাগরিক অধিকার আন্দোলন’ নামে পরিচিত। জন এফ কেনেডি নিজেও এ আন্দোলনের সমর্থক ছিলেন, নির্বাচনী প্রচারণার সময়ে তিনি এই নাগরিক অধিকারের আইন কংগ্রেসে পাশ করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছিলেন। কিন্তু ক্ষমতার মসনদে বসার পর আইনটি পাশ করার ক্ষেত্রে নানা ধরনের প্রতিকূলতা আবিষ্কার করেন তিনি। আমেরিকার দক্ষিণাঞ্চল থেকে নির্বাচিত তার নিজের দলের অনেক প্রার্থীই এই আইনের বিপক্ষে ছিলেন। ফলে, এ ব্যাপারে আরো কিছু সময় নেয়ার সিদ্ধান্ত নেন তিনি। 

নাগরিক অধিকার আন্দোলনের নেতাদের সাথে কেনেডি; Image Source: Universal History Archive/UIG via Getty images

আইন পাশ হতে দেরি করলেও কেনেডি নানাভাবে বর্ণবাদের বিরুদ্ধে নিজের অবস্থান জানিয়ে গেছেন, তার অফিসে তিনি বেশ কয়েকজন কৃষ্ণাঙ্গ কর্মচারী নিয়োগ দিয়েছিলেন। ১৯৬২ সালের ২০শে নভেম্বর সরকারি সম্পত্তি কেনাবেচার ক্ষেত্রে যেকোনো ধরনের বৈষম্য নিষিদ্ধ করে একটি আইন পাশ করেন কেনেডি। এদিকে দক্ষিণাঞ্চলে বিভিন্ন স্থানে কৃষ্ণাঙ্গদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করতে থাকায় নাগরিক অধিকার আন্দোলের মাত্রা দিন দিন বাড়তে থাকে।

এমতাবস্থায় ১৯৬৩ সালের ১১ই জুন টেলিভিশনে কেনেডি এক ঐতিহাসিক ভাষণ দেন, যা ‘রিপোর্ট টু দ্য আমেরিকান পিপল অন সিভিল রাইটস’ নামে পরিচিত। তার এ ভাষণে সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও ভোটদানের ক্ষেত্রে সকল শ্রেণির নাগরিকের অধিকার সংরক্ষণের ব্যাপারে নিশ্চয়তা দেওয়া হয়। পরবর্তীকালে ১৯৬৪ সালে যখন নাগরিক অধিকার আইন পাশ হয়, তখন কেনেডির এসব প্রস্তাব সে আইনের অংশে পরিণত হয়। এছাড়া নারী, অভিবাসী ও স্থানীয় আমেরিকানদের অধিকার রক্ষার ক্ষেত্রেও তিনি বেশ সচেষ্ট ছিলেন।

মহাকাশ অভিযান

স্নায়ুযুদ্ধ চলাকালে মহাকাশে নিজেদের আধিপত্য বিস্তারের ক্ষেত্রে এক অলিখিত লড়াইয়ে অবতীর্ণ হয়েছিল আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়ন। কেনেডি সিনেটের সদস্য থাকাকালে আকাশচুম্বী খরচের কারণে মহাকাশ অভিযানের বিরোধিতা করতেন। ক্ষমতায় এসে তিনি সোভিয়েত রাষ্ট্রপ্রধান ক্রুশ্চেভকে একসাথে মহাকাশে কাজ করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন, কিন্তু ক্রুশ্চেভ তা নাকচ করে দেন।

এদিকে ১৯৬১ সালের ১২ এপ্রিল প্রথম মানবসন্তান হিসেবে মহাকাশে পরিভ্রমণ করেন সোভিয়েত নভোচারী ইউরি গ্যাগারিন। ফলে, মহাকাশ লড়াইকে নিজেদের নিরাপত্তা ও সম্মানের ব্যাপার হিসেবে চিহ্নিত করে সবার আগে চন্দ্র অভিযান নিশ্চিত করার পরিকল্পনা করেন কেনেডি। সত্তরের দশক শেষ হওয়ার আগেই নিজেদের লক্ষ্যে পৌঁছানোর ব্যাপারে দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেন তিনি। পরে ১৯৬৯ সালে প্রথম মানুষ হিসেবে চাঁদে পা রাখেন নিল আমস্ট্রং, যার ফলে মহাকাশের লড়াইয়ে সোভিয়েতের বিপক্ষে আমেরিকার বিজয় নিশ্চিত হয়। 

ব্যক্তিগত জীবন ও বিতর্ক

জন এফ কেনেডি ও জ্যাকুলিন কেনেডির সংসারে ছিল এক কন্যা ও এক পুত্র। প্রেসিডেন্টের মতো জ্যাকুলিন নিজেও বেশ ক্যারিশম্যাটিক ছিলেন, তাই বাহ্যিক দিক থেকে সবকিছু মিলিয়ে কেনেডির পরিবার ছিল একটি আদর্শ পরিবার। কিন্তু পর্দার আড়ালের গল্পটা অত সুন্দর ছিল না, বিয়ের পরেও অন্য নারীদের সাথে সম্পর্ক রাখার কারণে কেনেডির সাথে তার স্ত্রীর দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছিল। শোবিজ জগতের বেশকিছু নারীর সাথে কেনেডি সম্পর্কে জড়ালেও মেরিলিন মনরোর সাথে তার সম্পর্ক নিয়েই সবচেয়ে বেশি আলোচনা হয়েছিল। তবে দু’জনের কেউ তাদের সম্পর্কের ব্যাপারটা কখনোই পরিষ্কারভাবে জানাননি। 

স্ত্রী ও দুই সন্তানের সাথে কেনেডি; Image Source: John F. Kennedy Library/John F. Kennedy Library/Getty Images

দুর্ভাগ্যজনক মৃত্যু

১৯৬৩ সালের নভেম্বর মাস, পরবর্তী নির্বাচনকে সামনে রেখে ধীরে ধীরে নিজের দলকে গুছিয়ে নিচ্ছিলেন কেনেডি। টেক্সাসে ডেমোক্র্যাটদের কিছু নেতার মাঝে বিরোধ চলছিল, তার নিষ্পত্তি করতে তিনি নিজেই ছুটে যান সেখানে। ২২ নভেম্বর, শুক্রবার টেক্সাসের ডালাস শহরে এক মোটর শোভাযাত্রায় অংশ নিচ্ছিলেন কেনেডি, সঙ্গে ছিলেন তার স্ত্রী। ডিলে প্লাজা অতিক্রম করার সময়ে দুপুর সাড়ে বারোটায় হঠাৎ গোলাগুলির শব্দ! প্রথমে একটি গুলি কেনেডির গলায় আঘাত হানে, পরমুহূর্তেই আরেকটি গুলি আঘাত হানে তার মাথায়। তৎক্ষণাৎ তাকে নিয়ে যাওয়া হয় পার্কল্যান্ড হাসপাতালে, তবে তাতে শেষরক্ষা হয়নি। ৩০ মিনিট পর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ কেনেডিকে মৃত ঘোষণা করে।

এ ঘটনায় জড়িত থাকার অপরাধে ডিলে প্লাজায় অবস্থিত টেক্সাস স্কুল বুক ডিপোজিটরির কর্মচারী লি হার্ভে অসওয়াল্ডকে গ্রেফতার করা হয়, তিনি ছিলেন আমেরিকার নৌবাহিনীর সাবেক সদস্য। গ্রেফতারের পর থেকেই এ অপরাধের দায় বারবার অস্বীকার করছিলেন অসওয়াল্ড, তাকে অবশ্য ভালোভাবে জেরা করাও যায়নি। কেনেডি হত্যাকাণ্ডের মাত্র দু’দিন পর, অর্থাৎ ২৪ নভেম্বর যখন অসওয়াল্ডকে ডালাস কোর্ট জেলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল, তখন জ্যাক রুবির গুলির আঘাতে নিহত হন তিনি। জ্যাক রুবি ছিলেন একটি নাইট ক্লাবের মালিক, অসওয়াল্ডকে খুন করার কারণ হিসেবে তিনি প্রেসিডেন্ট হত্যার প্রতিশোধ নেওয়াকেই কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। মামলা চলাকালীন ১৯৬৭ সালের ৩ জানুয়ারি ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা যান রুবি। 

বাবার কফিনের সামনে স্যালুটরত অবস্থায় ছেলে কেনেডি জুনিয়র;
Image Source: Keystone-France/Gamma-Keystone via Getty Images

সমগ্র আমেরিকা কেনেডির এ আকস্মিক মৃত্যুকে শোকে স্তব্ধ হয়ে যায়, কান্নায় ভেঙে পড়ে অসংখ্য মানুষ। কেনেডির শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে তার ছোট্ট ছেলে কেনেডি জুনিয়রের স্যালুট দেওয়া ছবিটা হয়তো পৃথিবীর ইতিহাসে অন্যতম আবেগঘন স্থিরচিত্র। কেনেডির মৃত্যুর পর ভাইস প্রেসিডেন্ট লিন্ডন বি জনসন প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন, এই চাঞ্চল্যকর হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদঘাটনের দায়িত্ব দেওয়া হয় ওয়ারেন কমিশনকে।  ৮৮৮ পৃষ্ঠার এক বিশাল তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয় ওয়ারেন কমিশন। কমিশনের তথ্যমতে, কেনেডি হত্যাকাণ্ডে অসওয়াল্ড একাই জড়িত ছিলেন, অন্য কোনো সংস্থা তাকে সাহায্য করেনি। তবে আমেরিকার সিংহভাগ মানুষ এ তদন্ত প্রতিবেদন বিশ্বাস করেনি; তাদের মতে, অন্য কোনো সংস্থা অবশ্যই এ হত্যাকাণ্ডে জড়িত ছিল। এ নিয়ে অনেক মতবাদ আছে, কিন্তু কোনো মতের পেছনেই অকাট্য যুক্তি পাওয়া যায়নি। তাই কেনেডির এই মৃত্যু রহস্য একপ্রকার অমীমাংসিতই রয়ে গেছে।

কেনেডির তুমুল জনপ্রিয়তার কারণ কী?

অধিকাংশ বিশেষজ্ঞের বিচারে আমেরিকার সেরা পাঁচ প্রেসিডেন্টের তালিকায় কেনেডির নাম আসে না। বে অভ পিগসের মতো ব্যর্থ মিশন নিয়ে অনেকে এখনো তার তুমুল সমালোচনা করে, ভিয়েতনাম যুদ্ধ ও নাগরিক অধিকার আন্দোলনে তার ভূমিকা নিয়েও অনেকে প্রশ্ন তোলে। বিয়ের পর একাধিক নারীর সাথে সম্পর্কের ব্যাপারটা তো আছেই, অনেকে তার শারীরিক অসুস্থতা নিয়েও তাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। এতকিছু সত্ত্বেও কেন আমজনতার বিচারে কেনেডি আজও সমানভাবে জনপ্রিয়?

সত্যি বলতে কেনেডিকে নিয়ে যত অভিযোগ আছে, তার কোনোটাই তার ভক্তদের খুব একটা আমলে নেওয়ার দরকার পড়ে না। বে অভ পিগস নিয়ে যত ব্যর্থতাই থাকুক, কিউবার মিসাইল সংকটে তার বুদ্ধিদীপ্ত পদক্ষেপ সে ব্যর্থতাকে অনেকখানি ঢেকে দিয়েছে। অনেক বিশেষজ্ঞের মতে, কিউবার মিসাইল সংকটে কেনেডি তেমন কোনো ভূমিকা রাখেননি, কিন্তু তখন কেনেডির একটি হঠকারী পদক্ষেপ পৃথিবীকে একটি ভয়ঙ্কর পারমাণবিক যুদ্ধের দিকে ঠেলে দিতে পারত– এ সত্য কি বিশেষজ্ঞরা অস্বীকার করতে পারবেন?

ক্যারিশম্যাটিক নেতা হিসেবে কেনেডি ছিলেন অতুলনীয়; Image Source: Corbis via Getty Images

নাগরিক অধিকার আন্দোলনে তার ধীরগতি নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়, কিন্তু কেনেডি চাইলেই কি আইনটি দ্রুত পাশ করতে পারতেন? তখনকার যা পরিস্থিতি ছিল, তাতে কেনেডির ধীরগতিতে এগিয়ে যাওয়াটাই যৌক্তিক বলে মনে করেন অনেকে। আর মানুষ হিসেবে কেনেডি নিজে যে বর্ণবাদের অভিশাপকে মনেপ্রাণে ঘৃণা করতেন, তা কিন্তু তার কর্মকাণ্ডেই স্পষ্ট। পরবর্তীকালে কেনেডির তৈরি করে যাওয়া পথ ধরেই আইনটি কংগ্রেসে পাশ হয় এবং আইনটি পাশ হওয়ার পর আন্দোলনের নেতা মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র আন্দোলনের চূড়ান্ত সাফল্যের জন্য কেনেডির অবদানকে স্মরণ করেছিলেন। তাছাড়া ভিয়েতনাম যুদ্ধের ব্যাপারে কেনেডির দায় থাকার ব্যাপারটা কিন্তু স্পষ্ট নয়, বরং মৃত্যুর কিছুদিন আগে তিনি নিজেই ভিয়েতনামে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন। এ ব্যাপারে প্রখ্যাত ঐতিহাসিক রবার্ট ড্যালেক বলেন,

কেনেডির মৃত্যুর পর জনসন ব্যাপকহারে ভিয়েতনামে সৈন্য পাঠানো শুরু করল। আমার মনে হয় না, কেনেডি বেঁচে থাকলে এমন কিছু হতো। কেনেডি যুদ্ধ থামাতেন কি না, তা নিয়ে আমারো সংশয় আছে; তবে জনসনের মতো বিধ্বংসী পথে তিনি যেতেন না।

রুজভেল্ট, ট্রুম্যান, আইজেনহাওয়ারের মতো অপেক্ষাকৃত প্রবীণ রাজনীতিবিদকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে পাওয়ার পর কেনেডির আগমনে হোয়াইট হাউস যেন তারুণ্যের রঙে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল। তার স্টাইলিশ সজ্জা, ক্যারিশম্যাটিক নেতৃত্ব আর অসাধারণ সব বক্তৃতায় আমেরিকানরা নতুন দিনের সূচনা দেখতে পেয়েছিল। আমেরিকান প্রেসিডেন্টদের মধ্যে তিনিই সর্বপ্রথম টেলিভিশনে তার সংবাদ সম্মেলনগুলো সরাসরি সম্প্রচারের অনুমতি দিয়েছিলেন, হোয়াইট হাউসে টিভি চ্যানেলগুলোর ছিল অবাধ প্রবেশের অনুমতি। প্রেসিডেন্টকে খুব কাছ থেকে দেখতে পাওয়ার ফলেই তার দিনবদলের আহ্বানে সাধারণ মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ সহজতর হয়েছিল। কেনেডিকে ‘ক্যামেলট’ হিসেবে আখ্যায়িত করে তার মৃত্যুর পর স্ত্রী জ্যাকি কেনেডি বলেছিলেন,

হয়তো ভবিষ্যতে ভালো প্রেসিডেন্ট আরো অনেক আসবেন, কিন্তু আরেকজন ক্যামেলট কখনোই আসবেন না।   

আসলে তখনকার পরিস্থিতি, বিভিন্ন ঘটনা ও জনতার ঢেউ- সবকিছু অদ্ভুতভাবে মিশে গিয়ে বেশকিছু ভুলত্রুটি থাকা জন এফ কেনেডিকে এক রূপকথার নায়কে রূপান্তরিত করেছে। প্রেসিডেন্ট হিসেবে কাটানো কেনেডির ১,০৩৬ দিন হয়তো লিংকন কিংবা রুজভেল্টদের তুলনায় কিছুটা কম সাফল্যমণ্ডিত ছিল, কিন্তু তার দেখানো আদর্শের পথ ধরে যে আশার আলো মানুষ দেখতে পেয়েছিল, তা যুগের পর যুগ আজও মানুষকে অনুপ্রাণিত করে যাচ্ছে। মানুষ হিসেবে তিনি যে দেশপ্রেমিক ও শান্তিকামী ছিলেন– এ ব্যাপারে তেমন একটা বিতর্ক নেই। এ কারণেই জন এফ কেনেডির একটি উক্তিকে নিজেদের মতো তৈরি করে তার ভক্তরা বলেন,

যদি রাজনীতিবিদেরা কেনেডির মতো দেশপ্রেমিক হতো

কিংবা কেনেডির মতো শান্তিকামী মানুষেরা রাজনীতি করত

তাহলে এ পৃথিবী আরো বেশি সুন্দর হতো।

This article is in Bangla language. It's about John F. Kennedy, the 35th American president.

References are hyperlinked inside the article.

Featured Image: Ed Clark/The LIFE Picture Collection via Getty Images

Related Articles