Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website. The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

নিঃসঙ্গ রমণী: মনিকা বেলুচ্চির নন্দিত-নিন্দিত জীবন

A crowd can excuse the person’s intelligence, even talent, but a crowd can never excuse the beauty.
– Monica Belucci

‘সিনেমা জগত’ শুনলে মাথায় ভেসে আসে চাকচিক্যময় বর্ণিল এক অদ্ভুত জগতের কথা। এই সময় অবধি কতই না তারকা এলেন, নিজেদের জেল্লা আর মেধার ঝলকানিতে জায়গা করে নিলেন এ জগতে। আবার অনেকেই ম্লান হয়ে গেলেন, জ্বলে উঠতে না পেরে ঝরে গেলেন অকালেই। ফিল্মের নেশা যখন একেবারে তুঙ্গে, সেই নব্বইয়ের দশকে সিনেমা জগতে পা পড়লো ইতালীয় এক উর্বশী রমণীর, আবেদনময়ী এই নারী নজর কেড়ে নিল অনেকের।

বলছিলাম মনিকা আনা মারিয়া বেলুচ্চির কথা, পেশাগত জীবনে যিনি আমাদের কাছে মনিকা বেলুচ্চি নামে অতি পরিচিত। কিন্তু তাকে দেখে অবশ্য তার বয়স বোঝার কোনো জো নেই। ইউরোপের এই সৌন্দর্যময়ীর চোখের রহস্য ভেদ করতে বেগ পেতে হবে যে কারও, তবে রূপের এই বাহুল্য ছাড়াও মনিকার আছে অসাধারণ বাচনভঙ্গি আর শরীরী এক ভাষা, যা তার অভিনয়কে পরিপূর্ণতা দান করেছে।

অনিন্দ্যসুন্দরী মনিকা বেলুচ্চি ধরা পড়েছেন স্থির আলোকচিত্রে; Source: Wallpaper Clicker

মনিকা বেলুচ্চির এই অসাধারণ রূপের পেছনে বিন্দুমাত্র অবদান নেই সার্জনের ছুরি-কাঁচির। প্লাস্টিক সার্জারির এই যুগে পঞ্চাশের ঘর পেরিয়ে যাওয়া নারীর এই লাবণ্য খানিকটা সন্দেহের উদ্রেক করে বটে, তবে সেটি পুরোপুরি চলে যাবে মনিকার শৈশবের ছবি দেখলে। ছোটবেলা থেকেই মনিকার ছিল চোখ জুড়ানো রূপ, ডাগর দুটি চোখ আর পেলব ঠোঁটের আড়ালের শ্বেতশুভ্র দাঁতের হাসি। লাস্যময়ীর এই সৌন্দর্যের পেছনের কৃতিত্ব খানিকটা কিন্তু দিতে হয় তার বাবা-মাকে, দুই প্রান্তের দুজন মানুষ, যাদের ভালবাসায় পৃথিবীতে এসেছিলেন মনিকা।

কৈশোরের মনিকা বেলুচ্চি, তখন থেকেই তীক্ষ্ণ চেহারা আর ভরাট ঠোঁটের অধিকারিণী ছিলেন তিনি; Source: The Place

মনিকার বাবা-মায়ের ভাগ্য কিন্তু একেবারেই তাদের সহায় হয়নি, বরং তাদের দাঁতে দাঁত চেপে জীবনের জন্যে লড়াই করে যাওয়ার গল্প শুনলে একটু আশ্চর্য বনে যেতে হয়। মনিকার বাবা ছিলেন বেলুচিস্তানের ইমিগ্র্যান্ট একজন মুসলমান। এদিকে মনিকার মা ব্রুনেলা ব্রিগান্তি ছিলেন আপাদমস্তক একজন ক্যাথলিক। কী অদ্ভুত ব্যাপার, এই দুই মেরুর দুজন মানুষ একে অন্যের প্রেমে পড়ে গেলেন! শেষমেশ ব্রিগান্তি তার রক্ষণশীল পরিবার ও সমাজের বিরুদ্ধে গিয়ে মুসলিম এই ব্যক্তিকে বিয়ে করে বসেন।

বিয়ের পর ইতালির ছোট্ট ছিমছাম শহর চিটা দি ক্যাস্টেলোতে তারা দুজনে ঘর বাঁধেন। স্বামী কাজ করা শুরু করেন ক্ষেতখামারে, আর স্ত্রী বনে যান চিত্রশিল্পী। দুজনের ছোট সংসারে দারিদ্র‍্য আর অনটনের ভিড় লেগেই থাকতো, তবু কোনোদিন ছন্দপতন হয়নি পথচলার। কেবল একটাই আক্ষেপ, তাদের কোনো সন্তানাদি ছিল না। ডাক্তার বলে দিয়েছিলেন, ব্রিগান্তি কোনোদিন মা হতে পারবেন না। আর তাই ১৯৬৪ সালের আজকের দিনে যখন মনিকা তাদের কোলজুড়ে এলো, নিছক ঈশ্বরের কৃপা বলেই ধরে নিলেন দুজন।

কালো রঙের প্রতি বরাবরই ছিল তার দুর্বলতা। তাই বহু স্থির চিত্রে আর ম্যাগাজিনের পাতায় তাকে দেখা যায় কালো পোশাকে; Source: The Place

মনিকা তার বয়সী মেয়েদের তুলনায় ছিলেন বেশ আলাদা। ছোটবেলা থেকেই তার ছিল লাবণ্যময় চেহারা, একবার নিষ্পাপ মুখটি দেখলে দ্বিতীয়বার ফিরে তাকাতেই হতো। এখন যেমন মধ্যবিত্ত পরিবারের কাছে শিক্ষার মূল্য অনেক বেশি, মনিকার বাবা-মায়ের কাছেও শিক্ষার মর্ম তেমনই হয়ে দাঁড়িয়েছিল। নিজেদের দারিদ্রের ছায়া মেয়ের ওপর পড়তে না দেওয়ার জন্যেই যেন ঢাল হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন উচ্চশিক্ষাকে। সেজন্যেই বোধহয় মনিকা তার মাতৃভাষা ছাড়াও সেই বয়সেই বিশুদ্ধ ইংরেজি, ফ্রেঞ্চ আর স্প্যানিশ শিখে ফেলেছিলেন, যা তার বয়সের তেমন কোনো ছেলেমেয়েই পারতো না।

ছোটবেলা থেকেই পড়াশোনার প্রতি মনিকার ছিল দুর্বার আগ্রহ। কেবল রূপ নয়; মেধা, মনন আর নতুনকে জানার উৎসাহ মনিকার মাঝে বরাবরই ছিল, সেজন্যে কেবল সৌন্দর্যের পুঁজিতে তিনি এত দূর এসেছেন তা ভাবা কিন্তু একেবারেই অমূলক। বরং কমনীয় রূপ আর কান্ডজ্ঞানের ভারসাম্য তাকে সকলের কাছে করে তুলেছে আরও কয়েক গুণ বেশি আকর্ষণীয়। আর দশজন ছেলেমেয়ের মতো তিনি বাড়ির উঠানে খেলে বেড়াতেন না খুব বেশি, ভালবাসতেন চুল এলিয়ে বসে কোনো একটা বইয়ের মাঝে ডুবে যেতে। বাবা-মায়ের সঙ্গে সময় কাটাতে খুব পছন্দ করতেন। এই সবকিছু মিলিয়ে মনিকা সেই আগে থেকেই ছিলেন সবার থেকে আলাদা।

সবার মাঝে থেকেও মনিকা সবার চেয়ে আলাদা, রূপের চর্চার চেয়ে অভিজ্ঞতা আর মেধার চর্চা তাই প্রাধান্য পেতে বেশি তাঁর কাছে; Source: WordPress.com

কিশোরীকাল থেকে বাবা-মাকে আর্থিক সহায়তা যোগাতে মনিকা তৎপর হয়ে ওঠেন। পড়াশোনার পাশাপাশি কাজ নেন এক রেস্তোরাঁয় ওয়েট্রেস হিসেবে। এ সময় তার এক বন্ধু আরও বেশি অর্থোপার্জনের জন্য তাকে দেখিয়ে দেয় মডেলিংয়ের রাস্তা। তা ইউরোপ আর ভূমধ্যবর্তী রক্তের মিশ্রণ মনিকাকে সেই বয়সেই দিয়েছিল এক অদ্ভুত কমনীয়তা, ১৩ বছরের মনিকার আবির্ভাব মডেল জগতের কারও চোখ এড়াতে পারেনি। সেই থেকে শুরু, জীবনের নতুন অধ্যায়ে আর কখনও পশ্চাৎমুখী হতে হয়নি তাকে।

মাত্র ১৬ বছর বয়সে তার সৌন্দর্যে সম্মোহিত হয়ে পড়েন বাঘা বাঘা সব আলোকচিত্রী, মডেলিং জগত মনিকার কাছে হয়ে গেল হাতের নাগালের চাঁদ। তিনি পুরোদস্তুর পেশাদার মডেল হয়ে পড়েন, কিন্তু এতে করে একটা ক্ষতি হয়ে যায় তার। আশৈশব লালিত আইনজীবী হবার স্বপ্নকে ইস্তফা দিতে হয় তার। হাল ছেড়ে দেবার পাত্রী মনিকা কবে ছিলেন? তাই ১৯৮৩ সনে ইতালির পেরুজিয়া ইউনিভার্সিটিতে আইন বিভাগে নিজেকে তালিকাভুক্ত করে নেন তিনি, পরে অবশ্য মাত্রাতিরিক্ত কাজের চাপে পড়ার পাট চুকিয়েই ফেলেন। ১৯৮৮-তে ২৪ বছর বয়সী মনিকা চলে এলেন মিলানে, সেখানে ‘এলিট মডেল ম্যানেজমেন্ট’ নামে একটি মডেলিং এজেন্সিতে তিনি কাজ শুরু করেন। এক বছরের মাথাতেই তিনি ইউরোপ আর আমেরিকার ফ্যাশন জগতের সম্ভাবনাময় এক নাম হয়ে ওঠেন।

Ladies and jewels | verbinina
রাশিয়ার টাটলার ম্যাগাজিনের জন্যে অঙ্গভঙ্গি করে দাঁড়িয়ে বেলুচ্চি, চিত্রগ্রাহক ফ্রাঙ্কেসো এস্ক্যালার ফ্রেমবন্দী করেন এই মুহূর্তটি। ২০১১ সালের ছবি এটি। Source: WordPress.com

মডেলিং জগতে সাড়া ফেলে দেয়া তারকা মনিকা নিজেকে সেখানে সীমাবদ্ধ রাখতে চাননি। অভিনয়ের প্রতি বিশেষ দুর্বলতা ছিল তার। ১৯৯০ সালে ‘ভিটা কোই ফিজলি’ নামের একটি টিভি সিরিজের মাধ্যমে অভিনয়ের ক্যারিয়ারের সূচনা করেন তিনি। একই বছরে ‘ব্রিগান্তি’ সিনেমাতে অভিষেক হয় তার, আর প্রথম সিনেমাতেই নিজের জাতটা চিনিয়ে দিতে ভুল করেননি মনিকা। এরপর পুরোদস্তুর অভিনয়ে মনোনিবেশ করেন তিনি, ইতালির গন্ডি পেরিয়ে সমস্ত সিনেমাজগত ঘুরে বেড়াতে খুব একটা সময় লাগেনি তার। আমেরিকার সিনেমায় পদচারণা শুরু হয় ব্রাম স্টোকারের ‘ড্রাকুলা’ সিনেমার মধ্য দিয়ে, রক্তপিপাসু ড্রাকুলার স্ত্রীর ভূমিকায় তিনি সেখানে অভিনয় করেন।

তবে মনিকার ক্যারিয়ারের মোড় ঘোরানো সিনেমার নাম বলতে গেলে নিঃসন্দেহে আসবে ‘এল এপার্টমেন্ট’ (১৯৯৬) এর নাম। রোমান্টিক এই সিনেমায় লিসা চরিত্রে অভিনয় করে অনেক নাম-ডাক কুড়ান এই অভিনেত্রী, ঝুলিতে জমা হয় বেশ কিছু পুরস্কার। সে সময়ে বিখ্যাত ফরাসি অভিনেতা ভিনসেন্ট ক্যাসেলের সান্নিধ্যে আসেন তিনি। পরবর্তীতে তার বিপরীতে ফরাসি অ্যাকশন ফিল্ম ‘ডোবারম্যান’ এ অভিনয় করেন। এখানে তার চরিত্র থাকে অপরাধ জগতের এক অধিপতির প্রেমিকা হিসেবে।

বেশি দিন আগের কথা নয়, বছর দু’তিনেক আগে একটি ফটোশ্যুটের মাধ্যমে সাড়া জাগিয়েছেন আবারও। ৫০ পেরিয়েও মনিকার আবেদন এখনও কমেনি এতটুকু। Source: lapai.al

মনিকা বেলুচ্চি সবসময়ে একটা ব্যাপারে খুব সজাগ ছিলেন, এমনকি এই ব্যাপারটি তিনি মুখেও বেশ কয়েকবার বলেছিলেন যে, সুন্দরী মাত্রই যে কেউ চাইলেই তাকে বুদ্ধিহীন ধরে নিতে পারে এমনটি যেন না হয়। নিজের রূপের ওপর তিনি যে নির্ভরশীল নন, তার প্রমাণ তিনি দিয়ে গেছেন বারবার। বেশিরভাগ সময়ে অনিয়মিত আর বিতর্কিত সব চরিত্রে তিনি অভিনয় করতেন, যা ফুটিয়ে তুলত সেই বিশেষ চরিত্রকেই। সৌন্দর্যের মাত্রা দিয়ে কোনো চরিত্রকে আধিক্য দিতে চাইতেন না। সেজন্যেই ‘আন্ডারসাসপিশন’, ‘ম্যালেনা’, ‘ইররিভার্সিবল’ জাতীয় সিনেমায় তার চরিত্র নিয়ে প্রশংসার পাশাপাশি ঝড় ওঠে সমালোচনার, যার বেশিরভাগই লাস্যময়ী অভিনেত্রী পাত্তা দেননি। 

একের পর এক সিনেমা উপহার দিতে থাকেন মনিকা, তবে ২০১৫ সালে মুক্তি পাওয়া জেমস বন্ড সিনেমায় তিনি দেখান এক অভাবনীয় চমক। ড্যানিয়েল ক্রেইগের বিপরীতে বয়স্কা নারী হিসেবে প্রথম তিনিই অভিনয় করেন ‘বন্ডগার্ল’ চরিত্রে। মনিকা অবশ্য নিজেকে বন্ডগার্ল বলতে একেবারেই নারাজ ছিলেন, নিজেকে তিনি দাবি করেন বন্ডওম্যান বলে। নারী হিসেবে এই চরিত্রে আবির্ভাব নিয়ে এতটুকু আক্ষেপ নেই, এই বয়সেও তিনি চাইলে যেকোনো চরিত্রে খাপ খাইয়ে নিতে পারেন- সেটাই প্রমাণ করে দিলেন তিনি।

ড্যানিয়েল ক্রেইগের সঙ্গে বন্ডওম্যান মনিকা; Source: Slashfilm.com

‘এল এপার্টমেন্ট’ সিনেমার কাজের সময়ে সেই যে ফরাসি যুবকের প্রেমে পড়েছিলেন মনিকা, তা থেকে নিজেকে আর তুলতে পারেননি বটে। অভিনেতা ভিনসেন্ট ক্যাসেলকেই তাই জীবনসঙ্গী করে নেন তিনি। দুজনের কোলজুড়ে আসে দুই মেয়ে দেভা ক্যাসেল ও মিউনি ক্যাসেল। দীর্ঘ এই সম্পর্কে ভাঙন কম ধরেনি। তবে সেজন্যে অভিনয় জীবনে কোনো রকম ঘাটতি পড়েনি তার।

মনিকা বেলুচ্চি সবসময়েই একজন স্বাধীনচেতা ব্যক্তি। মানুষের বিভিন্ন ট্যাবু ভেঙে দিয়ে নিজের বিতর্কিত সিনেমার চরিত্রের মাধ্যমে স্পর্শ করতে চেয়েছেন তাদের রহস্যময় জগতে। সৌন্দর্যের কাছে বাঁধা পড়েননি তিনি, নিজেকে খুঁজে বেড়ানোর এক আকাঙ্ক্ষা  তার মাঝে বরাবর ছিল। ঝুঁকিপূর্ণ সব চরিত্রের মাধ্যমে নানা আলোচনার সূত্রপাত ঘটে তার ব্যাপারে, কোনো কিছুই দমাতে পারেনি তাকে। এখনও বহাল তবিয়তে উচ্ছ্বাস নিয়ে তিনি অভিনয় করে যাচ্ছেন বৈপরীত্যে ভরা সব চরিত্রে। এমন একজন অভিনয়শিল্পীর মাধুরী আর মেধার এই শৈলীভরা বুনট কাকে মুগ্ধ করে না বলুন? মেধাবী এই সুন্দরীকে জন্মদিনের আন্তরিক শুভেচ্ছা রইলো, চলুক তার এই ভিন্নতার পথচলা!

ফিচার ইমেজ: Pinterest

Related Articles