Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

আলকাত্রাজের পাখিমানব: পাখিপ্রেমের বদৌলতে এক কুখ্যাত খুনির বদলে যাওয়ার গল্প

যুক্তরাষ্ট্রের আলাস্কার একটি পানশালার অলস বিকেলের কথা। তখনও সেখানে খদ্দেরদের ভিড় জমে ওঠেনি। দুই-চারজন চাষী সেদিনের কাজ শেষ করে আয়েশি ভঙ্গিতে এক কোণায় বসে মদ গিলছিলো। পানশালার দায়িত্বে থাকা মধ্যবয়স্ক এক লোক আসন্ন খদ্দেরদের জন্য গ্লাস, বোতল সব পরিষ্কার করে টেবিলে সাজিয়ে রাখছিল।

ঠিক তখন হুট করে পানশালার দরজা ভেঙে ভেতরে ঢুকে পড়লো এক আগন্তুক। এসেই লোকটা পানশালার পরিবেশকের সাথে বাক-বিতণ্ডায় জড়িয়ে গেলো। সাধারণত এসব স্থানে ঝগড়াঝাঁটি, মারামারি লেগেই থাকে। তাই বসে থাকা খদ্দেররা চেয়ে দেখা ছাড়া কোনো প্রতিবাদ করলো না। কিন্তু সেই তর্কাতর্কি ধীরে ধীরে হাতাহাতিতে পরিণত হলো। দুই-একজন বিরক্তি স্বরে তাদের থামার জন্য অনুরোধও করলো। কিন্তু তার অনুরোধ কর্ণপাত করলো না তারা। এরপর কিছু বুঝে উঠার আগেই আগন্তুক তার পকেট থেকে বন্দুর বের করে পরিবেশকের বুক তাক করে গুলি করে বসলো। আর্তনাদ করে ছিটকে গেলো গুলিবিদ্ধ পরিবেশক। যেভাবে এসেছিল, ঠিক সেভাবেই হন্তদন্ত হয়ে দ্রুত পালিয়ে গেল সেই আগন্তুক। আর পেছনে পড়ে থাকলো পরিবেশকের নিথর দেহ।

তর্কের এক পর্যায়ে গুলি করে বসলেন আগন্তুক; Image Source: ChokoOlate

এই ঘটনা দ্রুত চারদিকে জানাজানি হয়ে গেল। বিচারের আওতায় আনা হলো সেই আগন্তুককে। আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে থাকা সেই খুনির চোখের দিকে তাকিয়ে ভয় পেয়ে গেল উপস্থিত সবাই। কেমন নির্লিপ্ত তার চাহনি। চেহারায় নেই কোনো অনুশোচনার ছাপ। এ যেন সাক্ষাৎ দানব! সেদিন দোষী সাব্যস্ত করে কারাবরণে পাঠানো হয়েছিল তাকে। সেখানেও হত্যাযজ্ঞে নেমে সে বনে যায় কারাগারের কুখ্যাত খুনি। লোকটার অন্তরে যেন এক ফোঁটা দয়া নেই। পাঠক, আপনারাই বলুন, এমন ভয়ঙ্কর মানুষের সংশোধনের কোনো উপায় আছে কি? স্বাভাবিকভাবেই উত্তর আসবে, ‘না’। অথচ সবার উত্তরকে ভুল প্রমাণ করে এই খুনি একদিন হয়ে উঠেছিল পাখিপ্রেমী। ইতিহাস তাকে ‘বার্ডম্যান অফ আলকাত্রাজ’ উপাধিতে সম্মানিত করেছে। আমাদের আজকের প্রবন্ধে আমরা জানবো সেই খুনির বার্ডম্যান হয়ে ওঠার গল্প।

রবার্ট স্ট্রাউড

পানশালার সেই কুখ্যাত খুনির নাম রবার্ট ফ্রাঙ্কলিন স্ট্রাউড। ১৮৯০ সালের ২৮ জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনের সিয়াটল অঞ্চলে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। পৈতৃক সূত্রে রবার্ট স্ট্রাউড ছিলে জার্মান। দুই সৎবোনসহ এক দরিদ্র কুঠুরিতে বসবাস করতেন তারা। ছোট থেকে স্ট্রাউডের পারিবারিক অবস্থা ভালো ছিল না। আর্থিক অস্বচ্ছলতার কারণে পরিবারের সবার কাজ করতে হতো। তার উপর দিনশেষে মদ্যপ বাবার প্রহার সহ্য করতে হতো তাদের। রবার্ট পিতার মদ্যপ রূপ সহ্য করতে পারতেন না। তাই ১৩ বছর বয়সে বাড়ি থেকে পালিয়ে যান তিনি। ওয়াশিংটন থেকে পাড়ি জমান সুদূর আলাস্কায়। সেখানে কয়েক বছর এদিক-ওদিক কাজ করে শেষমেশ গণিকাপল্লীতে দালাল হিসেবে থিতু হন ১৮ বছর বয়সে। আর এখানেই শুরু হয় রবার্টের অপরাধনামা।

রবার্ট ফ্রাঙ্কলিন স্ট্রাউড; Image Source: Biography

খুনের হাতেখড়ি

গণিকাপল্লীতে রবার্ট স্ট্রাউড কিটি ওব্রেন নামক একজন পতিতার দালাল ছিলেন। বিভিন্ন পানশালায় অনুষ্ঠানে নাচগান করাও ছিল কিটির পেশা। তার কাজ ছিল খদ্দেরদের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ করা। অনেকে অবশ্য কিটিকে তার প্রেমিকা হিসেবেও চিত্রায়িত করেছেন। তবে সেটার পক্ষে শক্ত প্রমাণ নেই। বেশ কয়েক বছর ধরে তাদের এই ব্যবসা চলছিলো। একবার রবার্ট এক কাজের অজুহাতে শহরের বাইরে গিয়েছিলেন। তখন কিটির সাথে দেখা হয় এক পানশালার পরিবেশকের। লোকটির নাম চার্লে ফন দাহমার। চার্লের হয়ে কাজ করার পর কিটি যখন নিজের পাওনা বুঝতে যায়, তখন তাকে তিরস্কার করে বসে সে। একসময় কিটিকে সে বেদম প্রহারের মাধ্যমে বিতাড়িত করে। শহর থেকে ফিরে এসে এই ঘটনা জানতে পেরে রেগে উঠেন রবার্ট। এরপরই পানশালায় তর্কাতর্কিতে মেতে উঠেন দুজন এবং একপর্যায়ে গুলি করে চার্লেকে হত্যা করে বসে রবার্ট।

কারাবন্দীর সময়ে রবার্ট স্ট্রাউডের ছবি; Photograph: Matt laughrey

হত্যাকাণ্ডের পর রবার্ট নিজে থেকে আত্মসমর্পণ করেন। ১৯০৯ সালের ২৩ আগস্ট আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে নির্লিপ্ত রবার্ট নিজের দোষ স্বীকার করে নেন। তাকে ১২ বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত করে ম্যাকনিল দ্বীপপুঞ্জের কারাগারে প্রেরণ করা হয়।

কুখ্যাত খুনিতে পরিণত হওয়া

ম্যাকনিল দ্বীপপুঞ্জের কারাগার; Image Source: The Seattle Times

ম্যাকনিলে কারাবাসের সময় রবার্ট স্ট্রাউড বেশ কয়েকবার সহিংসতায় জড়িয়ে পড়েন। তাকে কারারক্ষীরা মোটেই পছন্দ করতো না। করবেই বা কীভাবে, প্রায়ই ঝামেলা বাঁধিয়ে তাদের ঘুম হারাম করতে উস্তাদ ছিলেন তিনি। কারাগারে তিনি মাদক চোরাচালান করতেন। এক হাসপাতালের আর্দালি এই তথ্য জানতে পেরে কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে দেয়। রাগান্বিত রবার্ট সেই আর্দালিকে ছোরা দিয়ে জখম করেন। এছাড়া বেশ কয়েকজন কয়েদিকে জখম করেন তিনি। শেষপর্যন্ত তাকে লেভেনওয়ার্থ কারাগারে বদলি করে দিতে বাধ্য হয় কর্তৃপক্ষ। কিন্তু তাতে তার সহিংস মনোভাব একটুও বদলায়নি। ১৯১৬ সালে তার ভাইয়ের সাথে সাক্ষাৎ করার অনুমতি না দেওয়ায় প্রায় এগারশো কয়েদির সামনে কারারক্ষীকে ছুরিকাঘাতে হত্যা করেন তিনি। এই ঘটনায় নতুন করে কাঠগড়ায় ওঠেন তিনি। প্রথম মাত্রার খুনের অপরাধে তাকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়।

যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের নির্দেশনা; Image Source: NY Daily News

তার মা এলিজাবেথ স্ট্রাউড ছেলের প্রাণভিক্ষা চেয়ে বসেন রাষ্ট্রপতি বরাবর। সবাই ভেবেছিল এই আবেদন নামঞ্জুর হবে। রবার্ট নিজেও হাল ছেড়ে দিয়ে মৃত্যুর অপেক্ষায় ছিলেন। তখন সবাইকে অবাক করে দিয়ে ১৯২০ সালে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি উড্রো উইলসন তার মৃত্যুদণ্ড মওকুফ করে দেন। তবে তার ঘাড়ে এবার যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের রায় চাপিয়ে দেওয়া হয়। কারা কর্তৃপক্ষ এই সিদ্ধান্তে বেশ নারাজ ছিলেন। ভয়ংকর রবার্টকে তারা বাকি জীবন তাকে একাকী নির্জন কারাবাসে রাখার সিদ্ধান্ত নেন।

তিনটি চড়ুই পাখি

কারাগারের বদ্ধ পরিবেশে যখন দিন গুজরান করছিলেন রবার্ট, তখন তার জীবনে নতুন অধ্যায়ের বার্তা নিয়ে আসলো তিনটি চড়ুই পাখি। তার কারাকক্ষের কুঠুরিতে বাস করতো সেই চড়ুইগুলো। রবার্ট স্ট্রাউডের বন্দী জীবনের সরব সাক্ষী ছিল সেসব মুক্ত পাখিরা। একদিন তিনি দেখলেন পাখিগুলো গুরুতর আহত হয়ে পড়ে আছে। রবার্ট পাখিগুলোকে কুঁড়িয়ে নিলেন এবং পরম যত্নে সেবা করতে থাকেন। পাখিগুলো সুস্থ হয়ে উঠলে অনুপ্রাণিত হয়ে যান তিনি। কারাগারে কয়েদিদের পাখি ক্রয় করার এবং পালনের অনুমতি ছিল। রবার্ট নিজের জন্য বেশ কয়েকটি ক্যানারি পাখি ক্রয় করেন। পাখি পালনের মাধ্যমে তিনি বেশ কিছু অর্থ উপার্জন করেন এবং সেগুলো তার মায়ের নিকট প্রেরণ করেন।

রবার্টের আচার-আচরণেও বেশ বড় পরিবর্তন দেখা দেয়। তিনি আর আগের মতো রগচটা থাকেন না। তার এই পরিবর্তন কারা প্রধান উইলিয়াম বিডলের নজরে আসে। তিনি রবার্টের মানসিক বিকাশের পেছনে পাখি পালনের ভূমিকা স্বীকার করতেন। পাখি পালন ছাড়াও তাদের নিয়ে ব্যাপক পড়াশোনা এবং গবেষণা শুরু করেন রবার্ট। উইলিয়াম বিডল প্রয়োজনীয় বই, খাতা, উপকরণ দিয়ে তাকে সর্বাত্মক সহায়তা করেন। লেভেনওয়ার্থের বন্দীশালায় প্রায় ৩০০ ক্যানারি পালন করতেন রবার্ট।

তিনি তার গবেষণাগুলো একত্র করে ১৯৩৩ সালে রচনা করেন ডিজিজ অফ ক্যানারিজ’ নামক একটি বই। কারাগার থেকে চোরাই পথে বাইরে পাঠিয়ে প্রকাশ করা হয়েছিল বইটি। প্রকাশনার পর পাখিপ্রেমীদের নজরে পড়েন রবার্ট। বাইরের জগতে তাকে নিয়ে আলোচনা শুরু হয়।

ক্যানারি পাখি নিয়ে পড়াশোনা শুরু করেন রবার্ট; Image Source: IMDb

আলকাত্রাজে বদলি

১৯৪২ সালের ১৯ ডিসেম্বর রবার্ট স্ট্রাউডকে ফের কারাগার বদল করার নির্দেশ দেওয়া হয়। তার পরবর্তী গন্তব্য হয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে অন্যতম সুরক্ষিত কারাগার আলকাত্রাজ। আলকাত্রাজে পাখিসহ পদার্পণ করেন রবার্ট স্ট্রাউড। এরপর থেকে তার নাম হয়ে যায় ‘বার্ডম্যান অফ আলকাত্রাজ’। এখানে জীবনের পরবর্তী ১৭ বছর অতিবাহিত করেন এই পাখিপ্রেমিক। এখানে আসার পর ১৯৪৩ সালে তার ২য় বই ‘স্ট্রাউড’স ডাইজেস্ট অন দ্য ডিজিজ অফ বার্ডস’ প্রকাশিত হয়। পাখি বিশারদদের মতে, পক্ষীবিজ্ঞানের ইতিহাসে এটি অন্যতম প্রভাবশালী বই হিসেবে গণ্য হয়। ৬ বছর ডি ব্লকে কারাবাসের পর অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি। তাকে কারাগারের হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এই অসুস্থতা থেকে কখনই সেরে ওঠেননি তিনি। ১৯৫৫ সালে থমাস গেডিস নামক এক লেখক ‘বার্ডম্যান অফ আলকাতরাজ’ নামে তার জীবনীগ্রন্থ প্রকাশ করেন।

খুনি থেকে বার্ডম্যান বনে গেলেন তিনি; Image Source: IMDb

শেষ জীবন

১১ বছর কারা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকার পর ১৯৬১ সালে তাকে স্প্রিংফিল্ডের হাসপাতালে বদলি করা হয়। এখানে চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থায় ১৯৬২ সালে তার জীবনীগ্রন্থের সিনেমা সংস্করণ ‘বার্ডম্যান অফ আলকাত্রাজ’ মুক্তিলাভ করে। বিখ্যাত অভিনেতা বার্ট লেঙ্কেস্টার রবার্টের চরিত্রকে ফুটিয়ে তোলেন। তার অনবদ্য অভিনয় তাকে সিনেমার সর্বোচ্চ সম্মানজনক পুরস্কার অস্কারের মঞ্চে সেরা অভিনেতা হিসেবে মনোনীত হওয়ার সম্মাননা এনে দেয়। দুঃখজনক হলেও সত্য, রবার্ট নিজে কখনও তার জীবনী সিনেমা দেখার সুযোগ লাভ করেননি। ১৯৬৩ সালের ২১ নভেম্বর মৃত্যুবরণ করেন এই পাখিমানব। তার মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করেন কারাগারের সহবন্দী মর্টন সবেল।

পত্রিকার পাতায় বার্ডম্যানের মৃত্যুর সংবাদ; Image Source: Archive Robert Straud

রবার্ট স্ট্রাউড ছিলেন একজন নির্দয় খুনি এবং সহিংস কয়েদি। ৩টি চড়ুই পাখির আহত হওয়ার ঘটনা এই নিষ্ঠুর মানুষটির মাঝে লুকিয়ে থাকা মমতাবান পাখিমানবকে প্রকাশ করতে সাহায্য করেছে। তিনি নিজেকে নতুন রূপে আবিষ্কার করতে সক্ষম হয়েছেন। তিরস্কারের বোঝা মাথায় নিয়ে তিনি কারাবরণ করলেও, মৃত্যুর সময় সহস্র ভক্তের ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে বিদায় নেন তিনি। তার জীবনীর মাধ্যমে মানুষের সাথে প্রকৃতির এক নিবিড় ভালোবাসার যে গাথা রচিত হলো, তা চিরকাল ইতিহাসের পাতায় অমলিন থাকবে।

This is a Bangla article about Robert Franklin Straud. He was a criminal with first degree murder. While passing his life sentences, he fell in love with birds and that completely changed him.

References: All the references are hyperlinked.

Feature Image: IMDb

Related Articles