Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website. The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

১৮ বছর বনবাসে থাকা কম্বোডিয়ার ‘জঙ্গল কন্যা’র গল্প

১৯৮৯ সালে রোকোম পিনজিয়েংয়ের বয়স প্রায় আট ছুঁইছুঁই। কম্বোডিয়ার উত্তর-পূর্ব দিকে পরিবারের সাথে থাকত মেয়েটি। বাড়ির লোকজন তাকে ফুটন্ত গোলাপের মতোই জানত, উচ্ছ্বল আর প্রাণবন্ত একটি মেয়ে রোকোম। সবার আদরের বাচ্চাটির শখ ছিল কলার খোসা দিয়ে ফুল, মানুষসহ অন্যান্য জীবজন্তুর প্রতিকৃতি বানানো। অক্টোবরের এক সকালে আর দশদিনের মতো গরুর পাল নিয়ে মাঠে চরাতে গিয়েছিল সে। সেবারই তাকে শেষবারের মতো দেখে পরিবারের লোকজন। আর কখনো বাড়ি ফেরেনি রোকোম।

এ ঘটনার প্রায় ১৮ বছর পরে, ২০০৭ সালের ১৩ জানুয়ারি প্রাপ্তবয়স্ক এক নারী বেরিয়ে আসে জঙ্গল থেকে। নোংরা, নগ্ন, ভীত এক নারী। প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, চার পায়ে ভর করে হাঁটছিল সে। মানুষের সাথে নয়, জন্তু-জানোয়ারের সাথেই তার আচরণের মিল ছিল বেশি। খাবারের সন্ধানে এদিক-ওদিক খুঁজতে খুঁজতে গ্রামে ঢুকে পড়ে মেয়েটি। পরদিন প্রতিটি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পত্রিকার পাতায় বেশ বড় শিরোনামে ছাপা হয় রোকোমের খবর। ডেইলি স্টার তার নাম দেয় ‘জন্তু মানব’, দ্য সান বলে ‘মোগলি গার্ল’, ডেইলি টেলিগ্রাফ ডাকে ‘জঙ্গল কন্যা’ বলে। তাকে ঘিরে জমে যায় উৎসাহীদের ভিড়।

বোনের সাথে রোকোম; Source: theguardian.com

প্রায় ১৮ বছর জঙ্গলে কাটিয়ে লোকালয়ে ফেরা রোকোমকে দেখতে আসে আশপাশের সব গ্রামের মানুষ। কৌতূহলী চোখ মেলে নীরবে তার পাশে বসে থাকে সবাই। বয়স তার প্রায় ২৭ তখন। এরই মধ্যে দুটি পরিবার থেকে তাকে নিজেদের মেয়ে বলে দাবি জানানো হয়। সাল লৌ নামের এক লোক তো তাকে বাড়িতে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রায় পাগল হয়ে উঠেছিল। বন্য এই নারীকে নিয়ে খুব দ্রুতই মানুষের মুখে মুখে একের পর এক রুপকথা জন্ম নিয়ে শুরু করে। গল্পের একটি সংস্করণে বলা হয়, জঙ্গল থেকে রোকোম একাই বের হয়নি, তার সাথে ছিল আরেকটি ছেলে। উন্মুক্ত তরবারি হাতে নগ্ন সেই পুরুষ পাশের কোনো গ্রামে গিয়ে আশ্রয় নেয় হয়তো। তবে তা নিয়ে গণমাধ্যমের খুব একটা মাথাব্যথা নেই। তারা বরং মেয়েটি কীভাবে ১৮ বছর ধরে মানব সভ্যতা থেকে দূরে ছিল, তা নিয়েই চিন্তিত।

রতনকিরি প্রদেশ থেকে উদ্ধার করা হয় রোকোমকে। ভিয়েতনাম এবং লাওসের সীমান্তবর্তী এই অঞ্চলটি রাজধানী ফনম পেন থেকে প্রায় ১২ ঘণ্টার রাস্তা। স্থানীয় শ্রমিকদের লাঞ্চবক্স থেকে খাবার গায়েব হয়ে যাচ্ছিল প্রায় প্রতিদিন। নিত্যদিনের এই হ্যাপা থেকে বাঁচতে তক্কে তক্কে ছিল সবাই। সেভাবেই ধরা পড়ে রোকোম। ৪৫ বছর বয়সী সাল লৌ তখন ছুটে আসে মেয়েটিকে দেখতে, ১৮ বছর আগে হারিয়ে যাওয়া তার মেয়েটির সাথে এই মেয়েটিকে মেলানোর তেমন কোনো সুযোগ না থাকলেও, বাবা তার মেয়েকে ঠিকই চিনতে পেরেছিল। বাহুতে একটি জন্মদাগের কথা হুবুহু মিলে যাওয়ায় সাল লৌয়ের কথাই বিশ্বাস করতে শুরু করে সবাই। সাল লৌয়ের মেয়ের নাম ছিল রোকোম, সেই নামেই তাকে ডাকতে থাকে আশপাশের লোকজন। তবে ডিএনএ পরীক্ষার মাধ্যমে মেয়েটির প্রকৃত পরিচয় কখনোই শনাক্ত করা হয়নি।

স্বাস্থ্যকর্মীদের সাথে রোকোম; Source: telegraph.co

কম্বোডিয়ার প্রত্যন্ত এলাকা থেকে সত্যিটা খুঁজে বের করে আনার চেয়ে গল্পের ঝুলি নিয়ে বাড়ি ফেরা অনেক সহজ, এ কথা সহজেই অনুমেয়। সভ্য দুনিয়ায় ফিরে আসার পর একটি শব্দও উচ্চারণ করেনি রোকোম। পরিবারগুলো তাকে নিজেদের মেয়ে বলে দাবি করলেও তার পেছনে জোরাল কোনো প্রমাণ দেখাতে পারেনি। সবাই যখন তার মোগলির মতো করে কাটানো জীবন নিয়ে জল্পনা-কল্পনায় ব্যস্ত, তখন তাকে পরীক্ষা করে চিকিৎসকরা বের করে আনে চমকপ্রদ কিছু তথ্য। জঙ্গলে হারিয়ে যায়নি রোকোম, তাকে আটকে রাখা হয়েছিল বছরের পর বছর! নারী স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করে এমন কিছু সংগঠন দাবি করে রোকোমের উপর নির্যাতন চালানো হয়েছিল, তাকে দেখে এমনটাই মনে হয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে পায়ের ব্যবহার না করায় হামাগুড়ি দিয়ে হাঁটতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করলেও চামচের ব্যবহার কিন্তু তাকে শিখিয়ে দিতে হয়নি। লোকালয়ের অন্যদের সাথে মানিয়ে নিতে অনেক কষ্ট হলেও কিছুদিনের মধ্যে তিনটি শব্দ উচ্চারণ করে সে, ‘বাবা’, ‘মা’ আর ‘পেট ব্যথা’। তার মানে মনুষ্য সমাজের কিছু রীতিনীতি, ভাষাও তার মধ্যে রয়েছে। কিন্তু তা কী করে সম্ভব?

কথা বলার চেষ্টা করত রোকোম। কিন্তু তার মুখ নিঃসৃত ভাষা ছিল দুর্বোধ্য। খিদে বা তৃষ্ণা পেলে আঙুল দিয়ে পেট বা মুখ ইশারা করেই বুঝিয়ে দিত কী চাইছে সে। বেশ কিছুদিন পার হয়ে গেলেও সোজা হয়ে হাঁটতে বেশ অসুবিধা হতো তার। তাছাড়া তাকে সার্বক্ষণিক প্রহরার মধ্যে রাখতে হতো। একটু একা হলেই জঙ্গলের দিকে দৌড় দিত সে। এটা দীর্ঘদিনের অভ্যাসবশত পালিয়ে বেড়ানোর তাগিদ নাকি মানুষের সঙ্গ উপভোগ না করার বিরুপ প্রতিক্রিয়া, তা বোঝার উপায় নেই। তবে একরাতে পালিয়ে যেতে সক্ষম হলেও, পরদিন দুপুরে ঠিকই আবার সালদের বাড়িতে ফিরে আসে সে। তবে কী রাত নিয়ে তার কোনো বিভীষিকাময় গল্প রয়েছে? প্রশ্নের উত্তর অনুসন্ধান করতে এগিয়ে আসে সচেতন কিছু মানুষ।

জঙ্গল কন্যাকে ঘিরে কমতি নেই উৎসুক জনতার ভিড়ের; Source: guardian.ng

রোকোমের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে রীতিমতো চমকে যায় চিকিৎসকরা। সারা গায়ে কাঁটা-ছেঁড়ার দাগ। দু’হাতের কব্জিতে চিকন দুটো কালো দাগ দেখলে বোঝা যায়, দীর্ঘদিন দড়ি বা শক্ত কিছু দিয়ে আটকে রাখা হয়েছিল তাকে। বেশ কিছুদিন তাকে পর্যবেক্ষণ করে চিকিৎসকরা জানায়, শারীরিক বা যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছিল রোকোম। খুব সম্ভবত সীমান্তবর্তী সে এলাকা থেকে আট বছরের বাচ্চাটিকে অপহরণ করে কোনো সংঘবদ্ধ মাফিয়া দল। সারাদিন তাকে আটকে রাখা হতো চেয়ার বা অন্য কিছুর সাথে, রাতের বেলা শুরু হতো পাশবিক নির্যাতন। তার যৌনাঙ্গও কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত ছিল। পুরো ব্যাপারটাই একরকম মনগড়া মনে হলেও পারিপার্শ্বিকতা আর রোকোমের শারীরিক অবস্থার সাথে খাপে খাপ মিলে যায় তা। স্প্যানিশ মানসিক স্বাস্থ্য সংস্থা সাইকোলোজস সিন ফ্রন্টেরাস স্বেচ্ছায় দায়িত্ব নিয়ে রোকোমকে স্বাভাবিক জীবনে অভ্যস্ত হতে সহায়তা করে।

সাল লৌয়ের পরিবারের সাথে বসবাস শুরু করে রোকোম। দীর্ঘদিন পর মেয়ে ফিরে আসায় পরিবারের সদস্যরা যেন নতুন করে প্রাণ ফিরে পায়। কাজেই বাড়িতে আসা সাংবাদিক আর দর্শনার্থীদের তারা হাসিমুখেই বরণ করত। কিন্তু ঝামেলা বাঁধাল কতিপয় গ্রামবাসী। জঙ্গল থেকে ফিরে আসা কন্যাকে তারা বনদেবী জাতীয় কিছু ভেবে বসলো। কাজেই তার কাছ থেকে পানি পড়া জাতীয় জিনিসের জন্য ধরনা দেয়া থেকে শুরু করে নগদ অর্থ বা উপঢৌকনও আসতে লাগল প্রচুর। কিন্তু মাসে ২৫ ডলারের মতো কামানো সাল লৌয়ের কাছে এসব জিনিস খুবই অপ্রত্যাশিত ও অপমানজনক মনে হচ্ছিল। তার হারিয়ে যাওয়া মেয়ে ফিরে এসেছে, এর চেয়ে খুশির খবর আর কী হতে পারে? ঘরভর্তি বাচ্চাকাচ্চা সহ ১৫ জন সদস্যের পরিবারে তাই শুরু হয়ে যায় আনন্দ-উচ্ছ্বাসের বন্যা। “এটাই আমার মেয়ে,” জোর গলায় বললেন সোই, রোকোমের মা। “ওর চেহারা স্পষ্ট মনে আছে আমার। দেখতে একদম ওর বোনের মতো হয়েছে। ও বাড়ি ফিরে এসেছে। এবার একটু শান্তিতে ঘুমোতে পারব”।

কিছু লোকের কাছে দেবী বনে গেছে রোকোম; Source: medium.com

এত শান্তির ভিড়েও অনাকাঙ্ক্ষিত অর্থের আহ্বান, চিড়িয়াখানার মতো উপচে পড়া লোক সমাগম- সব মিলিয়ে যেন দুদণ্ড শান্তিতে নিঃশ্বাস ফেলার জো নেই সাল লৌয়ের পরিবারবর্গের। বাড়ি হেঁটে এসে কেউ যদি প্রশ্ন করে- ‘এটা আসলেই আপনাদের মেয়ে?’ তখন কষ্ট পাওয়াটাই স্বাভাবিক। ডিএনএ পরীক্ষা করতেও রাজি ছিলেন সাল লৌ। কিন্তু রাজধানী থেকে দূরত্ব অনেক বেশি আর টাকা-পয়সার ঝামেলা থাকায় শেষ পর্যন্ত তা আর হয়ে ওঠেনি। এই অব্দি তিনবার পালানোর চেষ্টা করেছে সে। দিনের বেলা বেশ চুপচাপ থাকলেও রাতের বেলা এক অদ্ভুত চাঞ্চল্য দেখা যায় তার মধ্যে। সে কারণে মা সহ পরিবারের বাকি সদস্যরা রাতে পালা করে তাকে সঙ্গ দেয়। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত, রোকোম এখন দিনে ৩-৪ বার খাবার খেতে শিখেছে। মুখে কথা না বললেও চোখের ইশারায় ভাবের আদান-প্রদান করা রোকোমকে নিয়ে এখনো প্রায়ই খবর বের হচ্ছে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে।

ফিচার ইমেজ- theguardian.com

Related Articles