Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

ক্যাপ্টেন জেমস কুক: প্রশান্তের বুকে আবিষ্কারের নেশায় এক দুঃসাহসিক কাপ্তান

আগের দিনে সমুদ্রভ্রমণ ছিল অনেকটা মুদ্রা নিক্ষেপের মতো। একবার সমুদ্রের বুকে পাড়ি জমানোর পর যাত্রী ফিরে আসবে কি না, সেটা কেউ নিশ্চিতভাবে বলতে পারতো না। ঝড়-ঝঞ্ঝা, অশান্ত সমুদ্রের খপ্পর ছাড়াও নানারকম রোগ-শোক সর্বদা গ্রাস করতো নাবিকদের। সমুদ্রে বাঁধানো রোগবালাইগুলোর মধ্যে একসময় সবচেয়ে ভয়ংকর রোগ ছিল স্কার্ভি। মাড়ি ফুলে রক্তক্ষরণ হওয়া স্কার্ভি রোগের কবলে পড়ে কত নাবিক যে মৃত্যুবরণ করেছে, সেটার কোনো হিসাব নেই। এই স্কার্ভি ভীতির কারণে অনেক বিশ্বজয়ী, সম্ভাবনাময় অভিযাত্রিকের অকাল যবনিকাপাত ঘটেছে।

কিন্তু ব্যতিক্রম ছিলেন একজন সামুদ্রিক কাপ্তান। সেই ব্যতিক্রমী কাপ্তান তার পর্যবেক্ষণ শক্তিকে কাজে লাগিয়ে বের করে ফেললেন এক কালজয়ী পথ্য- লেবু। ভ্রমণের পূর্বে জাহাজ বোঝাই করে লেবু নেওয়ার ফলে সেবার তার নাবিকরা স্কার্ভির কবল থেকে রক্ষা পেলো। পরোক্ষভাবে পৃথিবীর বুকে উন্মোচিত হলো ভিটামিন-সি’র অস্তিত্ব। আর সেই অস্তিত্ব উন্মোচক ব্যতিক্রমী কাপ্তান ছিলেন ক্যাপ্টেন জেমস কুক। ভিটামিন-সি’র গল্পটি আমাদের প্রায় সবার জানা। কিন্তু এই একটি আবিষ্কার ছাড়াও তিনি বহু কারণে পৃথিবীর ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে অস্ট্রেলিয়া আবিষ্কার। সুপ্রিয় পাঠক, চলুন একবার জেনে নেওয়া যাক সেই দুঃসাহসী কাপ্তানের রোমাঞ্চকর জীবনগাঁথা।

মুদি দোকান থেকে সাগরজলে

ইংল্যাণ্ডের ইয়র্কশায়ার কাউন্টিতে জন্ম নেন জেমস কুক। ১৭২৮ সালের ২৭ অক্টোবর এক স্কটিশ দিনমজুরের ঘরে জন্ম হয় তার। তার পরিবারের কেউ নাবিক ছিল না। তাই একদম শুরু থেকে তিনি কখনো নাবিক হওয়ার স্বপ্ন দেখেননি। ১৭ বছর বয়সে কুককে এক মুদি দোকানের সহকারী হিসেবে কাজ শুরু করতে হয়। কিন্তু কুক সেখানে থিতু হতে পারলেন না। ফলাফল, কর্মস্থলে পরিবর্তন। এবার কাজ শুরু করলেন জন ওয়াকার নামক এক ভদ্রলোকের অধীনে। তিনি হুইটবি অঞ্চলে কয়লা খনিতে কাজ করতেন। এখানে এসে কুককে কয়লা শিপিং করার কাজে নিযুক্ত করা হয়।

ক্যাপ্টেন জেমস কুক; Image Source: Biography

কাজের তাগিদে কুককে তখন গণিত এবং জাহাজ চালানো শিখতে হয়েছিলো। এবার কিন্তু কুক মন দিয়ে কাজ করতে থাকলেন। সারাদিন কাজ করলেও রাতটুকু পড়াশোনা করে কাটিয়ে দিতেন। কুক তার মালিকের জাহাজ দিয়ে উত্তর সাগরে ভ্রমণ করতেন। এই অঞ্চলের আবহাওয়া মোটেও সুবিধাজনক ছিল না। সমুদ্রপথ ছিল দুর্যোগপূর্ণ। ধারণা করা হয়, এ পথ দিয়ে যাত্রার অভিজ্ঞতা কুককে দক্ষ নাবিক হিসেবে গড়ে উঠতে অনুপ্রেরণা দিয়েছে।

ব্রিটিশ নৌবাহিনীতে যোগদান

আট বছর পর কুককে পদোন্নতি প্রদান করা হয়। তার দক্ষতার কারণে তাকে পুরো জাহাজের দায়িত্ব নিতে অনুরোধ করা হয়। কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে কুক এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। তার মনে তখন ভিন্ন অভিসার। তিনি নাবিক হিসেবে ঐতিহ্যবাহী ব্রিটিশ রাজকীয় নৌবাহিনীতে যোগদান করেন। এর কারণ হিসেবে মনে করা হয়, উত্তর সাগরের সংক্ষিপ্ত গণ্ডি থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্যই কুক এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। তার মনে তখন ছিল বিশ্বজয়ের দৃপ্ত পিপাসা।

সপ্তবর্ষী যুদ্ধ; Image Source: Mikkiem12

সুঠাম দেহের অধিকারী কুক দ্রুত সবার নজর কাড়তে সক্ষম হন। চমৎকার নেতৃত্বগুণে তিনি অধীনস্থদের মন জয় করতে সক্ষম হন। ২৯ বছর বয়সে জেমস কুককে এইচ এম এস পেমব্রকের মাস্টার হিসেবে নিযুক্ত করা হয়। এর কিছুদিন পর তাকে শান্ত সাগর ছেড়ে যুদ্ধক্ষেত্রে প্রেরণ করা হয়। ঐতিহাসিক সপ্তবর্ষী যুদ্ধে তিনি বিক্সে উপসাগর অঞ্চলে একটি বন্দি জাহাজের কমাণ্ডার হিসেবে কর্মরত ছিলেন। একই যুদ্ধে তিনি লুইবোর্গ অবরোধ অভিযান, তৎকালীন ইল রয়্যাল, কুইবেক সমুদ্র যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। যুদ্ধ থেকে তিনি এক ঝুলি অভিজ্ঞতা আর সুনাম কুড়িয়ে দেশে ফেরত আসেন। শিখে আসেন মানচিত্র আঁকা।

যুদ্ধের পর কুককে শুনার গ্রেনভিল নামক একটি জাহাজের কমাণ্ডার হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। বছরের বেশিরভাগ সময় তিনি জাহাজ নিয়ে সমুদ্র চষে বেড়াতেন আর জরিপ করতেন। তিনি ১৭৬২ সালে এলিজাবেথ বেটস নামক এক ভদ্রমহিলাকে বিয়ে করেন। কর্মস্থলে দাপ্তরিক কাজকর্মের পাশাপাশি তিনি বিভিন্ন ভৌগোলিক ঘটনা নিয়ে শৌখিন গবেষণা করতেন। ১৭৬৬ সালের দিকে তিনি সূর্যগ্রহণ পর্যবেক্ষণ করে ছোটখাট গবেষণাপত্র লিখে ফেলেন। এরপর সেটি লণ্ডনের রয়্যাল সোসাইটি বরাবর প্রেরণ করেন, যেটা একজন নৌ কর্মকর্তার ক্ষেত্রে অনেকটাই অস্বাভাবিক ছিল।

ছদ্মবেশী অভিযান

অভিযাত্রীক কুকের অভিষেক ছিল একটু অন্যরকম। তাকে বলতে গেলে গুপ্তচর হিসেবে পাঠানো হয় ব্রিটিশ সাম্রাজ্যাধীন তাহিতি দ্বীপে। কাগজে-কলমে এই যাত্রার প্রধান লক্ষ্য ছিল বৈজ্ঞানিক গবেষণা। তাহিতি দ্বীপে অবস্থানকালে গবেষকরা সূর্যের সামনে দিয়ে বুধ গ্রহের গতিপথ পর্যবেক্ষণ করবেন। কিন্তু এর আসল উদ্দেশ্য ছিল বহু বছর ধরে লোকমুখে প্রচলিত এক অজ্ঞাত মহাদেশের সত্যতা যাচাই করা। তৎকালীন দার্শনিকদের ধারণা ছিল, সর্বদক্ষিণে এক বিশাল মহাদেশের অস্তিত্ব রয়েছে যেটা লোকচক্ষুর আড়ালে রয়ে গিয়েছে বছরের পর বছর ধরে। দুই গোলার্ধের মধ্যে ভূমির ভারসাম্য রক্ষার্থে এই মহাদেশের অবস্থান জরুরি ছিল। তারা এই অজ্ঞাত মহাদেশের নাম দিয়েছিলেন টেরা অস্ট্রেলিয়া’।

কাল্পনিক টেরা অস্ট্রেলিয়া; Image Source: Wikimedia Commons

প্রায় ১০০ জন ক্রু নিয়ে ১৭৬৮ সালের আগস্ট মাসে এইচ এম বার্ক এন্ডেভার জাহাজে অভিযাত্রিক অধ্যায়ের সূচনা করেন জেমস কুক। জাহাজে ক্রু ছাড়াও ধনকুবের বিজ্ঞানী জোসেফ ব্যাঙ্কস, উদ্ভিদবিদ দ্যানিয়েল সোলান্দার এবং কয়েকজন জ্যোতির্বিদ এবং আঁকিয়ে ছিলেন। প্রথমে জাহাজ তাদের দাপ্তরিক গন্তব্যস্থল তাহিতি দ্বীপে গিয়ে নোঙর ফেলে। এখানে কিছুদিন অবস্থান করার পর কুক তার আসল অভিযানে বের হন। দক্ষিণের মহাদেশ আবিষ্কার করতে গিয়ে তিনি আবিষ্কার করে বসেন কয়েকটি দ্বীপ। সেই দ্বীপটি মূলত আজকের নিউজিল্যাণ্ড। তিনি তার দক্ষতা কাজে লাগিয়ে পুরো নিউজিল্যাণ্ডের মানচিত্র এঁকে ফেলেন। অবশ্য এই অঞ্চলে পুরো পৃথিবীর কাছে একদম অজানা ছিল না। এর পূর্বে নাবিকদের আগমনের ফলে তাসমানিয়াসহ বেশ কিছু দ্বীপ আবিষ্কার হয়েছিলো।

প্রবাল বিপদ

কুকের জরিপ ঠিকঠাক মতো চলছিলো। তিনি নিউজিল্যাণ্ড জরিপ শেষে অস্ট্রেলিয়া উপকূল ঘেঁষে জাহাজ চালাতে থাকেন। এভাবে তিনি আবিষ্কার করে ফেলেন ওশেনিয়া অঞ্চলের সবচেয়ে বড় দ্বীপ অস্ট্রেলিয়ার বেশিরভাগ অঞ্চল। এই কাজের জন্য তাকে অস্ট্রেলিয়ার আবিষ্কারক হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। অস্ট্রেলিয়ার দক্ষিণ পূর্ব উপকূল পাড়ি দিয়ে তিনি সোজা উত্তর দিকে জাহাজ ঘুরিয়ে নেন। বহুল আলোচিত সেই বিশাল দক্ষিণ মহাদেশ তখনো তার নজরে পড়েনি। তাই সময় থাকতে ইংল্যাণ্ড ফিরে যাওয়াই শ্রেয় মনে করলেন।

ঠিক এই সময়ে তার জাহাজ এক অনাকাঙ্ক্ষিত দূর্ঘটনার মুখোমুখি হয়। অস্ট্রেলিয়া উপকূল ঘেঁষে অবস্থিত ভয়ংকর প্রবাল প্রাচীরগ্রেট ব্যারিয়ার রিফ’– এর আঘাতে জাহাজ ডুবে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেয়। ভাগ্যক্রমে সেই যাত্রায় বেঁচে যান কুক। নিকটবর্তী উপকূলে নোঙর ফেলে তিনি জাহাজ মেরামত সম্পন্ন করে পুনরায় যাত্রা শুরু করেন। কুকের এই দূর্ঘটনার পর থেকে এখন পর্যন্ত এই প্রবাল প্রাচীরকে নৌ পথের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর পথ বিপদ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।

গ্রেট ব্যারিয়ার রিফ; Image Source: রয়টার্স

যদি অভিযানের উদ্দেশ্য দিয়ে বিচার করা হয়, সেক্ষেত্রে কিন্তু ক্যাপ্টেন কুক ব্যর্থ ছিলেন তার প্রথম অভিযানে। তবে এই ব্যর্থতার মধ্যে তিনি বেশ গুরুত্বপূর্ণ একটি আবিষ্কার করতে সক্ষম হন। অস্ট্রেলিয়া মহাদেশ ছাড়াও তিনি স্কার্ভি রোগের পথ্য আবিষ্কার করতে সক্ষম হন, যার বদৌলতে পরবর্তীতে ভিটামিন সি আবিষ্কার হয়।  

টেরা অস্ট্রেলিয়া তত্ত্বের অবসান

যদিও বিশেষজ্ঞদের দৃষ্টিতে জেমস কুকের অভিযান বেশ সফল ছিল, কিন্তু সেটা ইংল্যাণ্ডের জনগণ মানতে পারলো না। কারণ, তার অভিযানের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল দক্ষিণের লুকায়িত মহাদেশের খোঁজ পাওয়া, যেটি করতে তিনি ব্যর্থ হয়েছেন। এর বদলে তিনি আবিষ্কার করেছেন অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যাণ্ডের মতো দ্বীপ মহাদেশ। কুক ইংল্যাণ্ডে যে মানচিত্র নিয়ে ফিরে আসেন, সেটি দেখে অনেক বিজ্ঞানী অভিভূত হয়ে যান। মানচিত্রের অঙ্কন এত স্পষ্ট এবং নিখুঁত ছিল অথচ জেমস কুক তার জাহাজে কোনো ক্রোনোমিটার নেন নি। ক্রোনোমিটার ছাড়াই তিনি দীর্ঘ ৫০০ মাইল উপকূলীয় অঞ্চলের বহু ভৌগোলিক তথ্য সঠিকভাবে লিপিবদ্ধ করেছিলেন। এই অবদানের জন্য তাকে টেরা অস্ট্রেলিয়া সন্ধানে দ্বিতীয়বারের মতো সুযোগ দেওয়া হয়।

জেমস কুক অঙ্কিত নিউজিল্যাণ্ড; Image Source: Te Ara

১৭৭২ সাল থেকে ১৭৭৫ সাল পর্যন্ত পরিচালিত এই অভিযানকে কুকের জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অভিযান হিসেবে গণ্য করা হয়। মূলত এই অভিযানে তিনি পূর্ণাঙ্গ অস্ট্রেলিয়া আবিষ্কারের কাজটুকু সম্পন্ন করেন। এই যাত্রায় তিনি তন্ন তন্ন করে সেই কাল্পনিক মহাদেশের অনুসন্ধান করেন কিন্তু কোথাও সেই মহাদেশের চিহ্ন দেখলেন না। তিনি সেবার টোঙ্গা, ইস্টার দ্বীপ, নিউ ক্যালিডোনিয়া, স্যাণ্ডউইচ দ্বীপ এবং দক্ষিণ জর্জিয়া দ্বীপ আবিষ্কার করেন। তিনি দেশে ফিরে রয়্যাল সোসাইটিকে জানান, টেরা অস্ট্রেলিয়া নামক কাল্পনিক সুবিশাল মহাদেশ বলতে আসলে কিছু নেই। দক্ষিণ গোলার্ধের যা ভূমি আছে, তার সবটুকুই অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যাণ্ড এবং অ্যাটার্কটিকার বরফের মাঝে সীমাবদ্ধ। এবারও জেমস কুকের লেবু-কমলা পথ্যের জোরে সব নাবিক স্কার্ভি থেকে রক্ষা পেলো। গত যাত্রায় ব্যর্থ হিসেবে চিহ্নিত জেমস কুক এবার ফিরলেন বীরের বেশে। তাকে ক্যাপ্টেন পদে উন্নীত করা হলো এবং রয়্যাল সোসাইটির ফেলো হিসেবে সম্মাননা দেওয়া হলো। স্কার্ভি নিয়ে গবেষণাপত্র লেখার জন্য তাকে রয়্যাল সোসাইটির সর্বোচ্চ সম্মাননা গোল্ড কপ্লি মেডেলপ্রদান করা হয়েছিলো।

জেমস কুকের লেবু-কমলা পথ্যের জোরে সব নাবিক স্কার্ভি থেকে রক্ষা পেলো; Image Source: MFame

প্রশান্তের পথচারী

ইংল্যাণ্ড ফেরার এক বছরের মাথায় ফের সাগরজলে ভাসলো ক্যাপ্টেন কুকের তরী। এবার তিনি কোনো দ্বীপ সন্ধানে বের হননি। এবার তার লক্ষ্য ছিল প্রশান্ত থেকে উত্তর-পশ্চিমে আর্কটিক মহাসাগরে যাওয়ার কোনো সংক্ষিপ্ত যাত্রাপথ থাকলে তার সন্ধান বের করা। তিনি তার বিখ্যাত এইচ এম এস রিজুল্যুশান এণ্ড ডিস্কোভারি জাহাজে চড়ে কানাডার পশ্চিম উপকূল অঞ্চলে জরিপ চালাতে থাকেন। কিন্তু সমুদ্রের অশান্ত ঢেউ ও বৈরী আবহাওয়ার দরুণ সেবার কুক ব্যর্থ হলেন। পরবর্তীতে যখন এই জলপথ আবিষ্কৃত হয়েছিলো, তখন দেখা গেলো, ক্যাপ্টেন কুক সেই জলপথ থেকে মাত্র ৫০ মাইল দূরে থেকে অভিযান বাতিল করেছিলেন। অশান্ত সমুদ্র থেকে কুকের ক্রুরা বিদ্রোহ শুরু করেছিলো বলে জানা যায়। এই বিদ্রোহের মুখে পড়ে তিনি অনিচ্ছাপূর্বক দক্ষিণ দিকে জাহাজ ঘোরাতে বাধ্য হন। অবশ্য সেবার যদি কুক অভিযান বাতিল না করতেন, তাহলে ঝড়ের কবলে তার সেখানেই মৃত্যু ঘটতে পারতো।  

বৈরী সমুদ্রে ক্যাপ্টেন কুক; Image Source: captcook-ne.co.uk

হাওয়াই দ্বীপের দেবতা

ব্যর্থ কুক দক্ষিণে যাত্রাপথে এক নতুন দ্বীপের সন্ধান পেলেন। ক্লান্ত সহযাত্রীদের সাথে পরামর্শ শেষে তিনি সেই দ্বীপে নোঙর ফেলার সিদ্ধান্ত নিলেন। এর মাধ্যমে ক্যাপ্টেন কুক সর্বপ্রথম ইউরোপীয় হিসেবে হাওয়াই দ্বীপের মাটিতে পদার্পণ করেন। কুকের পৃষ্ঠপোষক আর্ল অফ স্যান্ডউইচের সম্মানার্থে দ্বীপের নাম দেওয়া হয় স্যান্ডউইচ দ্বীপ। হাওয়াই অধিবাসীরা এর পূর্বে কোনো শ্বেতাঙ্গের দেখা পায়নি। তাই তারা ধরে নিয়েছিলো, নিশ্চয়ই এরা দেবতা। আর কাকতালীয়ভাবে কুকের পদার্পণের সময়কালের সাথে স্থানীয় দেবতা লোনোর আবির্ভাবকাল মিলে যাওয়ায় ক্যাপ্টেন কুক হয়ে উঠেন দেবতা লোনো। স্থানীয়রা কুককে উপঢৌকন আর স্ততি দ্বারা সন্তুষ্ট করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। কুকরাও সুযোগ বুঝে লুফে নিতে থাকে উপহারগুলো।

জেমস কুকের যাত্রাপথ; Image Source: Wikimedia Commons

কিন্তু ঝামেলা বাঁধলো যখন কয়দিন পর এক নাবিক আকস্মিকভাবে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। স্থানীয়রা এই ঘটনায় বিস্মিত হয়ে গেলো। তারা বুঝতে পারলো, এরা অমর দেবতা নয়। এই বিশ্বাসভঙ্গে স্থানীয়দের সাথে কুকদের সম্পর্ক খারাপ হয়ে গেলো।

স্থানীয়দের হাতে খুন

স্থানীয়রা এরপর থেকে কুকদের সাথে খারাপ ব্যবহার শুরু করে দেয়। এক স্থানীয় কুকের জাহাজ আক্রমণ করে তার মূল্যবান যন্ত্র চুরি করে। এই ঘটনায় কুক প্রচণ্ড রেগে গিয়ে স্থানীয় রাজাকে অপহরণ করার চেষ্টা করেন। তার এই সিদ্ধান্তে স্থানীয়রা ভয় পেয়ে যায়। তারা ভেবেছিল কুক বোধহয় তাদের রাজাকে হত্যা করবে। তারা রাজাকে উদ্ধারের জন্য কুককে আক্রমণ করে বসে। কুকের ক্রুরা অবস্থা বেগতিক দেখে জাহাজ থেকে কামান দাগানো শুরু করে। এর মাধ্যমে এক রক্তক্ষয়ী দাঙ্গার সূত্রপাত ঘটে।

ক্যাপ্টেন কুকের হত্যাকাণ্ড; Image Source: Alex Leff

অবস্থা বেগতিক দেখে কুক একটি নৌকায় চড়ে পালানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু এক হাওয়াইয়ান তাকে পেছন থেকে আক্রমণ করে এবং ক্রমাগত ছুরিকাঘাত করে হত্যা করে। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস যে, সেই স্থানীয়কে ছুরিটি স্বয়ং ক্যাপ্টেন কুক উপহার দিয়েছিলেন। পরবর্তীতে স্থানীয়রা তাদের রীতি অনুযায়ী কুকের মরদেহের সৎকার করে।

জেমস কুক পৃথিবীর অন্যতম সেরা অভিযাত্রিক; Image Source: James Cook 250

পৃথিবীর সেরা অভিযাত্রিকদের নাম নিলে উঠে আসবে কলম্বাস, হিরাম বিংহাম, পার্সি ফসেট, বুর্কহার্টসহ প্রমুখ অভিযাত্রীর নাম। কিন্তু এদের মধ্যে ক্যাপ্টেন কুকের নাম একটু আলাদাভাবে নিতে হবে। তিনি অভিযাত্রায় এক নতুন মান নির্ধারণ করেছেন। শুধু লক্ষ্য অর্জন নয়, তিনি তার সহযাত্রীদের সুস্বাস্থ্যের জন্যেও গবেষণা করেছেন, যা এক উজ্জ্বল মানবিক দৃষ্টান্ত। তার অবিস্মরণীয় অভিযানের ফলে পৃথিবীর মানচিত্রে যোগ হয়ে নতুন মহাদেশ। আবিষ্কৃত হয়েছে বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ কিছু দ্বীপ। যতদিন প্রশান্তের বুকে অশান্ত ঢেউয়ের সাথে পাল্লা দিয়ে অভিযাত্রিকরা অজানা দ্বীপের সন্ধানে ছুটে যাবে, ততদিন ক্যাপ্টেন কুকের নাম ইতিহাসের পাতায় লেখা থাকবে।

This is a Bangla article about Captain James Cook. He was the discoverer of Australia and New Zealand. He also indirectly discovered Vitamin-C. Termed as the greatest explorer around the globe, Cook has lead a very adventurous life. 

Reference: All the references are hyperlinked

Feature Image: Historic UK

Related Articles