Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

কার্লোস দ্য জ্যাকেল: ইউরোপ কাঁপানো ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসী

‘৭০ আর ‘৮০-র দশকে ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য তথা পশ্চিমা বিশ্বকে সন্ত্রস্ত করে রাখা এক নাম কার্লোস দ্য জ্যাকেল। একের পর এক সন্ত্রাসী হামলা আর হত্যাকাণ্ডের কুখ্যাত জনক এই ব্যক্তির নাম রাজনৈতিক সন্ত্রাসবাদের ইতিহাসের প্রথম দিকের তালিকাতেই স্থান পাবে। নিজেকে বিপ্লবী দাবি করা এই ব্যক্তি মূলত কিছুটা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পক্ষে-বিপক্ষে যোগদান করে তাণ্ডব চালিয়ে এসেছে ইউরোপ জুড়ে। আদর্শের নামে সংঘাতে জড়ালেও পরবর্তীতে সে পুরোপুরিভাবে বনে যায় ‘মার্সেনারি’ বা ভাড়াটে যোদ্ধা।

কার্লোসের প্রচলিত একটা পোট্রেট ছবি; source: independent.uk

কার্লোসের মূল নাম ইলিচ রামিরেজ সানচেজ, জন্ম ১৯৪৯ সালে ভেনিজুয়েলাতে এক উচ্চবিত্ত পরিবারে। বাবা ছিলেন একজন অবস্থাসম্পন্ন উকিল। মার্ক্সবাদী পিতার কারণে পারিবারিকভাবেই সে গড়ে ওঠে বামপন্থী ধ্যানধারণায়। যদিও তার প্লেবয় সুলভ জীবনযাপন কোনোভাবেই বামপন্থী ধ্যানধারণার সাথে ঠিক খাপ খায়নি। তার বাবা তার নাম রেখেছিলেন মহামতি লেলিনের নাম অনুকরণে (ভ্লাদিমির ইলিচ লেলিন, রুশ বিপ্লবের জনক)। কিন্তু পরবর্তীতে তার নাম হয়ে যায় ‘কার্লোস’, যা মূলত দক্ষিণ আমেরিকার লোক হওয়ার কারণে। এটি ছিল তার কোডনেম।

ষাটের দশকের মাঝামাঝিতে কার্লোস তার মায়ের সাথে লন্ডনে চলে আসে। এখানে বিভিন্ন ভাষা শিক্ষার কোর্সে ভর্তি হয়ে নিজের বিভিন্ন ভাষাগত দক্ষতা গড়ে নেয় সে, যা পরবর্তীতে তাকে ‘ভাষা শিক্ষক’ এর ছদ্মবেশে সন্ত্রাসবাদী কাজ চালিয়ে যেতে সাহায্য করেছিল। ব্রিটিশ প্রিপারেটরি স্কুল থেকে পাস করে সে মস্কোর প্যাট্রিস লুমুম্বা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনায় ঢোকে, কিন্তু কর্তৃপক্ষের সাথে ঝামেলায় জড়িয়ে ১৯৭০ সালে বহিষ্কৃত হয়। এরই সাথে শেষ হয় তার পড়াশোনা।

বহু প্রেমিকার সাথে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন জায়গায় দেখা যেত কার্লোসকে; source: Czech Security Services Archive

তার বামপন্থী পিতার হাত ধরেই শুরু হয় কথিত ‘বিপ্লবী’ জীবন, হাই স্কুলে থাকতেই সে ভেনিজুয়েলা কমিউনিস্ট পার্টির যুব শাখায় যোগদান করে। ১৯৬৬ সালে বাবার সাথে কমিউনিস্ট পার্টির ত্রি-মহাদেশীয় সম্মেলনে যোগদান করে, এসময় সে কিউবার হাভানায় ‘ক্যাম্প মাতানজাস’ নামক গেরিলা যুদ্ধ প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে পুরো গ্রীষ্মকাল অতিবাহিত করে। সেখানে সে গেরিলা যুদ্ধের নানা প্রশিক্ষণ লাভ করে সরাসরি কেজিবি প্রশিক্ষকদের দ্বারা।

১৯৭০ সালে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কারের পরে সে লেবাননের বৈরুতে গিয়ে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার জন্য লড়াই করতে স্বেচ্ছাসেবী যোদ্ধা হিসেবে নাম লেখায়। অস্বীকার করার উপায় নেই, রোমান্টিসিজমের বশে বিপ্লবী হলেও তার ভেতরে অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর একটা অনুভূতি ছিল; নতুবা যে যুদ্ধ তার নয়, সেখানে গিয়ে তার হাজির হওয়ার কথা নয়। কিন্তু সহিংসতাই যে বিপ্লব না, সেটা বোধহয় তার জানা ছিল না, তার কর্মকাণ্ডই তার প্রমাণ।

কোন এক রসিক গোয়েন্দা কর্মকর্তা গোপনে ছবিটি তুলেছিলেন, কার্লোসের পেছনে একটি মুভি পোস্টার দেখা যাচ্ছে, মুভির নাম ‘দংশন’; source: Czech Security Services Archive

বৈরুতে গিয়ে সে ইয়াসির আরাফাতের দল ‘পপুলার ফ্রন্ট ফর দ্য লিবারেশন অব প্যালেস্টাইন’ (PFLP) এ যোগ দিলে তাকে জর্ডানের রাজধানী আম্মানে পাঠানো হয় প্রশিক্ষণের জন্যে। সেখানে সে অস্ত্র প্রশিক্ষণ লাভ করে। ১৯৭০ সালে ঘটা ‘ব্ল্যাক সেপ্টেম্বর’ যুদ্ধে সে প্রথম তার সামরিক দক্ষতা দেখানোর সুযোগ পায়। এই যুদ্ধের পর তার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে PFLP-তে। এরপর সে লন্ডনের ইউনিভার্সিটি অব ওয়েস্টমিনিস্টারে একটি কোর্সে অংশগ্রহণ করতে যায়, কিন্তু ভেতরে ভেতরে PFLP এর জন্যে কাজ করতে থাকে। তার পড়ার বিষয় ছিল রসায়ন, তার মতে, এই পড়াশোনা তাকে বোমা বানাতে সাহায্য করেছিল।

যুদ্ধে দক্ষতার খ্যাতি কার্লোসকে এরপর গোপন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের দিকে ঠেলে দেয়। লন্ডনে আসার পর থেকেই সে হত্যা ও অপহরণ করা হবে, এমন ব্যক্তিদের তালিকা বানিয়ে ফেলে। ১৯৭২ সালে জার্মানির মিউনিখ অলিম্পিকে ইসরায়েলী অ্যাথলেটদের হত্যায় ফিলিস্তিনিরা জড়িত থাকলেও, এই ঘটনায় কার্লোসের সম্পৃক্ততা ছিল বলে ধারণা করা হয়। প্যারিসে ১৯৭২ সালেই এক ইসরায়েলী ব্যাংকের লন্ডন শাখায় বোমা হামলার চেষ্টা, তিনটি ফরাসি সংবাদপত্রের অফিসে গাড়িবোমা হামলা চালানো, একটি ক্যাফেতে গ্রেনেড হামলা চালিয়ে দুজনকে হত্যা আর ৩০ জনকে জখম করা, সবই এই কার্লোসের কীর্তি।

‘৮২ সালে প্যারিসের একটি পত্রিকা অফিসে সংঘটিত বোমা হামলা; source: BBC/AFP

১৯৭৩ সালে এক উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটায় সে। ঐ বছর মোসাদের এক অপারেশনে PFLP নেতা মোহাম্মদ বোদিয়া গুপ্তহত্যার শিকার হলে কার্লোস এই ঘটনার প্রতিশোধ নেওয়ার পরিকল্পনা করে। সে ব্রিটিশ জায়নবাদী ব্যবসায়ী জোসেফ সিফের (আন্তর্জাতিক কাপড়ের ব্র্যান্ড ‘মার্ক এন্ড স্পেন্সার’ এর ভাইস প্রেসিডেন্ট)  বাসায় গিয়ে হাজির হয়, এরপর সটান জোসেফের ঘরে ঢুকে তাকে গুলি করে বসে। কিন্তু গুলিটি জোসেফের নাকের নিচে হাড়ে বিদ্ধ হলে প্রাণে বেঁচে যায় সে।

গোয়েন্দা সংস্থার ফাইলে কার্লোসের বিভিন্ন রূপ; source: ITN tv

এ জাতীয় দুর্ধর্ষ ঘটনাসমূহের কারণে পুরো ইউরোপ জুড়ে গোয়েন্দা সংস্থাসমূহের রাতের ঘুম উধাও করে দেয় কার্লোস। সিআইএ, ফরাসি গোয়েন্দা সংস্থা ডিএসটি প্রভৃতি হন্যে হয়ে খুঁজতে থাকে তাকে। ১৯৭৫ সালে কার্লোসের এক সহযোগী গ্রেপ্তার হলে সে কার্লোসের বাসার সন্ধান দিয়ে দেয়। কয়েকজন ফরাসি গোয়েন্দা তার বাসায় হাজির হলে কার্লোস তাদেরকে ঘরে নিয়ে পানীয় পরিবেশন করে রীতিমতো সমাদর করে বসায়। এরপর ঠিক মূহুর্তের ভেতরে এলোপাতাড়ি গুলি করে দুজন গোয়েন্দাকে হত্যা আর আরেকজনকে আহত করে পালাতে সক্ষম হয় সে।

একই সময়ে লন্ডনে কার্লোসের একটি সেফ হাউজের সন্ধান পাওয়া যায়, সেখানে জনৈক ব্রিটিশ সাংবাদিক একটি বই খুঁজে পান। সেটি ছিল ফ্রেডারিক ফরসাইথের ‘দি ডে অব জ্যাকেল’ এর একটি কপি (যেটা কিনা গুপ্তহত্যাকারীদের পাঠ্যবই সুলভ)। এই ঘটনার পর কার্লোসের নাম হয়ে যায় ‘কার্লোস দ্য জ্যাকেল’।

জিম্মিদের বিমানে ওঠানো হচ্ছে আলজেরিয়ায় নেওয়ার উদ্দেশ্যে; source: Bettmann/CORBIS

এরপর ১৯৭৫ সালের ২১ ডিসেম্বর পুরো দুনিয়া কাঁপিয়ে দেয় সে। অস্ট্রিয়ার ভিয়েনাতে তেল রপ্তানিকারক দেশগুলোর সংগঠন ‘ওপেক’ এর সম্মেলনে সদলবলে আক্রমণ করে ১১টি দেশের তেল মন্ত্রী সহ ৪২ জনকে জিম্মি করে বসে সে। সে দাবি করে, রেডিও-টিভিতে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার ইশতেহার প্রচার করতে হবে, নতুবা সে ১৫ মিনিট পর পর এক এক করে জিম্মিকে হত্যা করবে। অস্ট্রিয়ান সরকার সে অনুযায়ী সম্প্রচার চালায়।

এরপর সে একটি বিমান দাবি করে বসে, যাতে করে সে তার জিম্মিদের সাথে নিতে পারে। সরকার চাপে পড়ে সে দাবিও পূরণ করে। কার্লোস অস্ত্রের মুখে ৪২ জনকে একটা বিমানে উঠিয়ে আলজেরিয়াতে অপহরণ করে নিয়ে যায়, বিনিময়ে তার চাই ১০ মিলিয়ন ডলার। হলিউড মুভিতে দেখা এ জাতীয় ব্যাপার নেহায়েতই ফিকশন মনে হলেও বাস্তব মাঝে মাঝে ফিকশনকেও হার মানায়।

আলজেরিয়ায় বিমান থেকে নেমে জিম্মিদের সাথে কার্লোস; source: algeria-paradis

ধারণা করা হয়, ২০ থেকে ৫০ মিলিয়ন ডলারের মাঝামাঝি পরিমাণ টাকা তাকে দেওয়া হয়েছিল, জিম্মিরা সবাই ছাড়া পায়। তবে কার্লোসের প্রশিক্ষক ফিলিস্তিনি নেতা ওয়াদি হাদ্দাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী জিম্মিদের মধ্যে ইরানী আর সৌদি মন্ত্রীকে গুলি করে মেরে ফেলার কথা ছিল। তা না করায় PFLP নেতারা তাকে বহিষ্কার করে। ধারণা করা হয়, এই কাণ্ড সে ঘটিয়েছিল ইরাকী প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনের পরিকল্পনায়, এর মাধ্যমে আন্তর্জাতিক বাজারে তেলে দাম বাড়িয়ে নেওয়ার দুরভিসন্ধি সাদ্দামের ছিল বলে কিছু বিশ্লেষকের ধারণা। উল্লেখ্য, ইরাক তখন ইরানের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত থাকায় বেশ অর্থনৈতিক চাপে ছিল।

এরপর কার্লোস ইয়ামেনের এডেন শহরে থিতু হয় কিছুদিনের জন্য। সেখানে সে নিজের একটি সশস্ত্র সংগঠন তৈরি করে কিছু সিরিয়ান, লেবানিজ আর জার্মান বিদ্রোহীদের সমন্বয়ে। তৎকালীন পূর্ব জার্মানির গোপন পুলিশি সংস্থা ‘স্টাসি’ কার্লোসকে বিভিন্ন সহায়তা প্রদান করত। কার্লোসকে পূর্ব জার্মানিতে একটি অফিস, সেফ হাউজ, ৭৫ জনের এক কর্মী বাহিনী এবং গাড়ি দেয়া হয়েছিলো। এমনকি তাকে পূর্ব জার্মানির ভেতরে প্রকাশ্যে অস্ত্র বহনের অনুমতিও দেয় তারা। বোঝাই যায় যে, তৎকালীন পূর্ব জার্মানির কমিউনিস্ট কর্তৃপক্ষ কার্লোসকে তাদের নানা কাজে ব্যবহার করত।

পুরো দুই দশক খবরের শিরোনাম হয় কার্লোস; source: ITN tv

পুরো আশির দশক জুড়ে সে তার ত্রাসের রাজত্ব চালু রাখে। এর মধ্যে রয়েছে ‘৮২ সালের ফ্রান্সের ‘টিজিভি’ ট্রেনে হামলা, প্যারিসের সংবাদপত্রের অফিসে গাড়িবোমা হামলা, মার্সেইতে রেল স্টেশনে বোমা হামলা, ‘৮৩ সালে মার্সেইতে ‘টিজিভি’ ট্রেন হামলা ইত্যাদি। প্রতিটি ঘটনাতেই কয়েকজন করে মানুষ নিহত আর প্রচুর মানুষ আহত হয়।

স্টাসি এবং কেজিবির সাথে কার্লোসের সম্পর্ক যে ছিল সেটা এখন জানা কথা, এছাড়াও সাদ্দাম হোসেন, মুয়াম্মার গাদ্দাফি এবং পশ্চিম ইউরোপের অনেক রাষ্ট্রই (যেমন হাঙ্গেরি) কার্লোসকে ব্যবহার ও আশ্রয় দিয়েছে। অব্যাহত এসব হামলার মুখে পশ্চিম ইউরোপের রাষ্ট্রগুলোর উপর আন্তর্জাতিক চাপ আসতে থাকে কার্লোসকে ধরিয়ে দিতে।

এখনো ফ্রান্সের আদালতে চলছে কার্লোসের বিচার; source: .dailymaverick

অবশেষে ‘৯৪ সালে সে সুযোগ আসে। কার্লোস তখন সুদানে আশ্রিত ছিল। ফরাসি ও মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সুদানি কর্তৃপক্ষের সাথে কার্লোসকে হস্তান্তরের চুক্তিতে পৌঁছায়। সুদানি কর্তৃপক্ষের নিয়োজিত দেহরক্ষীরাই রাতের বেলা ঘুমন্ত কার্লোসকে ট্রাঙ্কুলাইজার ব্যবহার করে অজ্ঞান করে ফরাসি গোয়েন্দাদের হাতে তুলে দেয়। ১৯৯৪ সালে ১৪ আগস্ট তাকে বিচারের জন্যে ফ্রান্সে আনা হয়। এরই সাথে শেষ হয় বিশ্বের মোস্ট ওয়ান্টেড এক আসামির ভয়ঙ্কর ক্যারিয়ার।

কার্লোসকে নিয়ে তৈরি হয়েছে বেশ কিছু মুভি ও ডকুমেন্টরি; source: imdb

কার্লোসের দুর্ধর্ষ কাহিনী নিয়ে তৈরী হয়েছে বিভিন্ন সিনেমা ও ডকুমেন্টারি। লেখা হয়েছে ৯টি বই, যার ভেতর কয়েকটি উপন্যাসও আছে। ‘৯৪ সাল থেকেই কার্লোস ফ্রান্সের কারাগারে রয়েছে, তার অপরাধের তালিকা এতই লম্বা যে, গত ২৫ বছর ধরেই তার বিচার চলছে। বাকি জীবন তাকে জেলে তো থাকতেই হবে, তবে তার জীবদ্দশায় এতগুলো অপরাধের বিচার শেষ করা যাবে কিনা, সেটাই প্রশ্ন।

ফিচার ছবি- telegraph.co.uk, wikimedia

Related Articles