Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

চৌধুরী চরণ সিং: কৃষক থেকে প্রধানমন্ত্রী হওয়া এক সাধু কিংবা পাপীর গল্প

প্রতিপক্ষ তাকে ‘চেয়ার সিং’ বলে ডাকতো। ভারতের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার দৃঢ় বাসনা নিয়ে ঠাণ্ডা মাথার কঠিন হৃদয়ের অধিকারী লোকটি ছিল ভীষণ বেপরোয়া আর দলদ্রোহী। নিজ মাতৃভূমিতে তার পরিচয় হয়েছিল ‘আয়া রাম-গায়া রাম’ নামে। ১৯৩১ সালে কংগ্রেসের পক্ষ থেকে মিরাট প্রদেশের সরকারি দলের সাধারণ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন তিনি। অল্প কিছুদিনের মধ্যে প্রাদেশিক শাসনকর্তা হওয়ার মোহে দলত্যাগ করে এমন সব উপাধি তো কুড়িয়েছিলেনই, পাশাপাশি মানুষের মনে বিশ্বাসঘাতক হিসেবেও একটি ইমেজ তৈরি করে ফেলেছিলেন।

কয়েক বছর পর আবারও কংগ্রেসে যোগদান করে ১৯৩৭ সালে উত্তর প্রদেশের বিধানসভার সদস্য হিসেবে জায়গা করে নেন। সবার মনে একটি বিষয় তখন ভালোভাবে গেঁথে গিয়েছিল যে, কংগ্রেসের সাথে এই ভদ্রলোকের ঘৃণা আর প্রেমের সম্মিলনে অদ্ভুত এক সম্পর্ক বিরাজমান। ১৯৬৭ সালে উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী হতে না পারার দুঃখে চিরদিনের মতো কংগ্রেস ছেড়ে দেন তিনি।

Image Source: jatland.com

ভক্তদের কাছে তার পরিচয় একজন নিষ্কলঙ্ক রাজনীতিবিদ হিসেবে, দুর্নীতি শব্দটি যার সাথে কোনোভাবেই যায় না। মানসিক দৃঢ়তা আর সততার প্রতিমূর্তিরূপী এমন মন্ত্রী সরদার প্যাটেলের পর ভারতের ইতিহাসে আর তেমন কাউকে পাওয়া যায়নি। দুর্নীতির সাথে আপোস করতে পারেননি বলেই বারংবার দল বদলের পথ বেছে নিতে হয়েছিল বলেই তারা দাবী করে। বলা হচ্ছিল চৌধুরী চরণ সিংয়ের কথা। কৃষক থেকে প্রধানমন্ত্রী হয়ে যিনি সাড়া জাগিয়েছিলেন সারা বিশ্বে।

চরণ সিংয়ের ভাষ্যমতে, তিনি ছিলেন চক্রব্যূহের (মহাভারত অনুযায়ী অভিমন্যু কুরুক্ষেত্রে চক্রাকার দুর্ভেদ্য সেনা-সমাবেশে ঢুকে একা হাতে অসংখ্য শত্রুসৈন্যকে বিনাশ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। এই চক্রাকার শত্রুপক্ষের ঘেরাওকে চক্রব্যূহ বলা হয়) মুখোমুখি দাঁড়ানো একাকী এক যোদ্ধা। শত্রু হিসেবে পুঁজিবাদী সমাজ, সমাজতান্ত্রিক মানসিকতা, এলিট বা অভিজাত শ্রেণী, তথাকথিত বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়কে চিহ্নিত করে গেছেন তিনি।

কে এই চরণ সিং, যার পেছনে শত্রুর এত লম্বা লাইন লেগে গেল? এই প্রশ্নের উত্তরে ফিরে তাকাতে হয় আজ থেকে ১১৭ বছর আগে। জনতা পার্টির লৌহমানব আর ইউনিয়ম হোম মিনিস্টার চরণ সিং ১৯০২ সালের ২৩ ডিসেম্বর বর্তমান উত্তর প্রদেশের নূরপুর নামক ছোট্ট একটি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন ‘জাত’ সম্প্রদায়ের সদস্য, ভারতের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে বসবাসকারী এক কৃষিজীবী সম্প্রদায়ের নাম জাত। হালচাষী আর সৈনিক হিসেবে জাতদের কদর থাকলেও সমাজের উচ্চশ্রেণীর কাছে তারা মানুষ বলেও গণ্য হতো না।

 Image Source: jatland.com

কথিত আছে, মস্তিষ্কের চেয়ে জাতরা নাকি মাংসপেশির যত্ন নিতেই বেশি পছন্দ করে। এই একটি লোকপ্রিয় কথা আজীবন বয়ে বেড়াতে হয়েছে ভারতের পঞ্চম প্রধানমন্ত্রী চৌধুরী সাহেবকে। প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর এক সংবাদ সম্মেলনে বলে ফেলেছিলেন,

“নিচু মানসিকতার লোকজনদের মুখে মুখে জাত-পাতের বিভেদ ক্রমেই ডালপালা ছড়াচ্ছে। আমার সারাটা জীবন কেটেছে এমন সব জঘন্য মন্তব্য শুনে।”

‘জাত সর্দার’ আখ্যাটি চৌধুরী চরণ সিংয়ের কানে কাঁটার মতো বিঁধত। যখনই তাকে জাতদের ব্যতিক্রম বলে ডাকা হতো, তিনি গোটা সম্প্রদায়ের হয়ে ফুঁসে উঠতেন। সুযোগের অভাবে এমন অনেক জাত সদস্যই তার অবস্থানে আসতে পারেননি, না হলে যোগ্যতা যে আর কারো ছিল না, তা কিন্তু নয়। তারপরও সেই জাতদের একাংশের কাছে তিনি কিংবদন্তীর নায়ক, আরেক অংশের কাছে সম্প্রদায়ের জন্য কাজ না করে নিজের বাহাদুরি দেখানো এক খলনায়ক।

“এমন একটি সময়ের কথা বলুন, যখন আপনাদের কথা না ভেবে নিজের স্বার্থ নিয়ে পড়েছিলাম আমি,” ভর্ৎসনাকারীদের উদ্দেশ্যে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেন চরণ সিং।

চৌধুরী সাহেব বড় হয়েছেন মধ্যবিত্ত এক কৃষক পরিবারে। স্থানীয় এক বিদ্যালয়ে পড়ালেখার পাঠ চুকিয়ে ভর্তি হন আগ্রা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১৯২৫ সালে সেখান থেকে মাস্টার্স শেষ করে আইন বিষয়ে পড়াশোনা শুরু করেন। ঘাজিয়াবাদে অনুশীলন শুরু করে ১৯২৯ সালে বড় পরিসরে কাজ করার উদ্দেশ্যে মিরাটে চলে আসেন তিনি। সেখান থেকেই কংগ্রেসের সাথে যোগাযোগ হয়। জাতীয় নানা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে অসংখ্যবার জেল খাটার অভিজ্ঞতাও হয়েছে।

Image Source: indiatoday.in

“পরিবারের কাছ থেকে কখনো বাধা পাইনি। যে বয়সে পরিবারকে আমার সাহায্য করার কথা, তখনো বাবা আমাকে পূর্ণ সমর্থন দিয়ে গেছেন,” বলেন তিনি।

এই একটি কারণেই গ্রামের প্রতি ভীষণ টান ছিল তার। মান্ধাতার আমলের দুর্নীতিগ্রস্ত এক রাজস্ব নিয়মের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছিলেন চরণ সিং। জমির উপর কৃষকদের মালিকানা প্রতিষ্ঠা করাই ছিল তার প্রধান লক্ষ্য। কর্তৃত্বপরায়ণ শাসকগোষ্ঠীর সামনে সমাজের নিপীড়িত শ্রেণীর অবস্থান তুলে ধরতে লিখেছেন বেশ কিছু বই, যার মধ্যে অন্যতম হলো ‘অ্যাবলিশন অফ জমিদারি’, ‘কোঅপারেটিভ ফার্মিং এক্স-রে’, ‘ইন্ডিয়া’স পোভার্টি অ্যান্ড ইট’স সল্যুশন’ আর ‘ল্যান্ড টু দ্য ওয়ার্কার্স’।

শৈশবে তার মনস্তাত্ত্বিক জগতে ঝড় তুলেছিল আর্য সমাজ। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরিয়ে আর্য সমাজের নানাবিধ কার্যকলাপের সাথে নিজেকে যুক্ত করেন তিনি। সেসব দিনের কথা স্মরণ করে তার স্ত্রী গায়েত্রি দেবী বলেন,

“চৌধুরী সাহেব ছিলেন আর্য সমাজের প্রেসিডেন্ট। আমি ছিলাম নারী দলের প্রেসিডেন্ট। আমার দেবর ছিল তরুণ আর্য সমাজের প্রেসিডেন্ট। আমাদের গোটা বাড়িটাই ছিল আর্য সমাজের আখড়া”।

Image Source: dailyhunt.in

আজীবন নীতির দিক থেকে খুব শক্ত ছিলেন তিনি। মেনে চলতেন জীবনযাপনের সঠিক রীতি। কখনো মদ পান করেননি, ছিলেন শাকাহারী, অধূমপায়ী। এমনকি জাতদের প্রতীক হুক্কাও কখনো ছুঁয়ে দেখেননি। যোগীদের মতো সহজ এক জীবনে অভ্যস্ত ছিলেন তিনি। তার জন্য দিন শুরু হতো ভোর সাড়ে চারটায়। জ্ঞানের প্রতি ছিলেন বুভুক্ষু। উত্তর প্রদেশের প্রধান সচিব বলেছিলেন,

“১৯৩৯ সালে চরণ সিং যখন অফিস সুপারিনটেন্ডেন্ট হিসেবে যোগ দিলেন, তখনই বইয়ে লেখা যাবতীয় নিয়ম-নীতি তার অক্ষরে অক্ষরে জানা ছিল”।

১৯৫১ সালের জুন মাসে উত্তর প্রদেশের ক্যাবিনেট মন্ত্রী হিসেবে ন্যায়বিচার এবং তথ্য বিভাগের দায়িত্ব দেয়া হয় তাকে। ১৯৫৯ সালে রাজস্ব ও পরিবহন বিভাগের মন্ত্রী থাকাকালীন অবস্থায় তিনি পদত্যাগ করেন। ইন্দোর কংগ্রেসের এক অধিবেশনে সমবায় কৃষির বিরুদ্ধে কথা বলে নেহ্‌রুর বিরাগভাজন হয়ে পড়েন তিনি। প্রগতিবিরোধী হিসেবে তাকে চিহ্নিত করেন জওহরলাল নেহ্‌রু। পরবর্তীতে ১৯৬০ সালে চন্দ্রবানু গুপ্তের গৃহ এবং কৃষি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নিয়ে আবারও ক্যাবিনেট মন্ত্রী হিসেবে ফিরে আসেন চরণ সিং। ১৯৬৭ সালে সংযুক্ত বিধায়ক দল গঠন করে কংগ্রেস ছেড়ে বেরিয়ে আসেন তিনি। পরের বছর পুনরায় সংসদের জন্য নতুন নির্বাচনের দাবী জানান। ১৯৬৯ সালে ভারতীয় ক্রান্তি দল নামে নতুন একটি দল গঠন করে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে ৯৮ আসনে জয়লাভ করে তার দল।

Image Source: indiatimes.com

১৯৭৭ সালের লোক সভা নির্বাচনে জনতা পার্টির ব্যানারে অংশগ্রহণ করেন চৌধুরী চরণ সিং। রাজ নারায়ণের সহায়তায় ১৯৭৯ সালে তিনি প্রধানমন্ত্রীর পদ অলংকৃত করেন। ক্ষমতায় আসার ঠিক ২৪ সপ্তাহ পর তিনি পদত্যাগ করেন। কারণ ইন্দিরা গান্ধীর কংগ্রেস পার্টি এই সরকারের প্রতি যাবতীয় সহায়তা প্রত্যাহার করে নেয়। চরণ সিং অবশ্য বলেন, ইন্দিরা গান্ধীর জরুরি অবস্থা সংক্রান্ত আদালতি ঝক্কি না পোহানোর জন্য আপোষেই তিনি ক্ষমতা ছেড়ে দেন। ছয় মাস পরে পুনরায় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে ক্ষমতায় আসেন রাজীব গান্ধী। আর ১৯৮৭ সালে মৃত্যুর আগপর্যন্ত লোক দলের প্রধান হিসেবে দায়িত্বে ছিলেন চরণ সিং।

এক পুত্র, পাঁচ কন্যা আর তাদের ছেলেমেয়ে সহ বিশাল এক খানদানের অধিকারী ছিলেন তিনি। কথোপকথনে চরণ সিং খুবই রক্ষণশীল ছিলেন। ব্যক্তিজীবনে আচারনিষ্ঠ এবং নিয়মাবদ্ধ এই রাজনীতিবিদ বুদ্ধিজীবী সমাজকে প্রকৃতপক্ষে বুদ্ধি খাটিয়ে সমাজের উপকারে আসতে বারবার উদ্বুদ্ধ করতেন। উচ্চাভিলাষী চরণ সিং ভারতের পিছিয়ে পড়া জাত সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব করে অন্য সব সংখ্যালঘুদেরও দেখিয়ে দিয়েছেন ইচ্ছে থাকলে দেশের প্রধানমন্ত্রী হওয়াও অসম্ভব কিছু না। কৃষক দিবসে এখনও তাকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করা হয় গোটা ভারত জুড়ে।

This article is in Bangla language. It's main focus is on Chaudhary Charan Singh, 5th Prime Minister of India.

References have been hyperlinked inside the article.

Feature Image: indiatimes.com

Related Articles