Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

ডালডা ১৩: ভারতের প্রথম নারী ফটোসাংবাদিক

নারী হয়ে এগিয়ে যাওয়ার গল্প লেখাটা কিন্তু খুব একটা সহজ বিষয় ছিল না কোনোকালেই। কেবল নারীই নয়, সমাজের চোখে এবং সমাজের মানুষের চোখে একটু অন্যরকম আর দুর্বল। পিছিয়ে পড়া মানুষগুলো সবসময়ই আরো পিছিয়ে গিয়েছে কেবল। সে মানুষটি নারীই হোক কিংবা পুরুষ। মনিষীরা বলেছেনও তো তেমনটাই। জানিয়ে গিয়েছেন যে, টিকে থাকার লড়াইয়ে যে সেরা সেই জিতবে, টিকে থাকবে। প্রশ্ন হল, সেরা কি কেবল শারীরিক শক্তি কিংবা স্বাভাবিকত্বের মাধ্যমে হয়? মোটেও না। তবে সে কথা বুঝতে অনেক সময় লেগেছে মানুষের। সর্বত্র এই কথাগুলো ছড়িয়ে দিতে প্রয়োজন আরো একটু বেশি সময়ের। তবে নারীদের জন্য এই পথের শুরুটা যারা করে দিয়ে গিয়েছিলেন তাদের কথা না বললেই নয়। আর নারীদের পথিকৃৎ হয়ে কাজ করেছেন এমন এক মানুষের কথাই আজ বলবো আপনাকে। তার নাম হোমাই ভিয়ারাওয়ালা। ভারতের প্রথম নারী ফটো জার্নালিস্ট বা ফটো সাংবাদিক।

ডালডা ১৩ বা হোমাই ভিয়ারাওয়ালা; Source: The Better India

অবাক হচ্ছেন? ভাবছেন লেখাটা ডালডা ১৩ কে নিয়ে, তাহলে এর মধ্যে হোমাই ভিয়ারাওয়ালা এলো কোথা থেকে? আলোকচিত্রশিল্পী হিসেবে বিখ্যাত ভারতের ডালডা ১৩ এবং হোমাই ভিয়ারাওয়ালা আলাদা কেউ নন। দুজনই এক ব্যক্তি। নিজের ছদ্মনাম হিসেবে ডালডা ১৩ কে বেছে নিয়েছিলেন হোমাই। নিজের ছদ্মনাম হিসেবে এমন একটি নাম কেন বেছে নিলেন তিনি? কারণ আর কিছু না, হোমাইয়ের জীবনে ১৩ শব্দটির বারবার উপস্থিতিই এর একমাত্র কারণ। হোমাইয়ের জন্ম ১৯১৩ সালে, তিনি বিয়ে করেন ১৩ বছর বয়সে, এই আলোকচিত্রী মাত্র ১৩ বছর বয়সে প্রথম ছবি তুলেছিলেন। সবশেষে প্রথম গাড়ি কেনার পর সেটার পেছনেও নম্বর লেখা দেখেন হোমাই ডিএলডি-১৩। ব্যস, জন্ম হলো এক নতুন ছদ্মনামের।

আলোকচিত্র নেওয়ার সময় হোমাই; Source: YouTube

ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের শেষের দিনগুলো এবং স্বাধীনতা পরবর্তী সময়গুলোকে নিজের ক্যামেরায় ধরে রাখেন হোমাই। না, সেভাবে কখনোই খুব একটা খ্যাতি কিংবা পরিচিতি পাননি। তবে তাই বলে থেমে যাননি তিনি। একটি নতুন রাষ্ট্র এবং তাকে ঘিরে চলা আশা-হতাশা, সবকিছু নিজের ক্যামেরায় ধারণ করেন এই শিল্পী। ১৯১৩ সালে গুজরাটের নাভসারিতে জন্মগ্রহণ করেন হোমাই। হোমাই খুব একটা ধনী পরিবারের সন্তান ছিলেন না। হোমাইয়ের বাবা ছিলেন উর্দু-পার্সি মঞ্চের একজন অভিনেতা। তবে ঘরে যতই অভাব থাকুক, মেয়েকে তার পছন্দের জায়গায় পড়তে বা কাজ করতে বাধা দেননি হোমাইয়ের বাবা-মা।

ছবি তোলা তাকে শেখান প্রেমিক মানেকশো ভিয়ারাওয়ালা। তবে ছবিকে দেখতে চোখ দরকার হয়। শিল্পীর সেই চোখ তৈরিতে হোমাইকে সাহায্য করেছে স্যার জে. জে স্কুল অব দ্য আর্টস। কেবল তা-ই নয়, ‘লাইফ’ ম্যাগাজিনের একবার পড়ে বেচে দেওয়া সংখ্যাগুলো পড়তেন হোমাই, দেখতেন সেগুলোকে। সেগুলোর মধ্যে ছাপা হওয়া আধুনিকতাবাদী আলোকচিত্র বা মডার্নিস্ট ফটোগ্রাফও ছিল হোমাইয়ের প্রেরণা। প্রথমদিকে যে কেবল নিজের তোলা ছবিগুলো ছাপতে সংকোচবোধ করেছেন এই আলোকচিত্রী তা-ই নয়, সেগুলোকে ছেপেছেন তার প্রেমিক মানেকশোর নামে। পরিচিত ছিলেন না হোমাই, তার উপরে ছিলেন নারী। খুব বেশি আশা তখনও দেখেননি তিনি। ‘ইলাস্ট্রেটেড উইকলি’ ও ‘বোম্বে ক্রনিকল’ ম্যাগাজিনগুলোতে সেসময় তার তোলা নাগরিক জীবন এবং আধুনিক তরুণীদেরকে নিয়ে তোলা তার আলোকচিত্রগুলোর নিচে ছিল মানেকশোর নাম। ১৯৪২ সালে ব্রিটিশ ইনফরমেশন সার্ভিসে যোগ দিতে দিল্লী চলে যান হোমাই।

হোমাইয়ের লেন্সে গান্ধীর চলে যাওয়া; Source: The Saffronart Blog

সেখানেই বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ আলোকচিত্র তোলেন এই শিল্পী। কংগ্রেস সদস্যরা তখন ভারত বিভাগের জন্য ভোট দিচ্ছিলেন। সেই মুহুর্তের ছবি তুলে নেন হোমাই। স্বাধীনতার সময় নতুন দেশের একটু একটু করে গড়ে ওঠা, বাঁধ ও স্টিল প্ল্যান্ট নির্মাণ, বিংশ শতকে ভারতে আগত বিখ্যাত সব মানুষ, এই যেমন- রেজা শাহ পাহলাভী, মার্টিন লুথার কিং, জুনিয়র হো চি মিন, মার্শাল টিটো, ব্রেজনাভ এবং ক্রুশেভের মতন রাশিয়ান নেতা। এদের সবাইকে নিজের ক্যামেরায় তুলে নিয়েছেন হোমাই। ১৯৫৬ সালে ভারতে তরুণ দালাই লামা প্রথম পা রাখলে তার ছবি তোলেন তিনি টাইম-লাইফের জন্য। সেসময় ভারতের ‘অনলুকার’ এবং ‘কারেন্ট’ এর মতো বিখ্যাত ম্যাগাজিনগুলো হোমাইকে অনুরোধ করে তাদের জন্য সুদর্শন নারীদের আলোকচিত্র তুলতে। ফলে এরপর এক এক করে রানী এলিজাবেথ এবং আমেরিকার ফার্স্ট লেডি জ্যাকি কেনেডির ছবি স্থান পায় সেসময়ের ম্যাগাজিনগুলোতে।

হোমাইয়ের ১০৪ তম জন্মদিনে গুগলের ডুডল; Source: Asia Inc 500

ছবি তোলার সময় শাড়ি পরতেন হোমাই। কখনোই তাকে শাড়ি ছাড়া ছবি তুলতে দেখা যায়নি। যদিও তৎকালীন পার্সি সমাজে যথেষ্ট পশ্চিমা হাওয়া লেগেছিল। বিশেষ করে হোমাই যে পরিবারের বাসিন্দা সেখানে তো অবশ্যই শাড়ির পাশাপাশি অন্যসব পোশাক পরতে অভ্যস্ত ছিলেন নারীরা। তবে হোমাই শাড়িকেই বেছে নিয়েছিলেন। সমস্ত পুরুষ আলোকচিত্রীর পাশে একমাত্র নারী হিসেবেই হয়তো এমন এক পোশাক বেছে নিয়েছিলেন তিনি। তবে তার এই বেশভূষার কারণেই সহকর্মীদের কাছে হাসির পাত্র হয়ে পড়েন হোমাই। তার ডাক নাম হয়ে যায়- ‘মাম্মি’। এ সময় একটু একটু করে বেশ পরিচিত হয়ে পড়েন হোমাই।

আলোকচিত্রী হিসেবে বেশ নাম হয় তার। হোমাইয়ের সবচাইতে পছন্দের বিষয় ছিলেন জওহরলাল নেহেরু। নিজের ছবির বিষয়বস্তুর উপরে সম্পূর্ণ সম্মান রেখেই কাজ করতেন হোমাই। হোমাইয়ের সবচাইতে বিখ্যাত আলোকচিত্রগুলোর একটি হচ্ছে গান্ধীর শেষকৃত্যের ছবি। ১৯৪৮ সালে তোলা তার এই ছবিগুলো অনেক বেশি পরিচিতি এনে দেয় তাকে। সাদাকালো নিয়ে কাজ করতে বেশি ভালোবাসতেন হোমাই। নিজের ছবিগুলোকে প্রস্তুত করতেন তিনি নিজেই। ভাবতেন, একবর্ণের ছবিগুলো অনেকদিন টিকে থাকে। কথাটি মিথ্যা নয়। হোমাইয়ের তোলা ছবিগুলো স্থান-কাল-পাত্রভেদে টিকে আছে এখনও।

বৃদ্ধা হোমাই; Source: Sunday Guardian

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কাছাকাছি সময়ে ১৯৩০ সালে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে কাজ শুরু করেন হোমাই। ‘দ্য ইলাস্ট্রেটেড উইকলি অফ ইন্ডিয়া’তে প্রথম কাজ করেন হোমাই। আর নিজের এই পুরো পেশাগতজীবনে অর্জন করে নেন অনেকগুলো পুরস্কার। ২০১১ সালে অর্জন করেন রাষ্ট্রীয় সম্মানজনক দ্বিতীয় বেসামরিক পুরস্কার ‘পদ্ম বিভূষণ’। প্রতিটি শিল্পীর পেছনে থাকে কারো না কারো অনুপ্রেরণা। হোমাইয়ের ক্ষেত্রে এই অনুপ্রেরণা ছিলেন মানেকশো জামশেতজি ভিয়ারাওয়ালা। একসময়ের প্রেমিক, পরবর্তীতে স্বামী হয়ে পাশে ছিলেন সারাজীবন হোমাইয়ের। ‘টাইমস অফ ইন্ডিয়া’ এ কর্মরত ছিলেন মানেকশো হিসাবরক্ষক এবং আলোকচিত্রী হিসেবে। তার মৃত্যু হয় ১৯৭০ সালে। মানেকশোর মৃত্যু থামিয়ে দেয় হোমাইকে। ছবি তোলা ছেড়ে দেন তিনি। আধুনিক নানা রকম সংস্কৃতি এবং হলুদ সাংবাদিকতার সাথে তাল মেলাতে চাননি হোমাই।

শেষযাত্রায় হোমাই ভিয়ারাওয়ালা; Source: Getty Images

ছেলে ফারুকের সাথে ১৯৮২ সালে তৎকালীন বারোদায় চলে যান তিনি। ১৯৮৯ সালে মাত্র ১৫ বছর বয়সে একমাত্র ছেলে ক্যান্সারে ভুগে মৃত্যুবরণ করলে আরো একা হয়ে পড়েন হোমাই ভিয়ারাওয়ালা। নিজের ছোট্ট এপার্টমেন্টেই ছোটোখাট বাগান বানিয়েছিলেন তিনি। সময় কাটতো সেখানেই। এর মধ্যে শরীরটা যে হালকা খারাপ হচ্ছিলো না তা নয়। তবে বেঁচে থাকার যুদ্ধ করে যাচ্ছিলেন হোমাই। ২০১২ সালের ১৫ই জানুয়ারি সেই যুদ্ধ শেষ হয়। মারা যান অদ্ভুত ‘দেখার ক্ষমতা’ নিয়ে জন্ম নেওয়া হোমাই ভিয়ারাওয়ালা। তার ১০৪ তম জন্মদিন উপলক্ষ্যে গত বছর, ২০১৭ সালে গুগল ডুডল তৈরি করে, যার নাম দেওয়া হয়- ‘ফার্স্ট লেডি অফ দ্য লেন্স’।

ফিচার ইমেজ: Storypick

Related Articles