Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website. The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

ডেমোক্রিটাস: পারমাণবিক তত্ত্বের আদি পিতা

“যে ব্যক্তি প্রাণ খুলে হাসতে জানে, নিজের প্রতি বিশ্বাস ও প্রত্যয়ের সাথে তার গভীর যোগ রয়েছে। কোনো প্রকার নেতিবাচকতা, অবিশ্বাস কিংবা আত্মবিশ্বাসহীনতা তাকে ছুঁতে পারে না!”- ডেমোক্রিটাস

প্রাণ খুলে হাসার উপকারিতা আমাদের সকলেরই জানা। তবে এর উপর প্রায় আড়াই হাজার বছর পূর্বেই গুরুত্বারোপ করে গেছেন ডেমোক্রিটাস। শারীরিক এবং মানসিকভাবে সুস্থ থাকতে হলে প্রাণ খুলে হাসার কোনো বিকল্প দেখেন না তিনি। সেজন্যই তো তাকে বলা হয় ‘দ্য লাফিং ফিলোসফার’ তথা সদা হাস্যময় দার্শনিক। তবে তার এই পরিচিতি অধিকাংশের নিকটই উদ্ভট ঠেকবে। কারণ তার দার্শনিক পরিচয় ছাপিয়ে গেছে তার অমর বৈজ্ঞানিক চিন্তাভাবনাগুলো, যেগুলো তাকে ইতিহাসে একজন দার্শনিক হিসেবেই প্রতিষ্ঠিত করেছে। পরমাণুবাদকে আধুনিক রসায়নের প্রাণ কিংবা ভিত্তি যা-ই বলা হোক না কেন, এর চিরাচরিত উন্নয়নের ধারা সেই প্রাচীন পৃথিবীতে বসে শুরু করে দিয়ে গিয়েছিলেন ডেমোক্রিটাস। সে ধারাই আজ চরম আধুনিক রূপ লাভ করেছে। এই ধারার শুরুটা জানতে হলে জানতে হবে ডেমোক্রিটাসকে।

ডেমোক্রিটাসের কাল্পনিক ছবি (৪৬০-৩৭০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ); image source: edu.glogster.com

প্রাচীন গ্রিসের অ্যাবদেরা নামক শহরে ৪৬০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে জন্মগ্রহণ করেন ডেমোক্রিটাস। প্রাচীন যুগে জন্ম নেয়া অপরাপর বিজ্ঞানীদের মতো তার জীবনীও যথাযথরূপে লিখিত হয়নি। বিভিন্ন দার্শনিক এবং ইতিহাসবিদের লেখার উদ্ধৃতিতে মিল/অমিল দুটোই রয়েছে। তবে সকলের উদ্ধৃতির সাধারণ ও অবিতর্কিত অংশটিকেই প্রামাণিক ধরে নিয়ে আলোচনা করবো আমরা।

ডেমোক্রিটাস বেশ ধনাঢ্য এক পরিবারে জন্মেছিলেন। কৈশোরে তার বাবা মারা গেলেও অর্থাভাবের মুখ দেখতে হয়নি তাকে। তিনি একরকম স্বশিক্ষিতই ছিলেন বলাচলে। প্রাচীন গ্রিক দার্শনিক ও বিজ্ঞানী থেলিস এবং পিথাগোরাসকে তিনি নিজের জীবনের আদর্শ মনে করতেন। তাদের পদচিহ্ন অনুসরণ করতেই তিনি কৈশোরেই ভ্রমণ শুরু করেন। প্রথমেই তিনি বিশ্ব ভ্রমণে বের হন। খুব সম্ভবত ভারতবর্ষেও এসেছিলেন একবার। এরপর ব্যাবিলন হয়ে পুরো গ্রিস ভ্রমণ করে নিজের জন্মস্থানে ফিরে আসেন। সদা হাস্যোজ্জ্বল এই মানুষটি মনে করতেন, ক্ষণস্থায়ী জীবনের প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিৎ সুখ। আর তার এই ভ্রমণপর্ব যতটা না ছিল জ্ঞান লাভের জন্য, তার চেয়ে বেশি ছিল সুখের অন্বেষণ।

ডেমোক্রিটাসের জন্মস্থান অ্যাবদেরার ধ্বংসাবশেষ; image source: visitgreece.gr

তবে সুখ লাভ করার জন্য অনৈতিক কোনো কিছুকে প্রশ্রয় দিতেন না ডেমোক্রিটাস। নিজের মনের উপর তার ছিল অগাধ নিয়ন্ত্রণ। বেশি বেশি খাওয়া, মদ্যপান কিংবা যৌনতার মাঝে তিনি সুখ খুঁজে পেতেন না। বরং তার নিকট সুখের সংজ্ঞা ছিল নতুনত্বের খোঁজ। প্রতিনিয়ত নতুন নতুন তথ্য ও জ্ঞান উদঘাটনই তার জন্য আনন্দদায়ক ব্যাপার ছিল।

গভীরভাবে চিন্তা করার জন্য অধিকাংশ সময় তিনি একা থাকার চেষ্টা করতেন। পৃথিবীকে তলিয়ে দেখার পথে বাঁধা হতে পারে ভেবে তিনি বিয়েই করেননি। অভিজ্ঞতা আর চিন্তাভাবনা প্রসূত সকল জ্ঞানই তিনি লিখে রাখতে পছন্দ করতেন। সমসাময়িক সময়ে তাকে শ্রেষ্ঠ লেখক বলে গণ্য করা হতো। তিনি সর্বদাই এই ভেবে তৃপ্ত হতেন যে তার লিখে যাওয়া বই গুলো যুগ যুগান্তর জ্ঞানপিপাসুদের জ্ঞানের তৃষ্ণা মেটাবে। অথচ ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, তার সমসাময়িক যেসব লেখক নিজেদের লেখায় তার কথা লিখে গেছেন, তাদের অনেক বই টিকে গেলেও ডেমোক্রিটাসের কোনো বই-ই যে আজ অবধি টিকে নেই!

তার লেখাগুলো ইতিহাস থেকে সম্পূর্ণরূপে বিলীন হয়ে যাবার পেছনে কারণ একটা অবশ্য রয়েছে। ডেমোক্রিটাসের অতিমাত্রায় মুক্ত চিন্তা ও দর্শনই তার জন্য কাল হয়েছিল। তার সময়ে প্লেটোর দর্শনের দোর্দণ্ড প্রতাপ ছিল। প্লেটো মনে করতেন মানুষকে কিছু শৃঙ্খলের মধ্যে থাকতে হবে এবং অবশ্যই পরিবার প্রতিপালন করতে হবে। কিন্তু ডেমোক্রিটাস মনে করতেন মানুষের ইচ্ছাশক্তি স্বাধীন হওয়া উচিৎ এবং কেউ পরিবারের বন্ধ ছিন্ন করতে চাইলে সেটিও তার ব্যাপার। উপরন্তু ডেমোক্রিটাস ঈশ্বরেও বিশ্বাস করতেন না। ‘ন্যাচারাল ল’ তত্ত্বের একেবারে প্রথম দিকের একজন বিশ্বাসী ছিলেন তিনি। আর এ কারণে সমাজের একটা বড় অংশ মনে মনে তার প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে ওঠে। ৩৭০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে জন্মস্থানেই মৃত্যুবরণ করেন ডেমোক্রিটাস। তার মৃত্যুর পর তার দর্শনের প্রতি বিরূপ মত পোষণকারীরা তার লেখাগুলোর প্রচার বা সংরক্ষণের কোনো ব্যবস্থাই করেনি। উপরন্তু সেগুলো ধ্বংসে তাদের হাত রয়েছে বলেই মনে করা হয়।

নিরেট পরমাণুতে বিশ্বাস করতেন ডেমোক্রিটাস; image source: sutori.com

ডেমোক্রিটাসের নাম সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত হয় যে কারণে তা হলো তার পারমাণবিক তত্ত্ব। সৌভাগ্যক্রমে তার এই তত্ত্বটি অনেকটাই মৌলিকরূপে টিকে আছে বিভিন্ন প্রাচীন গ্রিক দার্শনিক এবং বিজ্ঞানীর লেখায়। বিশেষ করে অ্যারিস্টটলের লেখায় ডেমোক্রিটাসের পারমাণবিক তত্ত্বের মৌলিক অংশটিই পাওয়া যায়। মজার ব্যাপার হলো, অ্যারিস্টটল ডেমোক্রিটাসের পারমাণবিক তত্ত্ব বিশ্বাস করতেন না। তথাপি এই তত্ত্বকে ভুল প্রমাণ করতেই তিনি তার লেখায় এর উল্লেখ করেন। ভাগ্যিস অ্যারিস্টটল এই তত্ত্বে বিশ্বাস করতেন না!
ডেমোক্রিটাসের পারমাণবিক তত্ত্ব

  • পৃথিবীর তাবৎ বস্তুসমগ্র ‘অ্যাটমোস’ (ইংরেজিতে অ্যাটম) দিয়ে তৈরি। গ্রিক শব্দ অ্যাটমোস অর্থ যে ক্ষুদ্র সত্ত্বা ভাঙা যায় না।
  • কোনো বস্তুর ক্ষুদ্রতম কণাই হচ্ছে পরমাণু যা খালি চোখে দেখা যায় না।
  • পরমাণু চির বিরাজমান। এদের ধ্বংস নেই।
  • পরমাণু অদৃশ্য এবং এদেরকে আলাদা করে ধরা যায় না কিংবা ক্ষুদ্রতর অংশে ভাগ করা যায় না।
  • পরমাণুর মাঝে শূন্যস্থান থাকে, যে কারণে পরমাণু স্বাধীনভাবে চলাচল করতে পারে।
  • পরমাণু নিখুঁতভাবে নিরেট এবং এদের ভেতরে ফাঁপা থাকে না।
  • পরমাণু চিরকালই গতিশীল ছিল এবং থাকবে।
  • এদের গতি পরস্পরের মাঝে সংঘর্ষের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে।
  • এরা সংখ্যায় অসীম।
  • পরমাণুর আকার আকৃতি ও ওজনের বিস্তর তারতম্য রয়েছে। ভিন্ন ভিন্ন পদার্থের পরমাণু ভিন্ন প্রকৃতির হয়।
  • দুটি পরমাণু পরস্পর বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারে।
  • পরমাণুর বন্ধনের ফলেই ভৌত বস্তুর সৃষ্টি।
  • বস্তুর ভৌত পরিবর্তন হয় পরমাণুর গতিশীলতার জন্য।

এবার আপনি এই তত্ত্ব নিয়ে হাজারটা প্রশ্ন তুলতে পারেন। পরমাণু ভাঙা যায় না, পরমাণুই ক্ষুদ্রতম কণা কিংবা পরমাণু নিরেট, এসব ভুল তথ্য দেখেই যদি ডেমোক্রিটাসের এই তত্ত্বকে ফেলে দেন, তাহলে ইতিহাসের সাথে অবিচার করবেন বৈকি। আজ থেকে প্রায় আড়াই হাজার বছর পূর্বে, পরমাণু নামক ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কোনো কণিকার কথা কেউ ভাবতে পেরেছে সেটিই কি বিস্ময়কর নয়? তার উপর পরমাণুর গতিশীলতা আর পারমাণবিক বন্ধনের ব্যাপারে আলোচনা রীতিমতো অবিশ্বাস্য। অথচ পরমাণু নিয়ে নতুন কোনো তথ্য পেতে আমাদের অপেক্ষা করতে হয়েছে ১৯ শতক পর্যন্ত। তখন পর্যন্ত অনেক নামকরা বিজ্ঞানীই বিশ্বাস করতেন পরমাণু বলতে কিছু নেই। ১৯০৫ সালে আধুনিক যুগের বিজ্ঞানীদের মধ্যে প্রথম আইনস্টাইনের ব্রাউনিয়ান গতি সংক্রান্ত গবেষণায় উঠে আসে যে কোনো ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কণার সংঘর্ষ ঘটছে। এরপর রাদারফোর্ডের স্বর্ণপাত পরীক্ষায় প্রথম বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত হয় যে পরমাণু বলতে আসলেই সূক্ষ্ম অদৃশ্য কিছু একটা আছে। অথচে ডেমোক্রিটাস সেই কথা বলে গেছে ২ হাজার বছর আগে।

২০ শতকের শুরুর দিকে রাদারফোর্ডের স্বর্ণপাত পরীক্ষা পরমাণুর অস্তিত্ব প্রমাণ করে; image source: ca.wikipedia.org

তবে ডেমোক্রিটাসের এই পারমাণবিক তত্ত্ব নিয়ে আধুনিক ইতিহাসবিদগণের মাঝে মতপার্থক্য দেখা দেয়। অনেকেই মনে করেন ডেমোক্রিটাসের পারমাণবিক তত্ত্বটি তার নিজের মৌলিক কাজ নয়। ডেমোক্রিটাসের শিক্ষক লিউসিপাসের দাঁড় করানো একটি তত্ত্বের পরিবর্ধিত এবং উন্নত রূপই ডেমোক্রিটাসের তত্ত্ব। অনেকে এর সাথে ইপিকিউরাসের নামও জুড়ে দিতে চান। লিউসিপাস আর ইপিকিউরাসেই শেষ নয়। ডেমোক্রিটাসের পারমাণবিক তত্ত্বের সাথে জুড়ে আছে প্রাচীন ভারতীয় বিজ্ঞানী কানাদার নামও। খুব সম্ভবত খ্রিস্টপূর্ব ৬০০-২০০ অব্দের মাঝে তার জন্ম। তিনি নিজের মতো করে একটি পারমাণবিক তত্ত্ব দিয়েছিলেন যেটিতে ডেমোক্রিটাসের কোনো প্রভাব ছিল না। ‘কানাদা সূত্র’ নামক একটি গ্রন্থে তিনি তার পারমাণবিক তত্ত্ব লিখেছিলেন। তার সংজ্ঞা অনুযায়ী, কোনো পদার্থকে ভাঙতে থাকলে এমন একপর্যায়ে পৌঁছবে যখন সেটিকে আর ভাঙা সম্ভব হবে না। আর সেটিই হবে পরমাণু। মাটি, পানি, বায়ু এবং আলো- এই চার প্রকারের পরমাণুর উল্লেখ করেন কানাদা!

প্রাচীন ভারতীয় বিজ্ঞানী কানাদার কাল্পনিক ছবি; image source: pinterest.co.uk

জ্যোতির্বিদ্যায়ও যথেষ্টই আগ্রহ ছিল ডেমোক্রিটাসের। তিনি দীর্ঘদিন পৃথিবীর ছায়াপথ আকাশগঙ্গা পর্যবেক্ষণ করার পর সিদ্ধান্ত দেন যে, আমাদের দৃশ্যমান ছায়াপথ মূলত অসীম সংখ্যক তারকার ক্ষীণ আলো দ্বারা গঠিত, যা কি না দিনের বেলা সূর্যের প্রখর আলোর কারণে আমাদের চোখে ধরা দেয় না। ২ হাজার বছর পূর্বে প্রাচীন গ্রিসে বসে এরূপ সিদ্ধান্ত দেয়া সত্যিই বিস্ময়ের যোগাড় করে।

অন্যদিকে সৃষ্টিতত্ত্ব নিয়ে ডেমোক্রিটাসের বিশ্বাস ছিল অসীমত্ব। তার মতে, কোনো কিছুরই কোনো শুরু ছিল না, নেই কোনো শেষ। যা কিছু আমরা দেখতে পাই, সবই পরমাণুর গতি ও সংঘর্ষের ফসল। এর বাইরেও পিরামিড ও কোণকের আয়তন নির্ণয় নিয়েও কিছু কাজ করেন ডেমোক্রিটাস। তবে দর্শন কিংবা সৃষ্টিতত্ত্ব, সবকিছু ছাপিয়ে তার পারমাণবিক তত্ত্ব চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।

ফিচার ছবি: yohabloytuhablas.blogspot.com (ছবিটি নিশ্চিতভাবেই ডেমোক্রিটাসের নয়। তার প্রকৃত ছবি ইতিহাসে সংরক্ষিত হয়নি)

Related Articles