Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

অ্যাডগার অ্যালান পো: রহস্যের আড়ালে বিষণ্ণতার গল্প

অ্যাডগার অ্যালান পো, একজন ইংরেজ কবি, ছোটগল্প লেখক, সাহিত্য সমালোচক এবং ইংরেজি সাহিত্যে প্রথম বিজ্ঞান কল্পকাহিনী ও গোয়েন্দা গল্পের স্রষ্টা। তার লেখা গল্প, উপন্যাস এবং কবিতার মাঝের ভৌতিকতা এবং রহস্যের আবহাওয়া আজও অপ্রতিদ্বন্দ্বী। তাই তো তার নাম শুনলেই প্রথমে মাথায় চলে আসে খুন, রহস্যময় কোনো কাক, জীবন্ত কবর এবং মৃত্যুর পর ফিরে আসা অদ্ভুত কোনো মহিলার ছবি। নীল চোখের এবং কালো কোট পরা বিষণ্ণ চেহারার এই মানুষটির রহস্যময় মৃত্যু এবং সংগ্রাম ও বিচিত্রতায় ভরা জীবনও পাঠকদের আকৃষ্ট করে সমানভাবে। আর আজ বলা হবে তারই গল্প।

১৮০৯ সালের ১৯ জানুয়ারি বোস্টনে এলিজাবেথ আর্নল্ড পো এবং ডেভিড পো জুনিয়র অভিনয়শিল্পী দম্পতির পরিবারে জন্ম নেন অ্যাডগার অ্যালান পো। সংস্কৃতিমনা এই দম্পতি শেক্সপিয়ারের ‘কিং লিয়ার’ থেকে ছেলের নাম রাখেন অ্যাডগার। জন্মের তিন বছরের মাথায় মা মারা গেলে তার কিছুদিন পর তার বাবা তাকে সহ তার তিন ভাইবোনকে ফেলে রেখে চলে যান। এরপর জন অ্যালান নামের একজন ধনী তামাক ব্যবসায়ী অ্যাডগার অ্যালান পোকে তার নিঃসন্তান পরিবারে দত্তক নেন এবং তার অন্যান্য ভাইবোনেরা অন্যান্য জায়গায় থাকতে চলে যায়। ছোটবেলা থেকেই পো লেখাপড়ায় বেশ মেধাবী ছিলেন। জন অ্যালান চাইতেন, ছেলে বড় হয়ে তার মতো ব্যবসায়ী হবে। কিন্তু সংস্কৃতিমনা বাবা-মায়ের বীজ রয়ে গিয়েছিল তার মাঝে। তাই অল্প বয়সেই তিনি ইংরেজ কবি লর্ড বায়রনের বিশেষ ভক্ত হয়ে ওঠেন এবং তার মাঝে লেখক হওয়ার স্বপ্ন জেগে ওঠে।

তরুণ অ্যাডগার অ্যালান পো; Source: mnn.com

১৮২৬ সালে অ্যাডগার অ্যালান পো রিচমন্ড ছেড়ে ভার্জিনিয়া আসেন ‘ইউনিভার্সিটি অফ ভার্জিনিয়ায়’ পড়তে। সেখানে গিয়ে তাকে পড়তে হয় চরম দারিদ্র‍্যের মুখে। কারণ ভার্জিনিয়ায় থাকতে যে টাকার প্রয়োজন ছিল, জন অ্যালান তাকে তার মাত্র এক-তৃতীয়াংশ টাকা দিয়েছিলেন। কাজেই খরচ যোগাতে তিনি তখন জুয়া খেলা শুরু করেন এবং আরো নিঃস্ব হয়ে যান। কয়েক মাসের মধ্যে তার দারিদ্র্য এমন পর্যায় পৌঁছে যে শীত থেকে বাঁচার জন্য তাকে তার আসবাবপত্র পোড়াতে হয়। চারিদিকে দেনা, দারিদ্র্যের লজ্জা এবং জন অ্যালানের প্রতি ক্ষোভে পো তখন বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে দিয়ে রিচমন্ড ফিরে আসতে বাধ্য হন। কিন্তু সেখানে তার জন্য অপেক্ষা করছিল আরো হৃদয়বিদারক ঘটনা। ফিরে এসে তিনি দেখেন তার প্রেমিকা সারাহ (এলমিরা রোস্টার) এর বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। ক্ষুব্ধ মন নিয়ে তিনি আবার বোস্টন চলে আসেন।

বোস্টনে এসে তিনি একটি বায়রনিক কবিতার ছোট বই প্রকাশ করেন। কিন্তু এখানেও অর্থাভাব জেঁকে ধরে তাকে। দারিদ্র‍্যের হাত থেকে বাঁচার জন্য তিনি যোগ দেন আর্মিতে এবং নিজের নাম বদলে রাখেন অ্যাডগার এ. পেরি। কিন্তু তার সৎ মা মারা যাওয়ার পর জন আল্যান তাকে আর্মি থেকে সরিয়ে এনে ওয়েস্ট পয়েন্টে মিলিটারি একাডেমিতে ভর্তি করিয়ে দেন। সেখানে মন না বসায় তিনি সেখান থেকে বের হওয়ার জন্য বিভিন্ন কলাকৌশল শুরু করেন এবং অবশেষে এক সপ্তাহ টানা ড্রিল ক্লাস বাদ দেয়ার ফলে মিলিটারি একাডেমি থেকে তাকে বের করে দেওয়া হয়। মিলিটারি একাডেমি থেকে বের হয়ে তিনি এবার চলে আসেন নিউইয়র্কে এবং প্রচুর ইংরেজি সাহিত্য ও কবিতা পড়া শুরু করেন।

অ্যাডগার অ্যালান পোর ১৩ বছর বয়সী স্ত্রী ভার্জিনিয়া ক্লেম; Source: womenhistoryblog.com

নিউইয়র্ক থেকে এরপর পো চলে আসেন বাল্টিমোরে এবং এখানে এসে তার জীবনের মোড় অনেকটা ঘুরে যায়। ছোটগল্প লেখা শুরু করেন তিনি। ১৮৩৩ সালে তার ‘মিস ফাউন্ড ইন অ্যা বটল’ বইটি প্রকাশিত হয় এবং বইটি ‘বাল্টিমোর উইকলি’ থেকে ৫০ ডলার পুরষ্কারও জেতে। একই সালে তিনি রিচমন্ডের ‘সাউদার্ন লিটারেরি মেসেঞ্জার’ এ সম্পাদক হিসেবে যোগ দেন এবং সাহিত্য সমালোচক হিসেবে বিশেষ সুনাম অর্জন করেন। আর এ সময়ই তিনি তার ফুপাতো বোন ভার্জিনিয়া ক্লেমের সঙ্গে ভালোবাসার সম্পর্কে জড়িয়ে যান, অতঃপর তারা বিয়েও করেন। বিয়ের সময় অ্যাডগার অ্যালান পোর বয়স ছিল ২৭ এবং ভার্জিনিয়ার বয়স ছিল ১৩।

ভার্জিনিয়া এবং পোর সুখের সংসার থাকলেও চিরচেনা দারিদ্র্য কখনোই পিছু ছাড়েনি তার। কষ্ট ভুলতে তাই একসময় মদ খাওয়া শুরু করেন তিনি এবং এ দোষেই তার চাকরি চলে যায়। চাকরি হারিয়ে তিনি রিচমন্ড থেকে আবার নিউইয়র্ক চলে আসেন, কিন্তু মদের নেশা আর ছাড়তে পারেন না। আর এ নেশাই তখন তার জীবনের জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়। বেশ কিছু যায়গায় জনসম্মুখে মাতলামি করে মাতাল হিসেবে নামও হয়ে যায় তার। এমন অবস্থায় ১৮৩৮ সালে তিনি তার ‘দ্য ন্যারেটিভ অফ আর্থার গরডন প্যম’ বইটি প্রকাশ করেন এবং ১৮৩৯ সালে তিনি ফিলাডেলফিয়ায় ‘বার্টনস জেন্টেলম্যানস ম্যাগাজিন’ এ সহ-সম্পাদক নিযুক্ত হন। একই সালেই তার ‘টেলস অফ গ্রোটেক্স অ্যান্ড অ্যারাবস্ক’ বইটিও প্রকাশিত হয়।

অ্যাডগার অ্যালান পোর কালজয়ী কবিতা ‘দ্য র‍্যাভেন’; Source: mentalfloss.com

১৮৪০ সালে তিনি তার চাকরিটি ছেড়ে দেন এবং ‘গ্রাহামস লেডিস অ্যান্ড জেন্টেলম্যান’ থেকে ইতিহাসের প্রথম গোয়েন্দা উপন্যাস ‘দ্য মার্ডার ইন দ্য রিউ মর্গ’ প্রকাশ করেন। ১৮৪৩ সালে তার ‘দ্য গোল্ড বাগ’ গল্পটি ফিলাডেলফিয়ার ‘ডলার নিউজপেপার’ থেকে ১০০ ডলার পুরষ্কার জিতলে এটি তাকে বেশ জনপ্রিয়তা এনে দেয়। ১৮৪৪ সালে তিনি আবার নিউইয়র্কে ফিরে আসেন এবং ১৮৪৫ সালের ২৯ জানুয়ারি ‘আমেরিকান রিভিউ’ থেকে তার কালজয়ী কবিতা ‘দ্য র‍্যাভেন’ প্রকাশিত হয়। এটি রাতারাতি তাকে দেশজোড়া খ্যাতি এনে দেয়। এর পর বিভিন্ন পত্রিকায় তিনি বেশকিছু ছোটগল্প এবং আরো কিছু বিখ্যাত লেখা প্রকাশ করেন। ভৌতিক এবং রহস্য গল্পের জন্য তার খ্যাতি বাড়তে থাকে।

কিছু সময়ের জন্য সুখের মুখ দেখলেও এরপর আবার ঝড় নেমে আসে পোর জীবনে। ১৮৪৭ সালের জানুয়ারি মাসে একটি সেমিনারে বক্তৃতা দিতে তিনি যখন শহরের বাইরে ছিলেন, এমন সময় তার স্ত্রী ভার্জিনিয়া টিউবারক্যুলোসিসে মারা যান। পোর জীবনে নেমে আসে বিষণ্ণতার আরেকটি গাঢ় অধ্যায়। মৃত স্ত্রীর স্মৃতি ভোলার জন্য তিনি নিউইয়র্ক ছেড়ে চলে আসেন এবং বাউন্ডুলের মতো বহু জায়গায় ঘুরে বেড়াতে থাকেন। ঘুরতে ঘুরতে প্রভিডেন্স রুধ আইল্যান্ডে তার দেখা হয়ে যায় প্রাক্তন প্রেমিকা সারাহ এর সাথে। সারাহও তখন বিধবা অবস্থায় ছিলেন, কয়েক বছর আগে স্বামী মারা গিয়েছিল তার। সারাহকে পেয়ে তখন পোর কষ্ট কিছুটা লাঘব হয়। সারাহ তাকে তার আর্থিক এবং মানসিক বিধ্বস্ত অবস্থা কাটিয়ে উঠতে নানাভাবে সাহায্য করেন এবং একসময় তারা বিয়ের সিদ্ধান্তও নেন। কিন্তু বিয়ের মাত্র দশদিন আগে ১৮৪৯ সালের ৭ই অক্টোবর অ্যাডগার অ্যালান পোর আকস্মিক মৃত্যু হয়।

মিসেস সেইন্ট লিওন লাউডের উদ্দেশে পোর লেখা শেষ চিঠি; Source: biography.com

অ্যাডগার অ্যালান পোর মৃত্যু নিয়ে রয়েছে বেশ কিছু বিচিত্র ঘটনা। তিনি যখন মারা যান তখন তিনি ফিলাডেলফিয়া যাচ্ছিলেন একটি কবিতার বই সম্পাদনার জন্য। তার লেখা শেষ চিঠিটি ছিল কবি মিসেস সেইন্ট লিওন লাউডের উদ্দেশে, যেখানে তিনি তার সাথে একটি মিটিংয়ের সময় ঠিক করেছিলেন। যেদিন তার রিচমন্ড ছেড়ে ফিলাডেলফিয়ার উদ্দেশে রওনা হওয়ার কথা, তার আগের রাতে তিনি অসুস্থ হয়ে যান এবং তার ডাক্তার বন্ধু জন কার্টারের বাসায় যান। জন তাকে আরো কয়েক সপ্তাহ রিচমন্ড থেকে যাওয়ার পরামর্শ দেন। কিন্তু জনের কথা না শুনে পরের দিনই তিনি ফিলাডেলফিয়ার উদ্দেশে রওনা দেন।

রওনা দেওয়ার পর বেশ কয়েকদিন পোর আরো কোনো খোঁজ পাওয়া যায় না। এরপর হঠাৎ করেই তার মৃত্যুর ঠিক চারদিন আগে তাকে খুঁজে পাওয়া যায় রায়ানস ফোর্থ ওয়ার্ডের নির্বাচনের দিন নির্বাচন কেন্দ্রে। সেদিন সেখানে ভোট জালিয়াতি চলছিল। বেশকিছু ভোট জালিয়াতরা সাধারণ মানুষদের ধরে এনে এনে তাদের দলে ভোট দিতে বাধ্য করছিল এবং মারপিট করছিল। পোকে সেখানে অবচেতনভাবে পড়ে থাকতে দেখা যায় এবং এর চারদিন পরেই তার মৃত্যু হয়। অনেকের মতে, তিনি সন্ত্রাসীদের হামলার শিকার হয়েছিলেন আর এ কারণেই হয়ত পরবর্তীতে তার মৃত্যু হয়। পোর কয়েকজন বন্ধু গুজব ছড়ায় পো ভোটকেন্দ্রে মাতাল অবস্থায় ছিল। এছাড়াও পোর প্রতিদ্বন্দ্বী কবি উইলমোট গ্রিসল্ড পোর মৃত্যুর পর একটি শোক সংবাদ লেখেন যেখানে তাকে মাতাল, নারীদের প্রতি আসক্ত, অদ্ভুত এবং বেশ বাজে চরিত্রের একজন মানুষ হিসেবে তুলে ধরা হয়। পোর সৎকার অনুষ্ঠানে মাত্র সাতজন মানুষ উপস্থিত ছিল।

লিজ্জি ডোটেন, যিনি দাবি করেছিলেন পোর ভূত তাকে কবিতা বলে দিয়ে জায়; Source: pinimg.com

এছাড়াও তার মৃত্যুকে ঘিরে বেশ কয়েকটি ভৌতিক কাহিনীও জানা যায়। তার প্রিয় পোষা বিড়াল ছিল, যেটিকে তিনি প্রায় সময়ই তার কাঁধের উপর রেখে লিখতেন। তার মৃত্যুর পর যখন তার শাশুড়িকে যখন মৃত্যু সংবাদটি দেওয়া হয় তিনি বিড়ালটিকে মৃত অবস্থায় খুঁজে পান। পোকে নিয়ে সবচেয়ে অদ্ভুতুড়ে ব্যপারটি হলো মৃত্যুও তার লেখালেখি থামাতে পারেনি! ১৮৬০ সালে লিজ্জি ডোটেন নামের একজন মহিলা কবি বেশ কিছু কবিতা প্রকাশ করেন এবং তিনি দাবি করেন পোর প্রেতাত্মা তাকে কবিতাগুলো বলে গিয়েছেন। এ কথা শোনার পর পোর বাগদত্তা সারাহ ওই মহিলার সাথে যোগাযোগ করেন এবং তার সাথে থাকতে চলে যান এই ভেবে যে, হয়ত সেই প্রেতাত্মা তার সাথেও যোগাযোগ করবে!

ফিচার ইমেজ- ©Rjrazar1

Related Articles