আমি তাকে আর কারো সাথে তুলনা করতে পারি না। কারণ তার মতো এত বিশেষ গুণসম্পন্ন মানুষ আমি আর দেখিনি। তার মধ্যে আছে দৃঢ় সংকল্প, কিন্তু মোটেও নাটুকে নয়। আমি তার মাঝে অর্থের পেছনে ছোটার মোহ দেখি না। সে একজন সন্ন্যাসীর মতো। তার মাঝে লোকদেখানো ভাব নেই।
- হেনরি কিসিঞ্জার
আমি জানতাম সে আলাদা। সে কোনো জটিল প্রায়োগিক সমস্যাকে যে অভিনব দৃষ্টিতে দেখতো তা ছিল অনন্য।
- চ্যানিং রবার্টসন (সাবেক প্রফেসর, কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়)
ডাক্তারের কাছে গেলে রোগ নির্ণয়ের জন্য রক্ত পরীক্ষা করা খুবই সাধারণ ঘটনা। রোগজীবাণু, কোলেস্টেরল বা গ্লুকোজ পরীক্ষা করার জন্য শরীর থেকে রক্ত নেয়া হয় হাতে সুই দিয়ে ফুটো করে ডিসপোজেবল সিরিঞ্জের মধ্যে। ছোট বাচ্চারা অনেকেই এই সিরিঞ্জ দেখলে ভয় পায়। প্রবীণ মানুষদের কাছ থেকেও এভাবে রক্ত নেয়া ঝামেলার বিষয়। তাই যদি এমন পদ্ধতি বের করা হয়, যেখানে মাত্র একটি ছোট চিকন সুই দিয়ে রক্ত বের করা হয় এবং এক ফোঁটা রক্ত থেকেই এই পরীক্ষা করা যায়, তাহলে কেমন হবে? এমনই এক উদ্ভাবনী বিষয় আমাদের কাছে নিয়ে এসেছিলেন একজন।
হেনরি কিসিঞ্জার আর চ্যানিং রবার্টসন যাকে নিয়ে এত প্রশংসা করেছিলেন, তিনিই সেই মানুষ। নাম তার এলিজাবেথ হোমস। তিনি ছিলেন বায়োটেক কোম্পানি ‘থেরানোস’ এর প্রধান কার্যনির্বাহী কর্মকর্তা। পাঁচ বছর আগেও তাকে বলা হতো ‘দ্বিতীয় স্টিভ জবস’। সিলিকন ভ্যালির অন্যতম সুপারস্টার মনে করা হতো তাকে। কিন্তু এখন তাকে সবাই একজন প্রতারক ও মিথ্যাবাদী হিসেবেই জানে। কীভাবে তিনি তারকাখ্যাতি পেলেন, আর কীভাবে তার পতন ঘটলো তা নিয়েই আজকের লেখা।
জন্ম ও শৈশব
এলিজাবেথ হোমস ১৯৮৪ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি ওয়াশিংটন ডিসিতে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা চতুর্থ ক্রিশ্চিয়ান হোমস ইউএসএআইডিতে কাজ করতেন। মা নোয়েল হোমস ছিলেন কংগ্রেশনাল কমিটির কর্মী। তারা ছিলেন পারিবারিকভাবেই ধনী এবং রাজনৈতিক প্রভাবশালী ব্যক্তিত্বদের কাছের মানুষ।
তার দাদার দাদা প্রথম ক্রিশ্চিয়ান হোমস ছিলেন একজন সার্জন। তার নামে ইউনিভার্সিটি অব সিনসিনাটি মেডিকেল সেন্টারে একটি হাসপাতাল আছে। আট বছর বয়সে এলিজাবেথ তার পরিবারের সাথে এই হাসপাতালে ঘুরতে যান। সেখানে প্রথম ক্রিশ্চিয়ান হোমসের ব্যাপারে জানতে পেরে ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন দেখেন। কিন্তু তিনি সিরিঞ্জে রক্ত নিতে দেখা ভয় পেতেন। একসময় টের পেলেন, তিনি আসলে রক্ত দেখলেই ভয় পান। আর এই ভয়ই তাকে একসময় থেরানোস প্রতিষ্ঠায় সাহায্য করে।
তিনি ছোটবেলা থেকেই প্রচুর বই পড়তেন, ছিলেন খুব মেধাবী। সাত বছর বয়সে একটি টাইম মেশিনের ডিজাইন আঁকার চেষ্টা করেছিলেন। নয় বছর বয়সে মান্দারিন ভাষা শেখেন। স্কুলে পড়ার সময়ই লেখাপড়ার পাশাপাশি ব্যবসাতেও হাত পাকিয়ে ফেলেন। তিনি চীনা স্কুলগুলোর কাছে সি++ কম্পাইলার বিক্রি করেন। এটি ছিল এমন একপ্রকার সফটওয়্যার, যা কম্পিউটার কোড অনুবাদ করতে পারতো। স্কুলে পড়ার সময় স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি প্রোগ্রামে চীনের বেইজিং যাওয়ার সুযোগ পান। সেখানে তার সাথে পরিচয় হয় পাকিস্তানি বংশদ্ভূত সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার সানি বালওয়ানির। এই সানিই পরে এলিজাবেথের থেরানোস কোম্পানির গুরুত্বপূর্ণ পদে আসেন।
ছোটবেলা থেকেই এলিজাবেথ কতটা উচ্চাভিলাষী ছিলেন তার প্রমাণ পাওয়া যায় নয় বছর বয়সে বাবার কাছে পাঠানো একটি চিঠি থেকে।
আমি জীবনে সত্যিকার অর্থে যা করতে চাই তা হচ্ছে, নতুন কিছু আবিষ্কার করা যা মানবজাতির কাছে মনে হতো অসম্ভব।
স্ট্যানফোর্ডে গমন
২০০১ সালে এলিজাবেথ স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন করেন এবং তার আবেদন মঞ্জুর হয়। তিনি কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পড়া শুরু করেন। ভর্তির পর তিনি 'প্রেসিডেন্ট’স স্কলার্স; এর তালিকায় নির্বাচিত হন। এতে তিনি ৩,০০০ ডলার পান গবেষণা প্রকল্পে খরচ করার জন্য। তার ডিপার্টমেন্টের প্রফেসর ছিলেন চ্যানিং রবার্টসন। রবার্টসনের কাছে এলিজাবেথ আবদার করেন তার বৃত্তির অর্থের বিনিময়ে তাকে যেন গবেষণার কাজে ল্যাব ব্যবহার করতে দেয়া হয়। তখন সেটা ছিল শুধুমাত্র পিএইচডি শিক্ষার্থীদের জন্য। কিন্তু এলিজাবেথ জোর করায় অবশেষে তাকে সুযোগ দেন প্রফেসর।
সেই বছর গ্রীষ্মের ছুটিতে এলিজাবেথ সিঙ্গাপুরের জিনোম ইন্সটিটিউটের ল্যাবে যান শিক্ষানবিশ হিসেবে। সেখানে রক্তের মধ্যে সিভিয়ার একিউট রেস্পিরেটরি সিনড্রোম ভাইরাস বা এসএআরএস ভাইরাস শনাক্ত করার কাজ করেন। তার স্ট্যানফোর্ডের ল্যাবে কাজ করার অভিজ্ঞতা থেকে দেখেন, রক্তে জীবাণু শনাক্ত করার কাজ আরো সহজে করা সম্ভব।
সিঙ্গাপুর থেকে আমেরিকায় ফিরে তিনি পেটেন্ট আবেদন লেখা শুরু করেন। পাঁচ-ছয় দিন এটা নিয়ে কাজ করেন এবং প্রতি রাতে মাত্র ১-২ ঘন্টা ঘুমান। তার বাবা-মা তখনই বুঝতে পেরেছিলেন যে, তিনি ব্যবসা শুরু করবেন। তাদের অনুমান সঠিক প্রমাণ করে তিনি একটি কোম্পানি চালু করেন, নাম দেন ‘রিয়েল টাইম কিউরস’।
থেরানোস এর যাত্রা
এলিজাবেথ যখন রবার্টসনকে ব্যবসার কথা বলেন, রবার্টসন তাকে ডিগ্রী শেষ করে ব্যবসা শুরু করতে বলেন। কিন্তু এলিজাবেথ বলেন, তিনি এখনই ভিন্ন কিছু করতে চান। তিনি রবার্টসনকে তাঁর কোম্পানির প্রথম বোর্ড সদস্য মনোনীত করেন। তাঁকে অনুরোধ করেন সপ্তাহে একদিন তাঁর কোম্পানিতে সময় দিতে। এলিজাবেথ তখন কোম্পানির কাজে সময় দিতে থাকেন। ২০০৪ সালের মার্চে তিনি স্ট্যানফোর্ড থেকে ড্রপ আউট হয়ে যান এবং পুরোটা সময় কোম্পানিতে দেয়া শুরু করেন। তাঁর পড়াশোনার জন্য মা-বাবার জমানো টাকাটা তখন কোম্পানির পেছনে খরচ করেন।
তার আইডিয়া ছিল একটি পরিধানযোগ্য প্যাচ এর মাধ্যমে ক্রমাগত একটি নির্দিষ্ট জায়গার রক্ত পরীক্ষা করতে থাকা এবং ওষুধের সঠিক ডোজ বের করা। পরে তিনি এটাকে আরো পরিবর্ধিত করেন। তার কোম্পানি থেকে ‘এডিসন’ নামে একটি যন্ত্র নিয়ে আসেন। এটি দিয়ে রক্তে প্রায় ৭০ রকমের বস্তু শনাক্ত করা যাবে বলে দাবি করেন। শুধু তা-ই নয়, এজন্য সুই দিয়ে মাত্র ১-২ ফোঁটা রক্ত নেয়া হবে শরীর থেকে। সাধারণত সিরিঞ্জ দিয়ে যেখানে ৩,০০০-৫,০০০ মাইক্রোলিটার রক্ত নেয়া হয়, এই পদ্ধতিতে মাত্র ২৫-৫০ মাইক্রোলিটার রক্ত নিয়েই কাজ করা হতো।
এই পদ্ধতিতে প্রথমে একটি ছোট সুই দিয়ে আঙুল থেকে ১-২ ফোঁটা রক্ত একটি কার্ট্রিজের মধ্যে নেয়া হতো। কার্ট্রিজ থেকে ছোট নলে রক্ত সংগ্রহ করা হতো। এলিজাবেথ এর নাম দেন ‘ন্যানোটেইনার’। এরপর সেখান থেকে এডিসন ডিভাইসের মাধ্যমে বিভিন্ন রক্ত পরীক্ষার ফলাফল নির্ণয় করা হতো। এর ফলে রক্ত পরীক্ষার খরচও অনেক কমে আসে। এর আগে রক্তে কোলেস্টেরল পরিমাপের জন্য যেখানে ৫০ ডলার বা তারও বেশি খরচ হতো, সেখানে এলিজাবেথ এই খরচ নামিয়ে আনেন মাত্র ২ ডলার ৯৯ সেন্টে। তাঁর প্রযুক্তি কীভাবে কাজ করতো তা কখনো প্রকাশ করতেন না। বলতেন, এটা প্রতিদ্বন্দ্বীরা যেন জানতে না পারে সেই কারণে ব্যবসায়িক গোপনীয়তার মধ্যে রাখা হয়। আর গোপনীয়তার মধ্যেই ছিল তাঁর প্রতারণা।
ইতোমধ্যে কোম্পানির নাম পরিবর্তন করে রাখেন ‘থেরানোস’। থেরানোস নামটি নেয়া হয় ‘থেরাপি’ ও ‘ডায়াগনোসিস’ শব্দ দুটি থেকে। তাঁর বাবার সাথে প্রভাবশালী ব্যক্তিদের ভালো জানাশোনা থাকায় তিনি বড় বড় বিনিয়োগকারীদের সাথে সহজেই যোগাযোগ করতে পারেন। এছাড়া রবার্টসনও তাঁকে বিভিন্ন বিনিয়োগকারীর সাথে পরিচয় করিয়ে দেন। প্রথম দশ বছর তিনি বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে পুঁজি জোগাড় করতে থাকেন।
শুরুতে তাঁর বাবার প্রতিবেশী ও পারিবারিক বন্ধু বিলিয়নিয়ার টিম ড্রেপার এক মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেন। ২০০৪ সালের মধ্যে এলিজাবেথ ৬.৯ মিলিয়ন ডলার জোগাড় করেন। ২০০৫ সালে ১৬ মিলিয়ন ডলার, ২০০৬ সালে ২৮.৫ মিলিয়ন ডলার এবং ২০১৪ সালে ৪০০ মিলিয়ন ডলার পান। এ সময় থেরানোস হয়ে যায় ৯ বিলিয়ন ডলারের কোম্পানি। এলিজাবেথ হয়ে যান ৪.৫ বিলিয়ন ডলারের মালিক। এর ফলে তিনি ফোর্বসের লিস্টে সবচেয়ে কম বয়সী নারী বিলিয়নিয়ার হয়ে যান।
এই সময়ে থেরানোসে অনেক বড় বড় বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগ করেন। তাদের মধ্যে ওয়ালমার্ট পরিবার ১৫০ মিলিয়ন ডলার, রূপার্ট মারডক ১২৫ মিলিয়ন ডলার, বেটসি ডেভোস ১০০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেন। তার বোর্ড সদস্যরাও ছিলেন অভিজাত শ্রেণীর মানুষ। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হেনরি কিসিঞ্জার, জেনারেল জেমস ম্যাটিস, জর্জ শুল্টজ, উইলিয়াম ফ্রিস্ট প্রমুখ। বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে অর্থ নেয়ার সময় তাদের শর্ত দিয়ে দিতেন যে, তার কাজের পদ্ধতি তারা জানতে পারবেন না।
এসময় থেরানোসের সাথে ক্যাপিটাল ব্লু ক্রস ও ক্লিভল্যান্ড হাসপাতালের মধ্যে চুক্তি হয়। তারা তাদের রোগীদের থেরানোসের টেস্ট করানোর জন্য রেফার করে। ওয়ালগ্রিন ফার্মেসি কোম্পানির সাথেও তাদের চুক্তি হয় বিভিন্ন স্থানে থেরানোসের সেন্টার প্রতিষ্ঠা করার জন্য। এছাড়া সেফওয়ের সাথেও থেরানোসের ৩৫০ মিলিয়ন ডলারের একটি গোপন চুক্তি হয়।
স্টিভ জবসের সাথে তুলনা
এলিজাবেথ হোমস মনে-প্রাণে স্টিভ জবসকে ধারণ করতেন। তিনি স্টিভ জবসকে অনুকরণ করতেন। তার মতো করে কালো গলবদ্ধ পোশাক পড়তেন। কখনো ছুটি নিতেন না। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত ঘুমানোর সময়টুকু বাদে পুরোটা সময়ই অফিসে কাটাতেন। জবসের মতো তিনিও ছিলেন নিরামিষভোজী। জবসের মতো তিনিও কর্মক্ষেত্রে চরম গোপনীয়তা বজায় রাখতেন।
তার অফিসে কর্মীদের মধ্যে একজনের কাজ নিয়ে অন্যজনের কাছে আলাপ করা নিষেধ ছিল। কর্মীদের নিয়োগ দেয়ার সময় অঙ্গীকারনামা নেয়া হতো কাজের গোপনীয়তা রক্ষার ব্যাপারে। একই কাজ করা হতো চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হলে। তিনি অ্যাপলের বিজ্ঞাপনী ফার্মকে নিজেদের বিজ্ঞাপনের জন্য নিয়োগ দেন। এমনকি অ্যাপলের অনেক সাবেক কর্মীকে থেরানোসে নিয়ে আসেন। যদিও দুই বছরের মধ্যেই তারা থেরানোস ছেড়ে চলে যান।
স্টিভ জবস সিলিকন ভ্যালিতে যে কাজ করছিলেন ব্যক্তিগত কম্পিউটার নিয়ে, একই কাজ করছিলেন এলিজাবেথ হোমস স্বাস্থ্যখাতে। তিনি চাইতেন প্রতি ঘরে থেরানোসের ডিভাইস পৌঁছে দিতে। ২০১৩ সালে থেরানোস যখন আলোচনায় আসে, এলিজাবেথ হোমসকে তখন স্বাস্থ্যখাতের স্টিভ জবস বলে ডাকা শুরু হয়। ফরচুন, ফোর্বস, ইঙ্ক ম্যাগাজিনের কভার পেজে ছাপা হয় তার ছবি। টেড টকেও বক্তৃতা দেন তিনি। কিন্তু এরপর থেকেই প্রকাশ পেতে থাকে তার প্রতারণার কাহিনী।
থেরানোসের পতন
২০১৪ সালের ডিসেম্বরে নিউ ইয়র্কার ম্যাগাজিনে এলিজাবেথ হোমসকে নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এতে এলিজাবেথের সাফল্য কাহিনী শোনানো হলেও একজনের মনে সন্দেহের দানা বাঁধে। তিনি দুইর পুলিৎজার পুরষ্কারজয়ী ওয়ালস্ট্রিট জার্নালের সাংবাদিক জন ক্যারিরু। তার কাছে এলিজাবেথের ব্যবসায়িক গোপনীয়তা রক্ষার প্রবণতা রহস্যজনক মনে হয়।
এলিজাবেথের স্বাস্থ্য বিষয়ে জ্ঞান বা অভিজ্ঞতা কোনোটিই নেই। থেরানোসের বোর্ড সদস্যদেরও মাত্র একজন ছিলেন ডাক্তার। স্টিভ জবস, বিল গেটস বা মার্ক জাকারবার্গ ড্রপ আউট হলেও তাদের ক্ষেত্র ছিল প্রযুক্তি নিয়ে। কিন্তু স্বাস্থ্যখাতে বড় কিছু করতে গেলে সেখানে অনেক বছরের অভিজ্ঞতা ও জ্ঞান থাকা প্রয়োজন। কারণ এই খাতের সাথে মানুষের জীবনও জড়িত। তাই ক্যারিরু এলিজাবেথের ব্যাপারে একটু খতিয়ে দেখার সিদ্ধান্ত নেন। পরে জানতে পারেন, শুধু তিনিই নন আরো অনেকেই আছেন যারা এলিজাবেথকে নিয়ে সন্দিহান।
এলিজাবেথ হোমস তার কোম্পানিতে রাজনৈতিক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের আনতে পারলেও স্বাস্থ্যখাত সম্পর্কিত লোকদের আকর্ষণ করতে পারেননি। স্ট্যানফোর্ডে থাকাকালীন সময়ে এলিজাবেথ মেডিসিনের প্রফেসরদের কাছে তাঁর আইডিয়া নিয়ে যান। কিন্তু তারা মনে করেন এলিজাবেথের আইডিয়া বাস্তবসম্মত নয়। স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিনের প্রফেসর ফিলিস গার্ডনার তাকে বলেন, এভাবে রক্ত পরীক্ষায় সঠিক ফলাফল পাওয়া অসম্ভব। কারণ আঙ্গুলে সুই দিয়ে আঘাত করলে সেখানকার রক্তের কোষগুলো ভেঙে যায়। এর ফলে জীবাণুগুলো কোষ থেকে ইন্টারস্টিশিয়াল ফ্লুইডে চলে যায়। তাছাড়া এত অল্প পরিমাণ রক্ত থেকে নির্ভরযোগ্য ফলাফলও পাওয়া সম্ভব নয়।
ক্যারিরু জানতে পারেন, থেরানোসের এডিসন ডিভাইস দিয়ে সঠিক ফলাফল আসত না। থেরানোসে কাজ করতেন ব্রিটিশ বিজ্ঞানী ইয়ান গিবনস। তিনি বুঝতে পারেন, এডিসন ডিভাইসটি রোগীদের পরীক্ষা করার জন্য উপযোগী নয়। ক্যারিরু আরো অনুসন্ধানের মাধ্যমে জানেন, থেরানোস ওয়ালগ্রিনকে জানায় এডিসন ডিভাইস দিয়ে ২৫০টি টেস্ট করা সম্ভব। কিন্তু বাস্তবে ২৪০টিরও বেশি পরীক্ষা করা হতো সিমেন্সের ডিভাইস দিয়ে। এই ডিভাইস অন্যান্য কোম্পানিও ব্যবহার করতো। অল্প পরিমাণ রক্ত দিয়ে পরীক্ষার ফল সঠিকও আসতো না। ডাক্তার ও রোগীদের মধ্যে এটি নিয়ে প্রচুর বিভ্রান্তি দেখা দিত।
থেরানোসের সাবেক কর্মীদের সাথে কথা বলে ক্যারিরু জানতে পারেন, সেখানের কাজের পরিবেশ ছিল খুবই কড়া। ২০০৯ সালে থেরানোসে যোগ দেন বেইজিংয়ে এলিজাবেথের সাথে পরিচিত হওয়া সানি বালওয়ানি। তার মাইক্রোসফটে কাজ করার অভিজ্ঞতা ছিল। কিন্তু স্বাস্থ্যখাতে তার কোনো অভিজ্ঞতা ছিল না, যেহেতু তিনি ছিলেন সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার। কিন্তু তিনি যোগ দেন থেরানোসের প্রেসিডেন্ট ও চীফ অপারেটিং অফিসার হিসেবে। তিনি এর আগে থেরানোসে না থাকলেও এর সাথে পর্দার আড়ালে যুক্ত ছিলেন ভালোভাবেই। তিনি ছিলেন এলিজাবেথ হোমসের প্রেমিক।
জানা যায়, ২০০৫ সাল থেকেই তারা একসাথে থাকতেন। শুরুর দিকে এলিজাবেথকে তিনি আর্থিক সহায়তা দেন। বালওয়ানি থেরানোসে যোগ দিয়েই কর্মীদের জন্য ভীতিকর পরিবেশ সৃষ্টি করেন। যখন তখন কর্মীদের চাকরিচ্যুত করতেন। কর্মীদের সাথে তার ও এলিজাবেথের ব্যবহার ছিল খুবই খারাপ। কর্মীদের সিসিটিভিতে পর্যবেক্ষণ করতেন। ২০১৬ সালে এলিজাবেথ তাকে থেরানোস থেকে বের করে দেন। তখন তাদের বিচ্ছেদ হয়। এলিজাবেথ ও সানি তাদের যন্ত্রের সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে সবই জানতেন। কিন্তু বোর্ড সদস্য, বিনিয়োগকারী থেকে ব্যবসায়িক পার্টনার সবার কাছেই তথ্য গোপন করেছেন এবং মিথ্যা বলেছেন।
যেহেতু থেরানোস থেকে তাদের ডিভাইস বাইরে বিক্রি করা হতো না, তাই তাদের ফুড এন্ড ড্রাগ এডমিনিস্ট্রেশন বা এফডিএ এর অনুমোদনের প্রয়োজন ছিল না। তাদের ল্যাব পরিদর্শন করতে সরকারি অনুসন্ধানকারী দল গেলে তারা শুধু থেরানোসের যন্ত্রগুলোই দেখাত। কিন্তু গোপনে অন্য কোম্পানির ডিভাইসে সেগুলো পরীক্ষা করতো। রক্তকে দ্রবণে দ্রবীভূত করে ঘনত্ব কমিয়ে রক্তের পরিমাণ বাড়ানো হত। এতে সঠিক ফলাফল না-ও আসতে পারতো। কিছু কিছু রোগীর ভুল ফলাফল এসেছিলও। হয়তো বা অনেক রোগী এর কারণে ভুল চিকিৎসার শিকারও হয়েছে। বাস্তবে এলিজাবেথ হোমসের থেরানোসের ধারণা ছিল কেবল একটি তত্ত্বীয় ব্যাপার। তার কোনো বাস্তব ভিত্তি ছিল না।
২০১৫ সালের অক্টোবরে জন ক্যারিরু ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের প্রথম পৃষ্ঠায় থেরানোসকে নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করেন। এতে এলিজাবেথের সব ত্রুটির কথা প্রকাশ পায়। এলিজাবেথ তার বিরুদ্ধে আসা সব অভিযোগ অস্বীকার করেন। কিন্তু পরে এগুলোর প্রমাণ পাওয়া যায়। ২০১৬ সালে এফডিএ, সেন্টার ফর মেডিকেয়ার এন্ড মেডিকেইড সার্ভিস এবং সিকিউরিটিস এন্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন বা এসইসি থেরানোসের বিরুদ্ধে তদন্তে নামে। ব্যবসায়িক পার্টনাররা সবাই মামলা করে থেরানোসের বিরুদ্ধে।
২০১৬ সালে এলিজাবেথকে ল্যাব টেস্টিং ইন্ডাস্ট্রি থেকে ২ বছরের জন্য নিষিদ্ধ করা হয়। ২০১৮ সালের মার্চে তাকে পাঁচ লাখ ডলার জরিমানা করা হয়। গত সেপ্টেম্বরে থেরানোস বন্ধ করে দেয়া হয়। এলিজাবেথ হোমস ও সানি বালওয়ানির বিরুদ্ধে এখনো মামলা চলছে। তাদের দুজনেরই ২০ বছরের কারাদন্ড হওয়ার সম্ভাবনা আছে। সবচেয়ে দুঃখজনক ব্যাপার হলো, এলিজাবেথ এখনো তার অপরাধের জন্য ক্ষমা চাননি।
শেষ কথা
এলিজাবেথ হোমস যে ধারণাটি সবার সামনে নিয়ে এসেছিলেন, সেটি নিঃসন্দেহে মহৎ ছিল। কিন্তু তিনি এর সীমাবদ্ধতাগুলোকে স্বীকার না করে নিজের দম্ভকে প্রশ্রয় দিয়েছিলেন। আর সেগুলো সেগুলো ঢাকতে একের পর এক মিথ্যা বলেছেন, যা রূপ নিয়েছে বিশাল বড় প্রতারণায়। মিডিয়াও এর দায় এড়াতে পারে না। মিডিয়াতে কেবল তার কাজের অতিরিক্ত প্রশংসা করা হয়েছে।
উদ্যোক্তাদের উচিত হবে এ ঘটনা থেকে শিক্ষা নেয়া, নিজের ভুল থাকলে সেটা সবার কাছে স্বীকার করা। কারণ নিজের একটি দারুণ আইডিয়া ভুল প্রমাণিত হতেই পারে, এতে লজ্জার কিছু নেই। গত বছর জন ক্যারিরু এই গল্প দিয়ে 'ব্যাড ব্লাড' নামে একটি বই লিখেছেন। এই বই থেকে একই নামে চলচ্চিত্রও নির্মাণ হবে। এতে এলিজাবেথের ভূমিকায় অভিনয় করবেন জেনিফার লরেন্স।
This is a Bangla article about formar Theranos CEO Elizabeth Holmes. It contains about the rise and fall of theranos and Elizabeth herself.
Featured Image: Ethan Pines/The Forbes Collection.
References:
1.The rise and fall of Elizabeth Holmes, who started Theranos when she was 19 and became the world's youngest female billionaire before it all came crashing down. - Business Insider
2. This CEO is out for blood. - Fortune
3. Blood, Simpler. - The New Yorker
4. Exclusive: How Elizabeth Holmes's House of Cards Came Tumbling Down. - Vanity Fair
5. Everything You Need to Know About the Theranos Saga so far. - Wired
6. Theranos- Silicon Valley's Greatest Disaster. - Youtube