Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website. The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

এম্পেডোক্লিস: যিনি ভাবতেন ‘ভালোবাসা’ একটি মৌলিক বল!

“চাঁদ যখন সূর্যকিরণের (সূর্য ও পৃথিবীর মধ্য দিয়ে বোঝানো হয়েছে) নিচে দিয়ে যায়, তখন এর ব্যাসের সমান অনুপাতের একটি এলাকা পৃথিবীতে অন্ধকার হয়ে যায়।”
– এম্পেডোক্লিস

সূর্যগ্রহণের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে এই উক্তিটি করেছিলেন এম্পেডোক্লিস। যদিও তিনি পৃথিবীকে ধরেছিলেন সৌরজগতের কেন্দ্রে; আর সূর্যকে তিনি ভাবতেন একটি বিশাল আগুনের গোলা, যেটি পৃথিবীর চারিদিকে ঘুরছে। তার এই ভাবনা ভুল হলেও সূর্যগ্রহণ সম্পর্কিত তার ব্যাখ্যা ছিল নির্ভুল। কেননা, চাঁদের দ্বারা সূর্যরশ্মি আটকে গেলেই গ্রহণ সংঘটিত হয়। তাই তার সৌরমডেল ভুল হলেও, তার গ্রহণ সম্পর্কিত ব্যাখ্যা জ্যোতির্বিজ্ঞানকে এগিয়ে দিয়েছিল বহুদূর।

সূর্যগ্রহণের প্রক্রিয়া; Source: exploratorium.edu

তখনকার সময়ে আলোর গতিকে অসীম ধরা হতো। জ্যোতির্বিদরাও মনে করতেন, সূর্য উদয়ের সাথে সাথেই আলো এসে আমাদের চোখে পৌঁছায়। কিন্তু এম্পেডোক্লিস এর বিরোধিতা করেন। তার মতে, আলোর গতি অসীম হতে পারে না। কেননা, সূর্যের আলো পৃথিবীতে পৌঁছানোর পূর্বে, পৃথিবী আর সূর্যের মাঝে বিশাল শূন্যস্থানে প্রবেশ করে। তারপর পৃথিবীতে পৌঁছায়। বলা হয়ে থাকে, তিনি জেনোর ‘ডাইকাটমি প্যারাডক্স’ বা দ্বিবিভাজন ধাঁধা দ্বারা প্রভাবিত হয়ে এই তত্ত্বে পৌঁছেছিলেন। আলোর গতি সম্বন্ধীয় তার এই পর্যবেক্ষণের প্রশংসা করেছিলেন অ্যারিস্টটলও।

মাটি, পানি, বায়ু এবং আগুন, এই চারটি উপাদানকে অবিনশ্বর বলে গণ্য করতেন এম্পেডোক্লিস। তার মতে, এগুলো হচ্ছে মৌলিক পদার্থ, যেগুলোর সমন্বয়ে সমগ্র মহাবিশ্ব গড়ে উঠেছে। ব্যাপারটা আজকে যতই হাস্যকর মনে হোক না কেন, এক দিক থেকে চিন্তা করলে আপনি দেখবেন যে, এম্পেডোক্লিস একটি চমৎকার কাজ করেছেন। তিনি সমগ্র মহাবিশ্ব যে কিছু মৌলিক পদার্থে সৃষ্টি হয়েছে, সে ব্যাপারটিতে অন্তত আলোকপাত করতে পেরেছেন। তবে মজার ব্যাপার হচ্ছে, এই চারটি মৌলিক পদার্থের উল্লেখ তার একার কৃতিত্ব নয়। এই ধারণাটি বরং কতগুলো ক্রমবর্ধমান ধারণার মধ্য দিয়ে এসেছিল।

এলিমেন্টস অব এম্পেডোক্লিস; Source: fineartamerica.com

এম্পেডোক্লিসের জন্মের ১০০ বছর আগেই থেলিস পানিকে মহাবিশ্ব সৃষ্টির একমাত্র উপাদান বর্ণনা করেছিলেন। এর কয়েক বছর পরই অ্যানাক্সিমেনেস নামক একজন জ্যোতির্বিদ দাবি করেন, পানি নয়, বায়ুই মহাবিশ্ব সৃষ্টির একমাত্র মৌলিক উপাদান। এরপর, এম্পেডোক্লিসের জন্মের কিছুকাল পূর্বে, দার্শনিক হেরাক্লিটাস দাবি করেন, পানি বা বায়ু কোনোটিই মৌলিক পদার্থ নয়। সত্যিকারের মৌলিক পদার্থ হচ্ছে আগুন! এম্পেডোক্লিস কারো সাথেই দ্বিমত পোষণ না করে বরং সবারটাই গ্রহণ করে নিলেন। সাথে একটি বাড়তি উপাদান, মাটি যোগ করে দিলেন। ব্যস, হয়ে গেল ‘এলিমেন্টস অব এম্পেডোক্লিস’ বা এম্পেডোক্লিসের মৌলিক উপাদান।

এম্পেডোক্লিস আসলে একক মৌলিক পদার্থ ভিত্তিক পৃথিবীর ব্যাপারটি কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলেন না। নিজের চারপাশ পর্যবেক্ষণ করেই তিনি সিদ্ধান্তে আসেন যে, এসব কিছু আসলে একটি পদার্থ দ্বারা তৈরি সম্ভব না। তাই পৃথিবীর সকল জড় এবং জীবিত বস্তুই তার মতে চারটি মৌলিক পদার্থ দিয়ে গঠিত। তবে এ পর্যন্ত এসেই বিজ্ঞান থেকে কিছুটা অতীন্দ্রিয়বাদের দিকে ঝুঁকে পড়েন এম্পেডোক্লিস। তিনি বলেন যে, জীবিত কিংবা জড়, সকল বস্তুর সচেতনতা আছে! সমাজের ভালোবাসা আর কলহের বৈপরীত্য, তিনি বস্তুর গঠনের মধ্যে খুঁজে পান। চারটি উপাদান দিয়ে বস্তু তৈরি হয়েছে ঠিকই, তবে এই চারটি উপাদানকে একত্র করলো কে? এম্পেডোক্লিসের উত্তর, ‘ভালোবাসা’ নামক একটি মৌলিক বল! অন্যদিকে ভালোবাসার বিপরীতে বিবাদ চলে এলে, মৌলিক পদার্থগুলো আলাদা হয়ে যায় আর বস্তুটি ধ্বংস হয়!

ভরের নিত্যতা সূত্র প্রমাণের পরীক্ষা; Source: socratic.org

“কোনো নতুন অস্তিত্বের সৃষ্টি হতে পারে না কিংবা হয় না। প্রকৃতিতে যেসব পরিবর্তন আমরা দেখি, সেগুলো কেবল মৌলিক পদার্থগুলোর সজ্জার পরিবর্তন!”
– এম্পেডোক্লিস

এম্পেডোক্লিসের চারটি মৌলিক পদার্থের তালিকায় অ্যারিস্টটল যোগ করেছিলেন নিজের একটি। আর এই তালিকার নাম হয়ে যায় ‘অ্যারিস্টটলিয়ান এলিমেন্টস’। পরবর্তী প্রায় ২ হাজার বছর যাবত মানুষ এই অ্যারিস্টটলীয় মৌলিক পদার্থগুলোকে পৃথিবীর সবকিছু সৃষ্টির মূল ভেবেছে। সপ্তদশ শতক থেকে জন ডাল্টন, ল্যাভয়সিয়ে আর রবার্ট বয়েলদের হাত ধরে এই ধারণার বিলুপ্তি ঘটে। এক্ষেত্রে ১৭৭০ সালে আবিষ্কৃত ল্যাভয়সিয়ের বিখ্যাত ভরের নিত্যতার সূত্রের কথা বিশেষভাবে প্রযোজ্য। এই সূত্রটি দুটি বিবৃতি আকারে প্রকাশ করেছিলেন ল্যাভয়সিয়ে। বিবৃত দুটি হচ্ছে এরূপ-

ক) পদার্থকে সৃষ্টি বা ধ্বংস করা যায় না। একে এক অবস্থা হতে অন্য অবস্থায় রূপান্তর করা যায় মাত্র।

খ) যেকোনো রাসায়নিক বিক্রিয়ায় উত্‍পন্ন পদার্থসমূহের মোট ভর, বিক্রিয়কগুলোর মোট ভরের সমান থাকে।

প্রথম বিবৃতিটি সহজেই বোধগম্য। দ্বিতীয় বিবৃতিটির অর্থ হচ্ছে, কোনো রাসায়নিক বিক্রিয়ায় ব্যবহৃত উৎপাদক বা বিক্রিয়কগুলোর মোট ভর, বিক্রিয়া শেষে উৎপন্ন পদার্থ বা উৎপাদের মোট ভরের সমান। অর্থাৎ বস্তুগুলোর অবস্থার পরিবর্তন হলেও ভরের পরিবর্তন হয়নি। এবার একটু আগেই পড়ে আসা এম্পেডোক্লিসের উক্তিটির উপর আরেকবার চোখ রাখুন। বিস্ময়কর নয় কি! যে তত্ত্ব আঠারো শতকে ল্যাভয়সিয়ে আবিষ্কার করে রসায়নের গতিপথ পাল্টে দিয়েছিলেন, সে তত্ত্ব নিয়ে আরো ২ হাজার বছর আগেই ভেবেছেন এম্পেডোক্লিস!

এম্পেডোক্লিসের ক্লেপসাইড্রা পরীক্ষা; Source: famousscientists.org

বায়ুচাপ এবং বায়ুর ওজন প্রমাণের জন্য এম্পেডোক্লিস একটি পরীক্ষা করেছিলেন। তার ‘চার মৌলিক পদার্থ’ তত্ত্ব প্রমাণের জন্য বায়ুকে একটি পদার্থ (যার ওজন আছে) প্রমাণ করা জরুরি ছিল। তিনি একটি ক্লেপসাইড্রা (একপ্রকারের জলযন্ত্র) নিয়ে এর উপরের নলে আঙ্গুল দিয়ে চেপে রেখে, একটি পানি ভর্তি পাত্রে নিমজ্জন করান। দেখা যায়, পাত্রের পানি উপচে পড়লেও ক্লেপসাইড্রার গোলকের ভেতরে কোনো পানি প্রবেশ করছে না। এবার তিনি আঙুল সরিয়ে নলের মুখ উন্মুক্ত করে দেন, আর গোলকে পানি প্রবেশ করতে শুরু করে। গোলক পানিতে পূর্ণ হয়ে গেলে এম্পেডোক্লিস পুনরায় নলের মুখ আঙুল দিয়ে বন্ধ করে, ক্লেপসাইড্রাটি পানির পাত্র থেকে উপরে তোলেন। দেখা যায় যে, গোলকের পানি ছিদ্র দিয়ে পড়ে যাচ্ছে না। কিন্তু আঙ্গুল ছেড়ে দেওয়ার সাথে সাথেই সব পানি পড়ে যায়।

এই পরীক্ষার ব্যাখ্যা হচ্ছে এই যে, যখন নলের মুখ বন্ধ রেখে গোলকটিকে পানিতে ডোবানো হয়, তখন গোলকের ভেতরে বাতাস ছিল যা পানিকে প্রবেশ করতে বাধা দেয়। কিন্তু নলের মুখ খুলে দিতেই সব বাতাস বেরিয়ে যায় আর পানি বিনা বাধায় গোলকে প্রবেশ করে। এবার নলের মুখ বন্ধ করে গোলক উপরে তুললে, গোলকের নিচের ছিদ্র দিয়ে বাতাস এর ভেতরে প্রবেশ করার চেষ্টা করে। বাতাসের এই প্রচেষ্টাই গোলকের পানিকে আটকে রাখে। তবে নলের মুখ উন্মুক্ত করার সাথে সাথে পানি পড়ে যায়, আর বাতাস সেই ফাঁপা স্থান দখল করে নেয়। তবে অনেক ইতিহাসবিদ বিতর্ক করেন যে, এম্পেডোক্লিসের সময়ে গ্রীকরা জানতোই না যে, বায়ু একটি উপাদান যার ভর আছে। এম্পেডোক্লিস নাকি এই পরীক্ষাটি করেছিলেন মানুষের শ্বসন ব্যাখ্যা করার জন্য!

‘ন্যাচারাল সিলেকশন’ বা প্রাকৃতিক নির্বাচন তত্ত্বের জন্য বিখ্যাত হয়ে আছেন চার্লস ডারউইন। এই তত্ত্বের প্রথম ধারণা প্রদানকারী কিন্তু এম্পেডোক্লিস! তিনি প্রাগৈতিহাসিককালের পৃথিবীর চিত্র আঁকেন, যা ছিল বীভৎস আর ভয়ানক সব জীবজন্তুতে ভরপুর। যেখানে মানুষ দেখতে ভীষণ কদাকার। সব অদ্ভুত আর কিম্ভুতকিমাকার জন্তুগুলো ধীরে ধীরে বিকৃত হয় (পরিবর্তিত হয়), ধ্বংস হয়ে যায় এবং টিকে থাকাদের নিয়ে গড়ে ওঠে আধুনিক (তার সময়ের প্রেক্ষাপটে) সমাজ। তবে এম্পেডোক্লিসের তত্ত্বকে ততটা গুরুত্ব দেওয়া হয় না, কারণ তিনি ভেবেছিলেন, পৃথিবী থেকে কেবল বাছাইকৃত ‘কদর্য’ প্রাণীগুলোই ধ্বংস হয়, যেন মানুষ শান্তিতে বসবাস করতে পারে! বিবর্তনের কথা তার মাথায় আসেনি।

এম্পেডোক্লিস; Source: Wellcome Library, London. Wellcome Images/Wikimedia Commons

“আমি একজন অমর ঈশ্বর! আমি আর মরণশীল নেই। কারণ, সবাই আমাকে সম্মান করে, আমার প্রশংসা করে। হাজারো মানুষ আমাকে আদর্শ মনে করে!”
– এম্পেডোক্লিস

হ্যাঁ, নিয়মকানুনের প্রতি অশ্রদ্ধাশীল, খেয়ালী এম্পেডোক্লিস নিজেকে ঈশ্বর ভাবতেন! পিথাগোরিয়ান বিশ্বাসে উদ্ভুদ্ধ হয়ে তিনি নিরামিষভোজী হন। যেহেতু মানুষও একটি পশু, তাই অন্য পশুর মাংস খাওয়া ‘ক্যানিবালিস্টিক’ বা স্বজাতি ভক্ষণের মতো ব্যাপার হয়ে যায় বলে ভাবতেন তিনি। তবে নিজেকে ঈশ্বর দাবি করলেও এম্পেডোক্লিস ছিলেন যথেষ্টই উদার মানসিকতার মানুষ। বিতর্কিত কিছু সূত্রে জানা যায়, তিনি জাদুকর ছিলেন এবং অসুস্থদের জাদু দিয়ে সুস্থ করতে পারেন বলে দাবি করতেন!

খুব সম্ভবত ৪৯০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে, প্রাচীন গ্রিসের সিসিলি দ্বীপপুঞ্জের অ্যাক্রাগাস নামক শহরে জন্মগ্রহণ করেন এম্পেডোক্লিস। তার বাবা মিটন একজন অলিম্পিক বিজয়ী ছিলেন। তার শিক্ষা-দীক্ষা জন্মস্থান অ্যাক্রাগাসেই সম্পন্ন হয়। সম্ভবত, পিথাগোরাসের উত্তরসূরীদের কাছেই শিক্ষা গ্রহণ করেছিলেন এম্পেডোক্লিস। মজার ব্যাপার হচ্ছে, এম্পেডোক্লিসের এসব বৈজ্ঞানিক কাজকর্ম তাকে বিজ্ঞানী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করলেও, তিনি ছিলেন মূলত একজন কবি! তার সব তত্ত্বই তিনি লিখেছেন কবিতার আকারে! অন্য সকল প্রাচীন বিজ্ঞানীর মতোই তার ব্যাপারেও খুব বেশি কিছু জানা যায় না। তার প্রায় সব কাজই হারিয়ে গেছে। কেবল ‘অন ন্যাচার’ এবং ‘পিউরিফিকেশন’ নামক তার দুটি বিশাল কবিতার গ্রন্থের কয়েক খণ্ড টিকে আছে। এগুলো থেকে অনেক মূল্যবান তথ্য পাওয়া গেছে। আর বাকি তথ্য পাওয়া যায় প্রাচীন দার্শনিক, যেমন অ্যারিস্টটল, অ্যাপোলোনিয়াসদের লেখায়।

এটনা পর্বতের এই আগ্নেয়গিরিতেই এম্পেডোক্লিস ঝাঁপ দিয়েছিলেন বলে প্রচলিত আছে; Source: ericgerlach.com

এম্পেডোক্লিসের মৃত্যু নিয়ে দুটি মজার ঘটনা প্রচলিত আছে, যদিও সত্যি কোনটি, তা জানা যায় না। প্রথমটি হচ্ছে এই যে, তিনি নিজেকে ঈশ্বর প্রমাণ করার জন্য সিসিলির এটনা পর্বতের আগ্নেয়গিরির মধ্যে ঝাঁপ দেন! তিনি ভেবেছিলেন, হয় তিনি জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ড থেকে ফিরে আসবেন আর তিনি সত্যিকারের ঈশ্বর বলে প্রতীয়মান হবেন। অথবা, মারা গেলেও তার দেহ যেন কেউ না পায়। তাতেও মানুষের মনে কিছুটা সন্দেহ থাকবে! দ্বিতীয় ঘটনাটির পক্ষে সমর্থন কম হলেও ফেলে দেওয়ার মতো নয়। একদল ইতিহাসবিদের মতে, তিনি আগুনে ঝাঁপ দেননি, বরং পালিয়ে পেলোপনেসিয়া চলে যান। সেখানেই তার মৃত্যু হয়। খুব সম্ভবত ৬০ বছর বয়সে ৪৩০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে এম্পেডোক্লিস মৃত্যুবরণ করেন।

ফিচার ছবি: Starry Heaven

Related Articles