Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

সম্রাট ঊ জেটিয়ান: চীনা সাম্রাজ্যের একমাত্র নারী সম্রাট

মার্কিন লেখক ও শিক্ষাবিদ বার্ট অ্যান অ্যাডামস এবং জেন ট্রোস্টের ভুবনখ্যাত বই ‘হ্যান্ডবুক অব দ্য ওয়ার্ল্ড ফ্যামিলিস’ থেকে আমরা প্রাচীন এবং মধ্যযুগীয় চীনা সমাজে নারীর ভূমিকা সম্বন্ধে মজাদার একটি তথ্য পাই, তখনকার চীনা নারীদের জীবন চালিত হতো ৩টি অনমনীয় আনুগত্য আর ৪টি অলঙ্ঘনীয় নীতির ভিত্তিতে। আনুগত্য তিনটি জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে বিভিন্নভাবে কার্যকর হতো। বিয়ের পূর্বে বাবার প্রতি আনুগত্য, বিয়ের পর স্বামীর প্রতি আর স্বামীর মৃত্যুর পর পুত্রের প্রতি আনুগত্য! অন্যদিকে অলঙ্ঘনীয় নীতিগুলো হলো নৈতিকতা, কথা কম বলা, আচরণে বিনয়ী হওয়া এবং কর্মোদ্যমী হওয়া। এসবের বিপরীত হলেই জীবন হয়ে উঠতো দুর্বিষহ। অথচ চীনের প্রথম এবং একমাত্র নারী সম্রাট ঊ জেটিয়ান এমনই একজন, যিনি এসব নীতি-নিয়মকে কেবল বুড়ো আঙুলই দেখাননি, বরং নিয়ম ভাঙতে ভাঙতে পুরো চীনের উপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছিলেন!

ফিনিক্স গেটে সম্রাট ঊ জেটিয়ানের সমাধি; Image Source: factinate.com

চীনের কিয়ানলিং সমাধি মন্দিরে ফিনিক্স গেট নামক একটি স্থান আছে। সেখানে গেলেই চোখে পড়বে একটি অতিকায় ফলক। কয়েক মিটার লম্বা এই মোনোলিথে না আছে কোনো খোদাই করা ছবি, না আছে একটি লিখিত শব্দও। অতন্দ্র প্রহরীর মতো দাঁড়িয়ে থাকা এই মোনোলিথের মাথায় আছে কেবল কয়েকটি উৎকীর্ণ ড্রাগন। আর এই সাদামাটা মোনোলিথটির নীচেই ঘুমিয়ে আছে জীবন্ত এক ইতিহাস, এমন এক নারীর ইতিহাস, যিনি দোর্দণ্ড প্রতাপে প্রবল পুরুষতান্ত্রিক চীনকে শাসন করেছেন, যিনি একইসাথে কুখ্যাতি এবং সুখ্যাতি লাভ করেছেন নির্দয় সম্রাজ্ঞী ও জনহিতৈষী সম্রাট হিসেবে। হ্যাঁ, চীনের প্রথম নারী সম্রাট এবং ট্যাং রাজবংশের (যদিও তিনি নিজেই আরেকটি রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, তথাপি ইতিহাসবিদগণ তাকে ট্যাং রাজবংশেরও অভিহিত করেন) একমাত্র নারী শাসক ঊ জেটিয়ান যেন তার সমাধির উপরে অবস্থিত মোনোলিথটির মতই আকাশ ছুঁতে চেয়েছিলেন। আর তার এই চাওয়ার মাঝে যত বাধা এসেছিল, সবকিছুকে তিনি নির্মম, নিষ্ঠুরভাবে ধ্বংস করেছিলেন।

চীনে সপ্তম শতক কিংবা এর পরের আরো শত শত বছর পর্যন্ত নারীদের জন্য দু’টি বিষয়কে অত্যন্ত অনুপযোগী বলে মনে করা হতো। একটি রাজনীতি এবং অপরটি হলো সাহিত্য। মজার ব্যাপার হলো, ঊ জেটিয়ান এ দু’টিতেই অত্যন্ত আগ্রহী ছিলেন এবং দু’টির সাথেই তার জীবন ওতপ্রোতভাবে জড়িত। শুধু কি তা-ই? রাজনীতিতে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে নিজের ঘনিষ্ঠজনদের হত্যা করা থেকে শুরু করে এহেন অপরাধ নেই তিনি করেননি! এই নির্মম, নিষ্ঠুর মানুষটির জন্ম ৬২৪ খ্রিস্টাব্দের ১৬ ফেব্রুয়ারি চীনের সিচুয়ান প্রদেশে। তখন চীনে ট্যাং রাজবংশের শাসন শক্তভাবে প্রতিষ্ঠিত হতে শুরু করেছে কেবল। তার বাবা ঊ শিহু ছিলেন এই রাজবংশের একজন প্রভাবশালী প্রাদেশিক গভর্নর ও ব্যবসায়ী। মেয়ের নাম তিনি রেখেছিল ঊ ঝাও অথবা ঊ মেই। পরবর্তীতে সেটি কীভাবে পরিবর্তিত হয়ে যায়, তার সঠিক দলিল আমাদের হাতে নেই।

ঊ’র শৈশব কেটেছিল গতানুগতিক চীনা মেয়েদের চেয়ে একেবারেই ভিন্ন পন্থায়। তার বাবা শিহু ছিলেন যথেষ্ট উদারমনা, যিনি মেয়েকে পড়ালেখার প্রতি ভীষণভাবে উৎসাহী করে তোলেন। ঊ’র বই পড়ার পছন্দও ছিল গতানুগতিক ধারার বাইরে। সাধারণত চীনা শিশুদের কনফুসিয়াসের দর্শন শেখানোর পাশাপাশি সঙ্গীত চর্চা করানো হতো। কন্যাশিশুকে সাহিত্যও পড়ানো হতো না। অথচ ঊ সাহিত্য, রাজনীতি, সরকার ব্যবস্থা, এসবের প্রতি ব্যাপকভাবে আকৃষ্ট হয়ে পড়েন। শিহুও তার কন্যাকে প্রবল উৎসাহে নানারকম রাজনৈতিক বই সরবরাহ করতে থাকেন।

সম্রাট টাই জং; Image Source: factinate.com

ঊ’র জ্ঞান সাধনায় কয়েক বছরের মাঝেই বাধ সাধেন তৎকালীন ট্যাং রাজবংশের সম্রাট টাই জং। তিনি ঊ’কে নিজের উপপত্নী হিসেবে প্রাসাদে নিয়ে গেলে বন্ধ হয়ে যায় ঊ’র পড়ালেখা। ১৩ বছর বয়সী ঊ অবশ্য সম্রাটের খুব একটা পছন্দের সঙ্গী ছিলেন না। তাই রাজপ্রাসাদে তার বেশিরভাগ সময়ই কাটতো অলসভাবে। জীবনের পরবর্তী ১২ বছর তার এভাবেই কাটে। ৬৪৯ খ্রিস্টাব্দে সম্রাটের মৃত্যু হয় এবং তার গর্ভে সম্রাটের কোনো সন্তান না আসায় তাকে আশ্রমে পাঠিয়ে দেয়া হয় সন্ন্যাসিনীর জীবনে প্রবেশ করবার জন্য। এখান থেকেই তার জীবনে নাটকীয় সব ঘটনা ঘটতে শুরু করে।

মাত্র কয়েক বছরের মাথায় ঊ আশ্রম থেকে পালিয়ে যান এবং ঘটনাক্রমে সম্রাট গাওজংয়ের উপপত্নী বনে যান। এখানে দু’টি তথ্য উল্লেখ করা প্রয়োজন। প্রথমত, রাজাদের উপপত্নী, যারা কিনা আশ্রমবাসী হন, তাদের সেই আশ্রমের জীবন থেকে ফিরে আসা অসম্ভবের নামান্তর। দ্বিতীয়ত, সম্রাট গাওজং হলেন টাই জংয়ের কনিষ্ঠ পুত্র! এই অসাধ্য কীভাবে সাধন করেছিলেন ঊ, তার সঠিক তথ্য জানা যায় না। তবে, এরূপ কাহিনী প্রচলিত আছে যে- গাওজং তার পিতার মৃত্যুবার্ষিকীতে আশ্রমে গিয়েছিলেন আত্মার শান্তি কামনা করতে। সেখানে তিনি পিতার সাবেক উপপত্নী ঊ’র সৌন্দর্যে বিমোহিত হন। উপরন্তু, তার স্ত্রী ওয়াংও তাকে উৎসাহিত করেছিলেন তিনি যেন ঊ’কে প্রাসাদে নিয়ে যান। এর কারণ হিসেবে বলা হয় যে, গাওজংয়ের আরেকজন উপপত্নী জিয়াও ছিলেন ওয়াংয়ের চেয়ে অধিকতর রূপবতী। ওয়াং তাই প্রতিহিংসার বশবর্তী হয়ে ঊ’কে প্রাসাদে নিয়ে আসেন প্রতিযোগী বৃদ্ধি করবার জন্য!

গাওজং এবং ঊ জেটিয়ানের ভাস্কর্য; Image Source: smithsonianmag.com

যা হোক, ঊ’র রাজপ্রাসাদে প্রত্যাবর্তন পূর্বের চেয়েও রাজকীয় হলো। কেননা, পিতার উপপত্নীর সাথে যৌন সংসর্গ অনাচার হিসেবে গণ্য হতো। তাই কোনোরূপ সমালোচনা শুরু যেন না হয়, সেজন্য ঊ’কে নিজের সঙ্গীদের মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পদমর্যাদায় আসীন করলেন সম্রাট গাওজং। আর সুযোগের পূর্ণ ব্যবহার করলেন ঊ। সম্রাট গাওজং ছিলেন যথেষ্ট অসংযমী এবং দুর্বল মনোবল সম্পন্ন মানুষ। ঊ শীঘ্রই তাকে অন্যদের থেকে দূরে সরিয়ে নিজের বশবর্তী করে নেন। প্রাসাদে প্রবেশের ২ বছরে ঊ’র গর্ভে সম্রাটের দুই পুত্র সন্তানের জন্ম হয়। তৃতীয় বছর একটি কন্যা শিশুর জন্ম হলেও সেটি জন্মের কয়েকদিন পরই মারা যায়। ঊ এই শিশুটির মৃত্যুর জন্য তৎকালীন সম্রাজ্ঞী ওয়াং এবং সম্রাটের আরেক উপপত্নী জিয়াওকে দোষী সাব্যস্ত করেন। সম্রাট উভয়কেই জেলে প্রেরণ করলে ঊ নতুন সম্রাজ্ঞী বনে যান। উল্লেখ্য, শিশুটিকে ঊ নিজেই হত্যা করেছিলেন বলে অভিমত প্রকাশ করেন অনেক ইতিহাসবিদ!

এদিকে কিছুকাল পরই সম্রাট বন্দীদের মাফ করে দিতে পারেন বলে সন্দেহ ছিল ঊ’র। তাই তিনি দ্রুততম সময়ের মাঝে উভয়ের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করেন! এখানেও রয়েছে প্রচলিত গল্প। বলা হয়ে থাকে, তিনি সম্রাজ্ঞী ওয়াং ও জিয়াওয়ের হাত পা কেটে তাদেরকে বড় মদের পিপার মধ্যে ফেলে দিয়েছিলেন! এই অভিযোগ মিথ্যা হবার সম্ভাবনাই বেশি। তথাপি, এ দুজনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার মাধ্যমেই তার খুনে সত্ত্বাটি জেগে ওঠে। তার বড় ছেলেকে পরবর্তী সম্রাট ঘোষণা করলে গাওজংয়ের প্রয়োজনীয়তা ঊ’র নিকট ফুরিয়ে যায়। তিনি খুব সম্ভবত গাওজংকে প্রতিদিনকার খাদ্যের সাথে অল্প পরিমাণ বিষ মিশিয়ে দিতে থাকেন, যা গাওজংকে ধীরে ধীরে প্রচণ্ড অসুস্থ করে তোলে। ৬৬৫ খ্রিস্টাব্দের মধ্যেই ঊ জেটিয়ান একপ্রকার সম্রাটের দায়িত্বই পালন শুরু করেন। অসুস্থ সম্রাটের পক্ষ থেকে রাজদরবারের প্রায় সব কাজ পর্দার আড়াল থেকে পরিচালনা করতে শুরু করেন। দরবারের কর্মকর্তারা ঊ’র রাজনৈতিক প্রজ্ঞা এবং প্রখর বুদ্ধিমত্তায় মুগ্ধ হয়ে যান।

ঊ জেটিয়ানকে নিয়ে নির্মিত সবচেয়ে জনপ্রিয় সিনেমা ‘ইমপ্রেস অব চায়না’য় ঊ’র চরিত্রে অভিনয় করেছেন ফ্যান বিংবিং; Image Source: imdb.com

এদিকে, ঊ’র বাড়তে থাকা ক্ষমতায় সম্রাট ভীত হয়ে পড়েন। ঊ’র সামনে তিনি কতটা অসহায় ছিলেন, তার প্রমাণ মেলে এসময়ের ঘটনাবলীতে। অনেক রাজকীয় সিদ্ধান্তই তিনি ঊ’র কথায় গ্রহণ কিংবা বর্জন করতে বাধ্য হতেন। একদিন তো ঊ’র সকল ক্ষমতা রদ করা বিষয়ক একটি ফরমানের খসড়াও তৈরি করে ফেলেছিলেন এক কর্মকর্তাকে দিয়ে। এরকম কিছু একটা রাজদরবারে ঘটছে জানতে পেরে সেখানে ছুটে যান ঊ। আর সম্রাজ্ঞীকে হঠাৎ সামনে দেখে এতটাই ভয় পেয়ে যান সম্রাট যে তিনি তৎক্ষণাৎ খসড়া ফরমানটি ছিঁড়ে ফেলেন! এ ঘটনার পর থেকে ঊ কোনোদিনও সম্রাটকে রাজদরবারে একা কাজ করতে দেননি। সম্রাট যেখানে বসে তার সভাসদদের সাথে কথা বলেছেন, ঊ ঠিক তার পেছনেই পর্দার আড়ালে বসে থাকতেন।

কেবল সম্রাটকে পাহারা দিয়েই ঊ’র সমস্যা মিটে যায়নি। সিংহাসনের উত্তরাধিকারী তার বড় পুত্র লি হং তার মায়ের অতিরিক্ত ক্ষমতা চর্চা অপছন্দ করতে শুরু করেন এবং মা’কে ক্ষমতা থেকে সরে যেতে পীড়া দিতে আরম্ভ করেন। এছাড়াও তিনি সম্রাটের পূর্বতন উপপত্নী জিয়াওয়ের কন্যাদ্বয়কে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেন। রহস্যজনকভাবে এর কিছুকাল পরই তার মৃত্যু হয়। অবশ্যই এই মৃত্যু ঘিরেও ঊ’র বিরুদ্ধে হত্যার অভিযোগ আছে, যে অভিযোগ বেশ শক্তই। যা হোক, এরপর সিংহাসনের উত্তরাধিকারী বনে যান তার দ্বিতীয় পুত্র লি জিয়াং। কিন্তু, তার অবাধ্য হওয়ায় লি জিয়াংয়ের গন্তব্য হয় নির্জন এক দ্বীপে নির্বাসন! তৃতীয়বারের মতো উত্তরাধিকার পরিবর্তিত হয় এবং এবার সিংহাসনের দাবিদার হন তার কনিষ্ঠ পুত্র লি ঝে।

৬৮৩ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে গাওজং প্রচণ্ড অসুস্থ হয়ে পড়লে লি ঝে ক্ষমতায় বসেন। সম্রাট হিসেবে তিনি ঝংঝং উপাধি গ্রহণ করেন। ক্ষমতায় বসেই তিনি তার বড় ভাইয়ের মতো স্বাধীনভাবে কাজ শুরু করেন এবং মায়ের প্রভাব থেকে সম্পূর্ণ বেরিয়ে আসেন। কিন্তু লি ঝে অনুধাবন করতে পারেননি তার মায়ের ক্ষমতা কত দূর। উ জেটিয়েন প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের বড় অংশের সমর্থন আদায় করে মাত্র কয়েক সপ্তাহ পরই লি ঝে কে ক্ষমতাচ্যুত করে গৃহবন্দী করেন ও কিছুকাল পর নির্বাসনে পাঠান! এবার তিনি তার চতুর্থ পুত্র রুইজংকে ক্ষমতায় বসান। রুইজং ছিলেন সত্যিকার অর্থে ঊ’র হাতের পুতুল। ঊ যা বলতেন, রুইজং তা-ই করতেন। এমনকি এসময় তিনি রাজসভায় পর্দার আড়ালেও থাকতেন না আগের মতো। ৬ বছর মায়ের হাতের পুতুল হয়ে থাকার পর মা’কেই ক্ষমতায় বসার আমন্ত্রণ জানিয়ে পদত্যাগ করেন রুইজং। এর মাধ্যমে ৬৯০ খ্রিস্টাব্দে চীনের প্রথম নারী ‘হুয়াংদি’ বনে যান ঊ জেটিয়ান। মান্দারিন শব্দ ‘হুয়াংদি’ অর্থ সম্রাট। মান্দারিন ভাষায় সম্রাট শব্দটির কোনো লিঙ্গভেদ নেই। তাই এ লেখায়ও সম্রাট শব্দটিই ব্যবহার করা হবে।

ট্যাং রাজবংশের সাম্রাজ্য বিস্তার; Image Source: chinahighlights.com

ক্ষমতায় বসেই পুরো চীনে নিজের সর্বময় কর্তৃত্ব স্থাপনের দিকে মনোযোগ দেন সম্রাট ঊ জেটিয়ান। বিবাহসূত্রে তিনি ট্যাং বংশের শাসক হিসেবে চিহ্নিত হলেও তিনি এ বংশের পরিচয় থেকে বেরিয়ে নতুন বংশ স্থাপনের উদ্যোগ নেন। তিনি জুহু রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করেন এবং চর লাগিয়ে তার সকল রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ এবং নিজেদের পুত্রদের ব্যতীত ট্যাং বংশের জীবিত সকল সদস্যকে হয় হত্যা করেন, নয়তো নির্বাসনে পাঠান। তবে, রাজনৈতি প্রতিপক্ষ নিধনের সাথে সাথে তিনি চীনের জন্য সুদূরপ্রসারী ভালো কাজও করেন। তিনি তার আশেপাশে গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে সর্বোচ্চ যোগ্য লোকদের নিয়োগ দেন। চীনের সরকারি ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজান, আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সর্বোচ্চ যোগ্য লোকদের নিয়োগ দিতে মানসম্মত সিভিল সার্ভিস পরীক্ষার ব্যবস্থা করেন।

ধর্মীয় দিক থেকে চীনের সংস্কারে হাত দেন সম্রাট ঊ। তিনি বৌদ্ধধর্ম, দাও ধর্ম এবং কনফুসিয়ান বিশ্বাস, সবগুলো নিয়েই ব্যাপক পড়াশোনার পর বৌদ্ধ ধর্মকে চীনের রাষ্ট্র ধর্ম করেন। তবে বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণে তিনি প্রজাদের কখনোই বাধ্য করেননি। তার আমলে নারীরাও পারিবারিক গণ্ডির ভেতর থেকে বেরিয়ে আসতে শুরু করে। তিনি প্রচুর কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেন এবং বেকারত্ব তখন ছিল না বললেই চলে। দরিদ্র কৃষকদের মাঝে তিনি জমি বিতরণ করেছিলেন, যেন সকলেই স্বচ্ছ হতে পারে। তাছাড়া, তার আমলেই চীনের প্রত্যন্ত অঞ্চলের, সমাজের দরিদ্র কিংবা তথাকথিত নিচু শ্রেণির মানুষ ব্যাপক হারে সরকারি আমলাতন্ত্রে প্রবেশ করার সুযোগ পায় নিজেদের মেধার বলে। ফলে, মানুষের সার্বিক জীবনযাত্রার মান বৃদ্ধি পায়। এসব কারণে সর্বসাধারণের মাঝে তিনি ছিলেন ব্যাপক জনপ্রিয়।

ঊ তার শাসনকাজের সুবিধার জন্য চীনকে পর্যাপ্ত প্রশাসনিক অঞ্চলে বিভক্ত করেছিলেন; Image Source: commons.wikimedia.org

৬৯২ খ্রিস্টাব্দে তিব্বতীয় সম্রাজ্যের একটা বড় অংশ চীনের দখলে আনতে সমর্থ হন সম্রাট ঊ। বাকি অংশে যুদ্ধে পরাজয় হলেও ঘুষ দিয়ে কিংবা স্বায়ত্ত্বশাসনের লোভ দেখিয়ে শীঘ্রই সেগুলোও করায়ত্ত করেন তিনি। এদিকে নিজের প্রতিষ্ঠা করা জুহু রাজবংশের ভবিষ্যতের কথা ভেবে তিনি তৃতীয় পুত্র লি ঝে’কে নির্বাসন থেকে নিয়ে আসেন এবং আনুষ্ঠানিকভাবে তার যুবরাজ হিসেবে অভিষেক করান। তিনি তার দুই ভাই ইঝি এবং চ্যাংজংকে নিজের উপদেষ্টা নিয়োগ করেন। কথিত আছে, ভাতৃদ্বয়ের সাথে তার প্রেমের সম্পর্ক ছিল। যা-ই হোক, বয়স হয়ে আসায় ক্রমাগত রাজকাজ থেকে নিজেকে একটু একটু করে গুটিয়ে নিতে থাকেন সম্রাট ঊ। ৭০০ খ্রিস্টাব্দে, তিনি যখন ৭৫ বছর বয়সে পা দেন, রাজদরবারের অনেক কাজই তখন তার দুই ভাই দেখাশোনা করতেন।

সম্রাট ঊ জেটিয়ান (৬২৪-৭০৫ খ্রিস্টাব্দ); Image Source: pinterest.ca

বদলে গেছে ভেবে লি ঝে’কে নির্বাসন থেকে ফিরিয়ে এনেছিলেন সম্রাট ঊ। কিন্তু তার ধারণা ভুল ছিল। এই লি ঝে’ই শেষ পর্যন্ত তার পতনের কারণ হয়। দীর্ঘ সময়ের ব্যবধানে ক্ষমতায় আহরণ করলেই সম্রাট ঊ’র পতন হয় অনেকটা আকস্মিকভাবে। যুবরাজ হয়ে লি ঝে গোপনে তার পিতার অনুসারী এবং ট্যাং রাজবংশের সমর্থকদের সংগঠিত করতে থাকেন। ৭০৫ খ্রিস্টাব্দের ৩রা মার্চ, অসুস্থ সম্রাট ঊ যখন শয্যাশায়ী, লি ঝে তখন বিদ্রোহ ঘটিয়ে ক্ষমতা দখল করেন এবং ঊ’র আপন ভাইদের সহ জুহু বংশের সকলের মুণ্ডুচ্ছেদ করে প্রাসাদের সামনে খুঁটিতে গেঁথে রাখেন। তার নিষ্ঠুরতার কারণ ছিল এই যে, পরবর্তীতে আর কেউ যেন ট্যাং রাজবংশকে উৎখাত করার সাহস না পায়, সে ব্যবস্থা করা। তিনি ঊ’কে পদত্যাগ করতে বাধ্য করে সেদিনই ক্ষমতা আনুষ্ঠানিকভাবে গ্রহণ করেন। সেবছরই ১৬ ডিসেম্বর গৃহবন্দী অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন ঊ। লি ঝে হয়তো তার প্রতিষ্ঠা করা জুহু বংশের নাম মুছে দিয়েছিলেন, কিন্তু চীনের একমাত্র নারী সম্রাটের রেখে যাওয়া বদলে যাওয়া চীনকে তিনি আর পুনরায় বদলাতে পারেননি। চীনের আধুনিকতার পথে, উন্নতির পথে সম্রাট ঊ জেটিয়ানের অবদান অনস্বীকার্য। তাই ক্ষমতার লোভে তার করা শত কুকর্মও ঢাকা পরে যায় বুদ্ধিদ্বীপ্ত রাষ্ট্র পরিচালনায়।

Language: Bangla
Topic: Biography of Emperor Wu Zetian
Reference: Hyperlinked inside the article

Featured Image: en.people.cn (This is a picture of Fan Bingbing in the movie 'Empress of China', biopic of Wu Zetian

Related Articles