এনভার হোক্সা: সমাজতান্ত্রিক আলবেনিয়ার জনক

আলবেনিয়ার নাম অনেকেই শুনেছেন। নব্বই এর দশকে কসোভো যুদ্ধের বদৌলতে দেশটির কথা বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে। ইউরোপের একমাত্র এই মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশটির ইতিহাস কিন্তু যুদ্ধ আর সংঘাতে ভরপুর। আর চল্লিশের দশকে এমনই অস্থির পরিবেশে দেশের হাল ধরেছিলেন জনৈক এনভার হোক্সা। সমাজতান্ত্রিক ব্লকের সদস্য হলেও এই একনায়ক আলবেনিয়াকে সোভিয়েত আর চীনা ব্লক থেকে পৃথক হয়ে সম্পূর্ণ নিজস্ব ঘরানায় চলবার মতো সক্ষম করে গড়তে চাইতেন। সে সময়ে বিশ্বের অনেক দেশের নেতাই নিজেদেরকে হোক্সাইজমের সাথে একাত্ম মনে করতেন। আমাদের ঢাকার গলিতেও এনভার হোক্সাকে নিয়ে গ্রাফিত্তি দেখবার কথা স্মরণ করতে পারেন অনেক প্রৌঢ়রা।

চার দশক ধরে আলবেনিয়া শাসন করেছেন হোক্সা; source: pinterest

কে ছিলেন এই এনভার হোক্সা? কীভাবে আলবেনিয়ার মতো একটি ছোট্ট রাষ্ট্রের নেতা হয়ে বিশ্বের বাঘা বাঘা দেশগুলোকে তোয়াক্কা না করে চলবার সাহস পেলেন তিনি? জেনে নেওয়া যাক সেসবই আজকের এই লেখনীর মধ্য দিয়ে।

আলবেনিয়া ও দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ

বুলগেরিয়া, আলবেনিয়া, সার্বিয়া, মন্টিনেগ্রো, বসনিয়া, রোমানিয়াসহ বেশ কিছু দেশ নিয়ে দক্ষিণ ইউরোপের বলকান অঞ্চল গঠিত। প্রাচীন আমল থেকেই এ অঞ্চলে যুদ্ধ বিগ্রহ লেগে থাকে। অটোমান শাসনামলে তুর্কিরা বলকান অঞ্চলের অনেকটা অংশ নিজেদের দখলে নিয়ে নেয়। আলবেনিয়া এ সময়ে তুর্কি শাসনের অধীনে ছিল।

অটোমান সাম্রাজ্য দুর্বল হয়ে পড়লে বুলগেরিয়া, সার্বিয়া, মন্টিনেগ্রো আর গ্রিস বলকান অঞ্চলে তুর্কিদেরকে যুদ্ধে পরাস্ত করে। এ ডামাডোলের মধ্যে আলবেনীয় নেতা ইসমাইল কেমালি স্বাধীনতা ঘোষণা করে বসেন। নানা পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে ১৯২৫ সালে আলবেনীয় প্রজাতন্ত্র গঠিত হয়। তবে তিন বছর পরেই ক্ষমতা চলে যায় রাজপরিবারের হাতে। রাজা জগু রক্ষণশীল শাসনে মুড়ে ফেলেন ছোট্ট দেশটিকে।

গেরিলাদের সাথে কমরেড হোক্সা (টুপি ছাড়া); source: ciml.250x.com

১৯৩৯ সালে মুসোলিনির ইতালী আচমকা আলবেনিয়া আক্রমণ করে দখল করে ফেলে। ১৯৪৩ সাল পর্যন্ত জার্মান আর ইতালীয় কর্মকর্তারা আলবেনিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করতেন। এই দখলদারিত্বের মধ্যেই দেশটির কম্যুনিস্টরা গড়ে তোলে ‘আলবেনিয়ান ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মি’। প্রায় লক্ষাধিক গেরিলা এই বাহিনীর হয়ে ফ্যাসিস্ট শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। ১৯৪৪ সালের নভেম্বরে আলবেনিয়া মুক্ত হয়। পরে যুগোস্লাভিয়ার যুদ্ধেও আলবেনিয়া সৈন্য পাঠায়। রাজতন্ত্র বিলুপ্ত হয় এবং এনভার হোক্সার নেতৃত্বে ১৯৪৬ সালে পিপলস রিপাবলিক অব আলবেনিয়া নামের সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়। হোক্সা হয়ে যান দেশের সবথেকে ক্ষমতাশালী ব্যক্তি।

এনভার হোক্সার উত্থান

দক্ষিণ আলবেনিয়ার এক ছোট্ট শহরে এনভার হোক্সার জন্ম হয় ১৯০৮ সালে। বাবা কাপড় বেচতেন। বালক হোক্সা পড়াশোনায় ভাল ছিলেন। স্কুল-কলেজ শেষ করে তিনি প্যারিসে যান পড়তে। সেখানেই রাজতন্ত্র বিরোধীদের সাথে তার সখ্যতা গড়ে ওঠে। হোক্সা পড়াশোনা শেষ না করেই দেশে ফিরে আসেন।

আলবেনিয়ার শাসক হোক্সা; source: thefamouspeople.com

হোক্সা রাজনীতি নিয়ে সচেতন হলেও রাজনীতি করতেন না। আলবেনিয়াতে ছোটখাট নানা কাজ করে সাদামাটা জীবন যাপন করতেন। ফ্যাসিস্ট ইতালী আলবেনিয়া দখল করে নিলে তিনি তার এক কম্যুনিস্ট বন্ধুর সূত্রে আলবেনিয়ার সমাজতান্ত্রিকদের সাথে জড়িয়ে পড়েন।

হোক্সা ছিলেন দক্ষ বাগ্মী এবং রাজনৈতিক সংগঠক। দ্রুতই তিনি আলবেনীয় সমাজতান্ত্রিকদের নেতা হয়ে দাঁড়ান। কসোভো প্রশ্নে যুগোশ্লাভ বিপ্লবী জোসেফ টিটোর সাথে তিনি দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েন। টিটো স্বীকার করতেন যে কসোভো আলবেনীয় জমি। কিন্তু বলে বেড়াতেন যে কসোভোর মারমুখী সার্বদেরকে শান্ত রাখবার জন্যেই ঐ অঞ্চলকে আলবেনিয়ার হাতে তুলে দেওয়া যাবে না। এসব বিরোধ সত্ত্বেও যুদ্ধে কিন্তু দুই পক্ষই একসাথে লড়তো। ১৯৪৪ সালে স্বাধীন হওয়ার পর এনভার হোক্সা আলবেনিয়ার কম্যুনিস্ট পার্টির প্রধান এবং দেশের নেতা হয়ে বসেন। রাজতন্ত্রকে বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়।

শাসক হোক্সা

হোক্সা শুরুর বছরগুলোতে স্টালিনপন্থী ছিলেন। তিনি যখন ক্ষমতায় বসেন তখন দেশের সিংহভাগ লোক অশিক্ষিত, কোনো বিশ্ববিদ্যালয় নেই, অর্থনীতির অবস্থাও খুব খারাপ। দশ লক্ষ লোকের মধ্যে আশি হাজার মানুষ যুদ্ধের কারণে নিহত, আহত বা বন্দী হয়েছেন। তবে সোভিয়েত সাহায্য পেয়ে হোক্সা আলবেনিয়াকে অনেক এগিয়ে নেন। স্তালিনের মতো তিনিও আলবেনিয়াতে পরিকল্পিত অর্থনীতির প্রচলন করেছিলেন।

হোক্সার আলবেনিয়া; source: pinerest

স্তালিন আর যুগোশ্লাভ নেতা মার্শাল টিটো একজন আরেকজনকে দেখতে পারতেন না। এবারে তাদের মধ্যে আলবেনিয়াকে নিয়ে রশি টানাটানি শুরু হয়ে গেল। টিটো চাইতেন আলবেনিয়া অন্যান্য স্লাভ দেশগুলোর মতো যুগোশ্লাভিয়াতে যোগদান করুক। আলবেনিয়ার ব্যবসা বাণিজ্যের ওপরে যুগোশ্লাভরা কড়া সব আইন কানুন প্রয়োগ করে। ওদিকে হোক্সা কিন্তু স্টালিনপন্থী ছিলেন। বিপুল অর্থসাহায্য পেয়ে তিনি নিজের দেশে নানা শিল্প গড়ে তুলতে চাইতেন। ১৯৪৮ সালের দিকে আলবেনিয়ার সাথে যুগোশ্লাভিয়ের সম্পর্ক একদম নষ্ট হয়ে যায়।

ওদিকে স্টালিন মারা গেলে ক্ষমতায় আসেন খ্রুশ্চেভ। তিনি এসেই যুগোশ্লাভিয়ার সাথে সম্পর্ক ভাল করার দিকে জোর দেন। ফলশ্রুতিতে তিনিও হোক্সার শত্রু হয়ে দাড়ান। মূলত খ্রুশ্চেভের চাপেই হোক্সা ঝুঁকে পড়েন আরেক সমাজতান্ত্রিক দেশ চীনের দিকে।

মাও সে তুং খ্রুশ্চেভকে পছন্দ করতেন না। এসব পুরানো ঝানু নেতাদের কাছে খ্রুশ্চেভের পশ্চিমা বিশ্বের সাথে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান নীতি মোটেও পছন্দ ছিল না। ১৯৬১ সালের পরে সম্পর্ক আরো খারাপ হতে থাকে। সোভিয়েত ইউনিয়ন আলবেনিয়াকে সমস্ত সাহায্য দেওয়া বন্ধ করে দেয়। অনানুষ্ঠানিকভাবে হলেও আলবেনিয়াকে ওয়ারশ চুক্তি থেকে বাদ দেওয়া হয়। এই সুযোগে চীন বিপুল অর্থ সাহায্য দিয়ে আলবেনিয়াকে নিজেদের শিবিরে যোগ করে নেয়।

আত্মনির্ভরশীল আলবেনিয়া

১৯৬৮ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন চেকোস্লোভাকিয়াতে আক্রমণ চালালে হোক্সা ওয়ারশ প্যাক্ট থেকে আলবেনিয়াকে আনুষ্ঠানিকভাবে সরিয়ে নেন। আলবেনিয়ার সাথে চীনের দহরম মহরমেও কিছুটা ঘাটতি দেখা যায়। বিশেষ করে মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন আর চীনা নেতা ঝৌ এন লাই এর সাক্ষাত এবং মাও পরবর্তী নেতা হুয়া গোয়োফেং এর নরমপন্থী বৈদেশিক নীতি হোক্সাকে ভীষণ ক্ষুব্ধ করে তোলে। এই সময়টাতে তিনি ক্রমেই চীনা আর সোভিয়েত শিবির থেকে আলাদা হয়ে পড়ছিলেন। এরই ফলে সত্তরের দশকে তত্ত্ব হিসেবে সৃষ্টি হয় হোক্সাইজম

হোক্সাইজম চীন, যুগোশ্লাভিয়া এবং সোভিয়েত ইউনিয়নকে সমাজতান্ত্রিক সাম্রাজ্যবাদের অভিযোগে দোষী মনে করে। হোক্সাইস্টদের ধারণা স্তালিনীয় শাসনের মাধ্যমেই প্রকৃতি সমাজতন্ত্র আনা সম্ভব এবং মার্কিন নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা বিশ্বের সাথে যেকোনো রকমের বোঝাপড়া হচ্ছে আত্মহত্যার নামান্তর। লাতিন আমেরিকাসহ অনেক দেশে হোক্সার এই নীতি দারুণ সমাদৃত হয়েছিল। আত্মনির্ভরশীল আলবেনিয়া গড়ে তোলার প্রত্যয় নিয়ে মাঠে নামলেন হোক্সা।

আলবেনিয়াতে সবাইকে সামরিক প্রশিক্ষণ নিতে হত; source: pinterest

১১ হাজার বর্গ মাইলের একটা ছোট্ট দেশ আলবেনিয়া। তার পক্ষে আর কতটুকু শিল্প গড়ে তোলা সম্ভব। এদিকে কোনো দেশই আলবেনিয়াকে সাহায্য করতে রাজি নয়। ফলে আলবেনিয়া ক্রমেই একঘরে হয়ে যেতে থাকলো। জীবনযাত্রার মানও অনেক নেমে যেতে থাকে। সত্তরের দশকের শেষ দিকে হোক্সা অত্যন্ত অসুস্থ হয়ে পড়ায় রাষ্ট্রীয় কাজে তাঁর তেমন মনোযোগ ছিল না। আলবেনিয়া ইউরোপের দরিদ্রতম রাষ্ট্রে পরিণত হয়। এরই মধ্যে ১৯৮৫ সালে এনভার হোক্সা মারা যান।

কেমন ছিল হোক্সার আলবেনিয়া

প্রায় ৪১ বছরের শাসনামলে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন নীতি গ্রহণ করেছেন এনভার হোক্সা। কখনো সোভিয়েত শিবিরে তো কখনো চীনা শিবিরে যোগ দিয়েছেন। আবার কখনো স্বতন্ত্র পথে চালিয়েছেন দেশকে। এর প্রভাব পড়েছে আলবেনিয়ার মানুষের ওপরেও। অনেক সমাজতান্ত্রিক দেশের মতোই আলবেনিয়াতেও বিনামূল্যে শিক্ষা আর স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া হত। কিন্তু স্বল্প বাজেটের কারণে সত্তরের দশকে এসব সেবার মান নেমে যেতে থাকে। হোক্সা সব সময় ভয় পেতেন যে এই বুঝি যুগোশ্লাভ বা সোভিয়েত সেনারা তার ছোট্ট দেশটিকে দখল করে ফেলে। সেই ভয়ে তিনি দেশজুড়ে কয়েক লক্ষ বাংকার নির্মাণ করেন। গরিব দেশ হিসেবে আলবেনিয়া এই ব্যয়বহুল প্রজেক্টের কারণে ভীষণ ভুগতে বাধ্য হয়।

আশির দশকে দেশের তিরিশ লক্ষ মানুষের মধ্যে আট লক্ষই কোনো না কোনোভাবে সামরিক বাহিনীর সাথে যুক্ত ছিল। হোক্সা ভাবতেন দেশের সমস্ত লোককে যদি সামরিক শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলা যায়, তাহলে যুগোশ্লাভিয়া বা সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমণ করলেও আলবেনিয়া টিকে যাবে। দেশজুড়ে নিয়মিত সামরিক প্রশিক্ষণ আর মহড়ার আয়োজন করা হত।

আলবেনিয়ার সর্বত্র দেখা মেলে এমন বাংকারের; source: pinterest

এনভার হোক্সা আরও অসংখ্য একনায়কদের মতো দেশে স্বাধীন বা বিরোধী মতের ওপরে দমন পীড়ন চালাতেন বটে, তবে চীন বা সোভিয়েত ইউনিয়নের তুলনায় তিনি কিছুটা নরমপন্থীই ছিলেন। বিরোধীদের অনেকেই অবশ্য গুলি খেয়ে মরতেন। গোপন পুলিশ সিগুরিমি দেশময় কড়া নজরদারি চালাতো।

হোক্সার শাসনামলে আলবেনীয়রা বিদেশে যেতে পারত না। পুরুষদের দাড়ি রাখা নিষিদ্ধ ছিল। আলবেনিয়া ছিল বিশ্বের প্রথম স্বঘোষিত নাস্তিক দেশ। নাগরিক জীবনে ধর্মের যেকোনো রকমের প্রভাব হোক্সার অপছন্দ ছিল।

তবে হোক্সার অনেক ভাল দিকও আছে। আলবেনীয়া শিক্ষার হারে পশ্চিমা বিশ্বের সমকক্ষ হয়ে ওঠে তার আমলে। রাজধানী তিরানায় স্থাপিত হয় দেশের প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়। বিশেষ করে মেয়েদের উন্নতির জন্য হোক্সা খুব চেষ্টা করেছিলেন। মেয়েরা কর্মক্ষেত্রে সমানতালে অংশ নিত। অনেক গুরুত্বপূর্ণ সরকারি আর রাজনৈতিক পদে মেয়েরা আসীন ছিল। আশির দশকে আলবেনিয়ার মোট শ্রমশক্তির ৪৬ শতাংশই ছিল নারীরা, যা পশ্চিমা বিশ্বের থেকেও বেশি। তিনি দেশের কৃষিজমির সুষ্ঠু বিলি ব্যবস্থাও করেছিলেন।

অন্য অনেক দেশের নেতারা যেমন প্রথমে কঠোর থেকে পরবর্তী আমলে নরম হন, হোক্সার শাসনামল ছিল ঠিক তার উলটো। উদার নেতা থেকে আশির দশকে তিনি পরিণত হন আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে নিঃসঙ্গ, কঠোর এক নেতায়, যার নতুন নতুন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা প্রায়ই ছোট্ট দেশটির সাধ্যে কুলাতো না। তবে তার আমলের অন্যান্য ঝানু নেতাদের তুলনায় হোক্সাকে ভাগ্যবানই বলতে হবে। ১৯৮৫ সালেই মারা যাওয়ায় তাকে দেখে যেতে হয়নি সমাজতন্ত্রের পতনের পর কীভাবে বিক্ষুব্ধ জনতা তিরানায় তার মূর্তি ভেঙ্গে চুরমার করে ফেলছে। হোক্সা অনেক বই লিখে গিয়েছেন।

ভেঙ্গে ফেলা হচ্ছে হোক্সার মূর্তি; source: Modern Albania

ফিচার ইমেজ – pinterest

 

Related Articles