Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

ফিল্ড মার্শাল বার্নার্ড ল’ মন্টগোমারি: দ্য স্পার্টান জেনারেল

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মিত্রবাহিনীর যে কজন জেনারেল পৃথিবীব্যাপী বিখ্যাত হয়ে আছেন এবং যাদের রণকৌশল পরবর্তীকালে দেশে দেশে জেনারেলদের পাঠ্য বস্তু তাদের মধ্যে জেনারেল মন্টগোমারি প্রথম সারির একজন। বিখ্যাত জার্মান জেনারেল ফিল্ড মার্শাল এরউইন রোমেলকে হারানোর জন্য তিনি স্মরণীয় হয়ে আছেন। ভীষণ নিয়মনিষ্ঠ ও স্পষ্টভাষী এই ব্রিটিশ জেনারেলের পুরো নাম বার্নার্ড ল’ মন্টগোমারি, ডাকনাম ছিল মন্টি এবং দ্য স্পার্টান জেনারেল।

মন্টগোমারি ১৮৮৭ সালের ১৭ নভেম্বর লন্ডনের কেনিংটনে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা হেনরি মন্টগোমারি ছিলেন চার্চের একজন বিশপ এবং মাতা মড মন্টগোমারি ছিলেন খুবই কড়া একজন মহিলা। ১৮৮৯ সালে হেনরি মন্টগোমারিকে অস্ট্রেলিয়ার তাসমানিয়ায় বিশপ করে পাঠানোর ফলে তার পরিবার সেখানে চলে আসে। ব্রিটিশ উপনিবেশিক প্রত্যন্ত দ্বীপ তাসমানিয়ায় থাকাকালীন তার মায়ের নিয়মিত মারধরের কারণে মন্টগোমারিকে খুব কঠিন শৈশব পার করতে হয়েছিল।

ফিল্ড মার্শাল বার্নার্ড ল’ মন্টগোমারি; Image source: Imperial War Museum, London

১৯০১ সালে তার পরিবার ইংল্যান্ডে প্রত্যাবর্তন করলে মন্টি লন্ডনের সেন্ট পল স্কুলে ভর্তি হন এবং স্কুলের পড়াশোনা শেষ করে প্রবেশ করেন রয়্যাল মিলিটারি একাডেমিতে। ১৯০৮ সালে কমিশনপ্রাপ্ত হয়ে সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট হিসেবে রয়্যাল ওয়ারউইকশায়ার রেজিমেন্টে যোগদান করেন।

১৯১০ সালে মন্টগোমারিকে লেফটেন্যান্ট পদে প্রমোশন দিয়ে ভারতবর্ষে পাঠানো হয়। কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে তাকে ব্রিটিশ এক্সপেডিশনারি ফোর্সের সাথে ফ্রান্সে নিযুক্ত করা হয়। মন্টগোমারি ও তার রেজিমেন্ট, লেফটেন্যান্ট জেনারেল থমাস স্নো নেতৃত্বাধীন চতুর্থ ডিভিশনের অধীনে থেকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশ নেয়। এ যুদ্ধে তিনি এত মারাত্মকভাবে আহত হয়েছিলেন যে, তার জন্য কবর পর্যন্ত খোঁড়া হয়েছিল! প্রতিপক্ষের স্নাইপারের গুলি তার ফুসফুসে আঘাত করেছিল। কিন্তু ভাগ্যক্রমে সে যাত্রায় তিনি বেঁচে যান।

সুস্থ হয়ে উঠলে মন্টিকে ব্রিটিশ এক্সপেডিশনারি ফোর্স Distinguished Service Order এ ভূষিত করে ব্রিগেড মেজর হিসেবে পদোন্নতি দেয়। ১৯১৬ সালে ৩৩তম ডিভিশনের স্টাফ অফিসার করে পুনরায় ফ্রান্সে নিযুক্ত করা হয়। পদাতিক বাহিনী, আর্টিলারি এবং ইঞ্জিনিয়ারিং কোরের সমন্বিত অপারেশন পরিচালনায় অসামান্য দক্ষতা প্রদর্শন করার ফলে এসময় তিনি নির্ভুল পরিকল্পনাকারী হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। ১৯১৮ সালের নভেম্বরে যুদ্ধ শেষ হলে মন্টি লেফটেন্যান্ট কর্নেল পদে অস্থায়ীভাবে অধিষ্ঠিত হন এবং ৪৭তম ডিভিশনের চিফ অফ স্টাফ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

পরবর্তীকালে, ১৯১৯-২১ সালে সংঘটিত আইরিশ স্বাধীনতা যুদ্ধ বা অ্যাংলো-আইরিশ যুদ্ধের সময় তিনি ব্রিটিশ ফোর্সের সাথে আয়ারল্যান্ডে অবস্থান করেন এবং স্বাধীনতাকামী গেরিলা বাহিনী Irish Republican Army-র বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযানে অংশগ্রহণ করেন। বিদ্রোহীদের ব্যাপারে কঠোর অবস্থানের পক্ষে ছিলেন তিনি। 

ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিলের সঙ্গে মন্টি; Image source: National Army Museum, Chelsea, London

৩৯ বছর বয়সী মন্টি যুদ্ধ শেষে ইংল্যান্ডে ফিরে এলিজাবেথ কার্ভারের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। ১৯২৮ সালে তাদের ঘর আলোকিত করে পুত্র সন্তান ডেভিড জন্মগ্রহণ করে।

বেশ কিছু পদোন্নতির পর ১৯৩১ সালে তাকে লেফটেন্যান্ট কর্নেল করে ভারতবর্ষ এবং মধ্যপ্রাচ্যে ব্রিটিশ উপনিবেশিক অঞ্চলগুলোতে পাঠানো হয়। ১৯৩৭ সালে সেপটিসেমিয়ায় আক্রান্ত হয়ে স্ত্রী এলিজাবেথ অকালে মৃত্যুবরণ করলে মন্টির জীবন বেদনা-বিধুর হয়ে ওঠে। শোক কাটিয়ে পরের বছর মন্টি এক বিশাল সামরিক প্রশিক্ষণের আয়োজন করেন যেটি তার ঊর্ধ্বতন সামরিক অফিসারদের দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হয়। এর ফলে তিনি মেজর জেনারেল পদে পদোন্নতির মাধ্যমে ৮ম ডিভিশনের নেতৃত্ব লাভ করেন। এসময় তাকে ব্রিটিশ উপনিবেশিক ফিলিস্তিনে নিযুক্ত করা হয়। ১৯৩৬-৩৯ সালে ব্রিটিশ ম্যান্ডেট বাতিল এবং ইহুদী অভিবাসন বন্ধ করাসহ ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার দাবিতে ফিলিস্তিনি আরবরা বিদ্রোহ করে বসলে জেনারেল মন্টগোমারি এ বিদ্রোহ সফলতার সঙ্গে দমন করেন।

তারপর ১৯৩৯ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে তাকে ৩য় পদাতিক ডিভিশনের মতো এলিট ডিভিশনের দায়িত্ব দিয়ে ফ্রান্সে নিযুক্ত করে ব্রিটিশ সরকার। কিন্তু এবারে মন্টগোমারি ছিলেন যথেষ্ট সতর্ক। ১৯১৪ সালের সেই বিপর্যয়ের আশঙ্কায় তিনি তার অধীনস্থ সৈন্যদের নিরলসভাবে প্রতিরক্ষামূলক যুদ্ধকৌশলের প্রশিক্ষণ দিতে থাকেন। পরবর্তীতে, ১৯৪০ সালে ফ্রান্সের উত্তর উপকূল ডানকার্কে ব্রিটিশ সৈন্যরা তিন দিক দিয়েই নাৎসিদের দ্বারা ঘেরাও হয়ে পড়লে মন্টির এই যুদ্ধকৌশল কাজে দিয়েছিল। ডানকার্ক হতে প্রায় নিশ্চিত মৃত্যু থেকে সে যাত্রায়ও বেঁচে ফেরেন মন্টি।

ডানকার্কে আঁটকে পড়া সৈন্যরা; Image source: Wikimedia commons

ইংল্যান্ডে প্রত্যাবর্তনের পর মন্টগোমারি ব্রিটিশ হাইকমান্ডের প্রকাশ্য সমালোচক হয়ে ওঠেন এবং দেশটির সাউদার্ন কমান্ডের কমান্ডিং অফিসার লেফটেন্যান্ট জেনারেল স্যার ক্লদ অচিনলেকের সঙ্গে ঝামেলায় জড়িয়ে পড়েন। পরের বছর মন্টিকে জেনারেল হ্যারল্ড আলেকজান্ডারের সাথে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব ইংল্যান্ডের প্রতিরক্ষার দায়িত্ব দেওয়া হয়। কেননা সম্ভাব্য নাৎসি আগ্রাসন হলে তার প্রধান ধকল এই দুটি অঞ্চল দিয়েই যাওয়ার কথা ছিল।

রোমেলকে হারানো

১৯৪২ সালের জুন মাসে উত্তর আফ্রিকায় গাজালার যুদ্ধে এরউইন রোমেলের নেতৃত্বাধীন ইতালীয়-জার্মান বাহিনীর নিকট পরাজিত হয়ে ব্রিটিশ ৮ম আর্মি তখন বিধ্বস্ত। কোনোক্রমে পিছু হটে এল আলামেইন শহরের নিকট বিশাল প্রতিরক্ষা লাইন তৈরি করে ব্রিটিশ বাহিনী। মূলত এসময় উত্তর আফ্রিকায় অক্ষশক্তি পশ্চিম হতে পূর্ব দিকে অগ্রসর হচ্ছিল সুয়েজ খাল অধিকারের লক্ষ্যে।

বিধ্বস্ত এবং মনোবল হারিয়ে ফেলা মিত্র বাহিনীর সৈনিকদের উৎসাহ দিতে মধ্যপ্রাচ্যে মিত্রবাহিনীর কমান্ডার-ইন-চিফ জেনারেল স্যার ক্লদ অচিনলেক নিজের হাতে ৮ম আর্মির কমান্ড তুলে নেন। মিশরের এল আলামেইনে প্রথম যে যুদ্ধটি সংঘটিত হয়েছিল সেটি এল আলামেইনের প্রথম যুদ্ধ (১-২৭ জুলাই, ১৯৪২) নামে পরিচিত। এই যুদ্ধে মিত্রবাহিনী ছিল রক্ষণাত্মক এবং অক্ষশক্তি ছিল আক্রমণাত্মক ভূমিকায়।

আগস্ট মাসে ইংরেজ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল কায়রো সফরে এসে জেনারেল অচিনলেককে সরিয়ে জেনারেল উইলিয়াম গটকে ৮ম আর্মির কমান্ডার এবং জেনারেল আলেকজান্ডারকে মধ্যপ্রাচ্যে মিত্রবাহিনীর সর্বাধিনায়ক হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু জেনারেল গট এর বিমান পথিমধ্যে জার্মানরা ভূপাতিত করলে তিনি প্রাণ হারান এবং তার পরিবর্তে বাধ্য হয়ে জেনারেল মন্টগোমারিকে ৮ম আর্মির কমান্ডার হিসেবে নিয়োগ দেন। মন্টির খুব কাছের বন্ধু ছিলেন ছিলেন জেনারেল আলেকজান্ডার। উভয়েরই কঠিন পরিস্থিতি মোকাবেলার পূর্ব অভিজ্ঞতা ছিল। দুই জেনারেলের সমন্বয়ের ফলে মধ্যপ্রাচ্যে মিত্রবাহিনীর ভাগ্য বদলে যায়। জেনারেল আলেকজান্ডার দায়িত্ব পান ৮ম আর্মির সঙ্গে ইঙ্গ-মার্কিন বাহিনীর অপারেশনের সমন্বয় সাধনের। অপরদিকে মন্টির দায়িত্ব ছিল রোমেলকে হারানো।

জেনারেল হ্যারল্ড আলেকজান্ডার; Image: Public domain

দায়িত্ব পাওয়ার পর পরই মন্টগোমারি পরিকল্পনা করতে থাকেন কীভাবে রোমেলকে হারানো যায়। মন্টি উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছিলেন যে, মরু যুদ্ধের স্বাভাবিক নীতির ব্যত্যয় ঘটেছে এখানে। তাই তিনি ট্যাংক বনাম ট্যাংক যুদ্ধের পরিবর্তে ১ম বিশ্বযুদ্ধের মতো ট্রেঞ্চ খুঁড়ে যুদ্ধের পরিকল্পনা করেন। তিন সপ্তাহ পর রোমেল যখন তার স্বভাবসুলভ কৌশলে প্রত্যাশিত আক্রমণ করে বসলেন তখন মন্টগোমারি ট্যাংক যুদ্ধ এড়িয়ে বালিতে ডুবে থাকা ক্ল্যামোফাজ (যুদ্ধে ব্যবহৃত ছদ্মবেশ) দেওয়া এন্টি ট্যাংক গান দিয়ে রোমেলের ট্যাংক বহরের অর্ধেক ট্যাংক ধ্বংস করে দিয়ে তাকে পিছু হটতে বাধ্য করেন।

তারপর অক্টোবরের ২৩ তারিখ মন্টগোমারি পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়ে রোমেলের বিরুদ্ধে তার বহুল প্রতীক্ষিত অভিযানে নামলেন যেটি এল-আলামেইনের ২য় যুদ্ধে (২৩ অক্টোবর – ১১নভেম্বর, ১৯৪২) নামে পরিচিত। যুদ্ধের প্রথমদিকে রোমেলও ভীষণভাবে প্রতি আক্রমণ চালালেন। কিন্তু প্রয়োজনীয় রসদের অভাব, ধ্বংসপ্রাপ্ত সাপ্লাই লাইন ও বিমানঘাঁটি এবং প্রধান শক্তি প্যাঞ্জার ডিভিশনের ট্যাংকগুলোর বেশিরভাগই ধ্বংস হওয়ায় রোমেল পরাজিত হন। কোনোমতে তার আফ্রিকা কর্পসকে সাথে নিয়ে উপকূলের দিকে পালিয়ে যান। তারপর একে একে তবরুক, ডেরনা, বেনগাজি থেকে ত্রিপলি এবং শেষ পর্যন্ত তিউনিসিয়াতে আশ্রয় নিলেন। প্রতিশোধ স্পৃহায় ভুগতে থাকা মন্টি তার ৮ম আর্মি নিয়ে অবিরাম তাড়া করে গেলেন রোমেলকে। পথিমধ্যে রোমেল দুবার প্রতিরোধের চেষ্টা করলেও মন্টগোমারি তা গুঁড়িয়ে দেন। রোমেলকে হারানোর ফলে রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে যান মন্টি।

ডেজার্ট ফক্স খ্যাত জার্মান জেনারেল এরউইন রোমেল; Image: Bundesarchiv Bild (TERCEROS)

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অন্যতম টার্নিং পয়েন্ট ছিল এই যুদ্ধ। কেননা এ যুদ্ধে প্রথমবারের মতো ব্রিটিশ কমনওয়েলথ বাহিনী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাহায্য ছাড়াই অক্ষশক্তির বিপরীতে জয়লাভ করে যা তাদের মনোবল বাড়িয়ে দেয় বহুগুণে। অপরদিকে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতিসহ পরাজিত হওয়ার ফলে ১৯৪৩ সালে তিউনিসিয়ায় আত্মসমর্পণ করে ইতালীয়-জার্মান বাহিনী। এর মাধ্যমে উত্তর আফ্রিকা থেকে বিতাড়িত হয় জার্মানরা।

উত্তর আফ্রিকা শত্রুমুক্ত করার পর মিত্রবাহিনী সিসিলি দ্বীপ এবং ইতালিতে অপারেশন পরিচালনা করলে মন্টগোমারি সেই অপারেশনে ব্রিটিশ ৮ম আর্মির নেতৃত্ব দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন।

অবশেষে মিত্রবাহিনী ইউরোপ মুক্ত করার লক্ষ্যে ১৯৪৪ সালের ৬ জুন ফ্রান্সের নরম্যান্ডি সৈকতে ইতিহাসের বৃহত্তম উভচর আক্রমণ পরিচালনা করে যা ইতিহাসে ডি-ডে নামে পরিচিত। ডি-ডে সফল করার নেপথ্যে নায়ক যে মানুষটি তিনি হলেন জেনারেল মন্টগোমারি। কেননা জেনারেল আইজেনআওয়ার মিত্রবাহিনীর সুপ্রিম কমান্ডার হওয়ার সুবাদে এই অপারেশনের সমস্ত কিছু তদারকি করলেও সকল পরিকল্পনা বাস্তবায়নের মূল কারিগর ছিলেন মন্টিই। নরম্যান্ডি সৈকতে অবতরণকারী সকল গ্রাউন্ড ফোর্স নিয়ে গঠিত ২১তম আর্মি গ্রুপের নেতৃত্ব ছিল তার কাঁধে।

ডি-ডে তে নরম্যান্ডি সৈকতে মিত্রবাহিনীর সৈন্যরা; Image source: Wikimedia commons

সুবিশাল এই আক্রমণের পরিকল্পনা, রিহার্সাল থেকে শুরু করে প্রতিপক্ষকে ধোঁকা দেওয়ার মতো প্রতিটি পদক্ষেপে ছিল মন্টির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। নরম্যান্ডিতে অবতরণ করার পর যে যুদ্ধগুলোর মাধ্যমে জার্মানদের পরাজিত করে গোটা উত্তর ফ্রান্সকে মিত্রবাহিনীর কব্জায় নিয়ে আসা হয়েছিল সেগুলোর পেছনেও ছিল মন্টির নির্ভুল পরিকল্পনা। ফলে তাকে ১৯৪৪ সালের সেপ্টেম্বরে ব্রিটিশ আর্মির সর্বোচ্চ পদবি ফিল্ড মার্শাল পদে পদোন্নতি দেয় ব্রিটিশ সরকার।

মন্টগোমারি এসময় ইতিহাসের বৃহত্তম এয়ারবর্ন অপারেশনের পরিকল্পনা করেন যা অপারেশন মার্কেট গার্ডেন নামে পরিচিত। উচ্চাভিলাষী এই অপারেশনের লক্ষ্য ছিল ৬৩০ কিলোমিটার দীর্ঘ, দুর্ভেদ্য জার্মান প্রতিরক্ষা লাইন ‘সিগফ্রিড লাইনকে’ এড়িয়ে ছত্রীসেনা এবং পদাতিক সেনা ব্যবহার করে নেদারল্যান্ডস হয়ে জার্মানির মূল ভূমিতে প্রবেশ করা এবং আসন্ন বড়দিনের আগেই যুদ্ধের ইতি টেনে ঘরে ফিরে যাওয়া। শেষ পর্যন্ত জার্মানদের প্রতিরোধ এবং আরো বেশ কিছু কারণে অপারেশনটি ব্যর্থ হয়ে গেলেও এই যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সৈনিকদের সাহসিকতা এবং দৃঢ় সংকল্পের কারণে এটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অন্যতম সেরা যুদ্ধে পরিণত হয়ে যায়।

পোষা কুকুর হিটলার এবং রোমেলের সঙ্গে; Image source: Wikimedia commons

এদিকে ১৯৪৪ সালের ১৬ ডিসেম্বর জার্মান বাহিনী ওয়েস্টার্ন ফ্রন্টে মিত্রবাহিনীর ওপর সর্বশেষ আক্রমণটি করে বসে যা Battle of Bulge নামে পরিচিত। মূলত এই আক্রমণের মাধ্যমে এডলফ হিটলার পশ্চিম ফ্রন্টে তার সর্বশেষ মরণকামড়টি দিতে চেয়েছিলেন। ইউরোপের হাড় কাঁপানো শীতে সংঘটিত এই যুদ্ধে জার্মান আক্রমণের মুখে মার্কিন বাহিনীর অবস্থা শোচনীয় হয়ে পড়ে। প্রয়োজনীয় রসদের অভাব, মাইনাস তাপমাত্রা এবং টানা যুদ্ধের ফলে প্রচুর মার্কিন সৈন্য মারা পড়তে থাকে। কিন্তু পরবর্তীতে জেনারেল প্যাটন এবং জেনারেল মন্টগোমারি দুই দিক দিয়ে জার্মানদের ওপর আক্রমণ করলে জার্মানরা পিছু হটে। এভাবে বালজের যুদ্ধেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন মন্টি।

১৯৪৫ সালের মার্চে মন্টগোমাারির নির্ভুল পরিকল্পনার ফলে তার সেনারা রাইন নদী অতিক্রম করে জার্মানিতে প্রবেশ করে। অবশেষে ১৯৪৫ সালের ৪ মার্চ ডেনমার্ক, নেদারল্যান্ডস এবং উত্তর জার্মানিতে অবস্থান করা সকল জার্মান বাহিনী তার নিকট আত্মসমর্পণ করে

৪ মার্চ ১৯৪৫ এ ডেনমার্ক, নেদারল্যান্ডস এবং উত্তর জার্মানিতে অবস্থান করা সকল জার্মান বাহিনীর আত্মসমর্পণ; Image: George Rodger/The LIFE Picture Collection via Getty Images

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হলে প্রথমে তিনি ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর কমান্ডার-ইন-চীফ হিসেবে এবং পরবর্তীতে ১৯৫১-৫৮ সাল পর্যন্ত পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটোর ডেপুটি কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৪৬ সালে তার সম্মানে ব্রিটিশ সরকার Viscount of Alamein উপাধির প্রচলন করে এবং তাকেই সর্বপ্রথম এতে ভূষিত করে।

১৯৫৮ সালে তার স্মৃতিকথা বই আকারে প্রকাশিত হয়। পরবর্তী জীবনে বেশ কিছু ব্যক্তিগত বিতর্কে জড়িয়ে পড়েছিলেন মন্টি। এগুলোর মধ্যে দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবাদীদের পক্ষে সমর্থন প্রদান এবং ভিয়েতনামে মার্কিন কৌশলের সমালোচনা উল্লেখযোগ্য। ১৯৭৬ সালের ২৪ মার্চ ইংল্যান্ডের হ্যাম্পশায়ারে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অন্যতম সেরা এই জেনারেল মৃত্যুবরণ করেন।

ব্যক্তিত্ব মূল্যায়ন

শীর্ণকায়, লম্বা নাক-ওয়ালা মন্টগোমারি ব্যক্তি হিসেবে ছিলেন কর্কশ, কঠোর এবং ভীষণ নিয়মনিষ্ঠ। ধূমপান এবং মদ্যপান ভীষণভাবে অপছন্দ করতেন। কিছুটা পাগলাটে, অহংকারী, একগুঁয়ে এবং দুর্দমনীয় জেনারেল হিসেবে পরিচিতি ছিল তার। সামান্য অনিয়মের জন্য নিজের স্টাফ অফিসারদের বরখাস্ত করতেন। কঠোর শৈশব তাকে কঠিন একজন মানুষে পরিণত করেছিল।

ইতালির রাস্তায় সৈনিকদের স্যালুট গ্রহণ করছেন মন্টি; Image: Getty Images

জেনারেল হিসেবে মন্টগোমারির আক্রমণে ছিল বহুমুখিতার ছাপ। এক যুদ্ধে যদি সর্বাধুনিক রণকৌশল ব্যবহার করতেন তো পরের যুদ্ধে প্রয়োগ করতেন অন্য কোনো কৌশল। প্রতি সপ্তাহে অন্তত একবার সাধারণ সৈনিক থেকে শুরু করে ব্রিগেডিয়ার পর্যন্ত অফিসারদের নিয়ে সাত মাইল রাস্তা দৌড়াতেন। তিনি প্রত্যেকদিন ফ্রন্টে যেতেন। সৈনিকদের সম্পর্কে তাদের চেয়ে অধিক জ্ঞান দেখে ফিল্ড কমান্ডাররা বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যেত।

জটিল চরিত্রের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও মন্টগোমারি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অন্যতম সেরা জেনারেল এবং ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর সর্বকালের সেরা জেনারেলদের একজন হয়েই আছেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অনবদ্য ভূমিকার জন্য ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছেন তিনি। 

This is a Bengali article about the great British General Field Marshal Bernard Law Montgomery. Necessary references have been hyperlinked inside. 

Additional reference: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, সংকলন ও সম্পাদনা- ডেল এইচ খান, নালন্দা প্রকাশনী, ফেব্রুয়ারী ২০১৯ 

Featured Image source: Wikimedia Commons.

Related Articles