Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website. The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

ফ্রাঙ্ক এবেগ্নেল: এক প্রতারকের সিকিউরিটি কনসালটেন্ট হয়ে উঠার গল্প

লোকটির পুরো নাম ফ্রাঙ্ক উইলিয়াম এবেগ্নেল জুনিয়র। ১৯৪৮ সালে নিউইয়র্কে জন্ম তার। পৃথিবীর অন্যতম সেরা এই প্রতারক শুধুমাত্র চেক জালিয়াতির মাধ্যমেই ২.৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের মালিক হয়ে গিয়েছিলেন! আর অন্যান্য প্রতারণা তো আছেই। এসব প্রতারণা করতে গিয়ে তাকে কমপক্ষে ৮ বার নিজের পরিচয় পাল্টাতে হয়, যার মধ্যে এয়ার লাইন্স পাইলট, ডাক্তার, আইনজীবী- কোনোকিছুই বাদ ছিল না! এ সবকিছুই তিনি করেছিলেন তার ২১ তম জন্মদিনের পূর্বে! আর এ প্রতারকই একসময় হয়ে যান এফ.বি.আই-এর পরামর্শক!

ফ্রাঙ্ক এবেগ্নেল

প্রতারণার শুরু

এবেগ্নেলের জীবনের প্রতারণার অধ্যায় শুরু হয় তার বাবাকে প্রতারণার মধ্য দিয়েই! তার বাবা তাকে একটি গ্যাসোলিন ক্রেডিট কার্ড ও ট্রাক দিয়েছিলেন এবেগ্নেলের পার্টটাইম জবের সুবিধার জন্য। কিন্তু এবেগ্নেল তা কাজে লাগিয়েছিলেন অন্য দিকে। ক্রেডিট কার্ড দিয়ে ক্যাশ টাকা তোলার কোনো সুযোগ নেই। তাই এবেগ্নেল ক্রেডিট কার্ড দিয়ে গাড়ির যন্ত্রপাতি কিনে নিতেন এবং পরবর্তীতে তা ফেরত দিয়ে ক্যাশ টাকা নিয়ে নিতেন! এই প্রতারণার ফলশ্রুতিতে তার বাবাকে ৩,৪০০ ডলারের ক্রেডিট কার্ড বিল পরিশোধ করতে হয়। এই প্রতারণা করার সময় এবেগ্নেলের বয়স ছিল মাত্র ১৫ বছর!

ব্যাংকে প্রতারণা

ব্যাংকে প্রতারণায় এবেগ্নেলের প্রথম কৌশল ছিল নিজের ব্যক্তিগত একাউন্টের ব্যালেন্সের চেয়ে বেশী এমাউন্টের চেক লিখে টাকা তোলা। কিন্তু এই কৌশল বেশি দিন কাজ করেনি। কারণ ব্যাংক খুব শীঘ্রই উত্তোলন করা অর্থের জন্য তাকে তাগাদা দিতে শুরু করে। এর ফলে মি. এবেগ্নেল তার কৌশল পাল্টে ফেলেন। তিনি একটি ব্যাংকে সীমাবদ্ধ না থেকে বিভিন্ন ব্যাংকে একাউন্ট খোলা শুরু করেন এবং একইভাবে ব্যালেন্সের থেকে বেশী টাকা তুলে নিতে থাকেন!

কিন্তু তিনি বুঝেছিলেন যে, এই কৌশল খুব বেশিদিন কাজ করবে না। তাই তিনি প্রতারণার নতুন কৌশল আবিষ্কারে নেমে পড়লেন। একদিন তিনি ব্যাংকের টেবিল থেকে কয়েকটি ডিপোজিট স্লীপ নিয়ে তাতে নিজের একাউন্ট নম্বর লিখে পুনরায় অন্যান্য ডিপোজিট স্লীপের সাথে রেখে দেন। এর কারণ? এবেগ্নেল লক্ষ্য করেছিলেন যে, বেশীরভাগ লোক ‘একাউন্ট নম্বর’ পূরণ করার অংশটুকু খালি রেখে দেয়। কিন্তু যদি একাউন্ট নম্বর লেখা থাকে তাহলে ব্যাংক ঐ নাম্বার অনুসারে টাকা জমা করে দেয়। এবেগ্নেল এই সাধারণ জিনিসটাকে অসাধারণভাবে কাজে লাগান। এর ফলশ্রুতিতে পরদিন সকালে তিনি তার নিজের একাউন্টে ৪০,০০০ ডলার আবিষ্কার করেন!

এবেগ্নেল পরবর্তীতে বুঝতে পারেন, তিনি চেক জালিয়াতিতে আরও সফল হবেন যদি তিনি নিজেকে একজন সম্মানিত ব্যাক্তিতে পরিণত করতে পারেন। কিন্তু সম্মানিত ব্যাক্তিতে পরিণত হওয়ার যোগ্যাতা তো তার নেই! হ্যাঁ, তাই তিনি আবারও প্রতারণার আশ্রয় নিলেন। আর এখানেই তার জীবনের মোড় ঘুরে যায়।

উড়ন্ত প্রতারক!

মি. এবেগ্নেল প্যান-আমেরিকান এয়ারলাইন্সের অনুমোদিত ইউনিফর্ম তৈরী করার দোকানে গিয়ে নিজেকে একজন কো-পাইলট বলে পরিচয় দেন। তিনি তাদেরকে বলেন যে, তিনি হোটেলে ইউনিফর্ম হারিয়ে ফেলেছেন! আর এই মিথ্যার মাধ্যমে তিনি কো-পাইলটের ইউনিফর্ম বানিয়ে নেন, সাথে চলতে থাকে চেক জালিয়াতি! পাইলট সেজে প্রতারণার সময় তিনি নিজের পরিচয় পাল্টে নতুন নাম দিয়েছিলেন ‘ফ্রাংক উইলিয়ামস’ এবং তার সাথে নিজের বয়স যোগ করেছিলেন ১০ বছর!

বিমানের ককপিটে ফ্রাঙ্ক এবেগ্নেল

প্যান-আমেরিকার ভাষ্যমতে, বয়স ১৮ পূর্ণ হতে হতে এবেগ্নেল ২৫০টিরও বেশি ফ্লাইটে নকল কো-পাইলট হিসাবে ছিলেন! এ সময় তিনি ২৬টি দেশ ও ১ মিলিয়ন মাইল ভ্রমণ করেছিলেন। প্যান-আমেরিকা এয়ারলাইন্সের পাইলট হিসাবে সকল সুযোগ-সুবিধা তিনি ভোগ করতেন!

এয়ারলাইন্সের কর্মচারীদের জন্য বিমান ভ্রমণ ফ্রী ছিল। তাই এবেগ্নেল মাঝে মাঝেই প্যাসেঞ্জার হিসাবে ভ্রমণ করতেন! এরকমই একদিন তিনি প্যাসেঞ্জার হিসাবে বিমান ভ্রমণ করছিলেন। তিনি যেহেতু পাইলট, তাই ঐ বিমানের পাইলটরা তাকে কিছুক্ষণের জন্য বিমান চালানোর প্রস্তাব দেন। এবেগ্নেল প্রস্তাবটি গ্রহণ করেন। কিন্তু অতি শীঘ্রই তিনি বিমানকে অটোপাইলট মোডে নিয়ে যান! যে লোকটা ঘুড়ি উড়াতে পারে না, তার দ্বারা বিমান উড়ানো একটি সাংঘাতিক ব্যাপার হতো বৈকি!

একজন যাত্রীসেবিকার সাথে ১৬ বছর বয়সী ফ্রাঙ্ক এবেগ্নেল

নকল ডাক্তার!

যখন তিনি নকল পাইলট হিসাবে প্রায় ধরা পড়ে যাচ্ছিলেন, তখনই তিনি স্থান ও পরিচয় বদলে ফেলেন। পরিচয় ও সার্টিফিকেট নকল করে তিনি একটি হাসপাতালে ডাক্তার হিসাবে কাজ করেছেন। তিনি সুপারভাইজর ডাক্তার হিসাবে যোগদান করেন যাতে কখনোই ইমারজেন্সি রোগী তাকে দেখতে না হয়!

একদিন একটি শিশু পায়ে গুরুতর আঘাত নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়। কিন্তু তখন কোনো বিশেষজ্ঞ ডাক্তার ছিলেন না হাসপাতালে। ফ্রাংক অবশ্য কয়েকজন ইন্টার্নকে দিয়ে তখনের মতো চালিয়ে নেন। অতি শীঘ্রই তিনি বুঝতে পারেন যে, তার এই মিথ্যা ডাক্তারি কারও মৃত্যুর কারণ হয়ে উঠতে পারে। তাই তিনি ডাক্তারি ছেড়ে অন্য চাকরি খুঁজতে থাকেন।

আইনে বে-আইনী প্রতারক!

হাসপাতালের চাকরি ছেড়ে দিয়ে লুইজিয়ানায় চলে যান তিনি এবং একজন অ্যাটর্নী হিসাবে নিজেকে দাবী করেন! এক্ষেত্রেও তিনি সার্টিফিকেট নকল করার কৌশলের আশ্রয় নিয়েছিলেন। কিন্তু প্রফেশনাল আইনজীবী হিসাবে কাজ শুরু করার জন্য তাকে লুইজিয়ানার ‘বার এক্সাম’ এর সম্মুখীন হতে হয়। অকল্পনীয়ভাবে ৭ মাস পড়াশোনা ও তিন বার চেষ্টা করেই তিনি ঐ পরীক্ষা উতরে যান!

পুলিশের হাতে ধরা পড়া

১৯৬৯ সালে তিনি ফ্রান্স পুলিশের হাতে ধরা পড়েন। সেখানে তাকে ১২ মাসের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। এছাড়াও সুইডিশ কারাগারে তিনি ৬ মাস জেল খাটেন। সবশেষে যুক্তরাষ্ট্রে তার ১২ বছরের সাজা হয়। কিন্তু এর মধ্যে মাত্র ৪ বছরই তাকে কারাভোগ করতে হয়েছিল।

এফ.বি.আই-তে যোগদান ও পরবর্তী জীবন

১৯৭৪ সালে যখন ১২ বছরের সাজার ৪ বছর পূর্ণ হয়, তখন FBI তাকে অফার দেয় যে, FBI-কে চেক প্রতারণা ধরতে বিনা পয়সায় সাহায্য করলে তাকে প্যারোলে মুক্তি দেবে। এবেগ্নেল এই প্রস্তাবে রাজি হয়ে যান। এরপর তিনি FBI-তে চেক জালিয়াতি বিষয়ক পরামর্শক হিসাবে কাজ করেন।

“এবেগ্নেল এন্ড এসোসিয়েট” নামে একটি সিকিউরিটি কনসালটেন্ট ফার্ম আছে তার। তার ওয়েবসাইট থেকে জানা যায়, তার জালিয়াতির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ব্যবস্থা ১৪,০০০ এরও বেশি প্রতিষ্ঠান গ্রহণ করেছে। বর্তমানে ৫০০টিরও বেশি ব্যাংক তার নকশা করা চেক ব্যবহার করে!

তার সেমি-বায়োগ্রাফিক বই “Catch Me If You Can” ১৯৮০ সালে প্রকাশিত হয়। এই বই অবলম্বন করেই হলিউডের বিখ্যাত নির্মাতা স্টিভেন স্পিলবার্গ তৈরী করেছেন একটি মুভি, যার নাম ঐ বইয়ের নামেই ‘Catch Me if You Can’। ছবিতে এবেগ্নেলের ভূমিকায় অভিনয় করেন বিখ্যাত অভিনেতা লিওনার্দো ডিক্যাপ্রিও।

কিন্তু আসল প্রশ্ন হলো, কেনইবা এরকম এক দুর্ধর্ষ প্রতারক এত তাড়াতাড়ি ভাল পথে ফিরে আসলেন? এই প্রশ্নের উত্তর মি. এবেগ্নেলের কথা থেকেই পাওয়া যায়। তিনি বলেন “আমি খুবই সৌভাগ্যবান ছিলাম এমন একজনকে খুঁজে পেয়ে, যে আমাকে বিশ্বাস করতো। আর এটাই আমাকে বদলে দিয়েছিল।”

মুভির সেটে লিওনার্দো ডিক্যাপ্রিও ও ফ্রাঙ্ক এবেগ্নেল

এই বিশাল পৃথিবীতে প্রতারকদের তালিকা করতে গেলে হয়ত শেষ খুঁজে পাওয়া দায় হবে। তাদের স্থান নির্ধারণ করাটাও হবে মুশকিলের কাজ। কিন্তু সবথেকে কম বয়সী প্রতারকদের তালিকা করলে হয়ত প্রথম নামটা এবেগ্নেলেরই হবে।

তথ্যসূত্র

১) en.wikipedia.org/wiki/Frank_Abagnale

২) abagnale.com/aboutfrank.htm

৩) biography.com/people/frank-abagnale-20657335

৪) criminalminds.wikia.com/wiki/Frank_Abagnale

 

Related Articles