Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website. The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

ফ্রাংক ড্রেক: এলিয়েন সভ্যতা গণনার সূত্র আবিষ্কার করেছেন যে জ্যোতির্বিদ

১৯৬১ সালের গ্রীষ্মকালের কথা। শিকাগো শহরের আকাশে তখন প্রতিদিন তেজস্বী সূর্যের প্রতাপ। প্রচণ্ড গরমে একটুখানি শান্তির পরশ পাওয়া যায় কেবল পার্কগুলোর গাছের ছায়ায়। ফ্রাংক ড্রেক সেদিন নিজের বাড়ির গাছের ছায়ায় বসে গভীর ধ্যানে মগ্ন ছিলেন। কেবল ভাবছিলেন নিজের গবেষণাটি কীভাবে আরো এগিয়ে নেয়া যায়, কীভাবে আরো উন্নত পন্থায় করা যায়। হঠাৎ নিস্তরঙ্গ পরিবেশের নীরবতা আর ড্রেকের একগ্রতা, দুটোই কেটে গেল ফোনের কর্কশ ক্রিং ক্রিং শব্দে। বিরক্তির সাথে ফোন কানে তুললেন তিনি। “ব্যস্ত আছি” বলেই ফোন রেখে দেবেন ভাবছিলেন। কিন্তু তার আগেই তার কানে এলো একটি বাক্য, যা তার ফোন কেটে দেয়ার সিদ্ধান্ত তো বদলে দিয়েছিলই, বদলে দিয়েছিল তার বৈজ্ঞানিক জীবনই!

গ্রিন ব্যাংকের টেলিস্কোপের সামনে দাঁড়িয়ে ফ্রাংক ড্রেক; source: alchetron.com

“আমি ‘ন্যাশনাল অ্যাকাডেমি অব সায়েন্স’ থেকে বলছি”, ড্রেকের সবটুকু মনোযোগ কেড়ে নেয়া এই বাক্যটি বলেছিলেন টেলিফোনের অপর প্রান্তে থাকা অ্যাকাডেমি অব সায়েন্সের ‘স্পেস সায়েন্স বোর্ড’ এর বিজ্ঞানী পিটার পিয়ারম্যান। ড্রেকের গায়ে শিহরন তৈরি হলো। কিছুক্ষণ আগেই তিনি যা ভাবছিলেন, ফোন করে সে ব্যাপারেই আগ্রহ প্রকাশ করলেন অ্যাকাডেমি অব সায়েন্সের একজন জ্যেষ্ঠ বিজ্ঞানী! তার স্বপ্ন যে সত্যি হতে চলেছে, পিয়ারম্যান ফোনে সে বর্তাই দিলেন! স্পেস সায়েন্স বোর্ড, ড্রেকের ‘প্রোজেক্ট ওজমা’ নিয়ে কাজ করতে আগ্রহী। সে কাজে পরে আসছি। তার আগে চলুন জেনে নিই প্রোজেক্ট ওজমার ইতিহাস।

Are we alone in the universe?

উপরের এই প্রশ্নটি, পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি জানতে চাওয়া প্রশ্নগুলোর একটি। পৃথিবীতে একটি মানুষও খুঁজে পাওয়া যাবে না, যার এই প্রশ্নের উত্তর সম্বন্ধে আগ্রহ নেই। ফ্রাংক ড্রেক তো পৃথিবীরই মানুষ, তাই তাকেও বেশ আকর্ষণ করতো এই প্রশ্নটি। পৃথিবীর বাইরে প্রাণের অস্তিত্ব নিয়ে গবেষণার স্বপ্ন তিনি ছাত্রজীবন থেকেই দেখে আসছিলেন। সৌভাগ্যবশত, সে স্বপ্ন বাস্তবায়নে একধাপ এগিয়ে গেলেন কর্মজীবনের প্রথম চাকরিতেই। ১৯৫৮ সালে হার্ভার্ড থেকে স্নাতক শেষ করেই চাকরি পান পশ্চিম ভার্জিনিয়ার গ্রিন ব্যাংক এ অবস্থিত ‘ন্যাশনাল রেডিও অ্যাস্ট্রোনমি অবজারভেটরি’তে। জ্যোতির্বিদ হিসেবে এটাই ছিল তার হাতেখড়ি। গ্রিন ব্যাংকের ৮৫ ফুট লম্বা রেডিও টেলিস্কোপটি ছিল সে সময়ের অন্যতম অত্যাধুনিক টেলিস্কোপ, যা দ্বারা ১২ আলোকবর্ষ দূর থেকে প্রেরণ করা বেতারতরঙ্গ শনাক্ত করা সম্ভব ছিল।

প্রোজেক্ট ওজমায় প্রাথমিকভাবে এই টেলিস্কোপটি ব্যবহার করা হয়েছিল; source: alchetron.com

এমন উন্নত টেলিস্কোপের সাথে কাজ করবার সুযোগ পেয়ে ড্রেকের মনের সুপ্ত স্বপ্ন প্রবলভাবে জেগে উঠলো। এক বছরের মধ্যে তিনি সহকর্মীদের বোঝাতে সক্ষম হলেন যে, পৃথিবীর বাইরে প্রাণের অস্তিত্ব আছে কিনা তা নিয়ে মানুষের গবেষণা করা উচিৎ। অবজারভেটরির সকলের মধ্যে চুক্তি হলো, তারা গ্রিন ব্যাংকের টেলিস্কোপ দ্বারা রুটিন কাজের পাশাপাশি এলিয়েন খোঁজার কাজ চালিয়ে নেবেন। তাদের এই পরিকল্পনার নামকরণ হলো প্রোজেক্ট ওজমা। সিদ্ধান্ত হলো, যতদিন কোনো দৃশ্যমান অগ্রগতি না হবে, ততদিন এই প্রোজেক্ট চালিয়ে নেয়া হবে সকলের অগোচরে। কারণ, এই পরিকল্পনার কথা জানাজানি হলে তা হাসির খোঁড়াকে পরিণত হতে পারে, এমন আশংকা ছিল। কিন্তু ১৯৬০ সালের ৮ এপ্রিল শুরু হওয়া এই প্রোজেক্টের কথা কিছুকাল পরই সংবাদমাধ্যমে চলে আসে। প্রাথমিকভাবে উপহাসের শিকার না হলেও, সাফল্যের অভাবে দ্রুতই তা বন্ধ হয়ে যায়।

কার্ল সেগানের সাথে ফ্রাংক ড্রেক; source: .seti.org

এই হচ্ছে প্রোজেক্ট ওজমার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস। পিয়ারম্যান প্রাথমিকভাবে ড্রেক, তার সকল সহকর্মী এবং আমন্ত্রিত কয়েকজন বিখ্যাত বিজ্ঞানীর সাথে একটি কনফারেন্স আয়োজনের পরামর্শ দেন, যেখানে প্রোজেক্ট ওজমা নিয়ে আলোচনা হবে। এই কনফারেন্সে একটি মজার ঘটনা ঘটে, যার জন্য অনেকেই ড্রেককে মজা করে ‘জ্যোতিষী’ ডাকতেন। সেদিন কনফারেন্সে ড্রেক এক বাক্স শ্যাম্পেন নিয়ে যান। ড্রেকের এই কাজে অবাক হয়ে অন্যরা তাকে কারণ জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, “আজকের কনফারেন্সে তো বিজ্ঞানী মেলভিন কেলভিনও উপস্থিত, তেই শ্যাম্পেন আনা হয়েছে!” তার উত্তরের আগামাথা কেউই বুঝতে পারেননি, বুঝতে পারেননি স্বয়ং কেলভিনও। এর কিছুক্ষণ পরই খবর আসে যে কেলভিন রসায়নে নোবেল জিতেছেন। সবার আর বুঝতে বাকি থাকে না ‘জ্যোতিষী’ ড্রেকের শ্যাম্পেন আনার কারণ! উল্লেখ্য, সেদিন পার্টি চলাকালীন নোবেল পুরস্কার ঘোষণার কথা ছিল।

সেটি ইনস্টিটিউটের গবেষণায় ব্যবহৃত টেলিস্কোপ; source:vox.com

‘সার্চ ফর এক্সট্রাটেরেস্ট্রিয়াল ইন্টিলিজেন্স’ বা সংক্ষেপে সেটি’র প্রথম কনফারেন্স থেকে বেশকিছু ভাবনার খোঁড়াক পেয়ে গেলেন ড্রেক। ভাবতে শুরু করলেন সেটি এবং এলিয়েন সম্বন্ধীয় সম্ভাবনা এবং অন্যান্য দিক নিয়ে। কয়েকমাস বিচ্ছিন্নভাবে ভাবনার পর সেগুলোকে জোড়া লাগাতে শুরু করেন ড্রেক। জোড়া লাগানো সম্পন্ন হলে তৈর হয় একটি সমীকরণ, যা ‘ড্রেক ইকুয়েশন’ নামে পরিচিত। সমীকরণটির বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা নীচে দেয়া হলো।

N = R* · fp · ne · fl · fi · fc · L

এখানে,
N = মহাবিশ্বে নির্ধারণযোগ্য মোট অপার্থিব (এলিয়েন) সভ্যতার সংখ্যা
R* = হচ্ছে নতুন তারকা সৃষ্টির হার
fp = মোট সে সকল তারকার সংখ্যা, যাদের ঘিরে গ্রহ আবর্তিত হচ্ছে
ne = যেসব তারকাকে ঘিরে গ্রহ রয়েছে, সেগুলোতে উপস্থিত সম্ভাব্য প্রাণধারনে সক্ষম গ্রহের গড় সংখ্যা
fl = মোট সে সকল গ্রহের সংখ্যা, যেখানে প্রাণের বিকাশ ঘটার সম্ভাবনা আছে
fi = মোট প্রাণের বিকাশ ঘটা গ্রহের সংখ্যা
fc = শনাক্তকরণ উপযোগী বেতার তরঙ্গ মহাকাশে প্রেরণ করতে সক্ষম প্রযুক্তি ধারণকারী সভ্যতা আছে, এরকম গ্রহের সংখ্যা
L = এই প্রযুক্তি সম্পন্ন সভ্যতাগুলো যে সময়ের মাঝে কোনোরূপ সিগন্যাল প্রেরণ করে, তার দৈর্ঘ্য

ড্রেক সমীকরণ; source: exoplanets.nasa.gov

এই সমীকরণ দ্বারা আমাদের গ্যালাক্সি মিল্কি ওয়েতে উপস্থিত মোট এলিয়েন সভ্যতার সংখ্যা নির্ণয় করা সম্ভব। সমীকরণটি এতোই জনপ্রিয়তা লাভ করে যে, একে অনেক সময় জ্যোতির্বিজ্ঞানের বা আরো নির্দিষ্টকরে বললে, সেটি’র অপর নাম বলা হয়। এই সূত্রের তাত্ত্বিক দিক বিবেচনা করলে মনে হবে যে আমাদের গ্যালাক্সি এলিয়েনে পূর্ণ! তাই তো সূত্রটি প্রকাশের পরপরই এটি নিয়ে আলোচনার ঝড় ওঠে। সে সময় থেকে এই সমীকরণের উপর অসংখ্য গবেষণা হয়েছে। তবে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্যটি হলো ২০১৬ সালের অ্যাডাম ফ্রাংক এবং উড্রাফ সুলিভানের গবেষণা, যা ‘অ্যাস্ট্রোবায়োলজি’ জার্নালে প্রকাশিত হয়।

১৯৬৩ সালে ফ্রাংক ড্রেক ‘জেট প্রোপালশন ল্যাবরেটরি’র প্রধান পদে নিযুক্ত হন। কিন্তু নতুন এই পদে তিনি মোটেও সুখী ছিলেন না। প্রশাসনিক কাজ তাকে এতটাই ব্যস্ত করে তোলে যে তিনি গবেষণায় একেবারের মনোযোগ দিতে পারছিলেন না। ফলাফল, চাকরি থেকে পদত্যাগ। ১৯৬৪ সালের জুনে তিনি নিউইয়োর্কের কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ে জ্যোতির্বিজ্ঞানের অধ্যাপক পদে যোগ দেন। কিছুকালের মধ্যেই তিনি চলে যান পুয়ের্তো রিকোর অ্যারিসিবো তে, কর্নেলের বিশালাকার টেলিস্কোপে কাজ করার জন্য। ১৯৭৪ সালে এখানেই তিনি ইতিহাস বিখ্যাত ‘অ্যারেসিবো ম্যাসেজ’ তৈরি করেন, যা পৃথিবী থেকে ২৫ হাজার আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত একটি গোলাকৃতি তারকাপুঞ্জ ‘এম-১৩’ তে প্রেরণ করা হয়। সম্পূর্ণ বাইনারি কোডে প্রস্তুতকৃত ম্যাসেজটি ডিকোড করলে নীচের ছবিটি পাওয়া যায়, যা পৃথিবী এবং মানবজাতি সম্পর্কিত কিছু মৌলিক তথ্য ধারণ করে।

ভয়েজার-১; source: .realitybeyondmatter.com

১৯৭৭ সালের আগস্ট এবং সেপ্টেম্বরে ভয়েজার-১ এবং ভয়েজার-২ মহাকাশে প্রেরণ করা হয়। পৃথিবীর প্রথম মহাকাশযান, যা মানুষের তৈরি করে দেয়া বার্তা বিস্তৃত মহাশূন্যে বয়ে চলেছে বিগত ৪০ বছর যাবত। এই বার্তাটি তৈরি করেছিলেন ফ্রাংক ড্রেক এবং তার আমৃত্যু বন্ধু কার্ল সেগান। ১০০টি ছবি এবং ৯০ মিনিটের অডিও রয়েছে এই বার্তায়। ভয়েজার-১ এখন পৃথিবী থেকে ১৯ ঘন্টা ৩৭ মিনিট ৫ সেকেন্ড (এই লেখাটি লেখার সময়ের হিসাব, প্রতিনিয়তই তা বাড়ছে) আলোক দূরত্বে অবস্থান করছে। অর্থাৎ, ১৯ ঘন্টা ৩৭ মিনিট ৫ মিনিটে আলো যে দূরত্ব অতিক্রম করে। ২ লক্ষ ৯৬ হাজার বছর পর এই বিস্ময়কর মহাকাশযানটি পৃথিবীর আকাশের উজ্জ্বলতম তারা সিরিয়াসের পৃষ্ঠে আছড়ে পড়বে!

ফ্রাংক ডোনাল্ড ড্রেক ১৯৩০ সালের ২০ মে, যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরে জন্মগ্রহণ করেন। প্রাথমিক শিক্ষালাভ করেন একটি চার্চে, মাধ্যমিক শিক্ষা সম্পন্ন করেন শিকাগোর একটি নামকরা মাধ্যমিক স্কুলে। ১৭ বছর বয়সে নেভি স্কলারশিপ জিতে সেখানে পড়ালেখা শুরু করেন। প্রাথমিকভাবে বিমানবাহিনীতে নিজের ক্যারিয়ার গড়ার স্বপ্ন দেখলেও পরে তিনি বিজ্ঞানের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েন এবং হার্ভার্ডে জ্যোতির্বিজ্ঞান পড়া শুরু করেন। সেখান থেকে স্নাতক শেষ করে বের হতে হতে তিনি এলিয়েন বিষয়ক গবেষণার প্রতি একপ্রকার নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়েন।

ফ্রাংক ড্রেক; source: astronoo.com

ফ্রাংক ড্রেক জীবনে দু’বার বিয়ে করেছেন। প্রথম স্ত্রীর ঘরে দুই পুত্র এবং দ্বিতীয় স্ত্রীর ঘরে দুই কন্যার জন্ম দিয়েছেন তিনি। ১৯৮৪ সালে তিনি কর্নেল ছেড়ে ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন এবং সেখানেই কর্মজীবনের বাকি সময়টা শিক্ষকতা করেন। বর্তমানে তিনি ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক। তাছাড়া ৮৭ বছর বয়সী ড্রেক, এখনো সেটি’র ‘বোর্ড অব ট্রাস্টি’তে কাজ করে চলেছেন। জ্যোতির্বিদ্যায়, বিশেষ করে সেটি’তে তার অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।

ফিচার ছবি: sciencefriday.com

Related Articles