Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

ফ্রিৎস হেবার: দেবদূত নাকি দানব?

১৯১৫ সালের বসন্ত প্রায় শেষের পথে। বেলজিয়ামের ইপ্রা তেপান্তরে পচতে শুরু করেছে হাজারও যুবকের মৃতদেহ। সুরক্ষিত পরিখার নিচে গাদাগাদি করে শুয়ে আছে কাঁদায় লেপটে থাকা একদল সৈন্য। আর তাদের ঠিক নিচেই গোর দেওয়া লাশগুলোতে ভাগ বসাচ্ছে মাছি আর ইঁদুর। ইপ্রার এপাশে বুলেটের ছোঁড়াছুড়ি থামছে না বললেই চলে, সাথে মর্টারের কান ফাটানো শব্দও ঢাকা পড়েছে আহতদের আর্তনাদে।

ইপ্রার জার্মানদের দখলে থাকা প্রান্তটা একটু অন্যরকম। সেদিকে চোখ ফেরালেই দেখা যাবে ছোটখাটো টাক মাথার এক ভদ্রলোককে, নাম তার ফ্রিৎস হেবার। পিন্স-নেজ চশমার পাশ দিয়ে দেশের শত্রুদের দিকে চোখ বুলাচ্ছেন জার্মান-ইহুদী এই রসায়নবিদ। হেবারের সামনে দাঁড়িয়ে আছে ৬ হাজার ট্যাংক, অপেক্ষা করছে তার হাতের ইশারার। সন্ধ্যার দিকে বাতাসের গতিপথটা পরিবর্তন হতেই তার বিশাল গোঁফের নিচে জ্বলতে থাকা ভার্জিনিয়া সিগারেটটা ছুঁড়ে ফেলে দিলেন, হাত নেড়ে সংকেত দিলেন। মুখ থেকে বেরিয়ে এলো ‘God Punish England’-এর মতো স্বগতোক্তি।

সাথে সাথেই ইপ্রার তেপান্তর ভেঙে পড়ল বিস্ফোরণের শব্দে। সিলিন্ডারের ভালভগুলো উন্মুক্ত হয়ে ছড়িয়ে পড়লো ১৬৮ টন ক্লোরিন গ্যাস। সবুজাভ হলুদ রঙের কুয়াশার মতো ক্লোরিন গ্যাসের স্তর যুদ্ধক্ষেত্রে ছড়িয়ে থাকা মৃতদেহের উপর দিয়ে চলে গেল মিত্রবাহিনীর সৈন্যদের দিকে। গাছের ডাল থেকে পাতা ঝরতে শুরু করল, সবুজ ঘাসের উপর ধাতবরঙা আস্তরণ পড়ল, আকাশ থেকে খসে পড়তে শুরু করল উড়তে থাকা পাখি। এটুকু দেখেই বুঝে নেওয়া উচিৎ ছিল মিত্রবাহিনীর সৈন্যদের। কিন্তু তা না করে, তারা নিজেদের অবস্থানে অটল থাকল। এরকম দৃশ্য যে আগে কখনো দেখা হয়নি তাদের।

কিছুক্ষণের মধ্যেই ট্রেঞ্চে শুয়ে থাকা সৈন্যদের ফুসফুসে আক্রমণ করলো ক্লোরিন গ্যাস। দাঁড়িয়ে থাকা সৈন্যরা হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল, যারা বসে ছিল তারা মাটিতেই শুয়ে পড়ল। অ্যালভিওলাই আর রক্তনালীগুলো ফেটে যাওয়ার উপক্রম হলো, মুখ থেকে গলগল করে রক্ত বের হওয়ার আগে হলুদ মিউকাসে ভেসে গেলো তাদের চেহারা। তাদের ভয়াবহ অভিজ্ঞতা বলার আর সময় হলো না, মাটিতেই ডুবে মরতে হলো কয়েক হাজার সৈন্যকে। পড়ে যেতে থাকা সহচরদের দেখে ইপ্রা থেকে পিছু হটলো মিত্রবাহিনীর সৈন্যরা, নিজেদের জীবনের সেরা দৌড়টা দিয়ে পালিয়ে বাঁচলো বিষাক্ত ক্লোরিন গ্যাস থেকে।

যুদ্ধক্ষেত্রে বোতলভর্তি বিষাক্ত দ্রব্য নিয়ে ফ্রিৎস হেবার; Source: chemicalweapons.cenmag.org

এটাই ছিল ফ্রিৎস হেবারের পরিকল্পনা। তিনি নিজেই স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন এই প্রাণঘাতী পরিকল্পনায়। যুদ্ধক্ষেত্র পরিচালনা করা জার্মান জেনারেলদের নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করেই জার্মানির উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদেরকে রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহারের দিকে উৎসাহী করে তুলেছিলেন এই রসায়নবিদ। এর তিন বছরের মাথায় এই হেবারই নোবেলের সোনালী পদক গলায় ঝুলিয়ে হাসিমুখে ছবি তুললেন। আর সেটাও পেয়েছেন ভালো কারণে। এমনকি আপনি নিজেও হয়তো নিজের জীবনের জন্য এই বিজ্ঞানীর কাছে ঋণী।

হেবার তার ইতিবাচক আবিষ্কার করার আগ মুহূর্ত পর্যন্তও বিজ্ঞানীদের কাছে সবচেয়ে বড় মাথাব্যথার কারণ হয়ে ছিল জনসংখ্যার আধিক্য। পৃথিবীর দেড় বিলিয়ন মানুষের পেটকে শান্ত রাখা মুখের কথা নয়, যেখানে প্রায় প্রতিদিনই কয়েক হাজার মানুষ দুর্ভিক্ষের আক্রমণে মাটিতে ঢলে পড়ছে। উনিশ শতাব্দীর শেষ দিকে জার্মানির মাঠে তখন ৩ কোটি মানুষের খাবার আছে, কিন্তু ফসলের ফলন ভালো না হলে না খেয়ে থাকতে হবে আরো ২ কোটি মানুষকে। তাত্ত্বিকভাবে এ সমস্যার ভালো একটা সমাধান আছে। ১৮৪০ এর দশকেই ফন লিবিগ বলে গিয়েছিলেন উদ্ভিদ কোষের বৃদ্ধির জন্য নাইট্রোজেন অপরিহার্য। ফসল কতটুকু ফলবে তা-ও নির্ভর করে নাইট্রোজেন সরবরাহের মাত্রার উপর। ৪ হাজার ট্রিলিয়ন টন নাইট্রোজেন গ্যাস ঘোরাফেরা করছে আমাদের বায়ুমণ্ডলে, দখল করে রেখেছে প্রায় ৮০% এলাকা। কিন্তু বাতাস থেকে কে এই নাইট্রোজেনকে টেনে বের করে জমিতে এনে দেবে?

বাতাস থেকে নাইট্রোজেন আলাদা করার সবচেয়ে বড় বাধাটা হলো এর শক্তিশালী ত্রিযোজী বন্ধন। বায়ুতে উড়তে থাকা নাইট্রোজেন অণুগুলো পরস্পরের সাথে এত দৃঢ়ভাবে সংযুক্ত যে এদেরকে আলাদা করার জন্য প্রয়োজনীয় শক্তি উৎপাদন করাও তৎকালীন সময়ে অকল্পনীয় ব্যাপার ছিল। ঠিক এই কারণেই দেশগুলোকে খুঁজতে হয়েছিল নাইট্রোজেনের বিকল্প উপায়– সমুদ্রশৈবাল আর পাখির মল থেকে তৈরি সার। কিন্তু এগুলোও বেশ দুর্লভ ছিল।

নোবেলজয়ী রসায়নবিদ ফ্রিৎস হেবার; Source: Wired

বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিক থেকেই হেবার এই নাইট্রোজেনের বন্ধন ভাঙার জন্য উঠেপড়ে লাগলেন। পরীক্ষার জন্য তৈরি করলেন বিশাল এক লোহার ট্যাংক। তারমধ্যে বাতাস আর হাইড্রোজেন ঢুকিয়ে দেওয়া শুরু করলেন প্রচণ্ড চাপ, সাথে দিলেন প্রবল মাত্রার তাপ। কাজও করলো তার পদ্ধতি। উদ্ভাবন হলো বাতাস থেকে নাইট্রোজেন বের করে নিয়ে আসার উপায়। আরো পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানোর পর ১৯০৯ সালে পৃথিবীবাসীর সামনে হেবার প্রকাশ করলেন তার আবিষ্কার।

প্রতিবছর ১০০ মিলিয়ন টনেরও বেশি সার উৎপাদন করা হয় এই প্রক্রিয়ায়। আপনি সহ ৭ বিলিয়নেরও বেশি মানুষের দেহের অর্ধেক নাইট্রোজেনই আসে এই হেবার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। বিংশ শতাব্দীর সেরা আবিষ্কার হিসেবে মনে করা হয় এই হেবার প্রক্রিয়াকে। যেটি পেটের ক্ষুধা নিবারণ করে মানুষের মুখে হাসি ফুটিয়েছে এবং আধুনিক সভ্যতার দিকে আরো একধাপ এগিয়ে নিয়েছে।

যুবক ফ্রিৎস হেবার; Source: chemicalweapons.cenmag.org

জনসংখ্যার সাথে তাল মিলিয়ে জার্মানির অর্থনীতির চাকাও ঘুরতে থাকল দ্রুতগতিতে। উচ্চাকাঙ্ক্ষী সাম্রাজ্যবাদী জার্মানি তাদের সীমানা বাড়াতে হাত বাড়ালো বেলজিয়ামে, সেখান থেকে ফ্রান্স। শুরু হয়ে গেল প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। জার্মানরা ভেবেছিল খুব অল্প সময়েই যুদ্ধ শেষ হয়ে যাবে। কিন্তু বিধি বাম, মিত্রবাহিনীর নৌবহর সাগর থেকে আসা অস্ত্র-বারুদের কাঁচামালের রসদ আটকে দিল।

বুকে একসাগর দেশপ্রেম নিয়ে বেড়ে ওঠা ফ্রিৎস হেবার সেনাবাহিনীর কাছে চিঠি পাঠালেন। রসায়নের তত্ত্বানুযায়ী নাইট্রোজেনকে ভাঙতে যতোটুকু শক্তি পাওয়া গিয়েছিল, জুড়তে পারলে ঠিক ততোটুকুই শক্তি ফিরে পাওয়া যাবে। যে বিক্রিয়া দিয়ে তিনি হাজারও জীবন রক্ষা করেছেন, তার উল্টোটা করলেই ঝরে পড়বে জার্মানির বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরা হাজারও মিত্রবাহিনীর সৈন্যের দেহ। তার এই পরিকল্পনার সদ্ব্যবহার করতেই সারা জার্মানিজুড়ে বসানো হলো বিস্ফোরক তৈরির কারখানা, যুদ্ধের দামামা বেড়ে গেল আরো।

কিন্তু এত পরিকল্পনার পরেও খুব একটা সুবিধা হয়নি জার্মানির। মিত্রবাহিনীর কাছেও রয়েছে একই প্রযুক্তি, বরং তাদের সৈন্যসংখ্যা ঢের বেশি। হেবার এবার তার শেষ পরিকল্পনাটা শোনালেন। ক্লোরিন গ্যাসের সাথে মিশিয়ে দেওয়া হবে অ্যামোনিয়া, তৈরি হবে শ্বাসরোধ করে ফেলা গ্যাস, মুহূর্তেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়বে সৈন্য। এহেন কর্ম নিয়ে হেবারের কোনো আফসোস ছিলো না। তার ভাষ্যমতে, “যুদ্ধবিরতিহীন অবস্থায় একজন বিজ্ঞানী পুরো বিশ্বের জন্য, কিন্তু যুদ্ধের সময় তার পুরোটাই দেশের জন্য।

ইপ্রার তেপান্তরে পরীক্ষামূলকভাবে রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহারের মাধ্যমে নতুনভাবে শুরু হলো যুদ্ধ। হেবারকে পদোন্নতি দিয়ে জার্মান বাহিনীর ক্যাপ্টেন বানানো হলো। এদিকে হেগ চুক্তি ভঙ্গের প্রতিশোধ নিতে মিত্রবাহিনীও রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার শুরু করলো জার্মানদের উপর। অবশেষে আত্মসমর্পণ করলো অক্ষবাহিনী, উভয় পক্ষেরই এক লক্ষেরও বেশি মানুষ মারা গিয়েছে গ্যাসের আক্রমণে, লক্ষ লক্ষ মানুষ আহত হয়েছে হেবারের পরিকল্পনায় গড়ে ওঠা বিষের আঘাতে।

Source: www.imgc.allpostersimages.com

বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর অন্যান্য জার্মানদের সাথে হেবারও মাথা হেট করে ফিরে আসলেন নিজ দেশে। জার্মানি তখন বিধ্বস্ত, মুদ্রাস্ফীতির কারণে মানুষের বেঁচে থাকাও কষ্টকর হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেশের এই দুঃসময়ে হেবার সাগরের পানি ছেঁকে সোনা বের করার উপায় খুঁজতে থাকলেন! কিন্তু, বাতাস থেকে নাইট্রোজেন বের করা আর সাগরের পানি থেকে সোনা বের করা তো এক জিনিস নয়।

হেবারের অবস্থা আরো খারাপ হয়ে পড়লো যখন হিটলারের নাৎসি বাহিনী জার্মানির কর্তৃত্ব হাতে পেল। তার মতো ইহুদীদের বিরুদ্ধে তখন উঠেপড়ে লেগেছে নাৎসিরা। তার হাতে প্রতিষ্ঠিত হওয়া উইলহেম কাইসার বিজ্ঞান ইন্সটিটিউট তখন ইহুদী বিজ্ঞানীদের আঁতুড়ঘর। হেবারসহ তার ইহুদী সহকর্মীরা উৎখাত হলো জার্মানি থেকে। হেবার এবার পালিয়ে বেড়ালেন ইউরোপের এমাথা থেকে ওমাথা। ইংল্যান্ডের ক্যামব্রিজে অধ্যাপনা করতে গিয়ে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে নাম লেখালেন, ফ্রান্সেও তাই। এভাবে পালিয়ে বেড়ানোর ফলে শরীর খারাপ হয়ে পড়লো, সুইজারল্যান্ডে যাওয়ার পথেই তার হৃৎপিণ্ড প্রায় থেমে গিয়েছিল। তারপর সেখানে পৌঁছানোর পর হোটেল রুমেই দ্বিতীয়বার হার্ট অ্যাটাক করে পরলোকে পাড়ি জমালেন ১৯১৮ সালের এই নোবেল বিজয়ী। বিলাসিতায় ডুবে থাকা এই বিজ্ঞানী শেষ বয়সে মারা গেলেন একাকী এবং দেউলিয়া অবস্থায়, যে অশুভ জিনিসকে তিনি গড়ে তুলেছিলেন তা নিয়ে অনুতপ্ত হয়ে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার অনেক আগেই ইহলীলা সাঙ্গ করেছিলেন হেবার, কিন্তু তার আবিষ্কার করা অনেককিছুই ব্যবহার হচ্ছিল তখনো। যার মধ্যে একটি হলো জিকলন নামের হাইড্রোজেন-সায়ানাইড যৌগ। নাৎসি বিজ্ঞানীরা হেবারের এই আবিষ্কারকে সামান্য পরিবর্তন করে এর গন্ধটুকু বের করে নিলেন। এই গন্ধহীন গ্যাস বুকে টেনে নিয়ে অসউইটজ ক্যাম্পেই প্রাণ হারালেন হেবারের পরিবার-বন্ধুসহ কয়েক লক্ষ ইহুদী।

ফ্রিৎস হেবারকে নিয়ে ইতিহাসবিদরা এখনো বিতর্ক চালিয়ে যাচ্ছেন। কোটি কোটি লোকের অস্তিত্বই থাকতো না যদি না হেবার থাকতেন। আবার তিনি না থাকলে প্রথম বিশ্বযুদ্ধও অনেক আগেই শেষ হয়ে যেতে পারতো, কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পেও প্রাণ দিতে হতো না লক্ষ লক্ষ মানুষকে। একইসাথে সৃষ্টিশীল এবং ধ্বংসাত্মক, দয়ালু এবং পাষাণহৃদয় এই রসায়নবিদ যেমন নিজের মেধাকে কাজে লাগিয়ে কোটি কোটি মানুষকে পেটভরে খাইয়েছেন, তেমনি প্রতিপক্ষের করুণ আর্তনাদেও উৎফুল্ল হয়ে উঠেছেন। ফ্রিৎস হেবার যেন বিজ্ঞানের ব্যবহার আর অপব্যবহারের নিখুঁত উদাহরণ।

ফিচার ইমেজ: gohighbro

Related Articles