Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

ড. বি আর আম্বেদকর: নিম্নবর্ণের অস্পৃশ্য ছেলেটির বেড়ে ওঠা

বোম্বের এলফিনস্টন হাই স্কুল, শিক্ষক পড়াচ্ছেন ক্লাসে। উদাহরণের একটি সমস্যা সমাধানের জন্য ক্লাসের পেছনের বেঞ্চে বসা একজন ছাত্রকে ডাকলেন তিনি। ভীমরাও নামের ছাত্রটি উঠে আসছিলো ব্ল্যাকবোর্ডের দিকে। মুহূর্তের মধ্যে যেন পুরো ক্লাসে হুড়োহুড়ি শুরু হয়ে গেল। অন্যান্য ছাত্ররা তাদের টিফিন বক্স রাখতো ব্ল্যাকবোর্ডের পেছনে। ভীমরাও ব্ল্যাকবোর্ডের কাছে আসার আগেই সবাই তাড়াহুড়ো করে নিজেদের টিফিন বক্স সরাতে লাগলো। কারণ ভীমরাও কাছাকাছি আসলে যে, তাদের খাবার অপবিত্র হয়ে যাবে।

কী প্রচণ্ড ঘৃণা! কেন? কারণ ভীমরাও যে জন্মেছেন নিন্মবর্ণের পরিবারে। মহর পরিবারে জন্ম নেয়া একজন দলিত তিনি। তার কাছাকাছি আসলে কি খাবারের পবিত্রতা থাকবে? উচ্চবর্ণের মানুষদের তার সাথে মেশা শোভা পায়? ভীমরাওয়ের জন্য অবশ্য এসব নতুন কিছু না। সেই ছোটবেলা থেকে সয়ে আসছেন তিনি। বোম্বের এই স্কুলে তো তা-ও ক্লাসের বেঞ্চে বসার জায়গা মিলেছে। হোক না তা এককোণে। একদম শেষের সারির বেঞ্চে।

এলফিনস্টন হাই স্কুলের পুরনো ছবি; Image Source: wikipedia

অনেক ধর্না দেয়ার পর দাপোলিতে তিনি প্রথম স্কুলে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন। তখন গোটা স্কুলে তারা কেবল ছয়জন দলিত ছিলেন। তাদের জন্য আলাদা একটি কক্ষের বন্দোবস্ত ছিল। হিন্দু শিক্ষকরা সেই কক্ষে কখনো প্রবেশ করতেন না। দরজার বাইরে থেকে মাঝেমধ্যে খোঁজ খবর নিয়ে যেতেন। শিক্ষকদের কোনো প্রশ্ন করার অধিকার ছিলো না তাদের। কোনো কিছু না বুঝলেও চলে আসতে হতো সেভাবেই। সেই ছয়জন থেকে ভীমরাও একাই প্রাথমিক স্কুলের বেশী পড়ার সুযোগ পেয়েছিলেন।

পরবর্তীতে তার পরিবার দাপোলি থেকে সতরে চলে আসে। এখানে অবশ্য তিনি ক্লাসের ভেতরে ঢোকার সুযোগ পেয়েছিলেন। কিন্তু বেঞ্চিতে বসতে পারতেন না। ক্লাসের এক কোনে নিজের নিয়ে আসা পাটের বস্তাটি বিছিয়ে বসে পড়তেন। দিনশেষে আবার সেটি নিয়ে যেতেন সঙ্গে করে। কারণ স্কুল পরিষ্কার করা কর্মচারীও সেটি স্পর্শ করতেন না।

স্কুলের ট্যাপ খুলে বা জগ থেকে তার পানি পান করার অনুমতি ছিলো না। কারণ তার ছোঁয়ায় এসব অপবিত্র হয়ে যাবে। কেবল যখন উচ্চ বর্ণের কেউ ট্যাপ খুলে দিত বা জগ থেকে পানি ফেলত তখনই তার পানি পানের সুযোগ মিলত। এ ‘নিচু’ কাজটার দায়ভার সাধারণত স্কুলের পিয়নের কাঁধেই পড়তো। সে জগ থেকে পানি ঢালত ভীমরাওয়ের জন্য। অন্য কেউতো কাছেই ঘেঁষতো না তেমন। যেদিন পিয়ন থাকতো না, সেদিন তাকে তৃষ্ণার্ত হয়েই কাটাতে হতো।

ভীমরাও রামজি আম্বেদকর; Image Source: wikimedia commons

এতক্ষণ যার কথা বলেছি তার পুরো নাম ভীমরাও রামজি আম্বেদকর। দলিতরা যাকে ভালোবেসে ‘বাবা সাহেব’ বলে ডাকেন। পরবর্তীকালে যিনি হয়ে উঠেছিলেন তুখোড় অর্থনীতিবিদ ও দার্শনিক। তিনি হয়েছিলেন ভারতের প্রথম আইনমন্ত্রী, ভারতীয় সংবিধানের মুখ্য স্থপতি। তবে সবচেয়ে আগে তার যে পরিচয়টি দেয়া দরকার তা হলো, বর্ণবৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব। ১৯৯০ সালে ভারতের সর্বোচ্চ বেসামরিক উপাধি ‘ভারতরত্ন’-তে ভূষিত করা হয় তাকে।

বি আর আম্বেদকর জন্মেছিলেন ১৮৯১ সালে। বর্তমান ভারতের মধ্যপ্রদেশের মোহ অঞ্চলে। রামজি মালোজি শাকপাল ও ভীমাবাই এর চতুর্দশ সন্তান ছিলেন তিনি। তার পূর্বপুরুষদের অধিকাংশই ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে কর্মরত ছিলেন। তার পিতা রামজি শাকপাল একজন সুবেদার হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন। মূলত পিতার ইচ্ছাতেই তার স্কুলের পাঠ শুরু হয়। সেখানে দলিত হওয়ার কারণে তিনি শৈশবেই যে তীব্র বিদ্ধেষের মুখোমুখি হয়েছেন তা উপরের ঘটনাগুলো থেকে কিছুটা টের পাওয়া যায়।

তবে এ বিদ্ধেষ যে শুধু স্কুলেই সীমাবদ্ধ ছিল তা নয়। স্কুলের বাইরেও এ হেনস্থা তার পিছু ছাড়েনি। একবারের একটি ঘটনা তার মনে ভীষণ দাগ কেটে যায়। তার বয়স তখন নয়-দশ বছরের মতো। তারা ভাই-বোনরা মিলে সতর থেকে তার পিতার কর্মস্থল কোরগাঁও বেড়াতে যাচ্ছিলেন। সেদিন রেলস্টেশন থেকে তাকে তার বাবার এসে নিয়ে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে তিনি তাদের যাওয়ার খবর পাননি।

ভারতের প্রথম মন্ত্রণালয়; Image Source: wikipedia

রেলস্টেশন এসে ভীমরাওরা বেশ বিপাকে পড়লেন। তারা বাচ্চা কয়েকটি ছেলেমেয়ে, বড়সড় সব ব্যাগ সাথে, তার ওপর এখানে কিছুই চেনেন না তারা। অনেকক্ষণ অপেক্ষার পরও কেউ এলো না। স্টেশন মাস্টার এগিয়ে আসলেন কী হয়েছে জানতে। তারা সব বৃত্তান্ত বললেন তাকে। তিনি সব দেখেশুনে বেশ আগ্রহের সাথে তাদের সাহায্য করতে চাইলেন। তাদের নতুন জামাকাপড় দেখে তিনি তাদের ব্রাহ্মণসন্তানই ভেবেছিলেন। একসময় তিনি কথায় কথায় তাদের পরিচয় জানতে চাইলেন। তারা দ্বিতীয়বার না ভেবেই বলে দিলেন যে তারা মহর গোত্রের।

তারা দলিত শুনে স্টেশন মাস্টার যেন বড়সড় ধাক্কা খেলেন। তিনি পিছু হটে নিজের কামরায় চলে গেলেন। অবশ্য আধাঘন্টা পর ফের এলেন। চেষ্টা করলেন তাদের একটি গাড়িতে উঠিয়ে দিতে। কিন্তু কোনো গাড়ির চালক তাদের গাড়িতে উঠতে দিতে চায়নি। কারণ দলিতদের সাথে একই গাড়িতে চালক বসবেন কীভাবে? তাছাড়া গাড়িও অপবিত্র হয়ে যাবে। অবশেষে ভীমরাও নিজে সেদিন গাড়ি চালিয়েছিলেন, পাশে চালক হেঁটে গিয়েছেন। আর তাকে ভাঁড়াও দিতে হয়েছে দ্বিগুণ।

Image Source: Velivada.com

সে রাতে তাদের সাথে যথেষ্ট খাবার থাকা সত্ত্বেও তাদের অভুক্ত থাকতে হয়েছিল। কারণ তারা পানি জোটাতে পারেন নি। অস্পৃশ্যকে পানি দেবে কে? এসব তো কেবল খন্ডচিত্র। তারা যে পাড়ায় থাকতেন যেখানে অধিকাংশই উচ্চবর্ণের হিন্দু ছিল। সেখানে কোনো নাপিত তাদের চুল কেটে দিতো না, কোনো ধোপা তাদের কাপড় কেঁচে দিতো না। তার বড় বোনকেই তার ও তার ভাইদের চুল কেটে দিতে হতো।

আর এ বৈষম্য যে শুধু উচ্চবর্ণের হিন্দুরাই করতো তা নয়। তার একটি স্মৃতিকথা থেকে এর একটি প্রমাণ দেখা যায়। তার যুবক বয়সের কথা। একবার তারা কয়েকজন দলিত আওরঙ্গবাদ হয়ে যাচ্ছিলেন। তাদের যাত্রাপথেই পড়ছিল বিখ্যাত দৌলতাবাদ শহর। এখান দিয়ে যাওয়ার সময় কোনো পর্যটক ঐতিহাসিক দৌলতাবাদ দুর্গে না ঘুরে যান না। আম্বেদকর ও তার সঙ্গীরাও দৌলতাবাদ দুর্গ ঘুরে যাবেন বলে ঠিক করলেন।

সে এলাকাটি ছিল মুসলিমপ্রধান এলাকা। আর তখন মুসলমানদের পবিত্র রমজান মাস। দৌলতদিয়া দুর্গের সামনে পানিতে পরিপূর্ণ একটি কূপ ছিল। যেখানে মুসলমানরা অজু করতেন। আম্বেদকররা যখন সেখানে গেলেন তখন ধুলাবালিতে তাদের সারা শরীর আচ্ছন্ন হয়ে আছে। তারা কূপের পানি দিয়ে হাত মূখ ধুয়ে নিলেন। তারপর এগিয়ে গেলেন দুর্গের দিকে। হঠাত পেছন থেকে একজন বৃদ্ধ মুসলমান বলে উঠলেন, “এই অচ্ছুতেরা কূপের পানিকে অপবিত্র করে দিয়েছে।”

দৌলতাবাদ দুর্গ; Image Source: remotetraveler.com

তার কথা শেষ হওয়ার পর আরো কয়েকজন চেঁচিয়ে উঠলেন, “অচ্ছুতের দল বড় বাড় বেড়েছে”, “এদের একটা শিক্ষা দেয়া উচিৎ” মুহূর্তের মধ্যে যেন পুরো লড়াই বাঁধার উপক্রম। অবস্থা গুরুতর দেখে আম্বেদকররা সহ বোঝাতে লাগলেন যে, তারা বাইরে থেকে এসেছেন। এখানের স্থানীয় রীতিনীতি সম্পর্কে তাদের জানা নেই। কিন্তু মুসলিমরা থামছিলেন না। তারা ওখানের স্থানীয় দলিতদের ওপর চড়াও হলেন, তারা কেন এদের জানায় নি। আম্বেদকর দেখলেন যে, এভাবে চলতে থাকলে দাঙ্গা বাঁধাও অসম্ভব নয়।

তিনি মুসলমানদের বোঝাতে লাগলেন। কিন্তু কে শোনে কার কথা। পেছন থেকে এক তরুণ মুসলিম বলে উঠলেন, “সবার নিজেদের ধর্ম মেনে চলা উচিৎ। নিজেদের সীমার মধ্যে থাকা উচিৎ।” এ কথা শুনে আম্বেদকর আর রাগ ধরে রাখতে পারলেন না। ক্ষিপ্ত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “তোমার ধর্ম কী তোমাকে এই শিক্ষা দেয়? যদি এই অস্পৃশ্যরা মুসলমান হয়ে যায়, তবেও কী তুমি তাদের এই কূপের জল স্পর্শ করা থেকে বাঁধা দেবে?” তার প্রশ্নগুলো শুনে উপস্থিত মুসলমানরা যেন কিছুটা থমকে গেল।

সেদিন তিনি বুঝেছিলেন, কেবল উচ্চবর্ণের হিন্দুদের কাছেই তারা অস্পৃশ্য বা ঘৃণিত নন। ভারতের একটা বড় মুসলমান জনগোষ্ঠীর কাছেও তারা ঘৃণিত। তিনি তার জীবনের প্রতিটি পদে পদে দেখেছেন কীভাবে এক অদ্ভুত প্রথার কারণে তীব্র ঘৃণার বান ছুঁড়ে দেয়া হচ্ছে এক বিশাল জনগোষ্ঠীর দিকে। কীভাবে টেনে হিঁচড়ে সমাজের নিচু স্তরে দমিয়ে রাখা হচ্ছে তাদের। এসব ঘটনা তীব্রভাবে আহত করে তাকে। সমাজের কাঠামো নিয়ে প্রচন্ড হতাশ হয়ে পড়েন তিনি।

লক্ষ্ণৌতে ড. আম্বেদকরের ভাস্কর্য; Image Source: columbia.edu

তীব্র হতাশা থেকেই জন্ম হয় সমাজ সংস্কারকদের, বিপ্লবীদের। কেননা এ হতাশাই এনে দেয় সমাজ বদলানোর জিদ। যা বি আর আম্বেদকরের মনেও তীব্রভাবে জেগেছিল। তিনি তার জীবনের মিশন হিসেবে নিয়েছিলেন বর্ণবৈষম্য দূরীকরণকে। দলিতদের মুখপাত্র হয়ে উঠেছিলেন গোটা ভারতে। তাদের স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন এক সুন্দর ভবিষ্যতের। আর এসব কারণেই তিনি দলিতদের কাছে হয়ে উঠেছিলেন ভালোবাসার ‘বাবা সাহেব’।

আম্বেদকরের অনুপ্রেরণায় এখনো দলিতরা তাদের অধিকার আদায়ে সোচ্চার। তার গোটা জীবনই যেন এক প্রেরণার বাতিঘর। সেই ক্লাসে পাটের বস্তা বিছিয়ে বসা ছেলেটির বিশ্বব্যাপী সমাদৃত জ্ঞানী হয়ে ওঠা, দলিতদের নিয়ে তার আন্দোলন গড়ে তোলা, এরপর তার সংবিধানের স্থপতি ও ভারতের প্রথম আইনমন্ত্রী হওয়া- পুরো জীবন যেন অনন্য এক সংগ্রামী সফর। তার জীবনের অন্য কোনো দিক নিয়ে অন্য কোনো লেখায় আলোচনা করা যাবে। আজ এ পর্যন্তই থাক।

This article is in Bangla language. It's about B.R Ambedkar's childhood, who grew up as a untouchable child in india. 

References:

For reference check hyperlinks inside the article. 

Featured Image: youtube.com/Top viral

Related Articles