Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

মার্শাল গিওর্গি ঝুকভ: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শ্রেষ্ঠ সমরনায়ক || পর্ব ৮

(পর্ব ৭ এর পর থেকে)

“কিয়েভ শহরকে সম্পূর্ণভাবে নাৎসি হানাদারদের হাত থেকে মুক্ত করা হয়েছে!” (জোসেফ স্তালিনের উদ্দেশ্যে গিওর্গি ঝুকভ, ৭ নভেম্বর, ১৯৪৩)

মে, ১৯৪৩। জার্মান–নেতৃত্বাধীন অক্ষশক্তি কর্তৃক সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমণের প্রায় দুই বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। লাল ফৌজের তীব্র প্রতিরোধের কারণে জার্মানদের মস্কো, লেনিনগ্রাদ ও ককেশাস দখলের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে এবং স্তালিনগ্রাদের যুদ্ধে জার্মানি ও তার মিত্র রাষ্ট্রগুলো শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়েছে। কিন্তু তখনও পশ্চিম সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরাট এক অংশ জার্মানদের করতলগত। জার্মানির সামরিক সামর্থ্যের বড় একটি অংশ তখনো অটুট এবং যুদ্ধের মোড় ঘুরিয়ে দেয়ার জন্য তারা বড় ধরনের একটি আক্রমণ পরিচালনার প্রস্তুতি নিচ্ছে। এমতাবস্থায় সোভিয়েত উপ–প্রতিরক্ষামন্ত্রী ও লাল ফৌজের উপ–সর্বাধিনায়ক মার্শাল গিওর্গি ঝুকভের ওপর ন্যস্ত হলো এক অতি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব– জার্মানদের সম্ভাব্য আক্রমণ প্রতিহত করতে হবে!

কুরস্কের যুদ্ধ: বিশ্বের বৃহত্তম ট্যাঙ্ক যুদ্ধে ঝুকভ

১৯৪৩ সালের ১২ মে ঝুকভ তামান উপদ্বীপের যুদ্ধক্ষেত্র থেকে মস্কোয় ফিরে আসেন এবং তাকে লাল ফৌজের কেন্দ্রীয় ও ভরোনেঝ ফ্রন্টদ্বয়ের আত্মরক্ষামূলক ও আক্রমণাত্মক যুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণ তত্ত্বাবধান করার দায়িত্ব প্রদান করা হয়। সোভিয়েতদের পরিকল্পনা ছিল– তারা গভীর প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা তৈরি করবে, যাতে করে জার্মান আক্রমণ প্রতিহত করা যায় এবং এরপর তারা পাল্টা আক্রমণ পরিচালনা করবে। এই উদ্দেশ্যে তারা কুরস্ক অঞ্চলের অভ্যন্তরে ও পশ্চাদ্ভাগে ২০০–২৫০ মাইল গভীর বেশকিছু নিরাপত্তাবেষ্টনী তৈরি করে। বিশেষ করে ট্যাঙ্ক–বিধ্বংসী অবস্থান তৈরির ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়, কারণ জার্মানরা আসন্ন আক্রমণে বিপুল সংখ্যক ট্যাঙ্ক ব্যবহার করবে বলে ধারণা করা হচ্ছিল।

কুরস্কের যুদ্ধের সময় ঝুকভ (মাঝখানে) এবং জেনারেল ইভান কোনেভ; Source: Wikimedia Commons

সোভিয়েতরা তাদের প্রস্তুতি গোপন রাখার জন্য যথাসাধ্য প্রচেষ্টা চালায়। এর ফলে জার্মানরা সোভিয়েতদের যুদ্ধপ্রস্তুতির অধিকাংশ পর্যবেক্ষণ করতে পারলেও লাল ফৌজের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার শক্তি ও গভীরতা সম্পর্কে পুরোপুরি জানতে পারেনি এবং তাদের পাল্টা আক্রমণ চালানোর সামর্থ্যও আন্দাজ করতে পারেনি। তদুপরি, সোভিয়েত পার্টিজানরা (জার্মান–দখলকৃত ভূমিতে সক্রিয় সোভিয়েত গেরিলা বাহিনীসমূহ) লাল ফৌজকে অত্যন্ত কার্যকরী গোয়েন্দা সহায়তা প্রদান করে এবং জার্মানদের রণপ্রস্তুতিকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য শত শত ক্ষুদ্র মাত্রার আক্রমণ ও অন্তর্ঘাতমূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে।

সোভিয়েতদের এই রণপ্রস্তুতির ক্ষেত্রে ঝুকভের দায়িত্ব ছিল প্রস্তুতি পরিদর্শন করা, প্রস্তুতির অগ্রগতি সম্পর্কে স্তালিনের কাছে প্রতিবেদন পেশ করা এবং স্তাভকার প্রতিনিধি ও লাল ফৌজের উপ–সর্বাধিনায়ক হিসেবে মাঠ পর্যায়ের সমস্যাগুলোর সমাধান করা। সপ্তাহের পর সপ্তাহ ধরে ঝুকভ কুরস্ক অঞ্চল পরিভ্রমণ করেন এবং লাল ফৌজের যুদ্ধপ্রস্তুতির ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অংশ পর্যন্ত পরিদর্শন করেন। ইতোমধ্যে ২ জুলাই স্তাভকা এই মর্মে সতর্কবাণী লাভ করে যে, ৩ থেকে ৬ জুলাইয়ের মধ্যে জার্মানরা আক্রমণ চালাতে যাচ্ছে।

৪–৫ জুলাই জার্মানরা ‘অপারেশন সিটাডেল’ সাঙ্কেতিক নামবিশিষ্ট একটি সোভিয়েতবিরোধী আক্রমণাভিযান আরম্ভ করে। জার্মানদের উদ্দেশ্য ছিল আর্মি গ্রুপ সেন্টার ও আর্মি গ্রুপ সাউথ কর্তৃক কুরস্ক অঞ্চলকে পুরোপুরি ঘিরে ফেলা। এই অভিযানের জন্য জার্মানরা ১৮টি পদাতিক ডিভিশন, ৩টি মোটরাইজড ডিভিশন এবং ১৭টি ট্যাঙ্ক ডিভিশন মোতায়েন করে। জার্মান ট্যাঙ্কবহরে ছিল তাদের সর্বাধুনিক ‘টাইগার’ ও ‘প্যান্থার’ ট্যাঙ্ক, যেগুলোর সমকক্ষ কোনো কিছু সোভিয়েত অস্ত্রভাণ্ডারে ছিল না।

এই পর্যায়ে ঝুকভকে লাল ফৌজের কেন্দ্রীয়, ব্রিয়ানস্ক ও পশ্চিমাঞ্চলীয় ফ্রন্টের কার্যক্রম সমন্বয়ের দায়িত্ব প্রদান করা হয় এবং ধারণা করা হচ্ছিল, এই অঞ্চলেই জার্মানদের মূল আক্রমণ পরিচালিত হবে। যখন জার্মান আক্রমণ শুরু হয়, তখন ঝুকভ ছিলেন কেন্দ্রীয় ফ্রন্টের সদর দপ্তরে এবং তিনি আক্রমণকারী জার্মানদের ওপর লাল ফৌজের সুপরিকল্পিত ও অত্যন্ত তীব্র গোলাবর্ষণ ও বিমান হামলা প্রত্যক্ষ করেন। জার্মানরা কিছু কিছু স্থানে অগ্রসর হতে সক্ষম হয়, কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে সোভিয়েতরা তাদের অবস্থান বজায় রাখতে সক্ষম হয়। ১১–১২ জুলাই প্রোখোরোভকায় লাল ফৌজের ৫ম রক্ষী ট্যাঙ্ক আর্মির সঙ্গে দুটি জার্মান প্যাঞ্জার কোরের লড়াই হয় এবং এই লড়াইয়ে উভয় পক্ষের শত শত ট্যাঙ্ক ধ্বংস হয়। বস্তুত কুরস্কের যুদ্ধ ছিল ইতিহাসের বৃহত্তম ট্যাঙ্ক যুদ্ধ!

কুরস্কের যুদ্ধের সময় সোভিয়েত–নির্মিত ‘টি–৩৪’ ট্যাঙ্কের পিছনে সোভিয়েত সৈন্যরা; Source: Wikimedia Commons

জার্মানরা ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হওয়ায় হিটলার জার্মান আক্রমণ বন্ধ করার নির্দেশ দিতে বাধ্য হন। কুরস্কের যুদ্ধ ছিল যুদ্ধের গতি নিজেদের নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য জার্মানদের সর্বশেষ প্রচেষ্টা। কিন্তু এই প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয় এবং এটি নিশ্চিত হয়ে যায় যে, এই প্রলম্বিত ও অত্যন্ত রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ে জার্মানির পক্ষে আর বিজয়ী হওয়া সম্ভব নয়, কারণ সোভিয়েত ইউনিয়নের শিল্পসামর্থ্য ও জনবল উভয়ই ছিল জার্মানির চেয়ে বেশি।

অপারেশন রুমিয়ান্তসেভ: ঝুকভের খারকভ বিজয়

কুরস্কে জার্মান আক্রমণ প্রতিহত করার পর সোভিয়েতরা পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী দুটি প্রতিআক্রমণ অভিযান শুরু করে, যেগুলোর সাঙ্কেতিক নাম ছিল ‘অপারেশন কুতুজভ’ এবং ‘অপারেশন রুমিয়ান্তসেভ’। ১২ জুলাই ওরেল অঞ্চলে জার্মান আর্মি গ্রুপ সেন্টারের ওপর লাল ফৌজের পশ্চিমাঞ্চলীয়, ব্রিয়ানস্ক ও কেন্দ্রীয় ফ্রন্ট কর্তৃক পরিচালিত আক্রমণের মধ্য দিয়ে অপারেশন কুতুজভ শুরু হয়। ৫ আগস্টের মধ্যে সোভিয়েতরা ওরেল পুনর্দখল করে নেয়, কিন্তু এর মধ্যে জার্মানরা তাদের সৈন্যদলের বড় একটি অংশ ওরেল থেকে নিরাপদে প্রত্যাহার করে নিতে সক্ষম হয়।

অপারেশন কুতুজভের সঙ্গে ঝুকভ সরাসরি সম্পৃক্ত ছিলেন না, কারণ তাকে অপারেশন রুমিয়ান্তসেভ তত্ত্বাবধান করার দায়িত্ব ছিল। এই অপারেশনের উদ্দেশ্য ছিল বেলগরোদ–খারকভ অঞ্চলে জার্মান আর্মি গ্রুপ সাউথের ওপর লাল ফৌজের ভরোনেঝ ও স্তেপ ফ্রন্ট কর্তৃক আক্রমণ পরিচালনা। স্তালিন ২৩ জুলাই এই অভিযান শুরু করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু ঝুকভ তাকে বোঝাতে সক্ষম হন যে, আক্রমণ শুরুর আগে তাদের পর্যাপ্ত প্রস্তুতি গ্রহণ করা প্রয়োজন। অবশেষে ৫ আগস্ট অপারেশন রুমিয়ান্তসেভ শুরু হয় এবং একই দিনে সোভিয়েত সৈন্যরা বেলগরোদ পুনর্দখল করে নিতে সক্ষম হয়। তীব্র যুদ্ধের পর ২৩ আগস্ট সোভিয়েত সৈন্যরা খারকভ পুনর্দখল করে।

একই সময়ে সোভিয়েতরা ‘অপারেশন সুভোরভ’ নামক আরেকটি আক্রমণাভিযান পরিচালনা করে। এই অভিযানে লাল ফৌজের পশ্চিমাঞ্চলীয় ও কালিনিন ফ্রন্ট ১৫০-২০০ মাইল পর্যন্ত অগ্রসর হয় এবং সেপ্টেম্বর নাগাদ জার্মানদের কাছ থেকে স্মোলেনস্ক পুনর্দখল করে নেয়।

মানচিত্রে ঝুকভ কর্তৃক পরিচালিত অপারেশন রুমিয়ান্তসেভ; Source: Wikimedia Commons

অপারেশন কুতুজভ, রুমিয়ান্তসেভ ও সুভোরভ ছিল লাল ফৌজের গ্রীষ্মকালীন আক্রমণাভিযানের অংশ, যেটির উদ্দেশ্য ছিল বিস্তৃত এক রণাঙ্গন বরাবর জার্মানদের পশ্চাদপসরণে বাধ্য করা। ১৯৪৩ সালের শরৎকালের প্রারম্ভে লাল ফৌজ দনেপ্র নদী অতিক্রম করে এবং সমগ্র ইউক্রেনকে জার্মান দখলদারিত্ব থেকে মুক্ত করার জন্য অভিযান শুরু করে। লাল ফৌজের ৫টি ফ্রন্ট (ভরোনেঝ, স্তেপ, দক্ষিণ–পশ্চিমাঞ্চলীয়, দক্ষিণাঞ্চলীয় ও কেন্দ্রীয়) এই অভিযানে জড়িত ছিল। ১৯৪৩ সালের অক্টোবরে এদের মধ্যে প্রথম চারটিকে যথাক্রমে ১ম, ২য়, ৩য় ও ৪র্থ ইউক্রেনীয় ফ্রন্ট নামকরণ করা হয়, আর কেন্দ্রীয় ফ্রন্টকে বেলোরুশীয় ফ্রন্ট নামকরণ করা হয়।

কিয়েভ বিজয়: বলশেভিক বিপ্লবের বর্ষপূর্তি উপলক্ষে স্তালিনের জন্য ঝুকভের ‘উপহার’

ঝুকভ প্রথমে ১ম ও ২য় ইউক্রেনীয় ফ্রন্টের স্তাভকা সমন্বয়কারী হিসেবে এবং পরবর্তীতে ১ম ইউক্রেনীয় ফ্রন্টের অধিনায়ক হিসেবে ইউক্রেন অভিযানে কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করেন। এই পর্যায়ে স্তালিন ও ঝুকভের মধ্যে রণনীতি নিয়ে মতপার্থক্য দেখা দেয়। যুদ্ধের চাকা নিশ্চিতভাবে সোভিয়েতদের পক্ষে ঘুরে যাওয়ায় এবং সোভিয়েতদের শক্তিসামর্থ্য জার্মানদের চেয়ে অনেক বেশি হওয়ায় স্তালিন তার সেনাপতিদের কাছ থেকে অধিকতর সাফল্য প্রত্যাশা করছিলেন। রাজনৈতিক কারণে তিনি চাচ্ছিলেন লাল ফৌজ দ্রুত যত বেশি সম্ভব সোভিয়েত ভূমি পুনর্দখল করুক। অন্যদিকে, ঝুকভ চাচ্ছিলেন স্তালিনগ্রাদের মতো করে শত্রুপক্ষের একেকটি সৈন্যদলকে ঘেরাও করে সেগুলোকে ধ্বংস করে দিতে।

কিন্তু ইতিপূর্বে জার্মান সৈন্যদলগুলোকে ঘেরাও করার অনেকগুলো সোভিয়েত প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছিল এবং এজন্য স্তালিন ঝুকভের রণনীতির সঙ্গে একমত ছিলেন না। অবশ্য এতদিনে ঝুকভ ভালোভাবেই বুঝতে পেরেছিলেন যে, স্তালিন একবার কোনো সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করার পর সেটি নিয়ে তার সঙ্গে তর্ক করা নিরর্থক। এজন্য তিনি স্তালিনের নির্দেশনা মোতাবেক কাজ করতে বাধ্য হন।

স্তালিন ঝুকভকে ৭ অক্টোবরের মধ্যে কিয়েভ পুনর্দখলের নির্দেশ দিয়েছিলেন, কিন্তু জার্মানদের তীব্র প্রতিরোধের মুখে এই নির্দেশ বাস্তবায়ন করা ঝুকভের পক্ষে সম্ভব হয়নি। ২৪ অক্টোবর ঝুকভ স্তালিনকে ১ম ইউক্রেনীয় ফ্রন্টের ব্যর্থতার কারণ ব্যাখ্যা করে একটি বার্তা প্রেরণ করেন এবং আক্রমণ স্থগিত রেখে অতিরিক্ত সৈন্য ও রসদপত্র সরবরাহের জন্য অনুরোধ করেন। স্তালিন ঝুকভকে মৃদু তিরস্কার করেন, কিন্তু তাকে অতিরিক্ত সৈন্য ও রসদপত্র সরবরাহ করতে সম্মত হন। কিয়েভ পুনর্দখলের জন্য ঝুকভকে ৭ নভেম্বর পর্যন্ত সময় দেয়া হয়। উল্লেখ্য, ৭ নভেম্বর বলশেভিক বিপ্লব দিবস এবং এই দিন কিয়েভ পুনর্দখলের মধ্য দিয়ে স্তালিন একটি বিরাট প্রতীকী বিজয় অর্জন করতে চেয়েছিলেন।

১৯৪৩ সালের নভেম্বরে ইউক্রেনের ঝিতোমিরে জার্মান ‘প্যাঞ্জার–৫’ ট্যাঙ্ক; Source: Wikimedia Commons

৩ নভেম্বর ঝুকভের ১ম ইউক্রেনীয় ফ্রন্ট কিয়েভের ওপর আক্রমণ শুরু করে। ২,০০০ কামান ও মর্টার এবং ৫০টি ‘কাতিউশা’ রকেট লঞ্চার একযোগে কিয়েভে জার্মানদের অবস্থানের ওপর গোলাবর্ষণ করে এবং এর মধ্য দিয়ে আক্রমণ শুরু হয়। এটি ছিল তখন পর্যন্ত পূর্ব রণাঙ্গনে সংঘটিত বৃহত্তম আর্টিলারি হামলা। তিন দিনের মধ্যে ঝুকভের সৈন্যরা কিয়েভ পুনর্দখল করতে সক্ষম হয় এবং ৭ নভেম্বর ঝুকভ এই বিজয়ের সংবাদ টেলিগ্রামের মাধ্যমে স্তালিনকে প্রেরণ করেন।

কিয়েভ অধিকারের পর ইউক্রেনে লাল ফৌজের আক্রমণাভিযান অব্যাহত থাকে এবং ১৯৪৩ সালের শেষ নাগাদ সোভিয়েত সৈন্যরা দনেপ্র নদীর পশ্চিমে সুদৃঢ় অবস্থান গড়ে তোলে। জার্মানরা ৫০-৮০ মাইল পশ্চাৎপসরণ করতে বাধ্য হয়।

সুপ্রিম কমান্ড সম্মেলন এবং কোর্সুন–শেভচেঙ্কোভস্কির লড়াই

১৯৪৩ সালের ডিসেম্বরে ঝুকভকে একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন সুপ্রিম কমান্ড সম্মেলনে অংশগ্রহণের জন্য মস্কোয় ডেকে পাঠানো হয়। স্তালিন সবে ইরানের তেহরানে অনুষ্ঠিত মিত্রশক্তির একটি সম্মেলন থেকে ফিরেছিলেন এবং সেখানে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল ও মার্কিন রাষ্ট্রপতি ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্ট তাকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে, ১৯৪৪ সালের গ্রীষ্মকালে পশ্চিমা মিত্রশক্তি উত্তর ফ্রান্সে আক্রমণ চালাবে। স্তালিনও প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে, পশ্চিমা মিত্রশক্তির ফ্রান্স আক্রমণের সময়ে সোভিয়েতরা পূর্ব রণাঙ্গনে একটি বৃহৎ মাত্রার আক্রমণাভিযান পরিচালনা করবে।

মস্কোয় অনুষ্ঠিত সুপ্রিম কমান্ড সম্মেলনে স্তালিন, ঝুকভ, ভাসিলেভস্কি ও আন্তোনোভ, লাল ফৌজের জেনারেল স্টাফের কর্মকর্তাবৃন্দ এবং শীর্ষ সোভিয়েত রাজনৈতিক নেতারা অংশগ্রহণ করেন। এই সম্মেলনের উদ্দেশ্য ছিল যুদ্ধক্ষেত্রের কৌশলগত পরিস্থিতি মূল্যায়ন করা এবং পরবর্তী বৃহৎ মাত্রার আক্রমণাভিযানের জন্য কর্মপরিকল্পনা নির্ধারণ করা। এই পর্যায়ে সোভিয়েতরা জার্মানদের কাছে হারানো ভূমির অর্ধেক পুনরুদ্ধার করেছিল এবং স্তালিনগ্রাদের যুদ্ধের পর জার্মানদের ৫৬টি ডিভিশন ধ্বংস হয়েছিল ও ১৬২টি ডিভিশন মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। বড় ধরনের কোনো আক্রমণাভিযান পরিচালনার ক্ষমতা আর তাদের ছিল না।

কিন্তু তখনো জার্মানি ও তার মিত্র রাষ্ট্রগুলোর কাছে ছিল ৫০ লক্ষ সৈন্য, ৫৪,৫০০টি কামান ও মর্টার, ৫,৪০০টি ট্যাঙ্ক ও অ্যাসল্ট গান এবং ৩,০০০টির বেশি যুদ্ধবিমান। এই শক্তির সাহায্যে তারা সোভিয়েতদের বিরুদ্ধে সক্রিয় প্রতিরক্ষা গড়ে তুলতে সক্ষম ছিল। অন্যদিকে, সোভিয়েতদের জনবল, আর্টিলারি ও বিমান ছিল অক্ষশক্তির তুলনায় যথাক্রমে ৩০%, ৭০% এবং ২৩০% বেশি। এই পরিস্থিতিতে সম্মেলনে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় যে, সোভিয়েতরা উত্তরে লেনিনগ্রাদ থেকে দক্ষিণে ক্রিমিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত এক শীতকালীন আক্রমণাভিযান চালাবে, কিন্তু তাদের মূল লক্ষ্য হবে দনেপ্র নদীর পশ্চিমে অবস্থিত ইউক্রেনের বাকি অংশ মুক্ত করা।

মানচিত্রে কোর্সুন–শেভচেঙ্কোভস্কি অঞ্চলের লড়াই; Source: Wikimedia Commons

ডিসেম্বরের মাঝামাঝিতে ঝুকভ যুদ্ধক্ষেত্রে ফিরে যান এবং মাসখানেক পর তার ১ম ইউক্রেনীয় ফ্রন্ট ও ইভান কোনেভের নেতৃত্বাধীন ২য় ইউক্রেনীয় ফ্রন্টকে কোর্সুন–শেভচেঙ্কোভস্কি অঞ্চলে অবস্থানরত জার্মান সৈন্যদলকে নির্মূল করার দায়িত্ব প্রদান করা হয়। ঝুকভ ও কোনেভের সৈন্যরা জার্মানদেরকে ঘিরে ফেলতে সক্ষম হয়, কিন্তু তাদের ধ্বংস করা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। স্তালিন এতে অসন্তুষ্ট হন এবং ১২ ফেব্রুয়ারি ঝুকভকে তীব্র ভর্ৎসনা করেন। কোনেভকে উক্ত জার্মান সৈন্যদলকে ধ্বংস করার দায়িত্ব প্রদান করা হয় এবং ঝুকভকে কোনেভের অভিযানকে জার্মান আক্রমণ থেকে রক্ষা করার দায়িত্ব দেয়া হয়। এক সপ্তাহ পর কোনেভ জার্মান সৈন্যদলটিকে ধ্বংস করতে সক্ষম হন এবং এই বিজয়ের কৃতিত্ব এককভাবে কোনেভকেই প্রদান করা হয়।

মস্কোর লড়াইয়ের পর ১ম ইউক্রেনীয় ফ্রন্টের অধিনায়কত্ব ছিল ঝুকভের প্রথম ‘অপারেশনাল’ কমান্ড। তার দায়িত্ব ছিল পশ্চিম ইউক্রেনে চলমান আক্রমণাভিযান অব্যাহত রাখা এবং দনেস্তর নদী পর্যন্ত অগ্রসর হওয়া, যাতে জার্মান আর্মি গ্রুপ সাউথ রুমানিয়ায় পশ্চাৎপসরণ করতে না পারে। কয়েক সপ্তাহ ধরে দনেস্তর অঞ্চলের যুদ্ধ চলতে থাকে, কিন্তু ঝুকভের মনোযোগ ক্রমশ পরবর্তী সোভিয়েত মহাপরিকল্পনার প্রতি নিবদ্ধ হতে থাকে।

অপারেশন বাগ্রাতিয়ন: সোভিয়েত মহাবিজয়ে ঝুকভের অবদান

১৯৪৪ সালের এপ্রিল থেকে মে মাসের মধ্যে স্তাভকা পূর্ব রণাঙ্গন জুড়ে এক বিস্তৃত আক্রমণাভিযান পরিচালনার পরিকল্পনা প্রণয়ন করে। এই অভিযানের সাঙ্কেতিক নামকরণ করা হয় ‘অপারেশন বাগ্রাতিয়ন’। ১৫ মে স্তালিন ঝুকভকে ১ম ইউক্রেনীয় ফ্রন্টের অধিনায়কত্বের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি প্রদান করেন এবং তাকে মস্কোয় ডেকে পাঠান। ২৫, ২৬ ও ২৭ মে ঝুকভ ও লাল ফৌজের অন্যান্য উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা স্তালিনের সঙ্গে তিনটি প্রলম্বিত বৈঠকে অংশ নেন এবং এসময় অপারেশন বাগ্রাতিয়ন সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করা হয়। এই অভিযানের উদ্দেশ্য ছিল জার্মান আর্মি গ্রুপ সেন্টারকে ধ্বংস করা এবং বেলোরুশিয়াকে দখলমুক্ত করা।

এই পরিকল্পনাটি ছিল সংক্ষেপে এরকম: জুনের প্রথম দিকে লাল ফৌজের লেনিনগ্রাদ ফ্রন্ট ফিনল্যান্ডে অগ্রসর হবে এবং এরপর ১ম ইউক্রেনীয় ফ্রন্ট বেলোরুশিয়ায় (বর্তমান বেলারুশ) একটি অতর্কিত আক্রমণ চালিয়ে এরপর লভোভের দিকে অগ্রসর হবে। এরপর ১ম বেলোরুশীয় ফ্রন্ট বারোনোভিচি, ব্রেস্ত ও ওয়ারশর দিকে, ২য় বেলোরুশীয় ফ্রন্ট মিনস্কের দিকে এবং ৩য় বেলোরুশীয় ফ্রন্ট ভিলনিয়াসের দিকে অগ্রসর হবে। ১ম, ২য় ও ৩য় বেলোরুশীয় ফ্রন্ট এবং ১ম ইউক্রেনীয় ফ্রন্টে ছিল মোট ২৪ লক্ষ সৈন্য, ৫,২০০টি ট্যাঙ্ক, ৩৬,০০০ আর্টিলারি পিস এবং ৫,৩০০টি যুদ্ধবিমান। জনবল, ট্যাঙ্ক এবং আর্টিলারি ও যুদ্ধবিমানের ক্ষেত্রে সোভিয়েতরা জার্মানদের তুলনায় যথাক্রমে দ্বিগুণ, ৬ গুণ এবং চতুর্গুণ শক্তিশালী ছিল।

১৯৪৪ সালের ৬ জুন পশ্চিমা মিত্রশক্তি উত্তর ফ্রান্সে আক্রমণ চালায় এবং তাদের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে সোভিয়েতরাও অপারেশন বাগ্রাতিয়ন শুরুর প্রস্তুতি গ্রহণ করে। অভিযানটির জন্য সোভিয়েতরা ব্যাপক বিস্তৃত প্রস্তুতি গ্রহণ করেছিল। এ সময় ঝুকভ ছিলেন ১ম ও ২য় বেলোরুশীয় ফ্রন্টের সমন্বয়ক এবং তিনি ফ্রন্ট দুটির রণপ্রস্তুতির তত্ত্বাবধান করেন।

মানচিত্রে অপারেশন বাগ্রাতিয়ন; Source: Wikimedia Commons

১৯৪৪ সালের ১৯–২০ জুন বেলোরুশিয়ায় জার্মানদের যোগাযোগ ব্যবস্থা, স্টাফ সদর সপ্তর ও বিমানঘাঁটিগুলোর ওপর সোভিয়েত পার্টিজানদের তীব্র আক্রমণের মধ্য দিয়ে অপারেশন বাগ্রাতিয়ন আরম্ভ হয়। ২১–২২ জুন সোভিয়েত বিমানবাহিনী জার্মানদের ওপর প্রচণ্ড আক্রমণ চালায় এবং পার্টিজানরা এক্ষেত্রে অগ্রবর্তী পর্যবেক্ষক হিসেবে কাজ করে। ২৩ জুন লাল ফৌজের স্থল আক্রমণ আরম্ভ হয় এবং সেটি ব্যাপক সাফল্য অর্জন করে। সোভিয়েত সৈন্যরা ৫০০ মাইল প্রশস্ত এক রণাঙ্গন বরাবর জার্মানদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা চূর্ণ করে দেয় এবং দ্রুত মিনস্কের দিকে অগ্রসর হয়। ৩ জুলাই লাল ফৌজ মিনস্ক পুনর্দখল করে এবং ঝুকভ শহরে সফর করেন।

মিনস্কের পূর্বে সোভিয়েত সৈন্যরা ১ লক্ষ জার্মান সৈন্যকে ঘিরে ফেলে, ঠিক যেমন ১৯৪১ সালে জার্মানরা সেখানে সোভিয়েত সৈন্যদের ঘিরে ফেলেছিল। ১৩ জুলাই লাল ফৌজ ভিলনিয়াস পুনর্দখল করে। জুলাইয়ের মাঝামাঝি ১ম ইউক্রেনীয় ফ্রন্ট লভোভ–সান্দোমিয়ের্জ অপারেশন শুরু করে এবং ঝুকভকে এই অভিযানে স্তাভকার সমন্বয়কারী হিসেবে নিযুক্ত করা হয়। ২৭ জুলাই সোভিয়েত সৈন্যরা লভোভ পুনর্দখল করে। এর দুই দিন পর ইউক্রেন ও বেলোরুশিয়া শত্রুমুক্ত করার ক্ষেত্রে ঝুকভের অবদানের জন্য তাকে দ্বিতীয়বারের মতো সোভিয়েত ইউনিয়নের সর্বোচ্চ সামরিক পদক ‘হিরো অফ দ্য সোভিয়েত ইউনিয়ন’ প্রদান করা হয়। ১৯৩৯ সালে খালখিন গোল যুদ্ধে জাপানিদের পরাজিত করার পর তিনি প্রথমবার এই পদক অর্জন করেছিলেন।

১৯৪৪ সালের ২২ জুন থেকে ৪ জুলাইয়ের মধ্যে জার্মান আর্মি গ্রুপ সেন্টার অন্তত ৩ লক্ষ সৈন্য হারায় এবং পরবর্তী সপ্তাহগুলোতে তারা আরো ১ লক্ষ সৈন্য হারায়। জুলাইয়ের শেষ নাগাদ এটি কার্যত ধ্বংস হয়ে যায়। অবশ্য এই অভিযানে সোভিয়েতদেরও প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয় এবং তারা প্রায় সাড়ে ৭ লক্ষ সৈন্য হারায়। কিন্তু অপারেশন বাগ্রাতিয়ন ছিল সোভিয়েতদের জন্য একটি বিশাল বিজয়। এই অভিযান যখন শেষ হয়, তখন বেলোরুশিয়া ও পশ্চিম ইউক্রেন সম্পূর্ণভাবে শত্রুমুক্ত ছিল, ফিনল্যান্ড আত্মসমর্পণ করার পর্যায়ে ছিল, সোভিয়েত সৈন্যরা বাল্টিক রাষ্ট্রগুলোর গভীরে অগ্রসর হয়েছিল এবং দক্ষিণ দিকে তারা হাঙ্গেরি, রুমানিয়া ও যুগোস্লাভিয়া আক্রমণের জন্য প্রস্তুত হচ্ছিল। ইতিহাসবিদ জন এরিকসনের মতে, অপারেশন বাগ্রাতিয়নে সোভিয়েতদের অর্জিত বিজয় ছিল স্তালিনগ্রাদে তাদের অর্জিত বিজয়ের চেয়েও বড়!

অপারেশন বাগ্রাতিয়নে জার্মানরা বিধ্বস্ত হয়েছিল, কিন্তু পুরোপুরি ধ্বংস হয়নি। সোভিয়েতদের উদ্দেশ্য ছিল নাৎসি জার্মানির সমরযন্ত্রকে পুরোপুরি ধ্বংস করে দেয়া এবং এই উদ্দেশ্য পূরণ করার জন্য তারা আরো প্রায় এক বছর যুদ্ধ চালিয়ে যায়। সুতরাং ঝুকভের যুদ্ধ তখনো শেষ হয়নি, কেবল চূড়ান্ত পর্যায়ে উপনীত হয়েছিল মাত্র!

(এরপর দেখুন ৯ম পর্বে)

Related Articles