Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website. The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

কোয়ান্টাম পরিসংখ্যান এবং বাঙালীর গর্ব সত্যেন্দ্রনাথ বসু

আমি নিশ্চিতভাবে বলতে পারি সত্যেন্দ্রনাথ শব্দটি দেখে প্রথমেই অধিকাংশের মনের মধ্যে কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের কথা চলে এসেছে। কিন্তু না, এখানে সত্যেন্দ্রনাথ এর পরের শব্দটি ‘দত্ত’ নয়, ‘বসু’; বাঙালী বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসু, যিনি বোস-আইনস্টাইন পরিসংখ্যান আবিষ্কারের জন্য দুনিয়াজুড়ে খ্যাতি লাভ করেন, যার নামের কারণে শুরুর দিকে বাংলাদেশের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম পশ্চিমা বিশ্বে পরিচিতি লাভ করে। হ্যাঁ, সত্যেন্দ্রনাথ বসু তিনি, যার কথা আজও বাঙালী গর্বভরে স্মরণ করে একজন বাঙালী বিজ্ঞানী হিসেবে।

সত্যেন্দ্রনাথ বসু (১৮৯৪-১৯৭৪); ছবিসূত্রঃ photodivision.gov

জন্ম ও প্রাথমিক জীবন

১৮৯৪ সাল, যখন ভারতবর্ষ ছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অধীনে, সেই ব্রিটিশ-ভারতের রাজধানী ক্যালকাটায় (বর্তনাম নাম কলকাতা যা ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যে অবস্থিত) তৎকালীন বেঙ্গল প্রেসিডেন্সিতে পহেলা জানুয়ারি এক মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন সত্যেন্দ্রনাথ বসু। তার বাবা সুরেন্দ্রনাথ বসু ছিলেন ‘ইস্ট ইন্ডিয়া রেলওয়ে কোম্পানি’ এর একজন হিসাবরক্ষক। তার গণিত এবং বিজ্ঞানের প্রতি ছিল অদম্য আকর্ষণ। এই আকর্ষণ থেকেই তিনি ১৯০৩ সালে তিনি একটি ফার্মাসিউটিক্যাল ও কেমিক্যাল কোম্পানি চালু করেন। সত্যেন্দ্রনাথের মা ছিলেন আমোদিনী দেবী। সত্যেন্দ্রনাথ ছিলেন তার বাবা-মায়ের ৭ সন্তানের জ্যেষ্ঠ সন্তান। তবে সাতজনের মধ্যে কেবল সত্যেনই ছিলেন ছেলে।

প্রাথমিকভাবে সত্যেন্দ্রনাথ স্থানীয় এলিমেন্টারি স্কুলে ভর্তি হন। তবে পরবর্তীতে তার পরিবার কলকাতার গোয়াবাগান নামক স্থানে চলে গেলে তিনি ‘নিউ ইন্ডিয়ান স্কুল’ এর শিক্ষার্থী হন। শৈশব থেকেই তিনি ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী। তার বাবাই মূলত তার গণিতে দক্ষতা বাড়াতে মূল ভূমিকা পালন করেন। সুরেন্দ্রনাথ প্রতিদিন কাজে যাবার সময় ঘরের মেঝেতে বিভিন্ন গাণিতিক সমস্যা লিখে যেতেন যা সত্যেন্দ্রনাথ তার বাবা বাড়ি ফেরার পূর্বেই সমাধান করে রাখতেন।এভাবে ধীরে ধীরে তার গণিতের প্রতি ঝোঁক অত্যন্ত বেড়ে যায় এবং দক্ষতাও বাড়ে। ১৯০৭ সালে ১৩ বছর বয়সে তিনি ভারতের অন্যতম পুরাতন বিদ্যালয় ‘দ্য হিন্দু স্কুল’ এর ভর্তি পরীক্ষায় ৫ম স্থান অধিকার করেন এবং সেখানে ভর্তি হন। স্কুলে ভর্তির অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি গণিতে অত্যন্ত ভালো শিক্ষার্থী হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। তার গণিত শিক্ষক বিশ্বাস করতেন যে সত্যেন্দ্রনাথ একদিন পিয়েরে লাপ্লাসের মতো বিখ্যাত গণিতবিদ হবেন।

উচ্চ শিক্ষা

বিখ্যাত বাঙালী বিজ্ঞানীদের সাথে সত্যেন্দ্রনাথ বসু; ছবিসূত্রঃ en.wikipedia.org/wik

মাধ্যমিক শিক্ষার গন্ডি পেরিয়ে ১৯০৯ সালে তিনি তৎকালীন ক্যালকাটার প্রেসিডেন্সী কলেজে ভর্তি হন। তিনি ফলিত গণিতে তার স্নাতক পড়ালেখা শুরু করেন। এবং এখানেও তার মেধার বিচ্ছুরণ ঘটার কোনরূপ ব্যত্যয় ঘটেনি। তিনি প্রথম স্থান অধিকার করে স্নাতক পড়ালেখা শেষ করেন ১৯১৩ সালে। গণিতে নিজের অসাধারণ দক্ষতার জন্যই হোক কিংবা ইচ্ছার জন্যই হোক, তিনি ততদিনে ঠিক করে ফেলেছেন যে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা করবেন। তিনি তৎকালীন ক্যালকাটা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফলিত গণিতে স্নাতকোত্তর পড়ালেখা শুরু করেন। ২১ বছর বয়সে, ১৯১৫ সালে তিনি সেখান থেকে মাস্টার্স ডিগ্রী লাভ করেন। এবং এবারো তিনি প্রথম স্থান অধিকার করেন। তার যে মেধা, তাতে তিনি প্রথম হবেন এটাই স্বাভাবিক ছিল। তবে যা শুনলে আপনি কিছুটা হলেও বিস্মিত হবেন তা হলো তিনি পরীক্ষায় রেকর্ড স্কোর করেন যা এখনো কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে অক্ষত আছে!

এরই মাঝে তিনি দুটি কাজ করে ফেলেন। একটি হলো তিনি জার্মান ও ফ্রেঞ্চ ভাষায় মোটামুটি রকমের দক্ষতা অর্জন করেন। আর অন্যটি হলো, উষা দেবীকে বিয়ে করেন।

প্রবীণ সত্যেন্দ্রনাথ বসু এবং তার স্ত্রী উষা; ছবিসূত্রঃ humanitycollege.org

গবেষণা এবং অধ্যাপনা

অনার্স এবং মাস্টার্স, উভয় ক্ষেত্রেই এতো চমৎকার ফলাফল করেও সত্যেন্দ্রনাথ দুর্ভাগ্যজনকভাবে পিএইচডি ডিগ্রী করতে পারেননি। এর পেছনে মূলত দুটি কারণ ছিল। প্রথমত ১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে ভারতীয় উপমহাদেশে পশ্চিমা বিশ্বে প্রকাশিত বিজ্ঞানের গবেষণাপত্রগুলো খুব একটা আসতো না। অপর সমস্যাটি ছিল এই যে, ক্যালকাটা বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি ডিগ্রী একেবারেই নতুন ছিল। ফলে সেখানে যথেষ্ট সুযোগ সুবিধা ছিল না।

ক্যালকাটা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য স্যার আশুতোষ মুখার্জি এ ব্যাপারে প্রথম উদ্যোগ নেন। তাকে দুজন প্রখ্যাত আইনজীবী বিশাল অঙ্কের অর্থ অনুদান দেন উচ্চ শিক্ষার উন্নয়নের জন্য। পোস্ট গ্র্যাজুয়েট কোর্সগুলোতে পাঠদানের জন্য স্যার আশুতোষ সত্যেন্দ্রনাথ এবং অন্যান্য গ্র্যাজুয়েটদেরকে গবেষণা করতে বলেন। তিনি এক্ষেত্রে বসু এবং অন্যান্যদের শিক্ষা বৃত্তি প্রদান করেন এবং নিজের ব্যক্তিগত লাইব্রেরিতে গণিত এবং পদার্থবিজ্ঞানের অনেক গুরুত্বপূর্ণ বই পড়ার সুযোগ দেন।

এর ফলে বসু এবং তার আরেক বিজ্ঞানী বন্ধু মেঘনাদ সাহা বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয় যেমন আপেক্ষিকতা, তড়িচ্চুম্বকত্ব, পরিসংখ্যান বলবিদ্যা, বর্ণালীবিদ্যা, তাপগতিবিদ্যার মতো বিষয়ে ব্যাপক জ্ঞানার্জন করেন। ১৯১৬ এর শেষ দিকে সত্যেন্দ্রনাথ ফলিত গণিতে অধ্যাপনা শুরু করেন। পরের বছর গাণিতিক পদার্থবিজ্ঞানেও তিনি পাঠদান শুরু করেন। ১৯১৯ সালে তিনি মেঘনাদ সাহার সাথে মিলে আলবার্ট আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতার বিশেষ এবং সাধারণ তত্ত্বের ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশ করেন। এটাই ছিল আপেক্ষিকতা তত্ত্বের প্রথম ইংরেজি অনুবাদ।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং সত্যেন্দ্রনাথ বসু

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে সত্যেন বোস জাদুঘরের উদ্বোধন করছেন বর্তমান উপাচার্য; ছবিসূত্রঃ theindependentbd.com

১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন সত্যেন বোস, রিডার পদে। এজন্যও তাকে কাঠখড় কম পোড়াতে হয়নি। অনেক প্রতিদ্বন্দ্বীর একজন ছিল তারই বন্ধু মেঘনাদ সাহাও। সাহার তাপ আয়নন তত্ত্ব তখন জোতির্বিজ্ঞানে বেশ জনপ্রিয়। কিন্তু বিশ্বখ্যাত ফিলোসফিক্যাল ম্যাগাজিনে সত্যেন্দ্রনাথের দুটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়ে তার জনপ্রিয়তাও বাড়িয়ে দেয়। শেষতক তিনিই চাকরিটি পান। চাকরি পেয়েই সপরিবারে ঢাকায় চলে আসেন সত্যেন্দ্রনাথ। বেতন ধার্য হয় ৪০০ টাকা।

উপাচার্যের নিকট সত্যেন্দ্রনাথ ইউরোপ ভ্রমণের জন্য ১২ হাজার ৫০০ টাকার অনুদানের আবেদন করেন। এই টাকা তিনি ইউরোপ ঘুরতে যাবার জন্য নয়, বরং ইউরোপের বিখ্যাত বিজ্ঞানীদের সাথে কাজ করার জন্য চেয়েছিলেন। তার এই আবেদন কিছুদিন ঝুলে ছিল। তবে তার বিখ্যাত প্রবন্ধটি প্রকাশের পরই এটি অনুমোদিত হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য স্যার পি জে হার্টজ তাকে ১৩,৮০০ টাকা অনুদান দেন এবং সাথে বিজ্ঞানী রাদারফোর্ডের সাথে কাজ করার সুপারিশ করেন।

রাদারফোর্ড তখন যুক্তরাষ্ট্রের ম্যানচেস্টারে তাঁর ছাত্রদের নিয়ে গবেষণা করছেন। তার ল্যাবরেটরিতে তখন আর জায়গা ছিল না। সত্যেন্দ্রনাথ তাই জার্মানি আর ফ্রান্সে কাটিয়ে দিলেন দুই বছর। এর মধ্যে তিনি হাইজেনবার্গের সান্নিধ্য পেয়েছেন। কাজ করেছেন দ্য ব্রগলির রঞ্জন রশ্মি গবেষণা কেন্দ্রে। মাদাম কুরির রেডিয়াম ইনস্টিটিউটেও কাজ করেন এই বিজ্ঞানী।

তার দুই বছরের ভ্রমণ শেষ হবার আগেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে অধ্যাপকের পদ খালি হয়। তিনি আবেদন করলেন এবং সাথে পাঠালেন বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইনের সুপারিশ। তবে একই পদে ডি এম বোস নামক আরেকজনকে সুপারিশ করেন আরেক বিখ্যাত বিজ্ঞানী সমারফিল্ড। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ডিএম বোসকে নির্বাচিত করলে সত্যেন্দ্রনাথ পুনরায় রিডার পদে যোগ দেন। এবার বেতন হয় সাড়ে ছয়শ টাকা। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই তিনি অধ্যাপক হয়ে যান, কারণ ডি এম বোস যে আর ঢাকায় আসেননি। ১৯২৬ থেকে ১৯৪৫ পর্যন্ত টানা ১৯ বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ছিলে বসু। এর মধ্যে ১৯৩৩ সালে বিভাগীয় প্রধানও হন। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে দেশভাগের পূর্বেকার সময়ে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে সাম্প্রদায়িক ভেদাভেদ চরমে উঠলে বোস ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে কলকাতায় চলে যান এবং তৎকালীন ক্যালকাটা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা শুরু করেন।

কোয়ান্টাম পদার্থবিজ্ঞান

ঈশ্বর কণা; ছবিসূত্রঃ wakingtimes.com

ভুল করা কোনো ভুল কাজ নয়, বরং ভুল থেকে কখনো কখনো বিস্ময়কর কিছু ঘটে যায়। হ্যাঁ, এই কথাটি সত্যেন বসুর চেয়ে ভালো আর কে প্রমাণ করতে পারবেন? কারণ তার জীবনের শ্রেষ্ঠ আবিষ্কার তথা কোয়ান্টাম পদার্থবিজ্ঞান পাল্টে দেয় যে আবিষ্কার, তা বেরিয়ে আসে একটি ভুল থেকে!

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কোয়ান্টাম তত্ত্ব পড়াতেন সত্যেন বোস। পাঠদানের ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন খুবই মনোযোগী। প্রতিটি লেকচারের আগে তিনি নিজেকে সর্বোত্তমভাবে প্রস্তুত করতেন। কিন্তু একদিন কি করে যেন তার এই প্রস্তুতিতে একটু কমতি থেকে গেল। তিনি কোয়ান্টাম তত্ত্ব পড়াতে গিয়ে একটা ভুল করলেন। কিন্তু তিনি যে ভুল করলেন তা আদতে কোয়ান্টাম তত্ত্বের গলার কাঁটার মতো বিধে থাকা ভুলটাকেই দূর করে দিল! তার ভুল হিসাব নিকাশ থেকে যে ফল বেরিয়েছিল তা আইনস্টাইনের মতো বিজ্ঞানীও অনেক চেষ্টা করে খুঁজে পাননি। বরং বাধ্য হয়ে কোয়ান্টাম নিয়ে চিন্তাভাবনাই বাদ দিয়ে দেন আইনস্টাইন!

সত্যেন্দ্রনাথ বসু যখন বুঝতে পারলেন তার ভুল আসলে স্বাভাবিক কোনো ভুল নয়, তখন তিনি দ্রুত তা নোট করে নিলেন। এরপর অনেক গবেষণা করে প্ল্যাঙ্কের কোয়ান্টাম তত্ত্বকে পুরোপুরি ত্রুটিমুক্ত করেন তিনি। এবার নিজের গবেষণাপত্র তিনি পাঠিয়ে দিলেন আইনস্টাইনের কাছে। আপেক্ষিকতা তত্ত্ব প্রথমবারের মতো ইংরেজিতে অনুবাদ করে তিনি ততদিনে আইনস্টাইনের নিকট মোটামুটি পরিচিত। আইনস্টাইন তখন জার্মানির জুরিখ বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক। তিনি চিঠিসহ গবেষণা পত্রটি পড়লেন। চিঠিতে গবেষণাপত্রটি বিখ্যাত বিজ্ঞান জার্নাল শাইটসিফ্রট ফ্যুর ফিজিকে ছাপাবার ব্যবস্থা করতেও অনুরোধ করেন বসু। গবেষণাপত্রটি আইনস্টাইনের মনে ধরে গেল। তিনি তা শাইটসিফ্রট ফ্যুর ফিজিকে পাঠিয়ে দিলেন এবং এরই সাথে সত্যেন বোস বিশ্বব্যাপী পরিচিতি লাভ করেন।

কোয়ান্টাম তত্ত্ব কোনো সাধারণ সহজবোধ্য তত্ত্ব নয়। তাই চেষ্টা করবো যথেষ্ট সহজ ভাষায় আলোচনা করার যেন মোটামুটিভাবে সবাই বুঝতে পারে। কৃষ্ণ বস্তুর বিকিরণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে কোয়ান্টাম তত্ত্বের অবতারণা করেন ম্যাক্স প্লাঙ্ক। তিনি শক্তিকে ব্যাখ্যা করেন অসংখ্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গুচ্ছ বা প্যাকেট হিসেবে। এই প্যাকেটের নাম কোয়ান্টাম। ১৯০৫ সালে আইনস্টাইন এই তত্ত্বের মাধ্যমে ফটোতড়িৎ ক্রিয়া ব্যাখ্যা করে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। যা হোক, এই কোয়ান্টাম বিজ্ঞানে পরিসংখ্যানের পরিচয় করান বিজ্ঞানী সত্যেন বসু।

প্ল্যাঙ্কের কোয়ান্টাম তত্ত্বের সমীকরণের ডানদিকে রয়েছে দুটি অংশ। একটিতে আলোকে দেখানো হয়েছে বিকিরণ শক্তি হিসেবে, আর অপরটিতে দেখানো হয়েছে গুচ্ছ শক্তির কণা হিসেবে। এখন প্রথম অংশকে বিজ্ঞানীরা ম্যাক্সওয়েলের তড়িচ্চুম্বক তত্ত্বের দ্বারা ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করছিলেন। আর ভুলটা ছিল এখানেই। নিউটনীয় বলবিদ্যা বা তড়িচ্চুম্বক তত্ত্ব, কোনোটিই আসলে কোয়ান্টাম তত্ত্বের জন্য সঠিক নয়। এখানেই সত্যেন বসু পরিবর্তন ঘটালেন। তিনি কোয়ান্টাম তত্ত্ব থেকে তড়িচ্চুম্বকীয় রাশিটাই বাদ দিয়ে দিলেন, রাখলেন কেবল কণাবাদী অংশটি। তিনি আলোর কণাকে আরো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশে ভাগ করে তাদের নাম দিলেন কোষ এবং পরিসংখ্যান এর মাধ্যমে ব্যাখ্যা করলেন আলোর কোয়ান্টাম ধর্ম। আসলে তার প্রধান কৃতিত্ব বলা যায় কোয়ান্টাম তত্ত্ব থেকে আলোর ফোটনের তরঙ্গ ধর্মকে বাদ দেয়া। এর ফলে তিনি সহজেই সমাধানে পৌছাতে পারেন। শাইটসিফ্রট ফ্যুর ফিজিকে এই গবেষণা প্রকাশের পর তাকে নিয়ে হৈচৈ পড়ে যায় বিজ্ঞান বিশ্বে।

কিন্তু বোসের কোয়ান্টাম পরিসংখ্যানও কণার চরিত্র সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করতে পারেনি। কেননা তখনো স্পিন ধারণার প্রবর্তন হয়নি। ফলে পরবর্তীতে বোস-আইনস্টাইন পরিসংখ্যানের পরিমার্জনের প্রয়োজন পড়ল। পরিমার্জনের পাশাপাশি আরও একটি পরিসংখ্যান তৈরী করলেন বিজ্ঞানী ফার্মি এবং পল ডিরাক। তাদের পরিসংখ্যানের নাম হলো ফার্মি-ডিরাক পরিসংখ্যান। এই বস্তুজগতের সকল কণাকে তখন দুটি গোত্রে ভাগ করে দিলেন এই বিজ্ঞানীগণ। একটি হচ্ছে বোসন, যেগুলো বোস-আইনস্টাইন পরিসংখ্যান মেনে চলে; অন্যটি ফার্মিওন, যেগুলো ফার্মি-ডিরাক পরিসংখ্যান মেনে চলে।

বোস-আইনস্টাইন ঘনীভবন

বোস-আইনস্টাইন কনডেনসেট

সত্যেন্দ্রনাথ বসুর পরিসংখ্যান নিয়ে বেশ কিছুদিন গবেষণা করেন আইনস্টাইন। তিনি এর প্রয়োজনীয় পরিমার্জন করেন। ফলে প্রকাশের পর এর নাম হয় বোস-আইনস্টাইন পরিসংখ্যান। এই পরিসংখ্যানের সূত্র ধরেই আবিষ্কৃত হয় পদার্থের পঞ্চম অবস্থা বলে পরিচিত বোস-আইনস্টাইন কনডেনসেট বা ঘনীভবন অবস্থার। এটি খুবই আশ্চর্যজনক অবস্থা।

পরম শুন্য তাপমাত্রার কাছাকাছি তাপমাত্রায় গ্যাসীয় পদার্থের পরমাণুগুলো নিষ্ক্রিয় হয়ে যায় এবং অনেকটা ফোটনের মতো আচরণ করে। তখন এদের এই অবস্থাকে পদার্থের কঠিন, তরল, বায়বীয় কিংবা আয়নিত, কোনো অবস্থার সাথেই মেলানো যায় না। তবে তাৎক্ষণিকভাবে এই অবস্থার দেখা পাওয়া যায়নি। ১৯৯৫ সালে সর্বপ্রথম তিনজন বিজ্ঞানী বোস-আইনস্টাইন ঘনীভবন অবস্থা ল্যাবরেটরিতে প্রমাণ করেন, যার জন্য তারা ২০১১ সালে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন।

কিছু ব্যক্তিগত তথ্য এবং সমাপ্তি

১৯১৪ সালে সত্যেন্দ্রনাথ বসু উষাবালা ঘোষকে বিয়ে করেন যিনি একজন খ্যাতনামা পদার্থবিদের মেয়ে ছিলেন। বিয়ের সময় বসুর বয়স ছিল ২০ এবং উষার বয়স ছিল মাত্র ১১! বসু দম্পতির ঘরে মোট নয়জন সন্তানের জন্ম হয় যাদের মধ্যে দুজন শৈশবে মারা যায়। বাকিদের মধ্যে পাঁচ মেয়ে এবং দুই ছেলে ছিল বসুর।

সত্যেন বসু ভাষা প্রেমিক ছিলেন। তিনি বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান চর্চা মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করেন। এক্ষেত্রে তার একটি বিখ্যাত উক্তি বলার লোভ সামলাতে পারলাম না।

“যারা বলেন যে, বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান চর্চা সম্ভব নয়,  তারা হয় বাংলা জানেন না, নয়তো বিজ্ঞান জানেন না।”

সত্যেন বসু ছিলেন অত্যন্ত সহজ সাধারণ একজন মানুষ। তিনি তার আবিষ্কারগুলো নিয়েই সন্তুষ্ট ছিলেন। পুরস্কারের জন্য তার কখনোই আক্ষেপ ছিল না। উইলার্ড গিবস, ফ্রেড হোয়েলের মতো বিজ্ঞানীদের পাশে নাম লেখান বসু, যারা বিজ্ঞানের জন্য অসাধারণ সব কাজ করেও নোবেল পুরস্কার জেতেননি। ১৯৭৪ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি আশি বছর বয়সে ব্রঙ্কিয়াল নিউমোনিয়ায় ভুগে এই মহান পদার্থবিদ মৃত্যুবরণ করেন। তাকে স্মরণ করে আজও গর্বিত এবং বিজ্ঞান চর্চায় অনুপ্রাণিত হয় দুই বাংলার কোটি কোটি মানুষ।

তথ্যসূত্রঃ

১) en.wikipedia.org/wiki/Satyendra_Nath_Bose

২) biography.com/people/satyendra-nath-bose-20965455

৩) famousscientists.org/s-n-bose/

৪) কোয়ান্টাম ফিজিক্স- আবদুল গাফফার রনি

Related Articles