জাদুঘর বললেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে বিরাট অট্টালিকা, তার মধ্যে বড় বড় হলঘর আর তাতে সাজিয়ে-গুছিয়ে রাখা বিভিন্ন ঐতিহাসিক জিনিসপত্র। কিন্তু বিশাল খোলা প্রান্তরে কিংবা প্রকৃতির মাঝে সাজিয়ে রাখা ঐতিহাসিক নানা নিদর্শনকে জাদুঘরের অংশ হিসেবে ভেবে নিতে যে কারো কিছুটা হলেও দ্বিধা হতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের এমনই এক জাদুঘরের গল্প শোনাবো আজ।
আমেরিকার ডেট্রয়েট শহরের উপকণ্ঠে অবস্থিত উপনগরী ডিয়ারবর্ন। এখানেই রয়েছে এডিসনস ইনস্টিটিউট নামের একটি ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠান। প্রসিদ্ধ বিজ্ঞানী টমাস আলভা এডিসনের নামে এই প্রতিষ্ঠানটির নামকরণ করা হয়েছে। এর প্রতিষ্ঠাতা হেনরি ফোর্ড, মোটরগাড়ির নির্মাতা হিসেবে যিনি সর্বাধিক পরিচিত।
হেনরি ফোর্ডের সাথে টমাস আলভা এডিসনের প্রগাঢ় বন্ধুত্ব ছিল। এডিসনের বৈজ্ঞানিক প্রতিভার গুণমুগ্ধ ভক্ত ছিলেন হেনরি ফোর্ড। আবার এডিসনও ফোর্ডকে তার গবেষণা ও আবিষ্কারে যথেষ্ট উৎসাহ দিতেন। সেই বন্ধুত্বের নিদর্শনস্বরূপ হেনরি ফোর্ড একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন, নাম দেন এডিসনস ইনস্টিটিউট।
১৯২৯ সালে প্রতিষ্ঠানটি গড়ে উঠে। প্রতিষ্ঠানের দু'টি অংশ। একটি অংশে রয়েছে হেনরি ফোর্ড মিউজিয়াম এবং অন্য অংশে রয়েছে গ্রিনফিল্ড ভিলেজ নামের আরেকটি অনন্যসাধারণ মিউজিয়াম। দর্শকমহলে তাই স্থানটি এডিসন্স ইনস্টিটিউটের পরিবর্তে হেনরি ফোর্ড মিউজিয়াম ও গ্রিনফিল্ড ভিলেজ নামেই বেশি পরিচিতি লাভ করেছে।
আমেরিকা আজ পৃথিবীর শিল্পোন্নত দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম। কিন্তু আঠারো ও উনিশ শতকে আমেরিকা ছিল মূলত কৃষিপ্রধান একটি দেশ। দেশটির সমাজব্যবস্থাও ছিল গ্রামীণ। কী করে এত বড় একটা কৃষিপ্রধান ও গ্রামনির্ভর দেশ শিল্পোন্নত দেশে পরিণত হলো, এই দুই মিউজিয়ামে তার ইতিহাস ধরা আছে। প্রথম পর্বে হেনরি ফোর্ড মিউজিয়ামটি গড়ে ওঠার কাহিনী সম্পর্কে বিস্তারিত জানবো।
হেনরি ফোর্ড মিউজিয়ামে আমেরিকার শিল্প-প্রযুক্তির বিবর্তনের ধারা তুলে ধরা হয়েছে। গ্রামীন অর্থনীতি থেকে সরে এসে শিল্প ও প্রযুক্তিখাতে আমেরিকার যে অভাবনীয় উন্নতি, তা সত্যিই বিস্ময়কর। আমেরিকা যে অবস্থা থেকে বর্তমানে উন্নতির চরম শিখরে পৌঁছেছে তা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে তুলে ধরার জন্য এই জাদুঘর দু'টি নির্মিত হয়েছে। হেনরি ফোর্ড বুঝেছিলেন, আমেরিকার এই শিল্প বিপ্লবের ইতিহাস আগামী প্রজন্মকে না জানাতে পারলে একটি দেশের উন্নতির যথার্থতা অনুধাবন করা যেমন সম্ভব হবে না, তেমনি দেশটির পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস অনেকের কাছে অজানাই থেকে যাবে।
সেই ভাবনা থেকে হেনরি ফোর্ড তার এই দু'টি সংগ্রহশালার মাধ্যমে আমেরিকার সেই বিশাল অগ্রযাত্রার ইতিহাসকে তুলে ধরেছেন। তিনি আমেরিকাবাসীদের জানাতে চেয়েছেন, দেশটা কত দূর এগিয়েছে এবং এ দুস্তর, দুর্গম পথ অতিক্রম করা কীভাবে সম্ভব হয়েছে। হেনরি ফোর্ডের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় জাদুঘরটি ক্রমান্বয়ে সমৃদ্ধশালী হয়েছে, যা বর্তমানে বিশ্বের অনন্য এক জাদুঘরের স্বীকৃতি পেয়েছে।
এডিসন্স ইন্সটিটিউটের এক প্রান্তে এক বিশাল অট্টালিকায় হেনরি ফোর্ড মিউজিয়ামটি গড়ে তোলা হয়েছে। ভবনে ঢুকতেই বিরাট একটা হলঘর। হলঘরের মাঝে স্থাপন করা আছে বিখ্যাত স্ট্যাচু অব লিবার্টির অনুরূপ একটি মূর্তি। এই স্থানটির নাম দেয়া হয়েছে প্লাজা। প্লাজার ডানপাশে ছোট একটা প্রেক্ষাগৃহ রয়েছে। সেই প্রেক্ষাগৃহে প্রতি ঘণ্টাতেই ছোট ছোট তথ্যচিত্র দেখানো হচ্ছে। এই অংশে বিভিন্ন যন্ত্রপাতির আবিষ্কার ও তার ব্যবহারিক দিকটি তুলে ধরা হয়েছে।
এছাড়া এখানে দর্শকদের সামনে বিভিন্ন মডেলের মাধ্যমে প্রযুক্তির উন্নয়নের ক্রমবিকাশের ধারাটি উপস্থাপন করা হয়েছে। আর এসব মডেল আজকের দিনের তৈরী নয়, অধিকাংশক্ষেত্রেই তা যে কালের উদাহরণ দেয়া হয়েছে, সেকালেই তৈরী এবং ব্যবহৃত। যেমন, রান্নাঘরের গোড়ার দিকের কথা। এ জাদুঘরে দেখানো হয়েছে, গোড়ার দিকে আমেরিকার বিভিন্ন অঞ্চলে কীভাবে ঘরের ফায়ারপ্লেসের ওপর রান্না হতো।
তারপর এলো লোহার পাতে ঘেরা কাঠের উনুন। বিবর্তনের ধারায় কাঠের পর এল কয়লা ও কেরোসিনের স্টোভ। ক্রমে ইলেকট্রিক ও গ্যাস ওভেন এবং হালফিলের মাইক্রোওয়েভ ওভেন এবং ইনডাকশন কুকার। শুধু কেবল উনুনই নয়, রেফ্রিজারেটার, ওয়াশিং মেশিন থেকে শুরু করে রান্নাঘরে ব্যবহৃত বিভিন্ন সময়ের উদ্ভাবিত যন্ত্রপাতিগুলো প্রথম দিকে কীভাবে তৈরি হয়েছিল এবং কীভাবে এগুলো বর্তমান চেহারা নিল, সবই দেখানো হয়েছে হেনরি ফোর্ড জাদুঘরের বিরাট হলঘরটিতে।
রান্নাঘরের ব্যাপারটাতো উদাহরণ মাত্র। এছাড়া রয়েছে টেলিগ্রাফ, টেলিফোন, রেডিও, টেলিভিশন ইত্যাদি যন্ত্রের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশের ইতিহাস। গত যুগের বিভিন্ন আকৃতি ও ঢঙের টেলিফোন রিসিভারগুলো ভারি মজার দেখতে ছিল। রয়েছে গ্রামাফোনের উৎপত্তি ও বিকাশ। ইয়ারফোন লাগিয়ে বোতাম টিপলেই শোনা যাবে পৃথিবীর সর্বপ্রথম রেকর্ডের গান।
এ সংগ্রহশালায় আরও রয়েছে আমেরিকান বাদ্যযন্ত্রের এক বিরাট সংগ্রহ। পূর্ববর্তী সময়ের বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্রের পাশে সাজিয়ে রাখা হয়েছে আধুনিককালের নানা বাদ্যযন্ত্র। এ সংগ্রহ দেখলে বোঝা যায়, এক পিয়ানো বা বেহালারই সময়ের পট পরিবর্তনের সাথে কত ধরনের সংস্করণ ঘটেছে।
প্লাজার পাশেই রয়েছে যানবাহনের এক সংগ্রহশালা। এই বিভাগে সাইকেল, মোটরগাড়ি, মোটর সাইকেল, এরোপ্লেন প্রভৃতি যানবাহনের ক্রমবিকাশের ইতিহাস দর্শকদের সামনে তুলে ধরা হয়েছে। কীভাবে এই যানবাহনগুলো প্রথম তৈরি হলো, তার ইতিহাস লেখা আছে সংক্ষেপে। আর পূর্ববর্তী যুগের সৃষ্টিগুলো সযত্নে সাজানো আছে। জাদুঘরের এই বিভাগের প্রধান আকর্ষণ হেনরি ফোর্ডের তৈরি প্রথম মোটরগাড়ি, যার নাম ফোর্ড দিয়েছিলেন ‘১৮৯৬ কোয়াড্রি সাইকেল’। ১৮৯৬ সালের ৪ জুন এই গাড়িটি প্রথম পথে বের হয়েছিল।
এই গাড়ির চাকাগুলো সাইকেলের চাকার মতো। তারপর অবশ্য হেনরি ফোর্ড প্রায় প্রতি বছরই মোটগাড়ির উন্নতি করে চলেন। পরবর্তী সময়ে তার টি-মডেলের গাড়ি খুব জনপ্রিয় হয়। ক্রমে অন্যান্য কোম্পানিও মোটরগাড়ি তৈরি করতে শুরু করে। শুরু হয় রেসিং কার তৈরি। এছাড়াও বিভিন্ন সময়ে নির্মিত আধুনিকতম বিভিন্ন মোটরগাড়ি দিয়ে এ বিভাগটি সাজানো হয়েছে।
এ বিভাগে যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতিদের ব্যবহৃত গাড়িগুলোর এক অনন্য সংগ্রহ রয়েছে। রুজভেল্ট, আইজেনহাওয়ার, ট্রুম্যান ও কার্টারের ব্যবহৃত গাড়ি এখানকার সংগ্রহের তালিকায় সাজানো রয়েছে। রয়েছে প্রেসিডন্ট কেনেডির ব্যবহৃত কালো মডেলের ফোর্ড গাড়ি, যেটিতে ১৯৬৩ সালের ২২ নভেম্বর তিনি গুলিবদ্ধ হয়ে মারা যান।
মোটরগাড়ির সংগ্রহের অল্প কিছু দূরত্বেই রয়েছে আরও কয়েকটি ঐতিহাসিক স্মৃতিচিহ্ন। জর্জ ওয়াশিংটনের ব্যবহৃত একটি ক্যাম্প খাট ও একটি কাঠের ছোট সিন্দুক। আব্রাহাম লিঙ্কন থিয়েটার হলের যে চেয়ারটিতে বসে আততায়ীর গুলিতে নিহত হন, সেই চেয়ারখানা এবং লিঙ্কনের ব্যবহৃত থিয়েটার প্রোগ্রাম।
মোটরগাড়ির পরেই রয়েছে বিভিন্ন সময়ে নির্মিত বিভিন্ন ধরনের সাইকেল ও মোটর সাইকেল। ১৮৮৫ সালে তৈরি বাইসাইকেলটিও জাদুঘরের এক উল্লেখযোগ্য দ্রষ্টব্য। এ বিভাগ থেকে একটু এগিয়ে গেলে উড়োজাহাজের এক বিচিত্র সংগ্রহের দেখা পাওয়া যাবে। সংগ্রহশালায় গত যুগের উড়োজাহাজের মধ্যে ১৯২৬, ১৯২৮ ও ১৯২৯ সালের তৈরী উড়োজাহাজও রয়েছে।
প্লাজার অন্য এক প্রান্তে স্টিম ও অন্যান্য ইঞ্জিনের ক্রমবিকাশ ধরা আছে। রয়েছে কৃষিতে ব্যবহৃত ট্র্যাক্টর ও অন্যান্য যন্ত্রের বিবর্তনের নানা ইতিহাস। জাদুঘরের মাঝামাঝি জায়গায় প্রতিষ্ঠাতা হেনরি ফোর্ডের জীবনালেখ্য দর্শকদের সামনে তুলে ধরা হয়েছে। তার জীবনের নানা স্মারক ও নানা ঘটনার ছবি প্রদর্শিত হয়েছে। বিজ্ঞানের উৎকর্ষের সাথে সাথে প্রযুক্তিক্ষেত্রে যে বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটে গেছে, তার সব নান্দনিক উপস্থাপনায় পুরো জাদুঘরটি সাজানো হয়েছে।
This article is in Bengali language. This is story about the Henry Ford museum and Greenfield Village are two wonderful and largest indoor-outdoor historical museum in the United States. Named for its founder, noted automobile industrialist Henry Ford, and based on his desire to preserve items of historical significance and portray the industrial revolution, the property houses a vast collection of buildings, machinery, exhibits and American artifacts. All the sources are hyperlinked inside the article.
Featured Image: foursquare.com