Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

গিয়ের্মো দেল তরো: তুলি ও ক্যামেরা হাতে এক সব্যসাচীর গল্প

একবিংশ শতাব্দীতে কত সহজেই না আমরা চলচ্চিত্রের স্বাদ আস্বাদন করে থাকি। সিনেমা হলের গ্রহণযোগ্যতা, ইন্টারনেটের সহজলভ্যতা, ডিভিডির প্রাচুর্যতা ইত্যাদি বিষয়গুলো পুরো দুনিয়া জুড়ে চলচ্চিত্র শিল্পকে করে তুলেছে বিনোদনের এক রাজকীয় মাধ্যম। কিন্তু এই শিল্প তো আর একদিনে অথবা কারো একক প্রচেষ্টায় এত বিস্তর প্রসার ঘটায়নি।

বহু বছর ধরে বহু দেশের জ্ঞানী-গুণী অনেক ব্যক্তিবর্গের অক্লান্ত পরিশ্রম ও দূরদর্শী চিন্তাধারার ফলশ্রুতিতে অল্প অল্প করে শেকড় গজিয়ে বেড়ে উঠেছে এই শিল্প। আর এই শিল্প জগতের অন্যতম কারিগর হিসেবে পরিচিত শ্রেণীকে আমরা নির্মাতা নামে চিনে থাকি। প্রতিটি চলচ্চিত্র নির্মাণের পেছনে এই শ্রেণীর ভূমিকা যে কতটা, তা লিখতে গেলে আস্ত একটি উপন্যাস হয়ে যাবে। তার চেয়ে চলুন, তাদের মধ্যে একজনের সাথে পরিচিত হয়ে আসা যাক আজকের এই আয়োজনে।

বর্তমান যুগে, বিশ্বব্যাপী যেসব সিনেমা নির্মাতা নিজ নিজ অবিস্মরণীয় সব সৃষ্টিকর্ম দ্বারা দাপটের সাথে সিনেমা দুনিয়াতে রাজত্ব করে বেড়াচ্ছেন, তাদের মধ্যে গিয়ের্মো দেল তরো একজন। তার আগের নির্মিত সব সিনেমার কথা বাদই দিলাম, তবুও শুধু গত বছর মুক্তিপ্রাপ্ত ‘দ্য শেপ অব ওয়াটার’ সিনেমার মধ্য দিয়ে তিনি যে এই সময়ের সিনে জগতের অন্যতম জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব, তা নিয়ে কোনো রকমের সন্দেহ নেই। দেল তরো এমন একজন মেক্সিকান পরিচালক, যিনি মার্কিন না হওয়া সত্ত্বেও আজ হলিউডে নিজের অনন্য সৃষ্টিশীলতা দিয়ে অটুট অবস্থান গড়ে নিয়েছেন।

গিয়ের্মো দেল তরোর আগমনী বার্তা

আজ থেকে তেপ্পান্ন বছর আগে মেক্সিকোর হালিস্কো স্টেটের রাজধানী গাডালাহারাতে জন্মেছিলেন গিয়ের্মো। ফেডারিকো দেল তরো ও গাডালোপে গোমেজ দম্পতি স্প্যানিশ রীতি অনুসারে শেষ নাম হিসেবে প্রথমে বাবার উপাধি ও পরে মায়ের উপাধি যোগ করে ছেলের পুরো নাম রেখেছিলেন গিয়ের্মো দেল তরো গোমেজ। গিয়ের্মো ছেলেবেলায় কঠোর ক্যাথলিক নিয়ম-কানুনের মধ্য দিয়ে বেড়ে উঠেছিলেন। শিশুকাল থেকেই দেল তরোর মনে সিনেমা ও ভৌতিক গল্পের প্রতি বিশেষ আকর্ষণ কাজ করতো। তার বয়সী বাকি ছেলেমেয়েরা যখন খেলাধুলা নিয়ে অবসর সময় কাটাতো, তখন তিনি নিজের বাবার ক্যামেরা দিয়ে স্বল্পদৈর্ঘ্যের চলচ্চিত্র নির্মাণে ব্যস্ত ছিলেন। এছাড়া তখন থেকেই নিজের বাড়িকে ভুতুড়ে সরঞ্জামাদি দিয়ে সাজানো তার আরও একটি শখ ছিল।

হাই স্কুলে পড়াকালীন সময় থেকে শর্ট ফিল্ম বানাতে পুরোদস্তর পটু হয়ে উঠলে, পরবর্তী জীবনে সিনেমা নির্মাণের ওপর আরও বিস্তর জানাশোনার জন্য মনস্থির করেছিলেন। তাই হাই স্কুলের পাট চুকিয়ে ইউনিভার্সিটি অব গাডালাহারাতে চলচ্চিত্র নির্মাণকে স্নাতকের বিষয় হিসেবে বেছে নেন। তিনি প্রায় দশটির মতো শর্ট ফিল্ম নির্মাণ করেছিলেন, যার মধ্যে ‘ডোনা লোপ’ ও ‘জিওমেট্রিয়া’ নামক দুটি শর্ট ফিল্ম বেশ প্রশংসা কুড়িয়েছিল। এছাড়া তিনি কাল্ট সিরিজ ‘লা হোরা মারসাডা’র চারটি পর্বের চিত্রনাট্য লিখেছিলেন এবং পাঁচটি পর্ব পরিচালনাও করেন। দেল তরো ডিক স্মিথের মতো প্রসিদ্ধ স্পেশাল মেকআপ আর্টিস্টের কাছ থেকে স্পেশাল ইফেক্ট ও মেকআপ বিষয়েও দীক্ষা গ্রহণ করেছিলেন।

সেই সময়ে ‘দ্য ডেভিলস ব্যাকবোন’ নির্মাণে ব্যস্ত ছিলেন দেল তরো; Source: Hero Complex – Los Angeles Times

নির্মাণশৈলী যখন শুধু নেশা নয়, পেশাও বটে

পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবে দেল তেরোর পথচলা শুরু হয়েছিল ১৯৯৩ সালে। ‘ক্রোনস’ নামের মেক্সিকান হরর-ড্রামা জনরার এই সিনেমার মধ্যদিয়ে তিনি নবীন পরিচালকের খাতায় নাম লিখিয়ে ফেলেছিলেন। সিনেমাটি স্প্যানিশ ও ইংরেজি দুটো ভাষাতেই নির্মিত হয়েছিল। প্রথম সিনেমা দিয়েই বলতে গেলে সিনেমা জগতে একরকম বাজিমাত করে ফেলেছিলেন তিনি। ‘অমরত্ব’কে মূল বিষয়বস্তু ধরে নির্মিত এই সিনেমা দর্শক ও সমালোচক উভয়ের কাছ থেকে বেশ পজিটিভ রিভিউ পেয়েছিল। রটেন টমেটোস থেকে প্রাপ্ত তথ্যমতে, নব্বই শতাংশ সমালোচক একে ‘ভালো’ সিনেমা হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। অবশ্য প্রদর্শনের জন্য স্বল্প সংখ্যক সিনেমা হল পাবার ফলে ব্যবসায়িক দিক থেকে সিনেমাটি সফল হতে পারেনি। এক সমালোচক সিনেমাটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেন।

গিয়ের্মোর একক অভিষেক ফিল্মটি শুধু স্টাইলিশই নয়, এটি মনোহর ও বুদ্ধিদীপ্তও বটে।

চার বছর পর, ১৯৯৭ সালে আবারো ‘মিমিক’ নামক সিনেমা নিয়ে উপস্থিত হয়েছিলেন তিনি। অবশ্য সিনেমাটির প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান মিরাম্যাক্স ফিল্মসের অপেশাদারি মনোভাব নিয়ে বেশ অসন্তুষ্ট ছিলেন তিনি। দেল তরোর মনে সিনেমাটি নিয়ে বেশ প্রত্যাশা থাকলেও প্রয়োজনের তুলনায় কম বাজেট ও সিনেমা নির্মাণকালীন অবজ্ঞার শিকার হবার কারণে পরবর্তীতে সিনেমাটি থেকে তার মন উঠে গিয়েছিল। সাই-ফাই, হরর জনরার এই সিনেমার দ্বিতীয় ও তৃতীয় পর্ব যথাক্রমে ২০০১ ও ২০০৩ সালে মুক্তি পেলেও দেল তরোর এই দুই পর্বের সাথে কোনো সম্পৃক্ততা ছিল না। সমালোচক ও দর্শকদের কাছ থেকে সিনেমাটি মিশ্র প্রতিক্রিয়া লাভ করেছিল।

এভাবেই তিনি সৃষ্টি করে চলেছেন একের পর অসাধারণ গল্পের; Source: Vice’s Creators

তার শিরায় শিরায় নির্মাণের উত্তাল আমেজ

পরিচালক হিসেবে দেল তরোর বৈপ্লবিক অধ্যায়ের সূচনা মূলত শুরু হয়েছিল নতুন শতাব্দীতে। ২০০১ সালে গোথিক হরর জনরার ফিল্ম ‘দ্য ডেভিল’স ব্যাকবোন’ দ্বারা তিনি বেশ ভালোই আলোড়ন তুলেছিলেন। মার্কিন স্যাটেলাইট টেলিভিশন নেটওয়ার্ক ‘ব্রাভো’র তালিকা অনুসারে, বিশ্বের সেরা ১০০টি ভৌতিক সিনেমার মধ্যে এর অবস্থান ৬১ নম্বরে। রটেন টমেটোস থেকে ৯২% রেটিং পেলেও বিখ্যাত সিনে সমালোচক রজার এবার্টের মতে, সিনেমাটির ‘দ্য আদারস’ নামের অন্য আরেকটা সিনেমার সাথে মিল রয়েছে। তবে দর্শক সমাজে সিনেমাটি দারুণ নন্দিত হয়েছিল। ‘দ্য নিউইয়র্ক টাইমস’ এর সাংবাদিক এ.ও. স্কট সিনেমাটির প্রশংসা করতে গিয়ে লিখেছিলেন,

সিনেমাটির পরিচালক, গিয়ের্মো দেল তরো, ভয় ও আবেগকে একই সুতোয় বেঁধে, এমন একটি পিচ্চি ছেলের দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে কাহিনীতে ফুটিয়ে তুলেছেন, যার নিজের কাছেই প্রত্যক্ষ ঘটনার অর্ধেক বোধগম্য হয়ে উঠছে না।

‘দ্য ডেভিলস ব্যাকবোন’ মুক্তির বছরখানেক পর দেল তরো সুপার হিরো ফিল্ম পরিচালনায় নেমেছিলেন। মার্ভেল কমিক্সের ফিকশনাল ক্যারেক্টার ব্লেডকে নিয়ে নির্মিত ব্লেড ফিল্ম সিরিজ ‘ব্লেড: ট্রিনিটি’ এর দ্বিতীয় পর্ব ‘ব্লেড টু’ দেল তরোর দ্বারাই পরিচালিত হয়েছিল। সিনেমাটি শুধু চরম মাত্রায় ব্যবসায়িক সাফল্যই অর্জন করেনি, পাশাপাশি সমালোচকদের মন জয় করতেও সক্ষম হয়। নির্দেশনা, অভিনয়শৈলী, সিনেমাটোগ্রাফি ও অ্যাকশন সিকোয়েন্সের জন্য সিনেমাটি বেশ সুনাম লাভ করে। তবে চিত্রনাট্যে কিছুটা ঘাটতি আছে বলে অল্প একটু সমালোচনারও মুখোমুখি হয় সিনেমাটি।

২০০৪ সালে ‘হেলবয়’ নামের সিনেমাটি নিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো সুপারহিরোর গল্পের ওপর নির্মিত সিনেমাতে পর্দার পেছনের কারিগর হিসেবে কাজ করেছিলেন তিনি। এই সিনেমাটির চিত্রনাট্য ‘ডার্ক হাউজ কমিক্স’ এর ‘হেলবয়: সিড অব ডেস্ট্রাকশন’ উপন্যাস থেকে সংকলিত হয়েছিল। সিনেমাটি বক্স অফিসে বেশি সফলতা না দেখাতে পারলেও সমালোচকদের দৃষ্টিতে ভালো সিনেমার ক্যাটাগরিতেই পড়েছিল। রটেন টমেটোসের মতো বিখ্যাত সাইটে ১৯৬টি রিভিউয়ের ভিত্তিতে ৮২% ও মেটাক্রিটিকে ৩৭টি রিভিউয়ের ভিত্তিতে ৭২% রেটিং পেয়েছিল সিনেমাটি। পরবর্তীতে ২০০৭ সালের দিকে রটেন টমেটোর এক জরিপে ‘সেরা কমিক বুক ফিল্ম অ্যাডাপ্টেশন’ এ মোট ৯৪টি ফিল্মের মধ্যে এটি ১৩তম নির্বাচিত হয়েছিল।

‘প্যাসিফিক রিম ২’ এর সেটে দেল তরো; Source:Los Angeles Times

‘প্যান’স ল্যাবিরিন্থ’ নামক ডার্ক ফ্যান্টাসি, ড্রামা জনরার মুভি পরিচালনা করে দেল তরো নিজেকে অন্য এক মাত্রায় নিয়ে গিয়েছিলেন। রূপকথার গল্পের ওপর সাজানো প্লট নিয়ে এই মুভিটি দেল তরোর ‘ফ্ল্যাগশিপ প্রজেক্ট’ হিসেবে গণ্য করা হয়ে থাকে। মুভিটি ১৯৪৪ সালের প্রেক্ষাপটের ওপর চিত্রায়িত করা হয়েছে। সবথেকে মজার ব্যাপার হচ্ছে, সিনেমাটির গল্পকার দেল তরোর মাথায় সিনেমাটির ধারণা নিজের নোটবুক থেকে এসেছিল।

প্রতিদিন নিজের টুকিটাকি এলেমেলো চিন্তাভাবনাকে টুকে রাখা সেই নোটবুক থেকে এমন এক অবিস্মরণীয় সৃষ্টির উৎপত্তি হয়েছিল বলেই এই জগদ্বিখ্যাত পরিচালক এক সাক্ষাতকারে জানিয়েছিলেন। রটেন টমেটোস থেকে ২২৯টি রিভিউয়ের ভিত্তিতে ৯৫% ও মেটাক্রিটিকে ৩৭টি রিভিউয়ের ভিত্তিতে ৯৮% রেটিং লাভ করে সিনেমাটি। তাছাড়া ব্যবসায়িক ক্ষেত্রে সিনেমাটি দারুণ লাভবান হয়েছিল। অস্কারে ছয়টি ক্যাটাগরিতে মনোনয়ন ছাড়াও ‘বেস্ট আর্ট ডিরেকশন’, ‘বেস্ট সিনেমাটোগ্রাফি’ ও ‘বেস্ট মেকআপ’- এই তিন ক্যাটাগরিতে পুরষ্কার জয়ের সাফল্য তো আছেই। বাফটাতে বিদেশী চলচ্চিত্র হিসেবে পুরষ্কার লাভসহ সিনেমাটি আরও অসংখ্য পুরষ্কার জিতে নিয়েছিল। রজার এবার্টও সিনেমাটি শ্রেষ্ঠ সিনেমার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করতে বাধ্য হন। রটেন টমেটোসে এক সমালোচক লিখেছিলেন,

এই সিনেমাটি হলো প্রাপ্তবয়স্কদের ‘এলিস ইন ওয়ান্ডারল্যান্ড’। এতে বাস্তবতা ও কল্পনাকে নিখুঁত ও জাদুকরী সংস্পর্শে একীভূত করা হয়েছে।

‘প্যান’স ল্যাবিরিন্থ’ সিনেমার পর এক বছর বিরতি নিয়ে ২০০৮ সালে দেল তরো ‘হেলবয় টু: দ্য গোল্ডেন আর্মি’ সুপারহিরো ভক্তদের জন্য নিয়ে সিনেমা জগতে আরও একবার নির্দেশক রূপে আগমন ঘটান। এই সিনেমাটি ২০০৪ সালে তার পরিচালিত ‘হেলবয়’ সিনেমার সিকুয়েল। আগেরটার মতো, এটার গল্পও মাইক মিগনোলার ‘হেলবয়’ উপন্যাস থেকে ধার নেওয়া হয়েছিল। সিনেমার চিত্রনাট্য অবশ্য দেল তরো নিজেই লিখেছিলেন।

প্রায় ৮৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বাজেটের ওপর নির্মিত এই সিনেমাটি বক্স অফিস থেকে প্রায় ১৬০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় করেছিল। সিনেমাটির চরিত্রগুলো তাদের অভিনয় দক্ষতার জোরে বেশ প্রশংসা অর্জন করেছিল। সিনেমাটি ‘সেরা মেকআপ’ শাখায় অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ডের জন্য মনোনীতও হয়েছিল। রোটেন টমেটোস থেকে ৮৬% ও মেটাক্রিটিক থেকে ৭৮% রেটিং প্রাপ্ত সিনেমাটি সমালোচকদের কাছ থেকেও পজিটিভ রিভিউ পেয়েছিল। শিকাগো সান টাইমসের রজার এবার্ট ৩.৫/৪ রেটিং দিয়ে সিনেমাটি সম্পর্কে বলেছিলেন,

এটা সব দিক থেকেই দেল তরোর আগের ‘হেলবয়’ এর মতো, শুধু আরেকটু জোরালো শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে, এই যা।

দেল তরোর জীবনের সামগ্রিক রূপ; Source: Hollywood Reporter

পরিচালক হিসেবে দেল তরোর যুগান্তকারী প্রত্যাবর্তন

এরপরের পাঁচ বছর দেল তরো সিনেমা পরিচালনা থেকে দূরে ছিলেন। সেই সময়ে আমেরিকান ঔপন্যাসিক, চিত্রনাট্যকার চাক হোগানের সাথে যৌথভাবে একই সিরিজের তিনটি উপন্যাস লিখেছিলেন তিনি। সেই ভ্যাম্পায়ার ট্রিলজির প্রথম পর্ব ‘দ্য স্ট্রেইন’ প্রকাশিত হয়েছিল ২রা জুন, ২০০৯ সালে। পরবর্তী পর্ব ‘দ্য ফল’ এরপরের বছরের ২১শে সেপ্টেম্বরে, আর ২০১১ সালের অক্টোবরে ‘দ্য নাইট অ্যাটার্নাল’ নামের উপন্যাসের মধ্য দিয়ে এই ট্রিলজিটি পূর্ণতা পেয়েছিল।

২০১৩ সালে আমেরিকান সায়েন্স ফিকশন মেকা অ্যাকশন ফিল্ম ‘প্যাসিফিক রিম’ নির্মাণের মধ্যদিয়ে আবারো চলচ্চিত্র নির্মাণে ফিরে এসেছিলেন তিনি। সিনেমাটির চিত্রনাট্যতেও তার ভূমিকা ছিল। সিনেমাটি দেখলে বোঝা যায়, নিজের পছন্দের মুভি ‘গডজিলা’ থেকে অনুপ্রাণিত হয়েই দেল তরো এমন একটি সিনেমা বানিয়েছিলেন।

বক্স অফিসে সিনেমাটি তুমুল ঝড় তুলেছিল সেই বছর। সিনেমাটি ভিজুয়াল ইফেক্ট ও অ্যাকশন সিকোয়েন্সের জন্য অনেক প্রশংসিত হয়। এই সিনেমার মাধ্যমে দেল তরো সমালোচকদের নজরে নিজেকে আরও উচ্চস্তরে নিয়ে যেতে সক্ষম হন। মোটামুটি সব বড় বড় সমালোচক এই সিনেমা দেখার পর বিশ্বাস করতে শুরু করেছিলেন যে, দেল তরো নিজের দূরদর্শী কল্পনাশক্তি ও সীমাহীন মেধা দিয়ে নিত্যনতুন প্রেক্ষাপটের ওপর অভূতপূর্ব সব সিনেমা নির্মাণের যোগ্য দাবিদার। সিনেমাটি সম্পর্কে দেল তরোর নিজের ভাষ্যমতে,

এটি আমার নির্মিত সবথেকে হিংস্র সিনেমা, এটাতে সবকিছুই প্রচুর মাত্রায় আছে। আর আমি শুধুমাত্রই একজন প্রাপ্তবয়স্ক শিশু, যে এসব উপভোগ করছি।

সেই বছর নিজের লেখা উপন্যাস ‘দ্য স্ট্রেইন’ অবলম্বনে নির্মিত টিভি সিরিজের পাইলট পর্বের পরিচালনাও করেন তিনি। এর পরের বছর, অর্থাৎ ২০১৪ সালে ম্যাথিউ রবিনস ও লুসিন্ডা কক্সকে নিয়ে ‘ক্রিমসন পিক’ সিনেমার জন্য চিত্রনাট্য লিখেছিলেন তিনি। পরে সেই চিত্রনাট্যের ওপর নির্ভর করে গোথিক হরর জনরার এই মুভিটি নির্মাণও করেন তিনি। ‘দ্য ওমেন’, ‘দ্য এক্সোর্সিস্ট’, ‘দ্য শাইনিং’ এর মতো বিখ্যাত সিনেমাগুলো থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে নির্মিত এই মুভিকে দেল তরো ‘ক্লাসিক, তবে আধুনিক যুগের প্রেক্ষাপটে ভৌতিক গল্প’ বলে অভিহিত করেছিলেন। এই সিনেমাটি সব মিলিয়ে দর্শক ও সমালোচকদের কাছে মধ্যম ক্যাটাগরির সিনেমা হিসেবে গণ্য হয়েছিল।

৯০তম অস্কারের মঞ্চে দু-দুটো অস্কার হাতে দেল তরো; Source: popsugar.com

গত বছর দেল তরো নিজের এখন পর্যন্ত সেরা সৃষ্টি দিয়ে আবির্ভূত হয়েছিলেন। ‘দ্য শেপ অব ওয়াটার’ নামের ২০১৭ সালের অন্যতম সাড়া জাগানো সিনেমার সৃষ্টিকর্তা তো দেল তরোই ছিলেন। অস্কারে একটি, দুটি অথবা দশটি নয়, তেরটি শাখায় মনোনয়ন পাবার রেকর্ড গড়েছিল এই সিনেমাটি।

একজন উভচর প্রাণী ও একজন বাকশক্তিহীন নারীর অসামান্য প্রেমগাঁথাকে কেন্দ্রবিন্দুতে রেখে তৈরি এই সিনেমার তাৎপর্য বিশ্বব্যাপী খুব কম মানুষ ধরতে পারলেও সত্যিকারের সিনেপ্রেমীরা এই মাস্টারপিসকে ঠিকই কদর করে চলেছে, সেই সাথে সিনে সমালোচকরা তো বটেই। এই সিনেমা দেল তরোকে প্রথমবারের মতো সেরা পরিচালক হিসেবে অস্কার হাতে তোলার সৌভাগ্য এনে দিয়েছে। সেই সাথে সেরা চলচ্চিত্র হিসেবে সিনেমাটির অস্কার জয়ের প্রাপ্তি তো আছেই।

সিনেমাটি বিভিন্ন অ্যাওয়ার্ড শোতে বিভিন্ন ক্যাটাগরি মিলিয়ে সর্বমোট ২৪৩ বার মনোনয়ন পেয়েছিল, যার মধ্যে ৮২টি পুরষ্কার নিজের করে নিতে সক্ষম হয়। ১৯.৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলারে খরচ করে বানানো এই সিনেমা বক্স অফিস থেকে প্রায় ১৯৪.৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলার তুলে আনতে সক্ষম হয়। রটেন টমেটোসে ৩৪৮টি রিভিউয়ের ভিত্তিতে ৯২% ও মেটাক্রিটিকে ৫৩টি রিভিউয়ের ভিত্তিতে ৮৭% রেটিং পায় সিনেমাটি। সব মিলিয়ে বলা যায় যে, এই সিনেমা দেল তরোকে পরিচালক হিসেবে সাফল্যের উচ্চশিখরে পৌঁছে দেওয়ার ক্ষেত্রে কার্যকরী ভূমিকা রেখেছে।

দেল তরোর অন্যান্য রূপ

শুধু পরিচালক হিসেবেই নয়, চিত্রনাট্যকার ও প্রযোজক হিসেবেও কিন্তু দেল তরোর বেশ নামডাক রয়েছে। তার পরিচালিত বিভিন্ন সিনেমাতে তিনি নিজের লেখা চিত্রনাট্য ব্যবহার করেছেন, সেটা তো আগেও উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়া বিখ্যাত ফ্যান্টাসি সিনে সিরিজ ‘হবিট’ এর পর্বগুলোর চিত্রনাট্যে আরও কয়েকজন চিত্রনাট্যকারের সাথে তারও হাতের জাদু মিশে আছে।

২০১০ সালে ‘মিরাডা স্টুডিও’ নামক প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান খোলার মধ্য দিয়ে প্রযোজক হিসেবেও আত্মপ্রকাশ করেছিলেন এই সিনে নির্মাতা। এই প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানে তার সহ-প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে আছেন দীর্ঘদিনের বন্ধু ও সিনেমাটোগ্রাফার গিয়ের্মো ন্যাভারো। ‘দ্য বুক অব লাইফ’ ও ‘জুলিয়া’স আইস’ এর মতো সিনেমা তাদের এই প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান থেকেই বের হয়েছিল। এছাড়া এই বছরের অন্যতম আলোচিত সিনেমা ‘প্যাসিফিক রিম আপরাইজিং’ও দেল তরো দ্বারাই প্রযোজিত হয়েছে।

লরেঞ্জার সাথে দীর্ঘ ২২ বছর সংসার করেছিলেন তিনি; Source:W3LiveNews.com

ছোটকালেই মা ও ভাইকে একটি মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় হারিয়েছিলেন তিনি। বাবার স্নেহছায়ায় বেড়ে ওঠা ছেলেটি ১৯৮৬ সালের দিকে লরেঞ্জা নিউটন নামের একজন মেক্সিকান তরুণীকে বিয়ে করেছিলেন। তাদের ঘর আলোকিত করে মারিসা ও মারিয়ানা নামের দুজন কন্যাসন্তানের আগমন ঘটে। ২০১৭ সালে দীর্ঘ ২১ বছর এক ছাদের নিচে বসবাসের পর লরেঞ্জার সাথে দেল তরোর বিবাহবিচ্ছেদ আনুষ্ঠানিকভাবে সম্পন্ন হয়ে গেছে।

ছোটকাল থেকে রোমান ক্যাথলিক হিসেবে লালিত হয়ে উঠেছিলেন তিনি। আর পরবর্তীতেও সেই ধর্মীয় আর্দশকে মেনে জীবনযাপন করে চলেছেন। মা-ভাইকে হারানো ব্যতীত দেল তরোর জীবনের অন্যতম ভয়াবহ ঘটনা হলো, ১৯৯৭ সালে তার বাবার অপহরণের ঘটনা। অবশ্য বাবাকে সহি সালামতই ফিরে পেয়েছিলেন তিনি। তবুও সেই স্মৃতির কথা বলতে গিয়ে এখনও দেল তরো আবেগপ্রবণ হয়ে ওঠেন। ব্যক্তিগত জীবনে, অবসর সময়ে ভিডিও গেমস খেলতে ও কমিক বুক পড়তে ভালোবাসেন তরো। ড্রাকুলা, দানব, পিশাচ ইত্যাদি নিয়ে গড়ে ওঠা সিনেমাগুলো তার ব্যক্তিগত পছন্দের তালিকায় সবার প্রথমে অবস্থান করে।

পরিচালক হিসেবে নিজেকে আরও বিকশিত করার সময় পড়ে আছে দেল তরোর। বয়স তো সবেমাত্র তেপ্পান্ন। এখনো বহু দূর চলার বাকি তার। সুস্থ-স্বাভাবিক জীবনের অধিকারী হতে পারলে, আগামীতেও তার কাছ থেকে আরও অনেক চমকপ্রদ সৃষ্টিই পাওয়া যাবে। হয়তো ‘দ্য শেপ অব ওয়াটার’ তার কিংবদন্তীদের খাতায় পদার্পণ করার প্রথমধাপ ছিলো মাত্র। সামনে এমন অথবা এর থেকেও চমৎকার কোনো সৃষ্টিকর্ম নিয়ে সিনেমা জগতে আবারো ‘দেল তরো’ ঝড় তুলবেন তিনি। একজন সাধারণ সিনেপ্রেমী হিসেবে শুধু এটুকুই চাওয়া, “তাই যেন হয়।”

ফিচার ইমেজ: FanArt

Related Articles