Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

গুলাবী গ্যাং: হাতে লাঠি তুলে নেয়া এক নারীর সাফল্যগাঁথা

উত্তর ভারতের ছোট্ট এক গ্রামের ঘটনা। এক লোক তার স্ত্রীকে রোজ গালাগালি করত আর হিংস্র পশুর মতো পেটাতো। তাদের পাশের বাড়ির এক নারী প্রায় প্রতিদিনের সেই ঘটনা দেখে নিজেকে আর আটকে রাখতে পারল না। একদিন যখন লোকটা তার স্ত্রীকে অমানবিকভাবে পেটাচ্ছিল তখন প্রতিবেশী সে নারী দৌড়ে গেলেন লোকটাকে বাঁধা দিতে। তিনি অনেক চেষ্টা করলেন লোকটার অত্যাচারের হাত থেকে মেয়েটিকে বাঁচাতে। কিন্তু ফল হল হিতে বিপরীত। এবার লোকটা তার উপর চটে গেল, অশ্রাব্য ভাষায় গালাগালি আর অপমান করে প্রতিবেশী মহিলাকে সে তার বাড়ি থেকে বিদেয় করল।

সম্পত পাল দেবী তার দলের সাথে © gulabigang.in

এখানেই জীবন বদলে দেয়া এক ঘটনার শুরু। একজন নারী যখন সংকল্প নেয় সে কিছু করবে, রুখে দাঁড়াবে, তখন পৃথিবীর কোনো শক্তিই আর তাকে পরাজিত করতে পারে না। পুরুষরা নারীর থেকে অনেক বিষয়ে শক্তিশালী হলেও নারীর ভেতরের এই শক্তিই তাকে অনেক ক্ষেত্রে পুরুষের থেকেও বেশি শক্তিশালী করে তোলে।

অত্যাচারী লোকটি তার সেই প্রতিবেশী নারীকে সেদিনের মতো বিদায় করে দেয়ার পরদিন ওই মহিলা আরও পাঁচজন নারীকে সাথে করে নিয়ে আসল এবং তারা তাদের হাতে করে নিয়ে আসা বাঁশের লাঠি দিয়ে আচ্ছামতো ওই লোককে ধোলাই দিয়ে বাধ্য করল তার স্ত্রীর কাছে প্রকাশ্যে ক্ষমা চাইতে এবং আর কোনোদিন সে তার স্ত্রীর সাথে খারাপ ব্যবহার করবে না এই প্রতিশ্রুতি দিতে।

ভারতের উত্তর প্রদেশ রাজ্যের বুন্দেলখান্ড নামক অঞ্চলের বাসিন্দা সম্পত পাল উপরোক্ত ঘটনার সেই প্রতিবাদী প্রতিবেশী নারী। মাত্র ষোল বছর বয়সে যিনি নিজে অপমানিত, নিগৃহিত হয়েও আরও একজন নারীকে বাঁচাতে এগিয়ে এসেছিলেন।

এ খবর আগুনের মতো চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল। উত্তর প্রদেশের গ্রামে গ্রামে ঘটনার নায়িকা সম্পত পালের নাম আলোচিত হতে থাকল। সম্পতের সাহস আর অন্যকে সাহায্য করার মানসিকতা অন্যান্য নারীদের উৎসাহ দিল পারিবারিক নির্যাতনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে।

সম্পতের পিতা একজন দরিদ্র মেষপালক ছিলেন। গরীব ঘরের সন্তান হয়েও তিনি নিজ চেষ্টায় পড়তে আর লিখতে শিখেন। মাত্র বারো বছর বয়সে তার বিয়ে হয় এক আইসক্রিম বিক্রেতার কাছে। বয়স বিশ হতে হতে তিনি পাঁচ সন্তানের জননী হয়ে যান।

লাঠি হাতে সম্পত ও তার দল © gulabigang.in

সম্পত বিশ্বাস করেন, মেয়েদের শিক্ষাই পারে তাদের স্বাবলম্বী আর স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকার অধিকার দিতে। তাই তিনি মেয়েদেরকে স্কুলে যেতে উৎসাহ দেন, বাল্যবিবাহ বন্ধে গ্রামে গ্রামে ঘুরে বৈঠক করেন, প্রয়োজনে বাঁধা দেন।

প্রতিবেশীর সাথে ওই ঘটনার পর উত্তর প্রদেশের প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলেও বিখ্যাত হয়ে ওঠেন সম্পত। নানা জায়গা থেকে নারীরা তাদের সাথে ঘটে যাওয়া পারিবারিক নির্যাতন, সামাজিক অবিচার আর যৌন নির্যাতনের খবর পাঠাতে থাকেন। অনুরোধ করেন তাদের বাঁচাতে।

ধীরে ধীরে সম্পতের সাথে অন্যান্য নারীরা যোগ দিতে থাকেন। সম্পত বাইসাইকেলে ঘুরে ঘুরে অঞ্চলের নারীদের একত্রিত করতে শুরু করেন। ইতিমধ্যে সম্পতের সাথে সমাজকর্মী জয় প্রকাশ শিবহরের দেখা হয় এবং তিনি তাকে নারীদের জন্যে আরো ব্যাপকভাবে কাজ করতে উৎসাহ দেন।

১৯৮০ সালে সম্পতের নেতৃত্বে গড়ে ওঠে ‘গুলাবী গ্যাং’। প্রাথমিকভাবে সম্পতের নিজের গ্রামের মহিলারা এতে যোগ দেন এবং পরে আশেপাশের বিভিন্ন গ্রাম থেকেও মহিলারা গুলাবী গ্যাংয়ে যোগ দিতে থাকেন। গুলাবী গ্যাংয়ের সদস্যদের হাতে থাকে বাঁশের লাঠি আর পরনে থাকে গুলাবী রঙের শাড়ি। যেহেতু গোলাপী রঙ নারীত্বের প্রতীক, তাই তারা তাদের দলীয় পোষাক হিসেবে গোলাপী রঙের শাড়িকেই বেছে নিয়েছেন। সময়ের সাথে সাথে সদস্য সংখ্যা বেড়ে বর্তমানে সেই গুলাবী গ্যাংয়ের সদস্য সংখ্যা দু’লক্ষ সত্তর হাজারের বেশি।

উঠান বৈঠকে সম্পত ও তার দল © indiatoday.in

ভারতের উত্তর প্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ রাজ্যের প্রত্যন্ত গ্রামের জনসংখ্যার অধিকাংশ মানুষ দরিদ্র আর নিচু জাতের। তাদের বাকি সমাজ অচ্ছুত মনে করে। বিশেষ করে নিচু জাতের মহিলারা প্রায়ই যৌন নির্যাতন, ধর্ষণের মতো অপরাধের শিকার হন। তাছাড়া পরিবারে পুরুষ সদস্যদের দ্বারাও নির্যাতনের শিকার হন অনেক মহিলা। মূলত, এসব অত্যাচার, নির্যাতনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোই হচ্ছে গুলাবী গ্যাংয়ের কাজ।

সম্পত পাল স্থানীয় প্রশাসন, এনজিও বা সমাজকর্মীদের সাহায্য নিতে পছন্দ করেন না। অনেক ক্ষেত্রে তিনি ও তার দলের সদস্যরা আইন নিজেদের হাতে তুলে নেন। যে পুরুষেরা স্ত্রীদের পেটান, যারা ধর্ষণ বা যৌন নির্যাতনকারী অথবা বাল্যবিবাহ বন্ধ করতে গুলাবী গ্যাংয়ের সদস্যারা লাঠি হাতে ঘটনাস্থলে পৌঁছে যান এবং তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেন। রিপোর্ট লেখাতে থানায় গেলে এক পুলিশ সদস্য রিপোর্ট লিখতে অসম্মতি জানান। এর প্রতিবাদে সম্পত হাতে থাকা লাঠি দিয়ে তার মাথায় আঘাত করেন। জরুরি ভিত্তিতে ঠিক করা প্রয়োজন এমন এক বেহাল হওয়া রাস্তার অবস্থা দেখাতে সরকারি এক কর্মকর্তাকে তার গাড়ী থেকে টেনে নামিয়ে আনেন সম্পত পাল।

এক সাক্ষাতকারে সম্পত বলেন,

এসব এলাকায় কেউ আমাদের সাহায্যে এগিয়ে আসে না। সরকারি কর্মকর্তা আর পুলিশ দুর্নীতিবাজ এবং দরিদ্রবিরোধী। তাই মাঝে মাঝে আইন আমাদের হাতে তুলে নিতে হয়। তবে অন্যান্য সময় অপরাধীকে আমরা লজ্জা দিতেই বেশি পছন্দ করি।

এ সমস্ত ঘটনায় সম্পত পাল এবং গুলাবী গ্যাংয়ের উপরে অনেকগুলো ফৌজদারী মামলা হয়েছে। তবুও সম্পত বা তার দল হাত গুটিয়ে বসে নেই। গোলাপী শাড়ি পরে গ্রামের পর গ্রাম ঘুরে তারা মেয়েদের স্কুলে পাঠাতে নারীদের উৎসাহ দিচ্ছে। কোথাও কোনো দুর্নীতির খবর পেলেই ছুটে যাচ্ছে, ধর্না দিচ্ছে।

একটি পুরষ্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে সম্পত পাল দেবী © gulabigang.in

২ মার্চ ২০১৪ সালে সম্পত পাল দেবীকে গুলাবী গ্যাঙের প্রধানের পদ থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়। তার বিরুদ্ধে আর্থিক অনিয়ম ও ব্যক্তিগত স্বার্থকে সংগঠনের স্বার্থ থেকে বেশি গুরুত্ব দেয়ার অভিযোগ উঠেছে, যদিও তিনি সেসব অভিযোগকে মিথ্যা এবং তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হিসেবে উল্লেখ করেছেন।

২০১২ সালের উত্তর প্রদেশ বিধানসভার নির্বাচনে তিনি ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের হয়ে মানিকপুর আসন থেকে নির্বাচনে অংশ নেন। কিন্তু নির্বাচনে তিনি পরাজিত হন। সম্পত পাল ২০১২ সালে ভারতের জনপ্রিয় টিভি শো ‘বিগ বসের’ ষষ্ঠ আসরেও অংশগ্রহণ করেন।

গুলাবী গ্যাংকে নিয়ে অনেক ডকুমেন্টারি ফিল্ম নির্মিত হয়েছে। ব্রিটিশ নির্মাতা কিম লঙ্গিনট্টো ২০১০ সালে গুলাবী গ্যাঙের উপর একটি ডকুমেন্টারি ফিল্ম ‘পিঙ্ক সারিজ (Pink Saris)’ নির্মাণ করেন। ২০১২ সালে নিষ্ঠা জৈন বানান ‘গুলাবী গ্যাং (Gulabi Gang)’।

গুলাবী গ্যাং অনেক পুরষ্কারেও ভূষিত হয়েছে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে গডফ্রে ফিলিপস ব্রেভারি অ্যাওয়ার্ডস ও দ্য কেলভিনেটর ইলেভেন্থ জিআর ৮! উইমেন অ্যাওয়ার্ড।

নারীদের নিজ পায়ে দাঁড়াতে শিখিয়েছেন সম্পত পাল দেবী © thenational.ae

সম্পত পাল দেবীর বিরুদ্ধে যত অভিযোগই থাকুক না কেন, এ বিষয়ে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই যে তিনি আধুনিক ভারতের নারীদের জন্য এক প্রেরণাদায়ী নাম। তিনি ভারতের একজন শক্তিশালী নারী যিনি অন্যায়, অবিচারের বিরুদ্ধে শুধু রুখেই দাঁড়াননি, বরং অন্যান্য নারীদের একত্রিত করেছেন, উৎসাহ জুগিয়েছেন অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে। অত্যাচারিত অসংখ্য নারীকে তিনি পথ দেখিয়েছেন নিজের ভাগ্য নিজেকেই গড়ে নিতে, নিজের পায়ে দাঁড়াতে আর আপন শক্তিতে জ্বলে উঠতে।

Related Articles