Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website. The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

জ্ঞানদানন্দিনী দেবী: সময়কে অতিক্রম করা আধুনিকার আখ্যান

বাপের বাড়ি থেকে মেয়েমানুষ শ্বশুরবাড়ি যাবে, আর সেখান থেকে শেষকৃত্য সম্পন্ন করার জন্য মৃতদেহ বের হবে।

নারীদের সম্পর্কে একটি সমগ্র জাতিগোষ্ঠীর ধারণা যখন এরকম, তখন একজন নারী কালাপানি পাড়ি দিয়ে গর্ভবতী অবস্থায় বিলেত যাত্রা করেন। মেয়েদের জবুথবু পোশাক বর্জন করে তৈরি করেন ফ্যাশনদুরস্ত ও আরামদায়ক শাড়ি পরবার পদ্ধতি। লাট সাহেবের নিমন্ত্রণ রক্ষার্থে শহর কলকাতার রাস্তায় নিজে গাড়ি হাঁকিয়ে বেরিয়ে পড়তে বিন্দুমাত্র দ্বিধাগ্রস্থ হন না। ছোটদের জন্য তিনি প্রকাশ করতে থাকেন সমৃদ্ধ সাহিত্য পত্রিকা। সমাজের চোখ রাঙানিকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে একের পর এক সাহসী সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছিলেন এই নারী। আলোর মশাল হাতে প্রথম অন্ধকার রাস্তায় এসে দাঁড়িয়েছিলেন জ্ঞানদানন্দিনী দেবী। সে আলোর শিখায় আজও আমরা উদ্ভাসিত হই।

১৮৫০ সালের ২৬ জুলাই জ্ঞানদানন্দিনী দেবীর জন্ম যশোরের নরেন্দ্রপুর গ্রামে। বাবা নরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী বাড়ির আঙিনায় একটি পাঠশালা খোলেন। নরেন্দ্রনাথ ভাবলেন, মেয়ে এখনও যথেষ্ট ছোট। এখন কিছুদিন পাঠশালায় গেলে হয়তো গ্রামে তেমন নিন্দা রটবে না। গ্রামের ছেলেদের সাথে জ্ঞানদানন্দিনীর আনাগোনা শুরু হতে থাকে পাঠশালায়। মা নিস্তারিণী দেবীও অল্পবিস্তর লেখাপড়া জানতেন। এ বিষয়ে স্মৃতিকথায় জ্ঞানদানন্দিনী লিখছেন,

একদিন রাত্রে হঠাৎ জেগে উঠে মাথা তুলে দেখি যে আমার মা কী লিখছেন না পড়ছেন। আমাকে দেখে তাড়াতাড়ি সেগুলো সব ঢেকে ফেললেন, পাছে আমি ছেলেমানুষ কাউকে বলে ফেলি।

আট বছর বয়সে গৌরীদান রীতি অনুযায়ী জ্ঞানদানন্দিনীর বিয়ে হয় কলকাতার ঠাকুরবাড়িতে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের মেজপুত্র সত্যেন্দ্রনাথের সঙ্গে। যশোরের মেয়েদের রূপের বেশ খ্যাতি ছিল ঠাকুরবাড়িতে। যেকোনো ছেলের বিয়ের সময় সর্বপ্রথম দাসীদের মেয়ে দেখতে যশোরে পাঠানো হতো। ঠাকুরবাড়ির অধিকাংশ বধূর পিতৃগৃহ তাই যশোর অঞ্চল। বিয়ের সময় সত্যেন্দ্রনাথের বয়স ছিল সতের বছর। পাশ্চাত্য শিক্ষার সঙ্গে এ কিশোরের ইতোমধ্যে পরিচয় হয়ে গিয়েছে। নতুন রকমের জীবনযাপন পদ্ধতি তার চোখে ঝলকানি দেয়। ১৮৫৯ কোনো এক ঐতিহাসিক লগ্নে এই কালজয়ী দম্পতি বিবাহসূত্রে আবদ্ধ হলেন।

আট বছরের গ্রাম্য শিশুটির মাথায় হঠাৎ করে অভিজাত ঠাকুরবাড়ির পুত্রবধূর তকমা চাপিয়ে দেওয়া হলো। সুবিশাল চুন-সুরকির প্রাসাদে নিজের দুধের দাঁতগুলো কোথায় ফেলবেন, বুঝতেই পারতেন না জ্ঞানদানন্দিনী। অনেক খুঁজেপেতেও এ বাড়িতে ইঁদুরের গর্ত আবিষ্কার করতে পারলেন না তিনি। শৈশবে অসম্ভব চিকন এবং শ্যামবর্ণা ছিলেন জ্ঞানদানন্দিনী দেবী। সারদা দেবী একবার পাশের বাড়ির বউদের দেখে আক্ষেপ করে বলেছিলেন, “এরা কেমন হৃষ্টপুষ্ট দেখ দেখি। আর তোরা সব যেন বৃষকাষ্ঠ।”

সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর; Image Source: Brainly.in

মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর বিভিন্ন সামাজিক ব্যাপারে রক্ষণশীল হলেও স্ত্রীশিক্ষার ব্যাপারে খুবই উদারমনা ছিলেন। তার প্রথম কন্যা সৌদামিনী দেবী বেথুন স্কুলের একদম প্রথমদিককার ছাত্রী। বউদের স্কুলে না পাঠানো হলেও বাড়িতেই চলত শিক্ষার আয়োজন। সৌদামিনী দেবী এবং স্বর্ণকুমারী দেবী, উভয়ের আত্মজীবনী থেকে জানা যায়, মেয়েদের শিক্ষার জন্য নিয়মিত বাড়িতে বৈষ্ণব এবং ইংরেজ মহিলারা আসতেন।

মহর্ষির সেজ ছেলে হেমেন্দ্রনাথ ঠাকুরের মেয়েদের পড়ানোর ব্যাপারে বেশ উৎসাহ ছিল। বাড়ির মেয়েরা মাথায় এক হাত ঘোমটা দিয়ে দক্ষিণের বারান্দায় মাদুর বিছিয়ে তার কাছে পড়তে বসতেন। রাশভারি গলার একেকটি ধমকে সবাই চমকে চমকে উঠত। মহর্ষি নিজে উদ্যোগ নিয়ে ব্রাহ্মসমাজের নবীন আচার্য অযোধ্যানাথ পাকড়াশিকে নিযুক্ত করেন মেয়েদের গৃহশিক্ষক হিসাবে। শুধুমাত্র মেয়েদের শিক্ষার জন্য অন্দরমহলে অনাত্মীয় পুরুষের প্রবেশ সেকালের সমাজে যথেষ্ট আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। তাদের সকলের তত্ত্বাবধানে জ্ঞানদানন্দিনীর পড়া এগোল মাইকেলের মেঘনাদবধ কাব্য পর্যন্ত।

বিয়ের কিছুদিন পরের কথা। সত্যেন্দ্রনাথের ঠাকুর সর্বভারতীয় স্তরে আইসিএস পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন। সে বছরই প্রথমবারের মতো ব্রিটিশদের দের সঙ্গে ভারতীয়রাও এ পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ পায়। সেই সময় একদিন তার প্রচণ্ড ইচ্ছা হলো নিজের প্রাণের বন্ধু মনমোহন ঘোষের সঙ্গে ‘জ্ঞেনি’র পরিচয় করিয়ে দেওয়ার। কিন্তু জ্ঞানদানন্দিনীর বাইরে বের হওয়া বা মনমোহন ঘোষের পক্ষে প্রকাশ্যে অন্দরমহলে প্রবেশ- কোনোটিই সম্ভব ছিল না।

কিন্তু সত্যেন্দ্রনাথ নাছোড়বান্দা। গভীর রাত্রে দুই বন্ধুতে সমান তালে পা ফেলে ঠাকুরবাড়ির দেউরি দালান পার হয়ে অন্দরমহলে প্রবেশ করলেন। যদি কোনোক্রমে ধরা পড়তেন, দুজনের এ কাজের জন্য চরম অপমানিত হওয়ার সম্ভাবনা ছিল। অন্দরমহলে নিজের ঘরে ঢুকে সত্যেন্দ্রনাথ বন্ধুকে মশারির মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়ে শুয়ে পড়লেন। আজন্ম সংস্কারের ফলে দুজনের কেউই সেদিন কথা বলতে পারেননি। খানিকক্ষণ পর হতাশ হয়ে সত্যেন্দ্রনাথে বন্ধুকে আবার মার্চ করে বাইরে দিয়ে আসেন।

১৮৬৩ সালের জুন মাসে ভারতবাসী বেশ যুগান্তরকারী একটি খবর পেল। সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিসে নির্বাচিত হয়েছেন। প্রবেশনারি ট্রেনিং সমাপ্ত করার জন্য তিনি পাড়ি জমান ইংল্যান্ড। সেই সুদূর বিলেত থেকে নতুনভাবে ভরা চিঠি আসতো ত্রয়োদশী কিশোরীর জন্য।

“আমাদের যখন বিবাহ হইয়াছিলো তখন তোমার বিবাহের বয়স হয় নাই- আমরা স্বাধীনতাপূর্বক বিবাহ করিতে পারি নাই, আমাদের পিতা-মাতারা বিবাহ দিয়া দিয়াছিলেন। তোমার বিবাহ তোমার হয় নাই, তাহাকে কন্যাদান বলে। তোমার পিতা কেবল তোমাকে দান করিয়াছেন। ইহা ভাই সত্য কিনা? যদিও আমি তোমাকে এ বিষয়ে কিছু মুখে বলি নাই, কিন্তু তুমি জানো আমার ভাব কি। যে পর্যন্ত তুমি বয়স্ক, শিক্ষিত এবং সকল বিষয়ে উন্নত না হইবে সে পর্যন্ত আমরা স্বামী-স্ত্রীর সমন্ধে প্রবেশ করিব না।”

এতদিন পরেও এসব চিঠির আধুনিকতা দেখলে চমকে উঠতে হয়! আদতে সেই আট বছরের শিশু থেকে দৃঢ়চেতা, অসম্ভব সাহসী একজন নারীতে পরিণত হওয়ার যাত্রায় সত্যেন্দ্রনাথের অবদান সর্বাধিক। কিছুদিনের মধ্যেই সত্যেন্দ্রনাথ পিতার কাছে স্ত্রীকে বিলেত পাঠানোর প্রস্তাব করেন। বলাই বাহুল্য, এই ‘সৃষ্টিছাড়া’ প্রস্তাব নাকচ করা হয়। ১৮৬৪ সালের নভেম্বর মাসে দেশে ফিরে আসেন সত্যেন্দ্রনাথ। তার কর্মস্থল ঠিক হয় বোম্বাই। স্বামী কর্মসূত্রে বাইরে গেলে স্ত্রীকে মায়ের তত্ত্বাবধানে রেখে যাওয়াই রেওয়াজ ছিল তখন। তবে এ দম্পতি খুব একটা নিয়ম মেনে চলেননি কোনোকালেই। ঠাকুরবাড়ির বড় বড় থামের আড়ালে জ্ঞানদানন্দিনী হারিয়ে যাক, চাননি সত্যেন্দ্রনাথ। কাজে যোগদানের জন্য সস্ত্রীক বোম্বাই যাত্রা করলেন তিনি।

যে বাড়ির গৃহকর্ত্রী গঙ্গাস্নান করতে গেলেও বেহারারা তাকে পালকিসুদ্ধ চুবিয়ে নিয়ে আসে, আজ তার অসূর্যম্পশ্যা গৃহবধূ সবার সামনে বর্হিজগতে পা রাখল। কিন্তু কী পরে বাইরে যাবেন জ্ঞানদানন্দিনী? ঘরের কোণে যাদের জীবন কাটবে, তাদের সাজসজ্জা নিয়ে মাথা ঘামানো অর্থহীন। একখানা শাড়ি কোনোক্রমে গায়ে পেঁচিয়ে রাখতেন তারা। তা কোনোমতেই বাইরে বের হওয়ার উপযুক্ত নয়। অনেক ভেবেচিন্তে ফরাসি দোকানে অর্ডার দিয়ে কিম্ভুতকিমাকার ওরিয়েন্টাল ড্রেস বানানো হলো। পোশাকটি যথেষ্ট অস্বস্তিকর।

জ্ঞানদানন্দিনী দেবী; Image Source: Telegraph India

তখন থেকে জ্ঞানদানন্দিনী ভেবেছিলেন, বাঙালি নারীর সবর্ত্র স্বাচ্ছন্দ্যে বিচরণের জন্য একটি আদর্শ পোশাক দরকার। যাত্রার প্রারম্ভে আরেক বিপত্তি। জাহাজঘাটা থেকে ঠাকুরবাড়ির দূরত্ব অনেকটা। সত্যেন্দ্রনাথ প্রস্তাব করলেন, বাড়ি থেকেই গাড়িতে ওঠা যাক। সেকালে মেয়েদের গাড়িতে ওঠা ভারি নিন্দনীয় ব্যাপার ছিল। দেবেন্দ্রনাথ কিছুতেই রাজি হলেন না। সাবেকি পালকি জ্ঞানন্দিনীকে জাহাজঘাটায় নামিয়ে দিয়ে এলো। কিন্তু এরপর আর কখনো ঘেরাটোপে আবদ্ধ পালকিতে চড়েননি তিনি!

বোম্বাইয়ের পারশি পরিবারে গিয়ে জ্ঞানদানন্দিনী লক্ষ্য করলেন, তারা শাড়ির আঁচল ডান কাঁধের উপর পরে। জ্ঞানদানন্দিনী পদ্ধতিটি সামান্য রদবদল করে আঁচল দেবার বা কাঁধের উপর দিয়ে শাড়ি পরবার অভিনব পদ্ধতি তৈরি করেন। জ্ঞানদানন্দিনীর পর কেশবচন্দ্র সেনের কন্যা মহারানী সুনীতি দেবী শাড়িতে আরেক মাত্রা যোগ করেন। সামনের দিকে দুটি ভাঁজ না দিয়ে তিনি বাড়তি কাপড়টুকু কুঁচি দিয়ে পরবার সিদ্ধান্ত নেন। এ রীতিই এখন পর্যন্ত প্রচলিত। জ্ঞানদানন্দিনী দেবী আরো শুরু করলেন শাড়ির সঙ্গে জ্যাকেট পরবার প্রচলন। নানা ধরনের লেস জুড়ে দেওয়া হতো জ্যাকেটে। জীবনস্মৃতিতে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন

“বিলিতি দরজির দোকান থেকে যতসব ছাটাকাঁটা নানা রঙের রেশমী ফালির সঙ্গে নেটের টুকরো আর খেলো লেস মিলিয়ে মেয়েদের জামা বানানো হতো।”

শাড়ির সঙ্গে মিলিয়ে পরা এই জামা বা জ্যাকেটেই পরবর্তী সময়ে ব্লাউজের রূপ ধারণ করে। প্রবাসে তাদের সঙ্গে প্রায়ই যোগ দিতেন ভাইবোনেরা। এসময় তিনি ইংরেজ শিষ্টাচারে যথেষ্ট পারদর্শী হয়েছিলেন। কলকাতা থাকাকালীন বাংলায় পড়াশোনা চললেও ইংরেজি একেবারেই জানতেন না জ্ঞানদানন্দিনী। সত্যেন্দ্রনাথের তত্ত্বাবধানে ইংরেজি, মারাঠি, গুজরাটি, হিন্দি- বিভিন্ন ভাষায় তিনি সাবলীল হয়ে ওঠেন।

১৮৬৬ সাল। আহমেদাবাদ, সিন্ধুদেশ, কানাড়া, মহারাষ্ট্র প্রভৃতি স্থান ঘুরে দু’ বছর পর আবার কলকাতাই ফিরলেন জ্ঞানদানন্দিনী। ঘোড়ার গাড়িতে চড়ে অপরূপ বেশবাসে, পায়ে জুতা ও বিলেতি মোজা পরিহিতা যে নারী ঠাকুরবাড়িতে প্রবেশ করলেন, তার সঙ্গে দু’ বছর আগের ভীতসন্ত্রস্ত মেয়েটির আকাশ-পাতাল তফাৎ। এতসব কাণ্ড একবারে হজম করা কারোর পক্ষেই সহজ নয়। স্বর্ণকুমারী দেবী লিখেছেন,

“ঘরের বৌকে মেমের মতো সেদিন গাড়ি হইতে নামিতে দেখিয়া সেদিন বাড়িতে যে শোকাভিনয় ঘটিয়াছিল তাহা বর্ণনার অতীত।”

বাড়ির অধিকাংশ নারী তার সঙ্গ বর্জন করলেন। নিজ গৃহে একঘরে করা হলো তাকে। জ্ঞানদানন্দিনীকে গ্রহণ না করলেও তার শাড়ির পরবার অভিনব ভঙ্গিমাটি কেউই উপেক্ষা করতে পারেনি। বাড়ির মেয়েদের মধ্যে পদ্ধতিটি চালু হয় ‘বোম্বাই দস্তুর’ নামে এবং বাংলায় দ্রুত তা ছড়িয়ে পড়তে থাকে। কলকাতা এবং মফস্বলে অনেকেই তখন মেয়েদের বাইরে বের হওয়ার আর্দশ পোশাক নিয়ে সচেতন হচ্ছিলেন। জ্ঞানদানন্দিনী বামাবোধিনী বিজ্ঞাপনও প্রকাশ করেছিলেন তার মতো করে শাড়ি পরার প্রশিক্ষণ দিতে। বিজ্ঞাপনে তিনি লিখেছিলেন, জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির মহিলারা যে সংস্কৃত পোশাক গ্রহণ করেছেন, তা একইসাথে সুন্দর এবং শীত, গ্রীষ্ম উভয় ঋতুর উপযোগী।

বর্ন অ্যান্ড শেপার্ড কোম্পানির কাছে ফটোগ্রাফি শিখে এসে জ্ঞানদানন্দিনী প্রায় জোর-জবরদস্তি করে বাড়ির সব নারীর একটি করে ছবি তোলেন। ঠাকুরবাড়ির অন্তঃপুরবাসিনীদের যেসব ছবি আজ দেখতে পাওয়া যায়, তার সমস্ত কৃতিত্ব জ্ঞানদানন্দিনী দেবীর। বোম্বাই থেকে ফিরে আসার পর তিনি ঠাকুরবাড়িতে আর থাকতে চাননি। স্বামী, পুত্র-কন্যা নিয়ে লোয়ার সার্কুলার রোডের ২৩৭ নম্বর বাড়িতে বসবাস শুরু করেন তিনি। তবে বৃহৎ পরিবারের কারোর সঙ্গেই সৌহার্দ্যের সম্পর্ক কখনো ছিন্ন হয়নি। রবিপত্নী মৃণালিনীর শিক্ষার ভার গ্রহণ থেকে শুরু করে জ্যােতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরকে নাটক অনুবাদের অনুপ্রেরণা জোগানো- সবখানে তার উজ্জ্বল উপস্থিতি। ঠাকুরবাড়ির বাইরে থেকেও সেখানকার মানুষদের সৃষ্টিশীল কাজে নিরন্তর অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন জ্ঞানদানন্দিনী।

একজন সিভিলিয়ানের স্ত্রী হিসাবে মাঝে মাঝেই বিভিন্ন ভোজসভায় তার আমন্ত্রণ পড়ত। ১৮৬৬ সালের অক্টোবর মাস থেকে পরের বছরের এপ্রিল মাস পর্যন্ত সত্যেন্দ্রনাথ খুব অসুস্থ ছিলেন। সে বছর ডিসেম্বর মাসের শেষের দিকে গর্ভনর জেনারেলের বাড়িতে তিনি সস্ত্রীক আমন্ত্রিত ছিলেন। সত্যেন্দ্রনাথের অসুস্থতার কারণে জ্ঞানদানন্দিনী একা নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে লাটভবনে যান। ইতোপূর্বে কোনো বাঙালি রমণী গভর্নমেন্ট হাউসে যাননি। পাথুরিয়াঘাটার প্রসন্নকুমার ঠাকুর সেখানে উপস্থিত ছিলেন। ঘরের বউকে প্রকাশ্যে রাজসভায় দেখে লজ্জায় সেখান থেকে পালিয়ে যান। সত্যেন্দ্রনাথ রসিকতা করে লিখেছিলেন, “সে কী ব্যাপার! শত শত ইংরেজ মহিলার মাঝখানে আমার স্ত্রী একমাত্র বঙ্গবালা!” তাকে দেখে প্রথমে সবাই ভূপালের বেগম ভেবেছিলেন, কারণ তিনিই তখন একমাত্র বাইরে বের হতেন।

১৮৭২ সালে প্রথম পুত্র সুরেন্দ্রনাথের জন্মের সময় এ দম্পতি পুনায় থাকতেন। ১৮৭৩ খ্রিষ্টাব্দে বিজাপুরে থাকাকালীন কন্যা ইন্দিরা দেবীর জন্ম হয়। এসময় সন্তানদের পরিচর্যার জন্য তিনি একজন মুসলিম সেবিকা নিয়োগ করেন। মুসলিম সেবিকা রাখার বিষয়টি রক্ষণশীল হিন্দু সমাজ সহজে মেনে নিতে পারেনি। ১৮৭৬ সালে হায়দারবাদে কনিষ্ঠ পুত্র কবীন্দ্রনাথের জন্ম হয়।

জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ি; Image Source: Kolkata Tourism

জ্ঞানদানন্দিনী ইংরেজ ভাষা ও কায়দা-কানুনের সঙ্গে আরো নিবিড়ভাবে পরিচিত হওয়ার জন্য ১৮৭৭ সালের মে মাসে যথাক্রমে পাঁচ, চার ও দু’বছরের তিনটি শিশু সন্তানসহ গর্ভবতী অবস্থায় ইংল্যান্ড যাত্রা করেন। কালাপানি পাড়ি দেওয়া পুরুষের পক্ষেই সাংঘাতিক কাণ্ড হিসাবে বিবেচিত হতো। সন্তানদের নিয়ে তিনি আড়াই বছর ইংল্যান্ড এবং তিন মাস ফ্রান্স বসবাস করেন। ফ্রান্সে থাকাকালীন তিনি দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহার করার মতো ফরাসি ভাষাও রপ্ত করেছিলেন।

মৃত সন্তানের জন্মদান এবং ছোট ছেলেটির মৃত্যুর জন্য জ্ঞানদানন্দিনীর প্রবাসজীবন মর্মান্তিক হয়ে ওঠে। ১৮৭৮ সালের অক্টোবরে সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর ছোট ভাই রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে সেখানে আসেন। ইন্দিরা ও সুরেন্দ্রনাথের সঙ্গে তাদের রবি কাকার চমৎকার ভাব হয়ে যায়। ইন্দিরা পরবর্তী জীবনেও রবীন্দ্রনাথের স্নেহধন্য হয়েছিলেন। ১৮৮০ সালের ফেব্রুয়ারিতে এস এস অক্সাস জাহাজে চেপে রবীন্দ্রনাথ ও সত্যেন্দ্রনাথসহ তিনি ফ্রান্স ত্যাগ করেন।

জ্ঞানদানন্দিনী দেবী নিজে সাহেবিয়ানা পছন্দ করতেন না। পশ্চিমা রীতির অনেক কিছুই তিনি গ্রহণ করেছিলেন বটে, কিন্তু আদর্শ জীবনযাপনের জন্য যতটুকু প্রয়োজন, ততটুকুই। তিনি ভুয়ো ইংরেজ নিন্দা করে সারাজীবন ইংরেজের অনুগ্রহ ভিক্ষা করে কাটিয়ে দেওয়াকে তীব্র অপছন্দ করতেন। বিলেত থেকে ফিরে আসার পর তিনি জন্মদিন পালন ও বিকালে বেড়াতে বেড়ানোর দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন, যা এখন স্বাভাবিকতম কাজ মনে হলেও দেড়শো আগের দিনে সহজ ছিলো না। সরলা দেবী ‘জীবনের ঝরাপাতা’ গ্রন্থে লিখেছেন,

আমার মামীমা জ্ঞানদা ব্রিটেন থেকে নতুন একটি প্রথা সঙ্গে করে নিয়ে আসেন। সেটি হলো জন্মদিন। এর আগে এই অদ্ভুত উদযাপনের সম্পর্কে আমাদের জানা ছিল না। প্রকৃতপক্ষে আমরা এমনকি কবে জন্ম নিয়েছি, সেটাই তো জানতাম না। এখন দেখুন, সারা দেশেই জন্মদিন উদযাপন করা হচ্ছে।

কলকাতার অভিজাত পরিবারের চল ছিল জন্মের পর নিয়োগকৃত দাইয়ের কাছে শিশুদের পাঠিয়ে দেওয়া। তারপর তাদের কথা একরকম ভুলেই যেতেন অভিভাবকেরা। জ্ঞানদানন্দিনী প্রথমে শিশুদের মানসিক বিকাশের কথা ভাবলেন। বাড়ির ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের জড়ো করে ‘বালক’ নামে একটি পত্রিকা বের করলেন। তার নিরন্তর উৎসাহে রবীন্দ্রনাথ ‘বালক’-এর জন্য ছোটদের লেখায় হাত দেন। তবে সম্পাদিকার একটিমাত্র রচনা সেখানে আছে। তিনি ‘কনটেম্পোরারি রিভিউ’ থেকে ডেবাগোরিও মোগ্রিয়েভিং এর সাইবেরিয়া থেকে পলায়নের কাহিনীটি বাংলা অনুবাদ করেন ‘আশ্চর্য পলায়ন’ নামে।

বালক পত্রিকা
বালক পত্রিকা; Image Source: Anandabazar

বাচ্চাদের ছবি আঁকায় উৎসাহ দিতে জ্ঞানদানন্দিনী বসিয়েছিলেন লিথো প্রেস। তার অধিকাংশ ব্যয় তিনি নিজে বহন করতেন। ভারতীতে কিন্টারগার্ডেন ও স্ত্রীশিক্ষা নামে দুটি প্রবন্ধ ছাপা হয়। এছাড়া তার আরেকটি রচনা ‘ভাউ সাহেবের খবর’ মারাঠী রচনার বঙ্গানুবাদ। ‘ইংরেজ নিন্দা ও স্বদেশ অনুরাগ’ নামক একটি প্রবন্ধও লিখেছিলেন তিনি। ‘সাত ভাই চম্পা’ এবং ‘টাক ডুমাডুম’ নামক দুটি রূপকথার নাট্যরূপ দিয়েছিলেন তিনি।

সবকিছু সহজাতভাবে আয়ত্ত করার আশ্চর্য ক্ষমতা ছিল জ্ঞানদানন্দিনী দেবীর। রবীন্দ্রনাথের নাটক মঞ্চস্থ করবার বিষয়েও তিনি সাহায্য করতেন। ঠাকুরবাড়িতে একের পর এক মঞ্চস্থ হতে থাকে ‘বাল্মীকি প্রতিভা’, ‘কালমৃগয়া’, ‘রাজা ও রানী’, ‘মায়ার খেলা’, ‘বিসর্জন’ ইত্যাদি। ‘রাজা ও রানী’ নাটকে রাজা বিক্রমের ভূমিকায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং রানী সুমিত্রার ভূমিকায় জ্ঞানদানন্দিনী অভিনয় করেন। বঙ্গবাসী পত্রিকায় এ অভিনয়কে কেন্দ্র করে তার নামে যথেষ্ট কটাক্ষ করা হয়েছিল।

১৯০৭ সালে এ দম্পতি জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাসভবন রাঁচিতে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। ১৯৪১ সালে সেখানেই জীবনাবসান ঘটে এই অসামান্য নারীর। তার সমস্ত জীবনাচরণের মধ্য দিয়ে তিনি বাঙালি নারীর চলার পথকে সুগম করেছেন।

This article is in Bangla. It is about Jnanadanandini Devi, a significant member of the Tagore family.

Reference Books:

1. ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহল- চিত্রা দেব

2. রাসসুন্দরী থেকে রোকেয়া নারী প্রগতির একশো বছর - গোলাম মুরশিদ

3. রবির বউঠান - মল্লিকা সেনগুপ্ত

 

Related Articles