Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

হেনরিখ থিওডোর বোল: বই বিক্রেতা থেকে নোবেল বিজেতা

হিটলারের নাৎসি পার্টিতে যোগদানের অনুরোধ সবিনয়ে প্রত্যাখ্যান করে নাম লেখালেন বই বিক্রেতার কাতারে। বই বিক্রি করতে গিয়ে নতুন নতুন বইয়ের ঘ্রাণ তাকে পরশ পাথরের মতো আকর্ষণ করতে লাগলো। তারপর নিজেই লেখালেখি শুরু করলেন। সাহিত্যিকের খাতায় নিজের নাম লেখালেন। তাও কি যেমন তেমন সাহিত্যিক! সাহিত্য চর্চা করে অর্জন করে নিলেন নোবেল পুরুস্কার। হ্যাঁ, তিনি আর কেউ নন। জার্মান ঔপন্যাসিক-লেখক হেনরিখ থিওডোর বোল। 

১৯১৭ সালের ২১ ডিসেম্বর জার্মানির কোলন শহরে, রাইন নদীর তীরে জন্ম তার। পিতা ভিক্টর বোল ছিলেন একজন ভাস্কর ও আসবাবপত্র নির্মাতা। ‘ক্যাবিনেট’ নির্মাণে তার বিশেষ সুখ্যাতি ছিল। তাই তাকে ‘ক্যাবিনেট মেকার’ নামে ডাকা হতো। আর মা মারিয়া গৃহবধূ ছিলেন।

ঔপন্যাসিক হেনরিখ থিওডোর বোল, ছবিটি ১৯৮১ সালে তোলা; Image Source: wikimedia.org

১৯২৪ সাল থেকে ১৯২৮ সাল পর্যন্ত তিনি প্রাথমিক শিক্ষা অর্জন করেন। ১৯৩০ সালে হিটলারের নাৎসি পার্টির যুব শাখা ‘হিটলার ইয়ুথ’-এ যোগদানের অনুরোধ আসলে তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন। এরপর ১৯৩৭ সালের শুরুর দিক পর্যন্ত তিনি উচ্চ শিক্ষা অধ্যয়নে মগ্ন ছিলেন। সে বছরের মাঝামাঝিতে তিনি বই বিক্রেতা হিসেবে পেশা জীবন শুরু করেন। বই বিক্রি করতে গিয়ে তিনি নানা শ্রেণীর মানুষের সাথে মেশার সুযোগ পান। তিনি অনুসন্ধিৎসু মন নিয়ে মানুষের জীবনের গল্প শুনতে থাকেন। মানুষের জীবন পাঠ করতে গিয়েই তার মধ্যে লেখালেখির বাসনা তৈরি হয়। তিনি স্বল্প পরিসরে লেখালেখি শুরু করেন।

১৯৩৮ সালে জার্মান সরকার তাকে সরকারি চাকরিতে আহ্বান করলে তিনি শ্রমবিভাগের কর্মকর্তা হিসেবে যোগদান করেন। ফলে তার বই বিক্রির পেশা বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু এ পেশায় বেশি দিন থাকা হয়নি তার। মাত্র ৬ মাস চাকরি করে অবসর নিয়ে নেন। তারপর আবার লেখাপড়ার জগতে ফিরে আসেন। ১৯৩৯ সালে তিনি ইউনিভার্সিটি অফ কলোনির জার্মানিস্টিকস এন্ড ক্লাসিক্যাল ফিলোলজি বিভাগে ভর্তি হন।

লেখালেখির কাজে মগ্ন হেনরিখ থিওডোর বোল; Image Source: rickrozoff.wordpress.com

সময়টি ছিল উত্থান-পতনের। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বারুদের গন্ধ চারদিকে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে জার্মানির আকাশে বাতাসে। হেনরিখ থিওডোর বোলের বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ালেখা থমকে দাঁড়ায়। দেশের প্রয়োজনে ১৯৩৯ সালেই বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে যোগ দেন জার্মান সেনাবাহিনীতে। সেখানে তিনি কর্পোরোল পদ পর্যন্ত উন্নীত হয়েছিলেন।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে তিনি তাতে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। জার্মান সেনাবাহিনীর পক্ষে ফ্রান্স, রাশিয়া, রুমানিয়া ও হাঙ্গেরিসহ বিভিন্ন ফ্রন্টে যুদ্ধ করেন। ১৯৪৫ সালে তিনি আমেরিকান সেনাদের হাতে বন্দী হয়ে বেশ কিছুদিন ফ্রান্সের কারাগারে বন্দি থাকেন। সেখান থেকে বেলজিয়ামের ইংলিশ ক্যাম্পে স্থানান্তরিত হন। অবশেষে ১৯৪৫ সালের ডিসেম্বরে তিনি বন্দী দশা থেকে মুক্তি পান। মুক্তি পেয়ে তিনি আবার জার্মান সেনাবাহিনীতে যোগদান করেন। 

কিন্তু বই আর লেখালেখির নেশা একসময়ের বই বিক্রেতা হেনরিখ বোলকে তাড়া করতে থাকে। ছেড়ে দিলেন সেনাবাহিনীর চাকরি এবং সিদ্ধান্ত নেন, বাকী জীবন সাহিত্য চর্চার মধ্য দিয়ে কাটিয়ে দেবেন। তাই সিদ্ধান্ত নিলেন কোলন শহরে তিনি স্থায়ীভাবে বসবাস করবেন। কোলেন জার্মানির সর্ববৃহৎ শহর, যাকে হেনরিখ থিওডোর বোল সাহিত্য চর্চার মোক্ষম জায়গা হিসেবে বিবেচনা করেন। 

হেনরিখ থিওডোর বোলের লিখিত প্রথম উপন্যাসিকা ‘দের জুং ওয়ার পাঙ্কটিচ’-এর প্রচ্ছদ; Image Source: picclick.de

১৯৪৬ সাল থেকে ১৯৪৯ সাল পর্যন্ত তিনি প্রচুর ছোট গল্প রচনা করেন। ১৯৪৯ সালের শেষ দিকে তার প্রথম উপন্যাসিকা ‘দের জুং ওয়ার পাঙ্কটিচ’  প্রকাশিত হয়। এই বইয়ের মাধ্যমেই তিনি পরিচিতি পেতে শুরু করেন। ১৯৫১ সালে তিনি ‘উ ওয়ারস ডু আদাম’ নামে একটি উপন্যাস প্রকাশ করেন। এই বই দুইটিতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াল তাণ্ডব, মানবাধিকার লঙ্ঘন, সৈনিকদের দুঃখ-কষ্ট ও হতাশা ইত্যাদি বিষয় সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তোলেন।

দ্বিতীয় বইটি তুমুল জনপ্রিয়তা পেয়ে যায়। ১৯৫১ সালেই তাকে জার্মানির প্রভাবশালী সাহিত্য সংগঠন ‘গ্রুপ ৪৭’ তাকে একটি সম্মেলনে নিমন্ত্রণ জানায়। সেখানে গিয়ে তিনি বিভিন্ন প্রভাবশালী লেখকদের সাথে পরিচিত হওয়ার সুযোগ লাভ করেন। এটি তার সাহিত্য সাধনায় নতুন অধ্যায়ের সূচনা করে। এরপর হেনরিখ বোল সাহিত্য সাধনায় আরও গভীরভাবে মনোনিবেশ করেন।

১৯৭১ সালে প্রকাশিত হেনরিখ বোলের বিখ্যাত উপন্যাস ‘গ্রুপেনবিলড মিট ডেইম’-এর প্রচ্ছদ; Image Source: wikimedia.org

১৯৭১ সালে তিনি ‘গ্রুপেনবিলড মিট ডেইম’ নামক একটি উপন্যাস লিখে সারা বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। বইটিতে লেখকের সারা জীবনের অভিজ্ঞতা ফুটে ওঠে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ থেকে শুরু করে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত জার্মানির যে বিবর্তন তা উপন্যাসের ভাষায় চিত্রায়িত করেন হেনরিখ বোল। বইটি বিশ্ব সাহিত্যে এতটাই প্রভাব বিস্তার করে যে, ১৯৭২ সালের নোবেল কমিটি তাকে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার দেয়ার জন্য মনোনীত করেন। নোবেল কমিটি তখন তার লেখালেখির বৈশিষ্ট নিয়ে বলেন-

তিনি তার লেখালেখিতে প্রশস্ত দৃষ্টিভঙ্গি ও দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। সময় ও প্রেক্ষিত লেখার মধ্যে সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। জার্মান সাহিত্যে তিনি নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছেন। তার এই অবদান অনস্বীকার্য। 

১৯৭২ সালে নোবেল পুরস্কার গ্রহণ করছেন হেনরিখ থিওডোর বোল (ডানে); Image Source: nytimes.com

তার লেখালেখির মূল শক্তি কী? তিনি কেন এত অসাধারণ হয়ে উঠলেন সেই বর্ণনা দিতে গিয়ে এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা সম্পাদক লিখেছেন-

বোল একজন রোমান ক্যাথলিক ও শান্তিবাদী লোক ছিলেন। তিনি লেখালেখির মাধ্যমে একটি উচ্চ নৈতিকতার জায়গা তৈরি করেছেন। পাশাপাশি সমাজ পরিবর্তনের জন্য প্রত্যেক মানুষকে ঘিরে তার সাহিত্যে তৈরি করেছেন সুদূরপ্রসারী সম্ভাবনা। জার্মান সাহিত্যে বহুল ব্যবহৃত থিমগুলো তিনি পরিহার করে নিজস্ব অনুপম থিম গ্রহণ করছেন। সাহিত্যের কাছে তিনি নিজের দায়বদ্ধতা সৃষ্টি করেছেন। তার লেখালেখির বর্ণনা অত্যন্ত প্রাঞ্জল ও গতিময়- পড়তে গেলে মনে হয় যেন, সেই বিভীষিকাময় যুদ্ধের দিনগুলোর মধ্যে দাঁড়িয়ে আমরা মানুষের প্রতি মানুষের বর্বরতা অবলোকন করছি। 

হেনরিখ থিওডোর বোল জার্মানির অন্যতম বহুল পঠিত লেখক। পৃথিবীর ৩০টিরও বেশি ভাষায় তার গ্রন্থসমূহ অনুদিত হয়েছে। তার অন্যান্য উপন্যাসের মধ্যে রয়েছে উন্ড স্যাগটি কেইন ইঞ্জিগেস ওর্ট ১৯৫৩, ডাস ব্রোট ডার ফ্রুহেন জাহের ১৯৫৫, বিলার্ড উম হালব জেহেন ১৯৫৯, দি ক্লাউন ১৯৬৩, ডাই ভরলরেন ইহরি দের ক্যাথেরিন ব্লাম অর্ডের: ওয়াই গেওয়াল্ট এন্টস্টেন্টথ উন্ড ওহিম সাই ফুহরিন ক্যান ১৯৭৪, ফ্রুসরগ্লিসি বেলগেরাং ১৯৭৯। 

স্ত্রী এননিমারাই চের সাথে হেনরিখ থিওডোর বোল, ছবিটি ১৯৮৩ সালের ১ সেপ্টেম্বরে তোলা; Image Source: stuttgarter-zeitung.de

১৯৪২ সালে তিনি এননিমারাই চে নামক এক নারীকে বিয়ে করেন তিনি। যিনি হেনরিখ থিওডোর বোলের লেখক জীবনের সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা হিসেবে নিভৃতে কাজ করে গেছেন। স্ত্রী সম্পর্কে তিনি বলেন:

আমার লেখক জীবনে এননিমারাই চের অবদান অপূরণীয়। তিনি শুধু আমার স্ত্রী-ই নন, সে একজন প্রকৃত সহযাত্রী। জার্মান নাৎসিবাদ ও ফ্যাসিবাদ যখন আমার উপর ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে, তখন তিনি আমার পাশে থেকে সাহস যুগিয়েছেন। আবার তিনিই ছিলেন আমার সবচেয়ে বড় সমালোচক, যা আমার পথ চলতে দিশারীর ভূমিকা পালন করেছে। 

পারিবারিক জীবনে তারা তিন পুত্র সন্তানের জনক-জননী ছিলেন। 

নিজ বাসগৃহে হেনরিখ থিওডোর বোল; Image Source: theparisreview.org

হেনরিখ থিওডোর বোল রোমান ক্যাথলিক ধর্মের অনুসারী হলেও তিনি ধর্মীয় বিতর্কে জড়িয়ে পড়েন, কেননা তিনি চার্চের অত্যাচার-নির্যাতন ও অযৌক্তিক মতবাদসমূহের বিরুদ্ধে সরব ছিলেন। তার ক্লাউন নামক উপন্যাসে জার্মানির খ্রিস্টান ডেমোক্রেটিক ইউনিয়ন ও চার্চের নেতিবাচক দিকসমূহ তুলে ধরে কট্টরপন্থীদের সমালোচনার মুখোমুখি হন।

১৯৭২ সালে নোবেল পুরস্কারের জন্য মনোনীত হলেও ধর্মীয় কট্টরপন্থীরা এর প্রতিবাদ জানান। তারা দাবি করেন, হেনরিখ থিওডোর বোল শুধুমাত্র একজন ‘উদারতাবাদী ও চরমপন্থি বাম’ হওয়ার কারণে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন।  

জার্মানের বার্লিনে অবস্থিত হেনরিখ থিওডোর বোলের একটি ভাস্কর্য; Image Source: wikimedia.org

১৯৭৪ সালে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল- আপনি কি এখনও নিজেকে একজন ক্যাথলিক খ্রিস্টান মনে করেন? জবাবে তিনি বলেন:

হ্যাঁ, আমি নিজেকে একজন ক্যাথলিক মনে করি। তবে এটি আমার ব্যক্তিগত বিশ্বাস মাত্র, ধর্ম আমার কাছে কোনো ব্যবসায়িক পণ্য নয়। মূলত ধর্ম কোনো সমস্যাই নয়, সমস্যা হয়ে ওঠে যখন এর রাজনৈতিক অপব্যবহার শুরু হয়। আপনারা হয়তো জানেন, চার্চের দুটি দিক রয়েছে। একদিকে প্রাতিষ্ঠানিক চার্চ, অন্যদিকে এর আধ্যাত্মিক পরিষদ। প্রাতিষ্ঠানিক চার্চ একটি বুর্জুয়া প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। ফলে আমি তাদের পরিহার করেছি। আমি এই দুই গ্রুপের মধ্যকার দ্বন্দ্ব থেকে নিজেকে সরিয়ে রেখেছি। কিন্তু তারা বারবার এই প্রশ্নই তোলার চেষ্টা করেছে যে, আমি কেন প্রাতিষ্ঠানিক চার্চে যাই না। এ প্রশ্ন অনেক সময় আমার স্ত্রীও তুলেছে। কিন্তু বিষয়টি খুব সহজ। আমি কেন তাদের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে নিজেকে জড়াবো? কিন্তু আমার বলতে দ্বিধা নেই যে, আমি বেড়ে ওঠার সময় ক্যাথলিক ধর্ম দ্বারাই সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত হয়েছি। 

কিন্তু একদিন সব যাত্রাই থেমে যায়। পথ চলতে চলতে একদিন মানুষকে মৃত্যুর দিকে হেঁটে যেতে হয়। ১৯৮৫ সালের ১৬ জুলাই সেই দিনটি আসে হেনরিখ থিওডোর বোলের জীবনে। অবসান হয়ে যায় বই বিক্রেতা থেকে নোবেল বিজেতা হয়ে ওঠা এক কিংবদন্তির জীবন।   

ফিচার ইমেজ- us.boell.org

Related Articles