Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

বাস্তবের রানী ক্লিওপেট্রা দেখতে কেমন ছিলেন?

কথায় কথায় ক্লিওপেট্রার রূপের বর্ণনা দেওয়া হয় অনেক স্থানেই। লেখনী এবং মৌখিক ভাষায় ক্লিওপেট্রাকে দেখানো হয়েছে অসম্ভব সুন্দরের প্রতীক হিসেবে। মিশরের এই রানীকে নিয়ে বলতে গিয়ে রোমান ঐতিহাসিক ক্যাসিয়াস ডিও লেখেন, “সবাইকে ছাড়িয়ে যাওয়ার মতো, সেরা রূপের অধিকারী নারী।” ক্লিওপেট্রাকে নিয়ে নির্মিত সমস্ত চলচ্চিত্রতেও এই রানীর সৌন্দর্য প্রদর্শন করা হয়েছে ঢালাওভাবে। কিন্তু সত্যিটা কী? বাস্তবে মিশরের রানী ক্লিওপেট্রা কি সত্যিই এতটা সুন্দর ছিলেন?

ক্লিওপেট্রার কাল্পনিক ছবি; Source: Answers Africa

ক্লিওপেট্রা সুন্দর। অনিন্দ্যসুন্দর এক নারীর ছবি ভেসে ওঠে সবার মনে প্রাচীন এই রানীকে মনে করলে। কিন্তু ২০০৭ সালে সব হিসেব গোলমাল হয়ে যায়। সে বছর সোসাইটি অব এন্টিক নিউক্যাসলের সংগ্রহে থাকা প্রাচীন আর ছোট্ট মুদ্রা ক্লিওপেট্রার সৌন্দর্য সংক্রান্ত এই ধারণা বদলে দেয়। সন্দেহ সৃষ্টি হয় সবার মনে। জিজ্ঞাসা ওঠে, সত্যিই কি এমন সুন্দর ছিলেন ক্লিওপেট্রা? মুদ্রায় অঙ্কিত ক্লিওপেট্রার অবয়ব দেখে অবশ্য সেটা মেনে নেওয়ার উপায় ছিল না। পুরো পৃথিবীতে সাড়া পড়ে যায় ব্যাপারটি নিয়ে। সমস্ত পত্রিকায় আসে খবর। মুদ্রা যদি সত্যি বলে থাকে তাহলে ক্লিওপেট্রা এলিজাবেথ টেইলরের মতো কেউ ছিলেন না। সাধারণ সৌন্দর্যের অধিকারী কোনো মানবীও ছিলেন না। বরঞ্চ একটু বেশিই যেন পুরুষালি, সমতল আর কঠিন ছিলেন। কিওপেট্রার প্রতি সাংবাদিকদের এমন বিশেষণে ঝড় ওঠে মানুষের মধ্যে।

মুদ্রায় অঙ্কিত ক্লিওপেট্রা; Source: Illustrert Vitenskap

তবে ক্লিওপেট্রার সত্যিকারের ভক্তদের জন্য কিন্তু ব্যাপারটা নতুন কিছুই ছিল না। নিউক্যাসলের আগেও আরো অনেক এমন অনেক মুদ্রা উঠে এসেছে সবার সামনে, ইতিহাসের পাতা থেকে। সেগুলোতেও ক্লিওপেট্রা দেখতে মোটেও সুন্দরী বা এর ধারেকাছে কিছুই ছিলেন না।

এখন প্রশ্ন আসতে পারে যে, সৌন্দর্য ব্যাপারটা কী? এটা তো আপেক্ষিক। হ্যাঁ, তা আপেক্ষিক। এবং এখানে বর্ণবাদের মতো কোনো ব্যাপারও নেই। তবে যে লাস্যময়ী এবং সৌন্দর্যের দেবীকে মানুষ মনে মনে পুষে এসেছে যুগের পর যুগ ধরে, মুদ্রার অঙ্কিত ক্লিওপেট্রা ঠিক তেমনটা নয়। ক্লিওপেট্রাভক্তরা অবশ্য মুদ্রার এই ক্লিওপেট্রার পেছনেও বেশ ভালো যুক্তি দেখিয়েছেন। দোষ পড়েছে অদক্ষ শ্রমিকের ঘাড়ে। অনেকে আবার ভেবেছেন নিজের আসল চেহারা দেখাতে চাননি রানী। তার সৌন্দর্যমন্ডিত রূপ কর্কশতার আড়ালে ঢেকে রাখতে চেয়েছেন তিনি সবার সামনে। তবে ক্লিওপেট্রার অবয়ব মুদ্রার চাইতে খুব যে বেশি ভিন্ন ছিল সেটা ভাবার কোনো অবকাশ নেই। উল্লেখ্য, মধ্যযুগে মানুষ ঠিক দেখতে যেমন, তার সমস্ত ত্রুটিসহই ফুটিয়ে তোলা হত ছবিতে। ক্লিওপেট্রার সময় সেই প্রথা একটু কমে আসে। সেই প্রভাব পড়েছে এই খোদাইয়ে। কিন্তু তাই বলে বিশাল নাক আর চিবুক- এ দুটো একজন মানুষের চেহারা অন্যজনের থেকে আলাদা করতে সাহায্য করে। তাই ক্লিওপেট্রার ক্ষেত্রে সেগুলো ঠিক রাখা হয়েছিল। এছাড়াও প্রশ্ন আসে যে, ক্লিওপেট্রার আসল চেহারা এমন না হলে রানী সেটাকে মুদ্রায় স্থান দিতেন কিনা। তবে ক্লিওপেট্রার বাবার প্রতিকৃতিতেও ক্লিওপেট্রার মত অনেকগুলো বৈশিষ্ট্য উপস্থিত ছিল। মনে করা হয়, এমন নাক, কপাল আর চিবুক হয়তো পারিবারিক ব্যাপার ছিল। তাই মুদ্রা তৈরির সময় সেগুলোর সবগুলোকেই রেখেছেন খোদাইকারী। সুন্দরী ক্লিওপেট্রা হয়ে উঠেছে অসুন্দর।

অবশ্য, কেবল ক্লিওপেট্রাই নয়, তার দুই প্রেমিক জুলিয়াস সিজার এবং এন্টোনিও বর্তমানের হিসেবে খুব যে দেখার মতো বা সুন্দর ছিলেন এমনটা কিন্তু নয়। জুলিয়াস সিজারের ভাঁজ পড়া গলা আর টেকো মাথা সম্পর্কে অনেকেই জানেন। এন্টোনিরও ছিল ভাঙা নাক আর ভাঙা থুতনি। পৃথিবীর বেশকিছু স্থানে ক্লিওপেট্রার ছবি সম্বলিত মুদ্রা খুঁজে পাওয়া যায়। মিশরের আলেকজান্দ্রিয়া থেকে শুরু করে গ্রীসের পাত্রাস- পূর্ব ভূমধ্যসাগরের আশেপাশে অনেক স্থানে পাওয়া যায় সেগুলো। শাসকদের শাসনের স্থানে তৈরি হয়েছিল সেগুলো। নতুন নতুন করে। তাই শিল্পীভেদে চেহারার ধরনেও ভিন্নতা থাকার কথা। তবে তা হয়নি। সবখানেই, সব মুদ্রাতেই ক্লিওপেট্রার চেহারা ছিল একইরকম। এর একটি কারণ হতে পারে এই যে, সবার কাছে নির্দেশ দেওয়া ছিল যে, ক্লিওপেট্রার থুতনি এবং নাক একটি নির্দিষ্ট আকৃতির হবে। আর নির্দেশ দিয়েছিলেন স্বয়ং রানী। আবার এমনটাও ধারণা করা হয় যে, ক্লিওপেট্রার একটি ছবি দেখেই মুদ্রাগুলো তৈরি করা হয়েছে। ফলে, চেহারায় কোনো পার্থক্য দেখতে পাওয়া যায়নি।

ক্লিওপেট্রার বাবা; Source: eBay

পোশাক এবং সাজগোজের জন্যে ক্লিওপেট্রা বেশ বিখ্যাত। নানারকম পোশাক পরতে পছন্দ করতেন তিনি। তবে মুদ্রায় নিজের আকৃতির ক্ষেত্রে এর কোনো ছাপ পাওয়া যায়নি। মাথার চারপাশে হেলেনীয় শাসকের পোশাক ডায়াডেম পরেছেন তিনি। চুলগুলো প্রথমে বেনী হয়ে নেমে এসেছে, এরপর মাথার সাথেই খোপা করে আটকে দেওয়া হয়েছে। কাঁধের কাছে নিজের গাউনের উপরে একটি আবরণ পরেছেন তিনি। কানে একটা সাদাসিধে গোছের দুল আর গলায় মুক্তার মালা। আর এই মুক্তার মালাটিই একমাত্র দামী কিছু ছিল যেটা ক্লিওপেট্রা মুদ্রায় অঙ্কিত ছবিতে রেখেছিলেন। অনেক মুদ্রায় আবার গাউনের উপরে থাকা আবরণেও আটকে রাখার মুক্তা পাওয়া গিয়েছে। এই মুক্তোকে অনেকে এন্টোনি আর সীজারের উপহার হিসেবেও ভাবেন।

বেশিরভাগ মুদ্রা তৈরির সময়কাল ছিল খ্রিস্টপূর্ব ৩০ অব্দ। সেসময় ক্লিওপেট্রা নিজে পার করছিলেন জীবনের ত্রিশতম অধ্যায়। সেক্ষেত্রে বয়সটাও এমন অবয়বের কারণ হতে পারে। প্রশ্ন উঠতেই পারে যে, এগুলো যে ক্লিওপেট্রার অবয়ব সেটা কী করে বলা যায়? মুদ্রাগুলোতে ক্লিওপেট্রা মাঝে মাঝে ছিলেন একা, মাঝে মাঝে ছিলেন এন্টোনির সাথে। তবে যেভাবেই থাকুন না কেন, সবখানে ক্লিওপেট্রা পরিচিত হয়েছিলেন নিজের নামে। কখনো তাকে লেখা হয়েছে “রানী ক্লিওপেট্রা, নতুন দেবী” হিসেবে, কখনো “রানী ক্লিওপেট্রা, রাজা এবং অনাগত শিশু রাজাদের রানী”। ফলে মুদ্রার এই লেখনীগুলোই ক্লিওপেট্রাকে পরিচিত করে দিয়েছে সবার সাথে আরো ভালোভাবে। একইসাথে অনেকের কাছে স্বয়ং শয়তানের প্রতিমূর্তি ছিলেন তিনি।

অসাধারণ রূপ ও গুণের অধিকারী না হলে এন্টোনি ও সীজার- একইসাথে দুজনকে কাবু করে ফেলতে পারতেন না ক্লিওপেট্রা। আর সৌন্দর্য? সেটা যে কেবল শারীরিক গঠনেই প্রকাশ পায় সেটাই বা কে বলেছে? তবে হলিউড নিজের আখের গোছাতে ইতিহাসের এই রানীকে সৌন্দর্যের দেবী বানাতে দেরি করেনি। তবে অনেকের ক্ষেত্রেই ব্যাপারটি হজম করতে কষ্ট হয়েছে। গ্রীক জীবনীকার প্লুট্রাক জানান, ক্লিওপেট্রার শারীরিক সৌন্দর্য নিয়ে তার সন্দেহ আছে। তবে তার মধ্যে কিছু একটা ছিল। এমন কিছু যেটা অন্যকে আকর্ষণ করে। ক্লিওপেট্রার কথা, তার চিন্তা-চেতনা এবং ব্যবহারে এমন কিছু ছিল যেটা অগ্রাহ্য করাটা কোনো পুরুষের পক্ষেই সম্ভব ছিল না। সম্ভব হয়নি সীজার কিংবা এন্টোনির পক্ষেও।

সামনের মানুষটির মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে নিজেকে রাখতে পারতেন ক্লিওপেট্রা। সেই ক্ষমতা তার ছিল। ক্লিওপেট্রা এবং মুদ্রায় তার সমস্ত প্রতিকৃতি, রানীকে নিয়ে আমাদের চিন্তা- এই সবকিছুর মূলে হয়তো এটিই ছিল। কোমল, সুন্দর এবং প্রেমিকা নয়, বরং কৌশলী, বিচক্ষণ এবং দৃঢ় একজন শাসক ছিলেন ক্লিওপেট্রা। মুদ্রায় ক্লিওপেট্রার অবয়ব মিথ্যে নয়, তবে অবাক হওয়ার মতো কিছুও নয়। ক্লিওপেট্রা সাধারণ কেউ ছিলেন না। আমাদের সাধারণ চিন্তাও তাই তার সাথে মেলে না। সবাইকে নিজের প্রতি আকৃষ্ট করতে, দেশের শাসনব্যবস্থা বজায় রাখতে এবং কাউকে ভালবাসতে নারীর কেবল শারীরিক সৌন্দর্যের দরকার পড়ে না। মানসিক সৌন্দর্য দিয়েও সেটা করা সম্ভব। মিশরের রানী ক্লিওপেট্রা তারই এক অনন্য উদাহরণ।

ফিচার ইমেজ: Stormfront

Related Articles