টেলিভিশনের উজ্জ্বল পর্দায় বড় বড় অক্ষরে ভেসে উঠলো প্রযোজন বিবিসির নাম। এরপরই উজ্জ্বল পর্দা একদম কালো হয়ে গেলো। সেই কালো পর্দার আড়াল থেকে খুব মিহি সুরে গান বাজতে থাকলো। কিন্তু শব্দটা ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। যেমন আমরা শুনে থাকি পুরনো দিনের কলের গানে। সেই গানের শব্দের সাথে সাথে তাল মিলিয়ে পর্দা আলোকিত করে উঠে এক নর্তকী। বিংশ শতাব্দীর ঐতিহ্যবাহী নাচের তালে তালে ঘুরতে থাকে তার চিকন অবয়ব। আলো-আঁধারির লুকোচুরিতে নাচতে থাকা নর্তকী আর সেই কলের গান হঠাৎ করে যেন পুরো পরিবেশ গুমোট করে দিলো। হাজারো শব্দ আর সুরের মাঝেও কেমন এক অস্থিরতা। এর পরের দৃশ্যে নর্তকীর ডানদিক থেকে ভেসে উঠলো এক কৃষ্ণাঙ্গ নারীর ছবি। এরপর গম্ভীর গলায় কেউ একজন ইংরেজিতে বলে উঠলো, “১৯৫১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের বাল্টিমোরে একজন নারীর মৃত্যু হয়। তার নাম ছিল হেনরিয়েটা ল্যাকস।” এবার কলের গানের বদলে কিছুটা ভৌতিক বাজনা বাজতে থাকে। যেন হেনরিয়েটা ল্যাকস কোনো মধ্যযুগীয় ডাইনির নাম। এক ভয়ার্ত আবহ তৈরি করে ফের আড়ালের লোকটি বলতে থাকে,
“হেনরিয়েটা ল্যাকসের কোষ, যাকে বিজ্ঞানীরা HeLa (হেলা) নামে জানেন, সেটি বিজ্ঞানের জগতে এক বিপ্লবের সূচনা করেছে। বিজ্ঞানের পর্বত জয় করে এই কোষ এখন মহাকাশ পাড়ি দিচ্ছে। রাজনীতিবিদদের স্নায়ুযুদ্ধের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে এই কোষ। আর এই কোষই আমাদের অমরত্ব অর্জনের পথের সম্ভাব্য পাথেয়।”1
ভৌতিক সুরের মাঝখানেই দেখানো হলো কিছু হেলা কোষ (HeLa cell)। এরপর সেখান থেকে দর্শকদের উড়িয়ে নেয়া হলো হেনরিয়েটা ল্যাকসের পারিবারিক সমাধিক্ষেত্রে। কিন্তু সেখানে শায়িত ডজনখানের ল্যাকসের মাঝে ঠিক কোথায় শায়িত আছেন হেনরিয়েটা, তা কেউ জানে না। যেন ট্যাবুর মতো সবাই এড়িয়ে যাছে তার পরিচয়। অথচ এই অবহেলিত হেনরিয়েটা ল্যাকসই হচ্ছেন আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের সবচেয়ে বড় নায়ক, যার পুরো পরিচয় পর্দার আড়ালে হারিয়ে যাওয়া সেই নর্তকীর অবয়বের ন্যায় অস্পষ্ট।
HeLa মানেই হেনরিয়েটা
রেবেকা স্ক্লুট যখন সর্বপ্রথম HeLa কোষের নাম শোনেন, তখন তিনি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। ওহ! এর আগে জানিয়ে রাখা ভালো, এই রেবেকা স্ক্লুটই পরবর্তীতে হেনরিয়েটা ল্যাকসের উপর একটি জীবনীগ্রন্থ রচনা করে ভূয়সী প্রশংসিত হয়েছেন। মাধ্যমিক প্রথম বর্ষের সিলেবাসের কারণে রেবেকার পাঠ্যবিষয়ে কোষ বিভাজন অন্তর্ভুক্ত ছিল। সেখান থেকে তিনি তার শিক্ষকের কাছ থেকে HeLa কোষ সম্পর্কে জানতে পারেন। কৌতূহলবশত কিশোরী রেবেকা জিজ্ঞাসা করেন, “HeLa মানে কী?” জবাবে শিক্ষক বোর্ডে চক দিয়ে দুটো শব্দের একটি নাম লিখেন- ‘Henrietta Lacks’। এই নামের সংক্ষিপ্ত রূপ দিয়ে নামকরণ করা হয়েছে এই কোষকে।
হেনরিয়েটা ল্যাকস নামক এক কৃষ্ণাঙ্গ তরুণী জরায়ুর ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। কিন্তু তার মৃত্যুর পূর্বে জন হপকিন্স হাসপাতালের চিকিৎসক ক্যান্সার কোষের কিছু নমুনা সংগ্রহ করে গবেষণাগারে প্রেরণ করেন। সাধারণ মানব কোষ গবেষণাগারের সুনিয়ন্ত্রিত পরিবেশে নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত বেঁচে থাকতে পারে। এরপর সেগুলো নষ্ট হয়ে যায়। কিন্তু হেনরিয়েটার কোষগুলো এদিক থেকে ব্যতিক্রম। মাত্র ২৪ ঘণ্টার ব্যবধানে সেই কোষগুলো এক প্রজন্ম কোষে বিভাজিত হয়ে গেলো এবং এর বিভাজন এখনও থামেনি। এরা অন্যান্য কোষের ন্যায় নষ্টও হয়ে যায়নি। সোজা বাংলায় বলতে গেলে, HeLa কোষ অমর।2
এই আশ্চর্যজনক কোষ সম্পর্কে হাজার হাজার জার্নাল থাকলেও হেনরিয়েটা ল্যাকস নিয়ে এই কয়েকটি তথ্যের বাইরে আর কোনো তথ্য জানতে পারেননি রেবেকা স্ক্লুট। পাঠকরা গুগলে সার্চ করলে একগাদা ওয়েবসাইটের লিংক পাবেন যেখানে হেনরিয়েটা ল্যাকসের জীবনবৃত্তান্ত নিয়ে বিশদ প্রবন্ধ প্রকাশ করা হয়েছে। কিন্তু আশ্চর্যজনক হলেও সত্য যে, মাত্র ২০ বছর পূর্বেও পুরো পৃথিবীর নিকট হেনরিয়েটা ল্যাকস ছিলেন এক রহস্য। এমনকি অনেক পাঠ্য বইয়ে HeLa এর পূর্ণরূপ হিসেবে লেখা হয়েছে ‘Helen Lane’! এর কারণ বিজ্ঞানী জর্জ গে সংবাদ মাধ্যমে দাতার নাম উত্থাপন করতে চাননি।3 তাই আসল হেনরিয়েটার নামে জায়গায় কোথাকার কোন হেলেনের নাম জুড়ে দেয়ার মতো হাস্যকর ঘটনা ঘটে।
সেদিনের কৌতূহলী কিশোরী রেবেকা স্ক্লুট তার পরবর্তী জীবনে প্রচুর গবেষণা করেন হেনরিয়েটা সম্পর্কে। ছুটে যান ল্যাকস পরিবারের বেঁচে থাকা বাকি সদস্যদের নিকট। হেনরিয়েটাকে নিয়ে রচিত হয় কালজয়ী জীবনীগ্রন্থ ‘The Immortal Life of Henrietta Lacks’। তার একক প্রচেষ্টায় পৃথিবীর সামনে উন্মুক্ত হয়ে যায় এই নায়কের পরিচয়। পৃথিবী জানতে পারে, HeLa মানেই Henrietta Lacks।
ভার্জিনিয়ার লরেটা
১৯২০ সালের ১লা আগস্ট ভার্জিনিয়ায় জন্ম নেন লরেটা প্লিজান্ট নামক এক শিশু। জন্মের সময় মায়ের দেয়া এই নাম অবশ্য তার জীবনের একপর্যায়ে পরিবর্তিত হয়ে যায় হেনরিয়েটা ল্যাকস-এ। মাত্র চার বছর বয়সে শিশু হেনরিয়েটাকে ছেড়ে চলে যান মমতাময়ী মা। তার মৃত্যুতে বাবা জন প্লিজান্ট কিছুটা অগোছালো হয়ে পড়েন। তার পক্ষে শিশুর দেখাশোনা করা সম্ভব ছিল না। তাই হেনরিয়েটাকে ক্লোভার শহরে দাদা টমি ল্যাকসের কাছে পাঠিয়ে দেয়া হয়। সেখানে দাদা পরিবারের অন্য সদস্যদের সাহায্যে তামাক চাষ করতেন। শিশু হেনরিয়েটা দাদাবাড়ির একান্নবর্তী পরিবারে অন্যান্য চাচাতো ভাই-বোনের সাথে এক নতুন জীবন শুরু করে।
এখানে তার পরিচয় হয় চাচাতো ভাই ডেভিড ল্যাকসের সাথে। এই পরিচয় গিয়ে প্রেমে পরিণত হয়। মাত্র ১৪ বছর বয়সে হেনরিয়েটা এবং ডেভিডের ঘর আলো করে জন্ম নেয় পুত্র সন্তান লরেন্স। এর চার বছর পর আরেকটি কন্যাসন্তান জন্ম নেয়। এবার ডেভিড ল্যাকস আর অপেক্ষা করতে রাজি হলেন না। ১৯৪১ সালে পারিবারিক সম্মতিতে প্রেমিকা হেনরিয়েটাকে বিয়ে করেন তিনি। নতুন সংসার গড়ার লক্ষ্যে দুজন ক্লোভার ছেড়ে পাড়ি জমান ম্যারিল্যাণ্ডে। সেখানে তাদের ঘরে আরো তিনটি সন্তান জন্ম নেয়। কিন্তু তাদের সেই সংসার সুখের ছিল না। কয়েক বছর পরে দেখা গেলো তাদের আদরের কন্যা সন্তান এলসি ল্যাকস শারীরিক প্রতিবন্ধী। আর কৃষ্ণাঙ্গদের জন্য তখনও সব হাসপাতাল উন্মুক্ত ছিল না। তাই মেয়েকে বাল্টিমোরের জন হপকিন্স হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। আশেপাশের কয়েক মাইল এলাকায় এই জন হপকিন্সই ছিল কৃষ্ণাঙ্গদের জন্য একমাত্র চিকিৎসালয়।
মেয়েকে ভর্তি করানোর কয়েক বছরের মাথায় হেনরিয়েটা নিজেও অসুস্থ হয়ে পড়েন। তলপেটে প্রচণ্ড ব্যথা অনুভূত হওয়ায় হেনরিয়েটা ল্যাকস ১৯৫১ সালের ২৯ জানুয়ারি সর্বপ্রথম জন হপকিন্সে চিকিৎসা নিতে যান। ডাক্তারদের জানান, “তার তলপেটে কোথায় যেন প্যাঁচ লেগে আছে বলে অনুভূত হচ্ছে।” হেনরিয়েটার দায়িত্বরত চিকিৎসক হাওয়ার্ড জোন্স পরীক্ষার পর জানালেন, তিনি জরায়ুর ক্যান্সারে আক্রান্ত। ‘ক্যান্সার’-এর মতো ভয়াবহ শব্দ যেন হেনরিয়েটার ভেতরটাকে নাড়িয়ে দিলো। কিন্তু এই সংবাদ কাউকে দেয়া যাবে না। তার উপর পুরো সংসার নির্ভর করে আছে। তিনি চুপচাপ বাড়ি ফিরে স্বাভাবিকভাবে কাজ করা শুরু করেন। যেন তার কিছুই হয়নি। কেউ টেরও পেলো না এই হাসিখুশি মানুষটির ভেতরে জন্ম নিচ্ছে এক প্রাণনাশী ক্যান্সার।
ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী হেনরিয়েটা নিয়মিত হাসপাতালে যাওয়া শুরু করেন। তখনকার হাসপাতালে ক্যান্সার চিকিৎসার জন্য রেডিয়াম থেরাপি প্রয়োগ করা হতো। রেডিয়াম দেহে জন্ম নেওয়া ক্যান্সার কোষ ক্ষয় করতে পারতো। এই তেজস্ক্রিয় এবং ক্ষতিকর রেডিয়াম মানবদেহের জন্য কতটা বিপদজনক হতে পারে, তা তখনও মানুষের জানা ছিল না। তাই যা হবার তা-ই হলো। রেডিয়াম হেনরিয়েটার ক্যান্সার কোষের পাশাপাশি নিজের বিষ তার দেহে ছড়িয়ে দিলো। আর সেই বিষক্রিয়ায় ধীরে ধীরে হেনরিয়েটার স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটতে থাকে।
HeLa'র আবির্ভাব ও হেনরিয়েটার তিরোভাব
জন হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষ বিজ্ঞানী জর্জ গে তখন কোষ বিভাজন নিয়ে গবেষণা করছিলেন। গবেষণার জন্য তিনি দীর্ঘস্থায়ী টিস্যু তৈরির চেষ্টা করছিলেন। তিনি হেনরিয়েটার ক্যান্সারের খবর পেয়ে আগ্রহ নিয়ে তাকে দেখতে আসেন। হেনরিয়েটা তখনও জানতেন না জর্জ গে ঠিক কী কারণে তাকে দেখতে এসেছেন। যখন জর্জ গে হেনরিয়েটার ক্যান্সার কোষের দুটো নমুনা কেটে নিজের গবেষণাগারে প্রেরণ করেন, তখন হেনরিয়েটা ধরে নিয়েছিলেন হয়তো ক্যান্সার পরীক্ষা করার জন্য কোষগুলো নেয়া হচ্ছে।
জর্জ গে’র গবেষণাগারে যখন হেনরিয়েটার কোষগুলো বিভাজিত হতে থাকে, তখন ড. গে কিছু অস্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করলেন। অন্যান্য ক্যান্সার কোষ গবেষণাগারে বড়জোর কয়েক সপ্তাহ পর্যন্ত টিকে থাকতে পারতো। কিন্তু হেনরিয়েটার নমুনা কোষগুলো বেশ কয়েক সপ্তাহ পরেও দিব্যি বিভাজিত হতে থাকে সমান তালে। জর্জ গে হেনরিয়েটার কোষগুলো আলাদা করে আলাদা আলাদা পাত্রে কোষ উৎপাদন করতে থাকেন। এই উচ্চ বৃদ্ধিহার সম্পন্ন টিস্যুগুলোর নাম দেওয়া হয় HeLa কোষ। এভাবে হেনরিয়েটার সম্মতি না নিয়েই তার অগোচরে জন্ম নেয় বিংশ শতাব্দীর বিস্ময় HeLa কোষ।
জর্জ গে তার এই কোষের নমুনা দেশের বিভিন্ন বড় বড় গবেষণাগারে ছড়িয়ে দেন। অতি দ্রুত বিজ্ঞান মহলে এই কোষ নিয়ে সাড়া পড়ে যায়। কোষ নষ্ট হয়ে যাওয়ার প্রতিবন্ধকতায় এতদিন যেসব গবেষণা বন্ধ ছিল, সেগুলো নতুন করে শুরু করা হয়। বিজ্ঞানভিত্তিক বাণিজ্যিক শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো মাত্র একটি নমুনা থেকে মিলিয়ন মিলিয়ন কোষ উৎপাদন করতে থাকে। আর এই কোষ যার দেহের অংশ, সেই হেনরিয়েটা ল্যাকস তখন মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছেন জন হপকিন্স হাসপাতালের শয্যায়। তার কোষ অমর হলেও, আর দশজনের মতো হেনরিয়েটা ছিলেন মরণশীল মানুষ। হেনরিয়েটার মেডিকেল রিপোর্ট থেকে জানা যায়, রেডিয়াম থেরাপি প্রাথমিকভাবে ক্যান্সার কোষ ধ্বংস করে ফেললেও কয়েকদিন পর তা পুনরায় জন্ম নিতে থাকে। এ কারণে ডাক্তাররা পুনরায় রেডিয়াম থেরাপি প্রয়োগ করলে হেনরিয়েটার জরায়ুসহ অন্যান্য অঙ্গে মারাত্মক ক্ষতিসাধন হয়। চিকিৎসা গ্রহণের ৮ মাসের মাথায় ১৯৫১ সালের ৪ অক্টোবর মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন মহীয়সী হেনরিয়েটা। তার হৃদস্পন্দন চিরতরে বন্ধ হয়ে গেলেও তখন তার কোষগুলো অবিরাম প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে জন্ম নিচ্ছিলো।
চিকিৎসাক্ষেত্রে বিপ্লব
লেখিকা রেবেকা স্ক্লুটের অনুসন্ধান থেকে জানা যায়, এখন পর্যন্ত HeLa কোষ নিয়ে প্রায় দশ হাজারেরও বেশি প্যাটেন্ট রেজিস্ট্রি করা হয়েছে। এ থেকে বোঝা যায়, হেনরিয়েটা চিকিৎসাক্ষেত্রের জন্য কী অমূল্য উপহার দিয়ে গেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের গণ্ডি পেরিয়ে তখন এই কোষ অন্যান্য দেশেও রপ্তানি করা হচ্ছিলো। হেনরিয়েটার মৃত্যুর মাত্র এক বছরের মাথায় বিজ্ঞানী জোনাস সাল্ক মহামারী পোলিও টিকা আবিষ্কার করেন। এই টিকার বদৌলতে হাজার হাজার শিশু বিকলাঙ্গতা থেকে রক্ষা পায়। এমনকি মহাকাশবিজ্ঞানীদের আগ্রহে মানব কোষের উপর মহাকাশের তাৎক্ষণিক প্রভাব পর্যবেক্ষণের উদ্দেশ্যে এই কোষকে মহাকাশেও প্রেরণ করা হয়েছে।
HeLa কোষ গবেষণার মাধ্যমে মানব কোষের ক্রোমোজোমের বিভিন্ন অস্বাভাবিকতা ও ব্যাধি নির্ধারণ করা সম্ভব হয়। জীববিজ্ঞানের জগতে অন্যতম সেরা গবেষণাগুলোর মধ্যে মানুষের জিনোম ম্যাপিংকে উল্লেখ করা হয়। এই অসাধারণ সাফল্যের পেছনেও হেনরিয়েটার কোষগুলোর অবদান রয়েছে। হেনরিয়েটার মৃত্যুর কারণ জরায়ুর ক্যান্সার গবেষণায়ও এই কোষগুলোর অসামান্য অবদান রয়েছে। ২০১৪ সালে পেন স্ট্যাট বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকগণ HeLa কোষ ব্যবহারের মাধ্যমে ক্যান্সারের নিরাময় তৈরির কাজ শুরু করেন। শীঘ্রই ক্যান্সার চিকিৎসায় বেশ বড় কিছু আবিষ্কার হতে পারে এই কোষের মাধ্যমে। তবে এই কোষের সবচেয়ে অসাধারণ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এর অমরত্ব। পৃথিবীর অনেক বিজ্ঞানী এই অমরত্বের পেছনেই ছুটছেন। হয়তো অমরত্ব অর্জন করা যাবে না, কিন্তু এই গবেষণার মাধ্যমে এমন কিছু আবিষ্কার হতে পারে, যা মানুষের কোষ এবং প্রাণের রহস্যজটের সমাধান দিতে পারবে।
HeLa'র রহস্য কী?
HeLa কোষের এই অত্যাশ্চর্য বৈশিষ্ট্যের পেছনে প্রধান কারণ হিসেবে বিজ্ঞানীদের ভিন্ন মতামত রয়েছে। তবে হাজার মতামতের ভিড়ে যদি বিজ্ঞানসম্মত কয়েকটি কারণ আলাদা করা যায়, তাহলে সবার প্রথমে উঠে আসবে হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাস দ্বারা মিউটেশন ঘটা। এই ভাইরাস আক্রান্ত ব্যক্তির ডিএনএ-তে নিজের ডিএনএ যুক্ত করে হাইব্রিড ডিএনএ'র উদ্ভব ঘটায়। তবে সবধরনের মিউটেশন ক্যান্সার ঘটায় না। আবার সব ক্যান্সার কোষ হেনরিয়েটার কোষের ন্যায় অমর হয় না।
হেনরিয়েটার ক্ষেত্রে এমন মিউটেশন ঘটেছিলো যা তা কোষে দু’ধরনের পরিবর্তন ঘটিয়ে দেয়। প্রথমত, ক্যান্সার কোষগুলোর বিভাজন ক্ষমতা কয়েক শত গুণ বৃদ্ধি পায়। দ্বিতীয়ত, ক্যান্সার কোষগুলোর মাঝে অতি সক্রিয় টেলোমারেজ এনজাইমের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। সাধারণ মানব কোষে বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে টেলোমারেজ এনজাইমের কর্মক্ষমতা কমে যায়। তার মানে টেলোমারেজের সক্রিয়তার সাথে কোষের সক্রিয়তা নিবিড়ভাবে সম্পর্কিত। HeLa কোষের টেলোমারেজ এতটাই সক্রিয় যে তা কোষের বয়স বাড়তে দেয় না। আর এর ফলে সৃষ্টি হয় চিরঞ্জীব HeLa কোষ, যা অনবরত বিভাজিত হতে থাকে। বিজ্ঞানীরা গবেষণাগারে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ এবং রাসায়নিক পদ্ধতিতে ক্ষণস্থায়ীভাবে এই কোষের বিভাজন হ্রাস করে সংরক্ষণ করে থাকেন।
হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাসের মিউটেশনের ফলে HeLa কোষের ক্রোমোজোমের সংখ্যাও সাধারণ কোষ থেকে বেশি। সাধারণ কোষে ৪৬ ক্রোমোজোমের বিপরীতে HeLa'র ক্রোমোজোম মোট ৭৬-৮০টি। এই বৈশিষ্ট্যের কারণে অনেক বিজ্ঞানী HeLa কোষকে আলাদা প্রজাতিতে নামকরণের প্রস্তাবও করেছিলেন।
HeLa যখন খলনায়ক
তৎকালীন রাষ্ট্রপতি নিক্সন তখন সোভিয়েন ইউনিয়নের সাথে ক্যান্সার নিরাময় আবিষ্কারের এক স্নায়ুযুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রের বিজ্ঞানীরা এই যুদ্ধ জয়ের লক্ষ্যে HeLa কোষের সাহায্যে সম্পূর্ণ মানব টিস্যুর একটি ডেটাবেজ তৈরির প্রকল্প হাতে নেয়। সাথে সাথে চলতে থাকে HeLa কোষের মাধ্যমে ক্যান্সার নিরাময়ের উপায় বের করা। তাদের কাজও অনেক দূর পর্যন্ত এগিয়ে গিয়েছিলো, কিন্তু মাঝখানে খলনায়ক হিসেবে দাঁড়িয়ে গেলো স্বয়ং HeLa।
এই ঘটনা সর্বপ্রথম আঁচ করতে পারেন বিজ্ঞানী স্ট্যানলি গার্টলার। তিনি তখন কোষের নতুন জেনেটিক মার্কার খোঁজার গবেষণায় নিয়োজিত ছিলেন। তখন তিনি লক্ষ্য করলেন যে, তার সংগ্রহের প্রায় ১৮টি নমুনার কোষের মাঝে একটি মার্কার সবসময় উপস্থিত ছিল। সেটি হচ্ছে G6PD-A (Glucose-6-Phosphate Dehydrogenase-A) মার্কার। এই মার্কারটি আমেরিকা অঞ্চলের কৃষ্ণাঙ্গদের নিকট পাওয়া যেত, যা অন্যান্যদের মাঝে সচরাচর দেখা যায় না। তাই ১৮টি ভিন্ন নমুনায় এই মার্কার একদম শুরু থেকে উপস্থিত থাকার কোনো সম্ভাবনাই নেই। তাই এই মার্কার অন্য কোষ থেকে এসেছে।
এখান থেকে তিনি সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, কালজয়ী HeLa কোষের আগ্রাসনে অন্যান্য সবধরনের কোষের নমুনা এই মার্কার দ্বারা আক্রান্ত হয়ে গিয়েছে। সোজা কথায়, HeLa কোষ যে গবেষণাগারে সংরক্ষণ করা হয়, সে কক্ষের বাকি কোষের নমুনাকে ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়ার মতো কলুষিত করতে পারে। এই আবিষ্কারে বিজ্ঞানীদের মাথায় হাত পড়লো। বাতাসে ভেসে কিংবা অন্য মাধ্যমে HeLa কোষগুলো তখন হাজার হাজার নমুনাকে দূষিত করে ফেলেছে। এর অতিমানবীয় বিভাজন ক্ষমতা দ্বারা দ্রুত পুরো নমুনার সব শূন্যস্থান পূরণ করার মতো ক্ষমতা রাখে HeLa। এই ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্রের বিজ্ঞানীদের ক্যান্সার প্রকল্পের বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার অপচয় হয়।4
হপকিন্স কেলেঙ্কারি
জন হপকিন্স হাসপাতালের বিরুদ্ধে বেশ গুরুতর অভিযোগ ওঠে যে, এখানে রোগীদের সম্মতি না নিয়েই ডাক্তাররা রক্ত ও কোষের নমুনা এবং মেডিকেল রিপোর্ট বিভিন্ন গবেষণাগারের পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়। এমনকি রেবেকা স্ক্লুট তার বই লেখার সময় অনুসন্ধানের মাধ্যমে এই ঘটনার সত্যতাও পান। বিশেষ করে, যে হেনরিয়েটার কোষ ব্যবহার করে হাজার হাজার বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান অর্থ উপার্জন করে ফুলে ফেঁপে উঠেছে, সেই হেনরিয়েটার মেলেনি একটি পয়সাও।
হেনরিয়েটার বংশধররা চিকিৎসার অর্থাভাবে বেশ কষ্টে দিন গুজরান করতে থাকেন। হয়তো তারা কোনোদিন জানতেও পারতেন না যে, তাদের বংশের একজনের কোষ ব্যবহার করে এখন চিকিৎসাক্ষেত্রে বিপ্লব ঘটে যাচ্ছে। হেনরিয়েটার কন্যা ডেবোরাহ ল্যাকস এক বন্ধুর সাথে আলাপকালে কথাপ্রসঙ্গে এই কোষের কথা জানতে পারেন। তখন থেকে তার মনে সন্দেহ হওয়ায় তিনি কিছুটা অনুসন্ধান করে বুঝতে পেরেছিলেন, এই কোষ তার মায়ের। তাছাড়া ১৯৭০ সালে এক গবেষণার জন্য পুনরায় ল্যাকস পরিবারের রক্ত সংগ্রহ করা হয়, যেখানে রক্তদাতাকে পূর্ব থেকে পরীক্ষার উদ্দেশ্য জানানো হয়নি। ল্যাকস পরিবার থেকে মামলা দায়ের করা হয়। আদালত থেকে দাতার সম্মতি না নিয়ে যেকোনো ধরনের পরীক্ষার উপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। জন হপকিন্স হাসপাতালও নিজেদের দোষ স্বীকার করে নেয়।
হেনরিয়েটার নাম যখন প্রকাশিত হয়, তখন বিবিসি তাকে নিয়ে একটি ডকুমেন্টারি নির্মাণ করে। বাণিজ্যিক সংস্থাগুলো কোষের দাতা হেনরিয়েটাকে স্বীকৃতি জানিয়ে বিবৃতি প্রদান করে। ন্যাশনাল ফাউণ্ডেশন ফর ক্যান্সার রিসার্চ থেকে ল্যাকস পরিবারকে সম্মাননা জানানো হয়। মর্গান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে হেনরিয়েটা ল্যাকসকে তার অবদানের জন্য মরণোত্তর সম্মাননা ডিগ্রী প্রদান করা হয়। রেবেকা স্ক্লুটের বইয়ের উপর ভিত্তি করে মিডিয়া মোঘল অপরাহ উইনফ্রে'র অভিনয়ে নির্মিত হয় ‘দ্য ইম্মর্টাল লাইফ অফ হেনরিয়েটা ল্যাকস’ নামক টেলিফিল্ম।
জাতীয় টিকা দিবসে হাজার হাজার শিশু তার মা-বাবার কোলে চড়ে টিকাদান কেন্দ্রে যায়। সেখানে শিশুকে পোলিও নিরোধক টিকা প্রদান করা হয়। টিকার প্রতিটি ফোঁটায় নিশ্চিত হয় শিশুর পোলিও মুক্তির সম্ভাবনা। বিজ্ঞানীদের অবদান এবং জনগণের সচেতনতায় পোলিও আজ পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্নপ্রায়। তবে এ কথা ভুলে গেলে চলবে না যে, এই পোলিও টিকার পেছনে সবচেয়ে বড় অবদান যার, তিনি হেনরিয়েটা ল্যাকস নামক এক অবহেলিত নারী। ইতিহাস তাকে একদম ভুলে বসেছিলো। কিন্তু রেবেকা স্ক্লুটের মতো এক অধ্যবসায়ীর কারণে পুরো পৃথিবী তার গল্প জানতে পেরেছে। ক্লোভারে পারিবারিক সমাধিক্ষেত্রে কোনো এক অজানা স্থানে শায়িত আছেন এই মহীয়সী। তার দেহ নিথর হয়ে গেলেও তার কোষগুলো বেঁচে আছে। যতদিন চিকিৎসাক্ষেত্রে HeLa কোষ নিয়ে গবেষণা হবে, ততদিন হেনরিয়েটার নামও বেঁচে থাকবে।
আরও জানতে পড়ুন এই বইগুলো-
১) হাতের মুঠোয় ডায়াবেটিস (ইতিহাস, লক্ষণ, চিকিৎসা, ব্যায়াম ও ফিজিওথেরাপি)
২) মাথায় যত প্রশ্ন ঘোরে
This is a Bangla article about Henrietta Lacks, the holder of HeLa cells. The HeLa cells are the only immortal cell line till now discovered in the medical science. It's a revolutionary cell line as it is used for advancing towards the future of our medicine and surgery. Moreover, we get to learn about different mysteries of cells by testing HeLa cells. Polio vaccine is the research child of this cell line.
Reference:
1 The Immortal life of Henrietta Lacks, Rebecca Skloot, Crown Publishing Group, Page 59
2 The Immortal life of Henrietta Lacks, Rebecca Skloot, Crown Publishing Group, page 17
3 The Immortal life of Henrietta Lacks, Rebecca Skloot, Crown Publishing Group, page 80
4 The Immortal life of Henrietta Lacks, Rebecca Skloot, Crown Publishing Group, page 112
& All the other references of this articles are hyperlinked.
Feature image: Stat News