Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

ইন্দ্রলাল রায়: প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী একমাত্র বাঙালি ফাইটার এইস পাইলট

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ফরাসিরা সর্বপ্রথম ‘ফাইটার এইস’ কথাটি চালু করে। বিমানযুদ্ধে যেসব পাইলট শত্রুপক্ষের পাঁচটি বা তার চেয়ে বেশিসংখ্যক জঙ্গিবিমান গুলি করে ভূপতিত করতে সক্ষম হন, কেবল তাদেরই ‘ফাইটার এইস’ উপাধিতে ভূষিত করে জাতীয় বীরের সম্মান জানানো হতো। এই উপাধি পাওয়া তরুণ পাইলটরাই তখন দেশবাসীর কাছে মহাসমাদরে আদৃত হতে শুরু করলো। মানফ্রেড ফন রিকটোফেন এবং এরিক হার্টম্যান বিশ্বযুদ্ধের সময়ে অগ্রগণ্য দুজন ফাইটার এইস হিসেবে ইতিহাসে নিজেদের স্থান করে নিয়েছেন।

অগ্রগণ্য পাইলটদের কথা বলতে গেলে বিদেশিদের নামই কেন যেন আগে চলে আসে। অথচ সাহসী এই ফাইটার এইস পাইলটদের মধ্যে কিন্তু একজন বাঙালিও ছিলেন, তার নাম ইন্দ্রলাল রায়। গোটা ভারতীয় উপমহাদেশের একমাত্র ফাইটার এইস পাইলট তিনি। শুধু ফাইটার এইস পাইলটই না, পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে দুঃসাহসী মানুষদের তালিকা করতে গেলেও চলে আসবে ইন্দ্রলাল রায়ের নাম।

গোটা ভারতীয় উপমহাদেশের গর্ব ইন্দ্রলাল রায়; Source: twimg.com

বৈমানিক ইন্দ্রলাল রায়ের বাবা পিএল রায় ছিলেন ব্যারিস্টার। একইসাথে তিনি বরিশাল জেলার লাকুটিয়ার জমিদারও ছিলেন বটে। আইনজীবী হিসেবে তিনি প্র্যাকটিস করতেন লন্ডনে। ১৮৯৮ সালের ২ ডিসেম্বর ইন্দ্রলাল জন্মগ্রহণ করেন কলকাতায়। মায়ের নাম ললিতা রায়। তিন ভাইয়ের মধ্যে তিনি ছিলেন দ্বিতীয়। শৈশবেই বাবা-মা এবং ভাইদের সঙ্গে তিনি পাড়ি জমান ইংল্যান্ডে। সেখানেই লেখাপড়ায় হাতেখড়ি হয় তার। আদর করে তাকে ‘লাড্ডি’ বলে ডাকা হতো।

মাত্র পাঁচ বছর বয়সে লন্ডনের একটি স্কুলে ভর্তি হন ইন্দ্রলাল। স্কুলজীবনে তিনি অসামান্য মেধার পরিচয় দিয়েছেন। এরপর বিশেষ মর্যাদার স্কলারশিপ পেয়ে ভর্তি হন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে। ইচ্ছে ছিল আইসিএস পরীক্ষা দিয়ে ভারতীয় প্রশাসনে চাকরি নিয়ে তিনি দেশে ফিরে আসবেন। কিন্তু মানুষ যেমনটা পরিকল্পনা করে, বাস্তবে তেমনটা আর হয়ে ওঠে কোথায়? ভাগ্য মানুষকে তাড়িয়ে নিয়ে যায় অন্যদিকে।

তখন চলছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। বিমান বাহিনীতে ভর্তি হওয়ার সর্বনিম্ন বয়স ১৮ বছর পূর্ণ হতেই ইন্দ্রলাল রাজকীয় বিমানবাহিনীতে ক্যাডেট হিসেবে যোগ দিয়ে বসেন। ছয় মাস প্রশিক্ষণের পর পাইলট হিসেবে তিনি লাভ করেন কিংস কমিশন। ভারতীয়দের মধ্যে তিনিই প্রথম এই যোগ্যতা অর্জন করেন। কমিশন লাভের পর ১৯১৭ সালের অক্টোবর মাসে তাকে রাজকীয় বিমান বাহিনীর ৫৬তম স্কোয়াড্রনে যোগ দেয়ার জন্য পাঠানো হয় ফ্রান্সে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে মিত্রশক্তির পক্ষে যুদ্ধ করেন তিনি।

দুঃসাহসী বৈমানিক ইন্দ্রলাল; Source: indiannerve.com

একই বছরের ডিসেম্বর মাসে একই স্কোয়াড্রনের পাইলট হিসেবে এক অভিযানে গিয়ে জার্মানির বিমান বাহিনী লুফটওয়াফের জঙ্গি প্লেন থেকে ছোঁড়া গুলির আঘাতে ইন্দ্রলালের প্লেন ভূপতিত হয় এবং তিনি গুরুতর আহত হন। প্লেনসমেত তিনি গিয়ে পড়েছিলেন যুদ্ধরত ব্রিটিশ এবং জার্মান ফ্রন্টের মধ্যবর্তী নোম্যান্স ল্যান্ডে। সেখানে পুরো তিনদিন সম্পূর্ণ অচেতন অবস্থায় পড়ে ছিলেন ইন্দ্র। তিনদিন পর ব্রিটিশ বাহিনীর সেনাসদস্যরা তাকে দেখতে পেয়ে উদ্ধার করে নিকটবর্তী হাসপাতালে নিয়ে যায়। কিন্তু হাসপাতালের লোকজন তাকে মৃত মনে করে মরদেহের স্তূপের মধ্যে রেখে দেয়। এমতাবস্থায় ইন্দ্রলালের দেহে একজন প্রাণের স্পন্দন লক্ষ্য করেন এবং সঙ্গে সঙ্গে তার চিকিৎসার যথাযথ ব্যবস্থা করা হয়। অলৌকিকভাবে তিনি জ্ঞান ফিরে পান এবং সে যাত্রায় প্রাণে বেঁচে যান। এমন অলৌকিক ঘটনা বস্তুত মানুষের জীবনে খুব কমই ঘটে থাকে।

সেবার প্রাণে বেঁচে গেলেও পুরোপুরি আরোগ্য লাভ করতে ইন্দ্রলালকে মাস কয়েক হাসপাতালের শয্যায় পূর্ণ বিশ্রামে কাটাতে হয়। ফলে সে সময় তার পক্ষে আর ফ্লাইং করা সম্ভব হয়নি। প্রায় সাত মাস বিরতির পর বিমানবাহিনীর ডাক্তাররা আবার তাকে শারীরিকভাবে যুদ্ধাভিযানে অংশগ্রহণের যোগ্য বলে ঘোষণা দেন। আর কী অবাক করা ব্যাপার, সাক্ষাৎ মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে আসা মানুষটি এবার যোগ দেন রাজকীয় বিমান বাহিনীর একেবারে অগ্রবর্তী ঘাঁটিতে। অবশ্য এবার তার পোস্টিং হলো ৪০তম স্কোয়াড্রনে।

যুদ্ধবিমান নিয়েই কেটে যায় যার জীবন; Source: amazonaws.com

১৯১৮ সালের ৬ থেকে ১৮ জুলাই পর্যন্ত ইন্দ্রলাল তার জঙ্গি প্লেন নিয়ে বহু দুঃসাহসিক অভিযান পরিচালনা করেন। এই সময় ১৩ দিন ধরে চলা যুদ্ধে তিনি সর্বমোট ৯টি জার্মান বোমারু এবং ফাইটার প্লেন গুলি করে বিধ্বস্ত করেন। অন্যদিকে, ১৮ জুলাই জার্মান যুদ্ধবিমান তার এরোপ্লেনকে গুলিবিদ্ধ করে। এবার আর প্রাণে রক্ষা পেলেন না তিনি। ২০ বছর বয়সে বিধ্বস্ত এরোপ্লেনের সঙ্গে নিহত হলেন বীর এই ফাইটার এইস পাইলট। ১৩ দিনে ৯টি জার্মান যুদ্ধবিমান ধ্বংস করার অনন্যসাধারণ কৃতিত্বের জন্য তাকে ব্রিটিশ রাজকীয় বিমান বাহিনীর তরফ থেকে মরণোত্তর বীরত্বের খেতাব ‘ফ্লাইং ক্রস’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়। ভারতীয়দের মধ্যে এই পদবী তিনিই প্রথম লাভ করেন।

ইন্দ্রলালের ‘ফ্লাইং লগবুক’ (যে বইয়ে ফ্লাইং সংক্রান্ত ব্যক্তিগত তথ্যাদি রেকর্ড করা হয়), উইংস (বৈমানিকদের প্রতীক চিহ্ন পাখির ডানার আকৃতির ব্যাজ), বিভিন্ন অভিযানে অংশগ্রহণ সম্পর্কিত ঘটনাবলির নিজের হাতে আঁকা স্কেচবুক, সম্রাট পঞ্চম জর্জের লেখা স্কোয়াড্রনের কমান্ডিং অফিসারের চিঠি ইত্যাদি নিদর্শন দিল্লীর ভারতীয় বিমান বাহিনীর জাদুঘরটিতে সংরক্ষণ করা হয়েছে।

১৯১৮ সালের ২৭ ডিসেম্বর রণক্ষেত্রের নিকটবর্তী ঘাঁটি থেকে ৪০তম স্কোয়াড্রনের কমান্ডিং অফিসার মেজর এলেক্স কেইন বৈমানিক ইন্দ্রলালের মায়ের কাছে নিজের হাতে ইংরেজিতে যে চিঠি লিখেছিলেন, তার কিছু অংশ এখানে অনুবাদ করে দেয়া হলো।

“আপনার ছেলের সম্পর্কে যতটা জানতাম, সে ব্যাপারেই লিখছি। তিনি তার তিনজন সতীর্থকে নিয়ে টহল দেয়ার জন্য আকাশে ওড়েন। তারা চারটি জার্মান জঙ্গি বিমানের মোকাবিলা করেন। দুটি জার্মান এবং আমাদেরও একটি বিমান বিধ্বস্ত হয়। বিধ্বস্ত-ভূপতিত আমাদের বিমানটির চালক ছিলেন আপনার ছেলে। যখন থেকে আপনার ছেলে আমাদের স্কোয়াড্রনে যোগদান করেন, তখন থেকেই তার জীবনের একমাত্র লক্ষ্য ছিল শত্রুর বিমান ভূপতিত করা। তিনি ছিলেন বিস্ময়কর রকমের সাহসী এবং সুদক্ষ পাইলট। আর ঐ সাহস এবং দক্ষতার বলেই তিনি ১৩ দিনে নয়টি শত্রু বিমান ধ্বংস করেন।”

ইন্দ্রলালের জন্মশতবার্ষিকীতে প্রকাশিত স্মারক ডাকটিকেট; Source: phila-art.com

ব্রিটিশ রাজকীয় বিমানবাহিনীর প্রথম ব্রিগেডের কমান্ডিং ব্রিগেডিয়ার ডিলেজি পিচার ইন্দ্রলাল রায়ের স্বল্প সময়ের এমন দুর্লভ বীরত্বপূর্ণ ও অনন্য সাধারণ কৃতিত্বের জন্য বিমান বাহিনীর সর্বোচ্চ বীরত্বের খেতাব ডিস্টিংগুইশড ফ্লাইং ক্রস প্রদানের সুপারিশ করে লেখেন,

“তিনি (ইন্দ্রলাল) নিপুণতা ও সাহসিকতার এক উৎকৃষ্ট উদাহরণ তৈরি করেছেন এবং তিনি একজন প্রকৃত আক্রমণাত্মক সাহসী সত্ত্বার অধিকারী, যিনি ১৩ দিনে ৯টি শত্রু বিমান ধ্বংস করেছিলেন।

ফ্রান্সের ইসটিবিউলসে সমাধিত করা হয় ইন্দ্রলালকে। অনেক দুঃসাহসী পাইলটের কথা আমরা পড়েছি, কিন্তু হয়তো অনেকের কাছেই অজানা রয়ে গিয়েছে বাঙালি পাইলট ইন্দ্রলালের জীবনের । ভারত সরকার ১৯৯৮ সালের ডিসেম্বর মাসে ইন্দ্রলাল রায়ের জন্মশতবার্ষিকীতে স্মারক ডাকটিকিট প্রকাশ করে। এছাড়া ফ্রান্সে তার সমাধির ওপর বাংলা ও ফরাসি ভাষায় গৌরবগাঁথা লেখা রয়েছে। তার নামে কলকাতায় একটি সড়কও রয়েছে। তার ভাতিজা এয়ার মার্শাল সুব্রত মুখার্জিও ছিলেন একজন ফাইটার পাইলট এবং স্বাধীন ভারতের প্রথম বিমানবাহিনী প্রধান। নিশ্চিত মৃত্যুর কোল থেকে ফিরে এসে ইন্দ্রলালের আবার ঠিক ততটাই সাহস প্রদর্শনের ঘটনায় আশ্চর্য না হয়ে পারা যায় না। এককথায় বলতে গেলে, ইন্দ্রলাল রায় ছিলেন সাহসিকতার এক অত্যুজ্জ্বল উপমা।

তথ্যসূত্র: সাত্তার, আলমগীর, বেলুন থেকে বিমান, সাহিত্য প্রকাশ (১৯৯৪), পৃষ্ঠা ন: ২২২-২২৪

ফিচার ইমেজ- ytimg.com

Related Articles