Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website. The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

জিম মরিসন: দ্য লিজার্ড কিং

একজন জিম মরিসনের শুরু

প্যারিসের রাস্তায় কিংবা ফ্লোরিডার আকাশে যখন রকগানের সুর ভেসে ওঠে, তখন সে সকল সুরে যে কয়েকটি নাম মিশে থাকে, তার মধ্যে একটি জিম মরিসন। নামটি সংগীতের ভুবনে যতটা জনপ্রিয়, ঠিক ততটাই ভালোবাসার। পুরো নাম জেমস ডগলাস মরিসন। বাবা মায়ের তিন সন্তানের মধ্যে তিনিই বড়। বাবা রেয়ার এডমিরাল জর্জ স্টিফেন মরিসন ও মা ক্ল্যারা ক্লার্ক মরিসনের প্রথম সন্তান জিম ১৯৪৩ সালের ৮ই ডিসেম্বর আমেরিকার ফ্লোরিডা স্টেটের মেলবোর্ন শহরে জন্ম নেন। বাবা ছিলেন নেভাল অফিসার এবং শখের পিয়ানো বাদক।

বাবার চাকুরির সুবাদে বিভিন্ন শহরে কেটেছে জিমের শৈশব। জিমের লেখাপড়ার শুরু ভার্জিনিয়ার ফেয়ারফ্যাক্স এলেমেন্টারি স্কুলে, সেখান থেকেই শেষ করেন থার্ড গ্রেড। এরপর পড়েছেন টেক্সাসের একটি স্কুলে। এখানেও বেশিদিন পড়া হলো না, কেননা আবারও বাবার বদলি হয়। এবার নিউ মেক্সিকোতে। সেখানকার একটি স্কুলে পড়েন কিছুদিন, তারপর ফিরে আসেন ক্যালিফোর্নিয়ায়। ক্যালিফোর্নিয়ার লংফেলো স্কুল থেকে সিক্সথ গ্রেড শেষ করে ভর্তি হন ভার্জিনিয়ার এলামেন্ডা হাই স্কুলে। এরপর আরো দুবার রথবদল হয় তার পড়ালেখার। অবশেষে ১৯৬১ সালে ভার্জিনিয়ার জর্জ ওয়াশিংটন হাই স্কুল থেকে গ্র্যাজুয়েশন শেষ করেন।

বাবার সাথে জিম মরিসন; Source: Reshareit

ফ্রেডরিখ নিৎসে, অ্যালেন গিন্সবার্গ, ফ্রাঞ্জ কাফকা ছিলেন তাঁর হৃদয় জুড়ে। যতটা সময় তিনি কাটিয়েছেন ক্লাসে, তার চেয়ে বেশি সময় কাটাতেন স্কুলের লাইব্রেরিতে। তখন থেকেই তার ভেতরে গেঁথে গিয়েছিল কবিতা, উদ্দামতা আর দ্রোহ। গেঁথে গিয়েছিল কীভাবে শিল্প দিয়ে বলা যায় নিজের কথা। চলচ্চিত্রের প্রতিও তাঁর ক্ষণিকের ভালবাসা জন্মেছিল। চলচ্চিত্রের ওপর পড়েছেন ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়া, লস এঞ্জেলসে।

বাবার ইচ্ছেতে ভিয়েতনাম যুদ্ধে যেতে চাননি বলে যোগ দেননি আর্মিতে। কিন্তু এতে এডমিরাল মরিসন খুবই কষ্ট পান, এর ফলে পিতা-পুত্রের মধ্যে সৃষ্টি হয় এক নীরব দূরত্ব। ছেলের সংগীতের প্রতি আগ্রহ ও নেশাকে বাবা কখনই মেনে নিতে পারেননি। তিনি চেয়েছিলেন, তাঁর মতোই সামরিক অফিসার হোক তাঁর পুত্র। কিন্তু বাবার এত অনাগ্রহ থাকা সত্ত্বেও গান, কবিতার প্রতি ভালবাসা তাঁর কখনই এতটুকু কমেনি। তাই তো কবিতা ও সংগীতের জগতে তিনি আজীবন অমর হয়ে থাকবেন। মিশে থাকবেন প্রতিটি রকগানের আদিমতায়।

‘দ্য ডোরস’

ব্যান্ডের বাকি সদস্যদের সাথে মরিসন; Source: Elektra Records

১৯৬৫ সালে গ্রীষ্মে বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধু রে মানজারেক (পিয়ানিস্ট) এর সাথে মিলে প্রতিষ্ঠা করেন জগত খ্যাত ব্যান্ডদল ‘দ্য ডোরস’। পরবর্তীতে তাদের সাথে যুক্ত হন রবি ক্রিগার (গিটারিস্ট) ও জন ডেনসমোর (ড্রামার)। ব্যান্ডের নামটি নেয়া হয় এলডস হাক্সলির ‘দ্য ডোরস পারসেপশন’ নামক বইটি থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে। ১৯৬৬ সালে রেকর্ড কোম্পানি ইলেক্ট্রা রেকর্ডস তাদের সাথে চুক্তি হয় এবং ১৯৬৭ সালে ইলেক্ট্রা রেকর্ডসের প্রযোজনায় মুক্তি পায় ‘দ্য ডোরস’ এর প্রথম অ্যালবাম, যার নাম হয় ব্যান্ডের নাম অনুসারে। প্রথম অ্যালবামেই বাজিমাত করে দেয় ‘দ্য ডোরস’, যাতে আছে ‘ব্রেক অন থ্রু’, ‘লাইট মাই ফায়ার’, ‘দ্য এন্ড’, ‘অ্যালাবামা সং’ এর মত জনপ্রিয় গান। এই গানগুলো আজও ঠিক ততটাই জনপ্রিয়, যতটা তখন ছিল।

সেই বছর বিলবোর্ড হিট লিস্টের ১ নাম্বার গান ছিল ‘লাইট মাই ফায়ার’। প্রথম অ্যালবামের অভাবনীয় সাফল্যের পর একই বছর মুক্তি পায় তাদের দ্বিতীয় অ্যালবাম ‘স্ট্রেঞ্জ ডেজ’। এবারও সাফল্যের মুখ দেখল ‘দ্য ডোরস’। এতে রয়েছে ‘লাভ মি টু টাইমস’, ‘পিপল আর স্ট্রেঞ্জ’, ‘হোয়েন দ্য মিউজিক’স ওভার’ এর মতো শ্রোতা সমাদৃত ও বিলবোর্ড হিট গান। ১৯৬৮ সালে তাদের তৃতীয় এ্যালবাম ‘ওয়েটিং ফর দ্য সান’ মুক্তি পায়। এই অ্যালবাম মুক্তি পাওয়ার পর যেন তাদের জনপ্রিয়তা আরো বেড়ে গেল। এই এ্যালবামের ‘হ্যালো, আই লাভ ইউ’ সে বছর বিলবোর্ড হিটের ১ নম্বর গান ছিল, যা তাদের বিলবোর্ড ১ নাম্বার হিট হওয়া দ্বিতীয় গান। এছাড়াও অ্যালবামটিতে রয়েছে ‘লাভ স্ট্রিট’ এবং ‘ফাইভ টু অন’ এর মতো অসাধারণ গান।

এরপরের তিন বছরে আরো তিনটি অ্যালবাম মুক্তি পায়। সেগুলো যথাক্রমে ‘দ্য সফট প্যারেড (১৯৬৯)’, ‘মরিসন হোটেল (১৯৭০)’, ‘এল.এ ওম্যান (১৯৭১)’। তিনটি এ্যালবামই ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। পৃথিবীর খুব কম ব্যান্ডদলই আছে, যাদের সবগুলো অ্যালবামই এত জনপ্রিয়তা পেয়েছে। ‘দ্যা ডোরস’ ও মরিসন মিলে কয়েকটি গানের মিউজিক শর্ট ফিল্মও বানিয়েছেন। সব গানের কথাই মূলত তাঁর লেখা, অসাধারণ লেখনী আর চমৎকার গায়কী ক্ষমতার অধিকারী জেমস ডগলাস মরিসন ব্যান্ড সংগীতে এক উজ্জ্বল অনুপ্রেরণা।

কবি জিম মরিসন

মরিসনের কবিতার খাতা; Source: Mild Equator

গায়ক মরিসনের চেয়ে কবি মরিসন কোনো অংশেই কম নন। সামাজিক অসঙ্গতি, দ্রোহ, প্রেম, বৈষম্য নিয়ে লিখেছেন অসংখ্য কবিতা। তাঁর দুটি কবিতার বই রয়েছে, সেগুলো হল ‘দ্য লর্ডস/ নোটস অন ভার্সন’ এবং ‘দ্য নিউ ক্রিয়েচারস’। তার মৃত্যুর পর ১৯৮৮ সালে প্রকাশিত হয় তার অপ্রকাশিত লেখা নিয়ে ‘দ্য লস্ট রাইটিংস অফ জিম মরিসন’। সাহিত্যিক হিসেবে অধিক সমাদৃত না হলেও মরিসন সাহিত্যিক হিসেবেও অনবদ্য ছিলেন। এর প্রমাণ রয়েছে তাঁর কবিতা ‘উইথ আউট এ ট্রেস’, ‘স্টোনড ইনম্যাকুলেট’, ‘পাওয়ার’, ‘দ্য মুভি’, ‘দ্য ওয়ার্ল্ড অন ফায়ার’, ‘অ্যা ফিস্ট অফ ফ্রেন্ডস’ এর মতো কবিতায়।

মরিসনের ব্যক্তিগত জীবন

জিম মরিসন ব্যক্তিগত জীবনেও ছিলেন খুবই রোমাঞ্চপ্রিয়। বন্ধুমহলে প্রেমিক পুরুষ হিসেবে খ্যাতি ছিল তাঁর। সুদর্শন মরিসনের অসাধারণ ব্যক্তিত্ব ও গায়কী ক্ষমতায় সেসময় মুগ্ধ ছিলেন না, এমন কোনো নারী খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। জিমের প্রথম প্রেমিকা ছিলেন ম্যারি ওয়েরবেলো। জিম মরিসনের সাথে ম্যারি ওয়েরবেলো’র পরিচয় হয় ফ্লোরিডার সমুদ্রসৈকতে। তারপর তাদের বন্ধুত্ব প্রণয়ে পরিণতি পায়, যা পরবর্তীতে ভেঙে যায়। প্রাক্তন প্রেমিকাকে বিদায় দিতে গিয়ে লিখলেন ‘দ্য এন্ড’ এর মতো বিখ্যাত গান।

ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়াতে অধ্যয়নকালেই পামেলা কার্সনের সাথে পরিচয় জিমের। পামেলা কার্সন জিমকে কবিতা লেখার প্রতি বরাবরই অনুপ্রাণিত করেছেন। ১৯৬৮ সালে তারা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। পামেলা কার্সনের সাথে বিয়ের পরও জিম মরিসনের বেশ কয়েকজন রমণীর সাথে প্রণয় ঘটে, যাদের মধ্যে একজন ছিলেন আমেরিকান লেখিকা পামেলা দেস বারেস।

মরিসন ১৯৭০ সালে প্যাট্রিসিয়া কেনিলি নামের একজন সাংবাদিককেও বিয়ে করেন। মরিসনের বাউণ্ডুলে জীবন ও অত্যন্ত রাগী মনোভাবের জন্য তিনি অনেক ঝামেলার সম্মুখীন হয়েছিলেন। তাঁর রাগের মাত্রা এতটাই বেশি ছিল যে তিনি বেশ ক’বার কনসার্টের মধ্যেই দর্শকের সাথে হাতাহাতির পর্যায়ে চলে গিয়েছিলেন। ১৯৬৭ সালের ৯ ডিসেম্বর স্টেজ থেকে তাকে গ্রেফতার করে নিউ হেভেন পুলিশ। পরবর্তীতে ১৯৭০ সালে ফ্লোরিডার শো থেকে তিনি আরেকবার গ্রেফতার হন।

দ্য লিজার্ড কিং খ্যাত এ গায়ক ছিলেন খুবই মদ্যপায়ী ও কোকেনসেবী, যার জন্য তাঁর খুব বদনামও ছিল। কিন্তু এসকলই ঢাকা পড়ে যায় তাঁর সংগীত প্রতিভা, দর্শন, সাহিত্য ও বিপ্লবী চিন্তার কাছে। কথা বলেছেন যুদ্ধের বিপক্ষে। ব্যক্তিগত জীবনে জিম মরিসন খুবই অন্তর্মুখী একজন মানুষ ছিলেন। খুব কাছের মানুষদের ছাড়া কথা বলতেন না সবার সাথে, এমনকি সাংবাদিকদের সাথেও খুব একটা কথা বলতেন না। পারতপক্ষে এড়িয়ে চলতেন সাংবাদিকদের।

স্ত্রী পামেলা কার্সনের সাথে জিম; Source: Pinterest

প্যারিস ও সমাপ্তি

প্যারিস শহরকে তিনি খুব ভালোবাসতেন। প্যারিস তাকে বরাবরই মুগ্ধ করে রেখেছিল। তাই তিনি তাঁর স্ত্রী পামেলা কার্সনকে নিয়ে একেবারে প্যারিসে চলে যান ১৯৭১ এর শুরুর দিকে। সেখানে থেকেই নিজের গান ও সাহিত্য চর্চা করছিলেন জিম।

৩ জুলাই, ১৯৭১। রাতে মাত্রাতিরিক্ত কোকেন সেবন করে মরিসন বাথটাবে শুয়ে থাকেন। সকালে স্ত্রী পামেলা কার্সন তাকে মৃত অবস্থায় উদ্ধার করেন। ডাক্তাররা তাঁর মৃত্যুর কারণ হিসেবে হৃদযন্ত্র বন্ধ হয়ে যাওয়াকে নির্দেশ করেন। যদিও ফ্রান্সের পুলিশদের কাছে ব্যাপারটি ঘোলাটে এবং চাঞ্চল্যকর ছিল। তাকে বিখ্যাত পেরে লাশেইসে সিমেট্রিতে সমাহিত করা হয়। প্যারিস ভ্রমণে গেলে সকলেই তাঁর সমাধি ঘুরে আসেন।

তাকে নিয়ে বেশ কিছু প্রামাণ্যচিত্র বানানো হয়েছে। এছাড়াও ১৯৯১ সালে ভ্যাল কিলমার অভিনীত ‘দ্য ডোরস’ নামে একটি বায়োগ্রাফি সিনেমা বানানো হয় মি. মোজো রাইজিং খ্যাত গায়ক জিম মরিসনকে নিয়ে। ২৭ বছরের ক্ষুদ্র জীবনে জিম মরিসন বিশ্ব সংগীতকোষে যোগ করেছেন অমূল্য কিছু গান আর সাহিত্যকোষে যোগ করেছেন অনবদ্য কিছু কবিতা। তাই হয়তো আজও প্যারিস কিংবা ফ্লোরিডার বাতাসে ভেসে বেড়ায় মরিসনের মোহময় সুর কিংবা কবিতার অক্ষরমালা।

Feature Image Source: Pinterest.com

Related Articles