Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

জন লক: রাজনৈতিক উদারনীতির প্রবক্তা

“শাসিতের ইচ্ছায় চলবে শাসক”
জন লক

কিংবদন্তী ব্রিটিশ দার্শনিক এবং রাজনৈতিক তাত্ত্বিক জন লক ‘লিবারেলিজম’ বা উদারনীতি তত্ত্বের প্রবক্তা। তার রাজনৈতিক দর্শন আমেরিকার প্রতিষ্ঠাকালীন নীতি ও নিয়মকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। অন্যদিকে প্রভাবশালী চার্চের যুগে রাষ্ট্র পরিচালনায় চার্চের প্রভাবমুক্ত করতে তিনি লিখেছেন অসংখ্য প্রবন্ধ। তার প্রবন্ধেই রাষ্ট্র ও চার্চ আলাদা সত্তা হিসেবে প্রথম পরিচিত হয়। অন্যদিকে জন লক ছিলেন একজন চিকিৎসকও, যিনি পরীক্ষামূলক বিজ্ঞানের বিপ্লবের মাঝে গবেষণামূলক বিজ্ঞানকে জনপ্রিয় করে তোলেন। চলুন তার জীবনী ও কাজ সম্পর্কে সংক্ষেপে জেনে নিই।

জন লক (১৬৩২-১৬৯৫ খ্রিস্টাব্দ); source: thinglink.com

১৬৩২ সালে ইংল্যান্ডের দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলীয় ছোট্ট এক গ্রাম রিংটোনে জন্মগ্রহণ করেন জন লক। তার বাবা ছিলেন ব্রিটিশ সংসদের একজন পিয়ন। ইংল্যান্ডের মধ্যবিত্ত জনগণের জন্য তখন সবচেয়ে সুবিধাজনক স্কুল ছিল ওয়েস্টমিনিস্টার স্কুল। জন লক সেখানেই ভর্তি হলেন। স্কুলের পরীক্ষাগুলোতে অসাধারণ ফলাফলের পুরস্কারস্বরূপ অক্সফোর্ডের ক্রাইস্ট চার্চ কলেজে স্কলারশিপে পড়ালেখার সুযোগ পান তিনি। সেখানে মানবিক বিভাগ থেকে স্নাতক শেষ করে শিক্ষকতা শুরু করেন তিনি। তবে চিকিৎসাবিজ্ঞান এবং ‘ন্যাচারাল ফিলসফি’ বা প্রাকৃতিক দর্শনের প্রতি তার প্রবল কৌতূহল জাগে। তিনি প্রয়োজনীয় একাডেমিক কোর্স সম্পন্ন করে ডাক্তার হন। পাশাপাশি প্রাকৃতিক দর্শন বিষয়ক নানা গবেষণায় প্রচুর সময় ব্যয় করেন। রবার্ট বয়েলের মতো বিখ্যাত প্রাকৃতিক দার্শনিকের সান্নিধ্যে এসে তার জ্ঞানতৃষ্ণা আরো বেড়ে যায়। উল্লেখ্য, আজকে আমরা যাকে বিজ্ঞান বলে চিনি, তা-ই তখন প্রাকৃতিক দর্শন বলে পরিচিত ছিল।

১৬৬৭ সালে জন লক মেডিসিনের উপর কোর্স সম্পন্ন করে অক্সফোর্ড থেকে লন্ডন ফিরে আসেন। লন্ডনে এসেই তিনি সেখানকার বিখ্যাত রাজনীতিবিদ অ্যাশলে এনথনির সাথে বন্ধুত্ব গড়ে তোলেন। আর এখান থেকেই রাজনীতির সাথে তার পরিচয়ের শুরু। অন্যদিকে লন্ডন শহরের সবেচেয়ে বিখ্যাত ডাক্তার থমাস সিডেনহামের সাথে তার ভালো সম্পর্ক গড়ে ওঠার সুবাদে দুজন একসাথে অনেক শল্যচিকিৎসাও করেন। এ সময়েই লক শুরু করেন তার জীবনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ প্রবন্ধ ‘অ্যাসে অন হিউম্যান আন্ডারস্ট্যান্ডিং’ লেখার কাজ। এই প্রবন্ধ তিনি তার জীবনের পরবর্তী ২০ বছর যাবত লিখেছেন! ১৬৭৫ সালে লক ফ্রান্স ভ্রমণ করেন। কয়েক বছর ফ্রান্সে কাটিয়ে যখন তিনি স্বদেশে ফিরে আসেন, তখন স্বদেশের রাজনৈতিক আবহাওয়া সম্পূর্ণ বদলে গেছে। অ্যাশলে এনথনির তখন আর ক্ষমতা নেই, বরং এনথনির সাথে সুসম্পর্কের কারণে লকের উপর সেসময় রাজনৈতিক রোষানল নেমে আসে।

এই সঙ্কটকালেই লক রচনা করেছিলেন ‘টু ট্রিটিজ অব গভর্নমেন্ট’, তার জীবনের শ্রেষ্ঠ রাজনৈতিক লেখা। তবে রাজনৈতিক কোপানলে পড়ার ভয়ে লক এই লেখা ১৬৮৯ এর আগে প্রকাশ করতে পারেননি। এদিকে হঠাৎ করে এনথনির মৃত্যুতে লকের অবস্থান আরো নড়বড়ে হয়ে যায়। তিনি লন্ডন থেকে নেদারল্যান্ডে পালিয়ে গেলেন। হিউম্যান আন্ডারস্ট্যান্ডিংয়ের উপর প্রবন্ধটি তখনো লিখে চলেছেন লক। তবে এ সময়কার রাজনৈতিক অস্থিরতার উপর ‘এপিস্টোলা ডি টোলারেনশিয়া’ নামক আরো একটি প্রবন্ধ রচনা করেন লক। এই প্রবন্ধে তিনি সরকারের সহনশীল হবার প্রয়োজনীয়তা ব্যাখ্যা করেন, বিশেষ করে ভিন্ন ধর্মের প্রতি এবং ভিন্ন মতের প্রতি।

গ্লোরিয়াস রেভ্যুলেশন; source: Stories from History

১৬৮৮-৮৯ সালে ইংল্যান্ডে একটি বিখ্যাত বিপ্লব সংঘটিত হয়, যে বিপ্লবে রাজা জেমসকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়। বিপ্লবটি ‘গ্লোরিয়াস রেভ্যলুশন’ নামে পরিচিত। এই বিপ্লবের পরই লক দেশে ফিরে আসেন এবং নিজের দীর্ঘদিনের প্রবন্ধ প্রকাশ করেন। একইসাথে তিনি তার ‘টু ট্রিটিজ’ও প্রকাশ করেন, তবে ছদ্মনামে। এ সময় তিনি রাজনীতি, সহনশীলতা, উদারনীতি আর শিক্ষাগত ব্যাপার নিয়ে পুরোদমে কাজ শুরু করেন। তার এসব তত্ত্ব নিয়ে তাকে কম ঝামেলা পোহাতে হয়নি। বিশেষ করে চার্চের বিশপদের সাথে তার প্রায়ই বাকবিতণ্ডা হতো। এর মধ্যে ওরচেস্টারের বিশপ এডওয়ার্ড স্টিলিংফ্লিটের সাথে তার দ্বন্দ্ব বেশ আলোচিত হয়েছিল ইংল্যান্ডে।

জীবনের শেষভাগটা জন লক ধর্মতত্ত্ব নিয়ে গবেষণা এবং লেখালেখি করেই কাটিয়েছেন। ১৬৯৫ সালে ‘রিজনেবলনেস ইন ক্রিশ্চিয়ানিটি’ নামক লকের একটি লেখা বেনামে প্রকাশ হয়, যেখানে তিনি খ্রিস্টান ধর্মকে উগ্রপন্থার বিপরীতে সহনশীলতা দিয়ে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেন। তিনি প্রচলিত অনেক গোঁড়া বিশ্বাসকে ছুঁড়ে ফেলেন এবং এর বদলে চিন্তা-চেতনার উদারতাকে স্থাপন করেন। ১৮ শতকের শুরুর দিক থেকেই লক স্বাস্থ্যগত সমস্যায় ভোগেন। তার শ্বাসকষ্টের সমস্যা হয়। ১৭০৪ সালে তার শারীরিক অবস্থা একেবারেই খারাপ হয়ে যায় এবং তিনি শয্যাশায়ী হন। অক্টোবরের ২৮ তারিখ এক রৌদ্রোজ্জ্বল সকালে তিনি তার শেষ জীবনের সেরা বন্ধু ম্যাশামকে বাইবেল পড়ে শোনানোর অনুরোধ করেন। ম্যাশামের মুখে ‘বুক অব সামস’ এর কিছু অংশ শুনতে শুনতেই চিরনিদ্রায় শায়িত হন জন লক। ওটিস শহরের হাইলেভার নামক সমাধিক্ষেত্রে তাকে সমাহিত করা হয়।

জন লকের সমাধি; source: Find A Grave

জন লকের কাজ আলোচনা করতে গেলে প্রথমেই চলে আসবে তার প্রবন্ধগুলোর কথা। প্রবন্ধের ব্যাপারে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে লক একবার বলেছিলেন, তিনি এই প্রবন্ধ লেখার অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন তার বন্ধুদের সাথে খোশগল্প করতে গিয়ে। বন্ধুদের সাথে একদিন এমন একটা বিষয়ে বিতর্কে জড়িয়ে পড়েন লক, তার কোনো সমাধানই হচ্ছিল না। তখন তিনি অনুধাবন করেন, যেকোনো বিতর্কের সমাধানে সর্বপ্রথম যে জিনিসটি প্রয়োজন তা হচ্ছে মানুষের মধ্যে পারস্পরিক সমঝোতা। আর এই সমঝোতা এবং সহনশীলতা নিয়ে পর্যবেক্ষণ শুরু করার মাধ্যমেই শুরু হয় তার প্রথম প্রবন্ধ ‘হিউম্যান আন্ডারস্ট্যান্ডিং’ এর কাজ। এখানে তিনি তার অন্তর্দৃষ্টি থেকে ব্যাখ্যা করেন, আমরা যখনই কোনোকিছু ব্যাখ্যা করতে যাই, তখন প্রথমেই আমাদের নিজেদের সম্পর্কে জ্ঞান রাখতে হবে, জানতে হবে সেই জ্ঞান কীভাবে অর্জন করতে হয়। উপরন্তু জানতে হবে সেই জ্ঞান আসলে কী। কারণ, সব বিষয়ই আমাদের বোধগম্য হবে না। আমাদের খুঁজে বের করতে হবে জ্ঞানের কোন শাখা আমাদের সবচেয়ে নিকটে এবং কোন শাখায় আমাদের কোনো ধারণা নেই। তবেই প্রকৃত জ্ঞান অর্জন করা যাবে এবং তা কাজে লাগানো যাবে।

লকের এই প্রবন্ধটি চারটি খণ্ডে বিভক্ত। প্রথম খণ্ডে তিনি মানুষের জ্ঞান ও বোধশক্তির উৎস খুঁজে বের করার চেষ্টা করেছেন। দ্বিতীয় খণ্ডে তিনি অভিজ্ঞতার প্রয়োজনীয়তাকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন এবং ব্যাখ্যা করেছেন যে, মানুষের জ্ঞান মাত্রই অভিজ্ঞতা। তৃতীয় খণ্ডটিতে আলোচনা করেছেন ভাষার ভূমিকা নিয়ে। শেষ খণ্ডে তিনি আলোচনা করেছেন জ্ঞান, বিশ্বাস আর মতাদর্শ নিয়ে। তবে চারটি খণ্ডেরই প্রধান উদ্দেশ্য ছিল মানুষের বোধশক্তির ব্যাখ্যা করা। এই ব্যাখ্যা করতে গিয়ে লক যেসব বিশেষ দর্শনের অবতারণা করেছেন সেগুলোর আলোচনা করতে লক্ষাধিক শব্দের প্রয়োজন হবে। তাই আমরা কেবল সংক্ষেপে মূল দিকগুলো দেখবো।

হিউম্যান আন্ডারস্ট্যান্ডিং এর উপর লকের প্রবন্ধ; source: Wikimedia Commons

  • দেহই আমাদের মনে বিভিন্ন ধারণার উৎপত্তি ঘটায়। যেমন- একটি টমেটো দেখলে আমাদের মনে লাল রঙের ধারণা আসে, গোলাকৃতির ও অবয়বের ধারণা আসে।
  • মানুষের উপলব্ধি আলোচনা করতে গিয়ে লক চলে গেছেন বৈজ্ঞানিক আলোচনার মধ্যে। যেমন- তিনি উদাহরণ টেনেছেন একটি সেদ্ধ আলুর ঘ্রাণের! এই ঘ্রাণ আমরা উপলব্ধি করছি কোনো অদৃশ্য গতি এবং সংঘর্ষের জন্য। অবশ্যই কোনো অদৃশ্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কণা আলু থেকে ভেসে এসে আমাদের নাকের স্নায়ুগুলোতে সুড়সুড়ি দিচ্ছে এবং আমরা তা অনুভব করছি।
  • যেকোনো বস্তু যার বাহ্যিক আকার আছে, বিস্তৃতি আর দৃঢ়তা আছে, কখনোবা চলনের ক্ষমতা আছে, তা-ই আমাদের মনে নতুন চিন্তার উদ্রেক করে। এর জন্য সে বস্তুটির নির্দিষ্ট কোনো রং, স্বাদ বা গন্ধ থাকা আবশ্যক নয়। তাই লক এই সিদ্ধান্তে এসেছেন যে, নতুন ধারণার সৃষ্টি হতে একটি দেহ বা কাঠামোই যথেষ্ট।
  • লক অক্সফোর্ডে গিয়ে সেসময় সবে মাত্র বিকশিত হতে শুরু করা ‘মেকানিকস’ বা বলবিজ্ঞানের সাথে পরিচিত হন। তিনি এতে এতটাই মুগ্ধ হন যে, তিনি যান্ত্রিক দর্শনকে প্রকৃতি বিশ্লেষণের শ্রেষ্ঠ উপায় বলে অভিহিত করেন।
  • লক মানুষের ইচ্ছাশক্তিকে বুঝতে গিয়ে ইচ্ছাশক্তির স্বাধীনতাকে নিয়ে প্রশ্ন করেছেন। কোনো ব্যক্তি যদি নদীতে লাফ দেন সেটা তিনি তার ইচ্ছায় করেছেন। আবার তিনি লাফ দিতে চাননি কিন্তু তার বন্ধু তাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলে সেটা হবে ইচ্ছার বিরুদ্ধে। আবার তিনি লাফ দিতে চান কিন্তু তার শারীরিক সমস্যার জন্য পারছেন না, তখন তিনি নদীর পারে দাঁড়িয়ে আছেন অনিচ্ছাকৃতভাবে। কিন্তু লক এই ইচ্ছা-অনিচ্ছার স্বাধীনতা নিয়েই প্রশ্ন তুলেছেন। আমরা যা ইচ্ছাকৃতভাবে করছি বলে দাবি করি, তা কি আসলেই ইচ্ছাকৃত নাকি আশেপাশের পরিস্থিতি দ্বারা চালিত!
  • আমাদের অনিচ্ছাকৃত ইচ্ছের পেছনে কাজ করে একধরনের অস্বস্তি। এই অস্বস্তি থেকে আমাদের মনে কামনার সৃষ্টি হয়, যা আমাদেরকে অনিচ্ছাকৃত সিদ্ধান্ত নিতে উত্তেজিত করে। এই কামনা সম্পর্কে যদি আমরা সচেতন হই, তাহলে আমাদের ইচ্ছেগুলো স্বাধীন হবে।
  • লক বিশ্বাস করতেন, মানুষের বিশ্বাস এবং অনুধাবন তার ব্যক্তিত্ব গঠন করে। বিশ্বাস পরিবর্তনের সাথে সাথে ব্যক্তিত্বও পরিবর্তিত হয়।
  • লকের মতে প্রতিটি ব্যক্তি/বস্তুর রয়েছে দুটি সত্ত্বা। একটি বাস্তব সত্ত্বা এবং একটি নামমাত্র, যা অধিকাংশ সময় বাস্তব বলে মনে হতে পারে। লক এই নামমাত্র সত্ত্বার ব্যাপারে সচেতন হতে বলেছেন।

টু ট্রিটিজ অব গভর্নমেন্ট; source: The British Library

জন লকের রাজনৈতিক দর্শন নিয়ে গবেষণার ব্যাপারে খুব একটা অবাক হবার কিছু নেই। কারণ তিনি যে সময় তার দর্শন নিয়ে কাজ করেন, তখন ইংল্যান্ডে ব্যাপক রাজনৈতিক অস্থিরতা চলছিল। তা শেষ হয় গ্লোরিয়াস বিপ্লবের মাধ্যমে। তাই রাজনীতি তাকে আকর্ষণ করবে এটাই স্বাভাবিক ছিল। তার ‘টু ট্রিটিজ অব গভর্নমেন্ট’ প্রকাশিত হয় ১৬৮৯ সালে। প্রথম ট্রিটি ছিল রবার্ট ফিলমারের ‘প্যাট্রিয়ার্কা’র সমালোচনা নির্ভর। প্যাট্রিয়ার্কাতে ফিলমার দাবি করেন যে, রাজার ক্ষমতা স্বর্গীয় এবং তা কালে কালে ঈশ্বর কর্তৃক নির্দিষ্ট করা। এই তত্ত্বের তীব্র সমালোচনা করেন লক। তবে লকের দ্বিতীয় ট্রিটিই অধিক জনপ্রিয়, যা সরকারের উৎস এবং প্রকৃতি নিয়ে আলোচনা করে। ফিলমার যেখানে বলেছিলেন, মানুষ মাত্রই রাজনৈতিক শক্তির দাস, লক সেখানে দাবি করেন ঠিক বিপরীত মেরুতে গিয়ে। তার মতে, আজকের সকল রাজনৈতিক শক্তির উৎসই হচ্ছে ‘স্টেট অব ন্যাচার’। স্টেট অব ন্যাচার হচ্ছে এমন অবস্থা যখন মানুষে মানুষে কোনো ভেদাভেদ ছিল না। প্রত্যেকে ছিল প্রত্যেকের মতো স্বাধীন এবং নিজের অধিকার সবাই নিজেই রক্ষা করতো। ঈশ্বর কাউকে নির্দিষ্ট করে দেবেন ক্ষমতা ভোগ করার জন্য এবং বাকিরা দাসত্ব করবে, এ কথা লকের বিশ্বাস হয়নি।

স্টেট অব ন্যাচারে সকল মানুষ ছিল সমান এবং তারা অবাধ স্বাধীনতা ভোগ করতো। আর এই অবাধ স্বাধীনতাই আবার অনিশ্চয়তার সূচনা ঘটালো। মানুষ দেখতে পেলো, তারা একা এমন অনেক কাজ করতে অক্ষম যা কয়েকজন একত্রে করতে পারতো। আবার নিজের নিরাপত্তা বিধানেও অনেক সময় দলগত ভূমিকার প্রয়োজন হলো। আর এই প্রয়োজনীয়তা থেকেই তৈরি হলো কন্ট্রাক্ট বা চুক্তি। যে চুক্তি অনুযায়ী, একদল মানুষ রাষ্ট্র পরিচালনা করবে এবং সর্বসাধারণের নিরাপত্তা ও অন্যান্য অধিকার নিশ্চিত করবে। এর বিনিময়ে সাধারণ জনগণ তাদের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করবে। তার এই তত্ত্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিকটি হচ্ছে, সরকার সৃষ্টি হয়েছে সাধারণ জনগণের দ্বারাই। অতএব সরকারকে অবশ্যই সাধারণের ইচ্ছা-আকাঙ্ক্ষার প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে। সরকার কখনোই সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হতে পারবে না, কারণ, তাদের সাথে জনসাধারণের রয়েছে চুক্তি। অন্যদিকে এই চুক্তি যদি সরকার সঠিকভাবে পালনে ব্যর্থ হয়, অর্থাৎ জনগণের নিরাপত্তা বিধানে অসমর্থ হয়, তাহলে সরকারকে অবশ্যই সরে দাঁড়াতে হবে।

লকের সোশ্যাল কন্ট্রাক্ট থিওরির একটি সাধারণ ব্যাখ্যা; source: Pinterest

দ্বিতীয় ট্রিটিতে জন লক আরো একটি বিষয়ে দৃষ্টিপাত করেছেন, আর তা হচ্ছে পৃথিবীর প্রাকৃতিক সম্পদ। তার মতে, সৃষ্টিকর্তা পৃথিবীর সকল সম্পদ সকলের ব্যবহারের জন্য তৈরি করেছেন। কিন্তু মানুষ যে সম্পত্তি নিজের বলে দাবি করে তা আদতে দখল করে নেয়া সম্পত্তি। অথবা নামমাত্র পরিশ্রমের বিনিময়ে পাওয়া সম্পত্তি। পৃথিবীরই একটি প্রাকৃতিক সম্পদ লৌহ থেকে মানুষ তৈরি করছে মুদ্রা, আর সে মুদ্রা দিয়েই আবার অন্যান্য সম্পদ আদান-প্রদান করছে! লকের মতে রাষ্ট্রের সৃষ্টির অন্যতম প্রধান একটি কারণ হচ্ছে এই ব্যক্তিগত সম্পত্তি। সম্পত্তিতে ব্যক্তিগত মালিকানা এসেছে বলেই তার নিরাপত্তা বিধানের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয় এবং সৃষ্টি হয় রাষ্ট্রের। লকের মতো করে একবার ভাবুন তো, রাষ্ট্র সম্পর্কে আপনার ধারণা পাল্টে যেতে বাধ্য!

ইউরোপে তখন রাষ্ট্র পরিচালনায় ধর্ম ছিল একচেটিয়া। জন লক এ ব্যাপারে ভিন্নমত প্রকাশ করেন। তিনি ধর্মকে মানুষের ব্যক্তিগত বিশ্বাস হিসেবেই দেখতেন। কোনো রাষ্ট্রধর্ম থাকা মানে রাষ্ট্রের অন্যান্য ধর্মের মানুষের সাথে অবিচার করা। তাই তিনি ধর্মের ব্যাপারে রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ বন্ধের আহ্বান জানান। তার এই আহ্বান ব্যাপকভাবে সমালোচিত হয়। এপিস্টোলা লেখার পর থেকেই ধর্মের ব্যাপারে রাষ্ট্রের ভূমিকা নিয়ে সোচ্চার ছিলেন লক। তার মতে ধর্মীয় বিষয়াবলীতে রাষ্ট্রের ভূমিকা কেবল একটাই হতে পারে, আর তা হচ্ছে ‘টলারেশন’ বা ‘সহনশীলতা’। এই সহনশীলতাকে তিনি আবার সীমাবদ্ধ করে দিয়েছেন। প্রথমত, যারা অসহনশীল তাদের সাথে সহনশীলতা না দেখিয়ে তাদের দমন করতে হবে। দ্বিতীয়ত, যারা নিজের ধর্ম অন্যের উপর চাপিয়ে দিতে চেষ্টা করে এবং রাষ্ট্র পরিচালনায় ব্যাঘাত ঘটায় তাদেরও সহ্য করা যাবে না। এখানে তিনি সরাসরি রোমান ক্যাথলিকদের আক্রমণ করেন তাদের গোঁড়ামির জন্য। এ পর্যন্ত যথেষ্ট যৌক্তিক ছিল সহনশীলতার ব্যাপারটি। তবে এ পর্যায়ে এসে লক অযৌক্তিক দাবি করে বসেন। তার মতে, নাস্তিকদেরও বরদাস্ত করা যাবে না। কারণ, তারা মৃত্যু পরবর্তী শাস্তিতে বিশ্বাস করে না এবং তাই পৃথিবীতে খারাপ কাজে লিপ্ত হয়।

source: Pinterest

জন লকের প্রবন্ধগুলোর যে তীব্র সমালোচনার কথা আমরা জানলাম, তা বেশিদিন ধোপে টেকেনি। খুব দ্রুতই তার প্রবন্ধগুলো বিশ্বের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অত্যন্ত মূল্যবান দর্শন হিসেবে পড়ানো শুরু হয়। সমালোচকেরা সমালোচনা সত্ত্বেও এর অনন্যতা মেনে নিতে বাধ্য হন। আর তার ‘টু ট্রিটিজ’কে তো পৃথিবীর ইতিহাসে অন্যতম শ্রেষ্ঠ রাজনৈতিক প্রবন্ধ বলে গণ্য করা হয়। আমেরিকার অভ্যুত্থানের সময় লকের ‘টু ট্রিটিজ’ ছিল একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অনুপ্রেরণা। অন্যদিকে বর্তমানে অনেকেই লককে ব্রিটিশ প্রয়োগবাদ এবং রাজনৈতিক দর্শনের জনক বলে অভিহিত করেন। সব মিলিয়ে জন লক পৃথিবীর সবচেয়ে প্রভাবশালী রাজনৈতিক দার্শনিকদের একজন। তার দর্শন মানুষের মুক্তচিন্তা ও মুক্তবুদ্ধির চর্চার পথের এক ঐতিহাসিক পাথেয় হিসেবেই স্মরণীয়।

ফিচার ইমেজ- The Imaginative Conservative

Related Articles