থাইল্যান্ডের রাজা ভুমিবল আদুলাদেজ, পৃথিবীরে সর্বোচ্চ ধনী রাজা, সবচেয়ে দীর্ঘ সময় জুড়ে রাজত্ব করা রাজা। টানা ৭০ বছর সিংহাসনে অধিষ্ঠিত এই ব্যক্তির আরও একটি পরিচয় আছে থাইল্যান্ডবাসীর কাছে। আর তা হলো, পৃথিবীর সবচেয়ে সম্মানিত এবং ভালোবাসার ব্যক্তি। হ্যাঁ, থাইল্যান্ডবাসীর নয়নের মণিই যেন ছিল তাদের রাজা। সাধারণ জনগণ তাকে ভালোবেসে কত নাম দিয়েছে; নাই লুয়াং (রাজাধিরাজ), ফ্রা চাও ইউ হুয়া (সম্মানিত প্রভু), চাও চিবিত (জীবনের রাজা)। নিজের বুদ্ধিমত্তা আর দেশপ্রেমের জোরে দেশকে বহুবার সংকটময় পরিস্থিতি থেকে উদ্ধার করেছেন ভূমিবল। তাই তো ২০১৬ সালে তার মৃত্যুতে পুরো থাইল্যান্ডে নেমে এসেছিল শোকের ছায়া। তার মৃত্যুতে থাইল্যান্ডবাসী যেভাবে শোক প্রকাশ করেছে, তা আর কোনো রাজা কিংবা রাষ্ট্রনেতার মৃত্যুতে বিরল।
২০১৬ সালের ১৩ অক্টোবর ৮৮ বছর বয়সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন ভূমিবল। থাইল্যান্ডে এক বছরের আনুষ্ঠানিক শোক ঘোষণা করা হয় তাতে। ব্যাংককের গ্র্যান্ড প্যালেসে সোনা, হীরা আর উজ্জ্বল সিল্কে সজ্জিত সোনালি এক সমাধিতেই শান্তিতে ঘুমিয়ে আছেন ভূমিবল, যেখানে অনবরত চলতে থাকে বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের মন্ত্রপাঠ। তার মৃত্যুতে তার একমাত্র পুত্র ভাজিরালংকর্ন সিংহাসনে বসেন। কিন্তু ভূমিবলের মতো জনপ্রিয়তা বা গ্রহণযোগ্যতা তার আছে কি না, তা নিয়ে সংশয়ে অনেকে। বিশ্বরাজনীতিতে ক্ষমতাবান কেউ না হলেও ভূমিবল ছিলেন সকলের শ্রদ্ধাভাজন। তার মৃত্যুতে থাইল্যান্ড অনাগত সময়ে কীভাবে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের দিকটা চালিয়ে নেবে, সেখানেও রয়ে গেছে প্রশ্নচিহ্ন। এত আদরণীয় আর পূজনীয় এই রাজা উত্তরাধিকারসূত্রে হয়ে যাননি। বরং তিনি তার ঘটনাবহুল জীবনে নিজের যোগ্যতাগুণে মানুষের হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছেন।
চলুন, শুরুর দিকে যাওয়া যাক। তখন সিয়ামের (থাইল্যান্ড তখন ‘কিংডম অব সিয়াম’ নামে পরিচিত) রাজা ছিলেন প্রজাধিপক। তার ভাই প্রিন্স মাহিদোল আদুলাদেজ ছিলেন সিংহাসনের উত্তরাধিকারী। মাহিদোলের স্ত্রীর নাম শ্রীনাগারিন্দ্রা। সিয়ামে তখন সংকটময় সময় চলছিল। প্রজাধিপককে উৎখাত করার গোপন ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয় রাজ্যের প্রভাবশালীরা। প্রজাধিপক ও তার ভাই মাহিদোল সর্বোচ্চ চেষ্টাই চালিয়ে যাচ্ছিলেন সবকিছু নিয়ন্ত্রণে রাখতে। এরকম এক পরিস্থিতিতে, এই সংকটের ভবিষ্যৎ ত্রাণকর্তার পৃথিবীতে আগমন। ১৯২৭ সালের ডিসেম্বরের ৫ তারিখ, ম্যাসাচুসেটসের অবার্ন হাসপাতালে জন্ম হয় ভূমিবল আদুলাদেজের, যিনি আমেরিকার মাটিতে জন্ম নেয়া প্রথম রাজাও বটে।
শিশু ভূমিবলের আগমনের পর যেন পরিস্থিতি আরো ঘোলাটে হতে শুরু করেছিল। ১৯২৯ সালে মাহিদোলের অকালমৃত্যু সেই আগুনেই ঘি ঢেলেছিল। কারণ, তার মৃত্যুতে তার দুই পুত্র আনন্দ এবং ভূমিবলই হয়ে ওঠেন প্রজাধিপকের সিংহাসনের উত্তরাধিকারী। ফলে তাদের প্রাণসংশয় দেখা দেয়। ষড়যন্ত্রকারীরা আনন্দ আর ভূমিবলকে হত্যার ছক কষতে শুরু করলে টের পেয়ে যান শ্রীনাগারিন্দ্রা। তিনি ছেলেদের নিয়ে আমেরিকা চলে যান।
আমেরিকায় নিজের মূল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে সম্পূর্ণ বিপরীত এক পরিবেশে পাশ্চাত্য ভাবধারায় বড় হয়ে উঠতে থাকেন ভূমিবল। মন্দির, মঠ, রাজকীয় আচার সংস্কৃতি আর চিরায়ত জাফরানি রঙের ঢিলেঢালা গাউনে বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের মন্ত্রপাঠ, এসব কিছুই ভূমিবলের কল্পনারও বাইরে ছিল। তিনি বরং একঝাঁক বন্ধু নিয়ে ঘুরে বেড়ানো, ফূর্তি করা আর ব্যান্ড গান শোনার মধ্য দিয়েই দিন পার করছিলেন। অবশ্য পড়ালেখায়ও বেশ মনোযোগী ছিলেন ভূমিবল। তবে তার বড় ভাই আনন্দ ছিলেন সম্পূর্ণ ভিন্ন চরিত্রে। সর্বদা গুরুগম্ভীর আর একা থাকাই তার স্বভাব ছিল। তবে তিনি ছিলেন অত্যন্ত রুগ্ন স্বাস্থ্যের অধিকারী। এতটাই রুগ্ন যে ১৯৩৫ সালে তার চাচা প্রজাধিপকের মৃত্যুর পর তিনি পরবর্তী রাজা ঘোষিত হলেও সিংহাসনে বসতে তার আরো তিন বছর অপেক্ষা করতে হয়।
যা হোক, কিশোর রাজা আনন্দ ছিলেন একপ্রকার আনুষ্ঠানিক পুতুল রাজা। রাজসভা পরিচালিত হচ্ছিল ক্ষমতাবান অভিজাত শ্রেণীর দ্বারা। কিন্তু পুতুল হয়েও শেষ রক্ষা হয়নি তার। ১৯৪৬ সালের ৯ অক্টোবর আনন্দের মৃতদেহ পাওয়া যায় তার শয়নকক্ষে। তার মাথায় গুলি করা হয়েছিল। সেদিনই ভূমিবলকে নতুন রাজা ঘোষণা করা হয়। চাকরি রাজপরিবারের রাজতন্ত্র চালিয়ে নিতে রাজা নবম রমা (চাকরি বংশের রাজাদের রমা বলা হয়) হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। তবে তৎক্ষণাৎ তিনি সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হননি। তিনি চলে যান সুইজারল্যান্ডে পড়ালেখা শেষ করতে। অবশ্য পড়ালেখাও তার শেষ করা হয়ে ওঠেনি। এমনকি স্নাতকটাই সম্পন্ন করেননি ভূমিবল।
ভূমিবল ক্ষমতায় বসার পর থেকেই থাইল্যান্ডের রাষ্ট্রীয় রাজনীতির সাথে রাজতন্ত্র একসূত্রে গেঁথে যেতে শুরু করে। সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ১৯৫৭ সালে রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন জেনারেল সারিত। ভূমিবল সারিতকে রাজকীয় অভ্যর্থনা জানিয়ে রাজপরিবারের বন্ধু ঘোষণা করেন। সারিতও তাই রাজার উপকারের প্রতিদান দিতে ভোলেননি। তিনি রাষ্ট্রীয় সেনাবাহিনীর সাথে রাজপরিবারের যে যোগসূত্র স্থাপন করেন, তা আজবধি টিকে আছে।
অন্যদিকে, সিংহাসনে কয়েকবছর কাটানোর পর থাইল্যান্ডের প্রাচীনতম বন্ধু রাষ্ট্র আমেরিকাও ভূমিবলকে সাদরে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করে। আমেরিকার মাটিতেই জন্ম নেয়া, পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত এবং আধুনিক মানসিকতার একজন রাজাকে আমেরিকা পছন্দ না করে পারে? সুন্দরী রানী সিরিকিত ক্রিত্যিকারার সাথে চশমা পরিহিত সুদর্শন ভূমিবল সপ্তাহান্তেই ককটেল পার্টির আয়োজন করতেন, যেখানে গল্প-আড্ডায় মেতে উঠতেন মার্কিন বন্ধুদের সাথে। কিংবদন্তি সুরকার ডিউক এলিংটনকে প্রাসাদে আমন্ত্রণ করে তার সাথে স্যাক্সোফোনও বাজিয়েছেন তিনি। অথচ এই উদার রাজাকেই প্রাথমিকভাবে সহজে গ্রহণ করতে পারেনি মার্কিনীরা। ১৯৫০ সালে তার রাজ্যাভিষেকের সময় নিউ ইয়র্ক টাইমস তাকে নিয়ে ব্যাঙ্গ কার্টুন ছেপেছিল, ওয়াশিংটন সন্দেহ প্রকাশ করেছিল তার দীর্ঘস্থায়িত্ব নিয়ে। অথচ এর এক দশক পর আমেরিকা যখন ভিয়েতনাম যুদ্ধে জড়িয়ে গিয়ে তথৈবচ অবস্থা সৃষ্টি করেছে, তখন টাইমস তাদের প্রথম পাতায় বড় করে শিরোনাম দিয়েছিল, “একজন রাজা যিনি স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করছেন!” ওয়াশিংটনের তখন কী ভাবটাই না ছিল ভূমিবলের সাথে! আর ভাব কেন নয়, ভূমিবলই তো ছিলেন এই অঞ্চলে আমেরিকার সবচেয়ে বড় মিত্র।
ভূমিবলের সাথে ওয়াশিংটনের বন্ধুত্ব নানামুখী উপকারে আসে আমেরিকার। একে তো ভিয়েতনাম যুদ্ধের সমর্থক, অন্যদিকে কমিউনিজম বিরোধিতা। অভ্যুত্থানে ক্ষমতা গ্রহণ করা প্রধানমন্ত্রী সারিত দিনকে দিন স্বৈরাচারী হয়ে উঠতে থাকলেও তিনি সর্বদা কট্টর কমিউনিস্ট বিরোধী ছিলেন। আর এ কারণে আমেরিকা তার সাথে বন্ধুত্ব রাখার জন্য হলেও রাজার সাথে সম্পর্ক বজায় রাখে। লক্ষ লক্ষ ডলার খরচ করে আমেরিকা পুরো থাইল্যান্ড জুড়ে ভূমিবলের বিশাল বিশাল ছবি সম্বলিত পোস্টার লাগিয়ে, তার উন্নয়নের চিত্র প্রচার করে। ১৯৬০ এর দশকের ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে নিশ্চিতভাবে বলা চলে যে, আমেরিকার কারণে সে সময় ভূমিবলের জনপ্রিয়তা আকাশ ছুঁয়ে যায়।
তবে, ভূমিবলের সবটাই যদি মার্কিন মদদপুষ্ট ভাবতে শুরু করেন, তাহলে বিশাল ভুল করছেন। তার জনপ্রিয়তার প্রাথমিক মঞ্চটা হয়তো ওয়াশিংটনের তৈরি, তবে সে মঞ্চের নায়ক তিনি একাই। ভূমিবল তার ব্যক্তিগত উদ্যোগে সামাজিক কল্যাণমূলক কার্যক্রম শুরু করেন। অলস বসে থাকার মতো মানুষ তিনি মোটেও ছিলেন না। রাজকীয় প্রথা ভেঙে তিনি রানী সিরিকিতকে নিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছেন থাইল্যান্ডের প্রত্যন্ত সব গ্রামে, কথা বলেছেন দরিদ্র ভূমিহীন কৃষক আর শ্রমিকদের সাথে, সর্বদা পান চাবাতে ব্যস্ত রঙিন ঠোঁটের যে মানুষগুলোর কোনোদিন রাজসভার কোনো উর্ধ্বতন কর্মকর্তার সাথেই কথা বলার সুযোগ হয়নি।
ভূমিবলের এই ভ্রমণগুলো শুধু নিছক ভ্রমণ আর কথাবার্তা বলার মাঝে সীমাবদ্ধ ছিল না। তিনি আসলে গ্রামে গ্রামে ঘুরে তার প্রজাদের হালহাকিকত জানার চেষ্টা করতেন। এসব ভ্রমণে তার সাথে থাকতো একটি মেডিকেল টিম। যেদিন যে গ্রামে যেতেন, সেদিন সেখানকার প্রত্যেক অসুস্থ বাসিন্দাকে বিনামূল্যে চিকিৎসা ও ঔষুধ দিয়েই তবে প্রাসাদে ফিরতেন। প্রত্যন্ত গ্রামগুলোর একটি বড় সমস্যা ছিল খরা। শুষ্ক মৌসুমে এসব গ্রামের দরিদ্র লোকজনকে বেশ ঝক্কি পোহাতে হতো। সাধারণ জনগণের এসব সমস্যা দূর করার দায়িত্ব যেখানে সরকারের ছিল, সেখানে ভূমিবল এগিয়ে আসেন। তিনি প্রায়ই ব্যর্থ রাজনীতিবিদদের সমালোচনা করতেন।
প্রকৌশল বিদ্যায় পড়ালেখা করা ভূমিবল নিজের অর্জিত বিদ্যাকে কাজে লাগান জনগণের সেবায়। পুরো থাইল্যান্ড জুড়ে চার হাজার গভীর কূপ খনন করেন, খাল কাটা প্রকল্প হাতে নেন। অন্যদিকে উপকূলবর্তী গ্রাম সমূহকে বন্যার হাত থেকে বাঁচাতে বাঁধ তৈরির কাজও হাতে নেন। এসব প্রকল্পে তিনি নিজে সরাসরি যুক্ত ছিলেন। ভূমিবলকে চেনেন না, এরকম মানুষ প্রকল্পের কাজ দেখতে গেলে প্রায়ই তাকে প্রধান প্রকৌশলী ভেবে ভুল করেছেন। মাথায় হেলমেট, গলায় মাপ ফিতা আর প্রকৌশলীদের ব্যবহার্য ক্যামেরা, হাতে নোটবুক নিয়ে প্রজেক্টের ম্যাপের উপর ঝুঁকে পর্যবেক্ষণ করছেন আর অন্যদের সাথে আলোচনা করছেন, এরকম একজন লোককে না চিনলে রাজা ভাবাটা খানিকটা মুশকিল বৈকি!
১৯৬৩ সালে প্রধানমন্ত্রী সারিত মৃত্যুবরণ করলে থাইল্যান্ডের রাজনীতি ভিন্ন পথে মোড় নেয়। ক্ষমতায় বসেন ফিল্ড মার্শাল থানোম, যিনি সারিতের চেয়ে অধিক কমিউনিজম বিদ্বেষী ছিলেন। তিনি ক্ষমতায় গিয়েই দেশে বাকস্বাধীনতার পরিসর কমানো শুরু করেন, ভিন্ন মত দমন করতে শুরু করেন। কিন্তু চিরায়ত নিয়ম মেনেই স্বৈরাচারী শাসকের শোষণ বৃদ্ধির সাথে সাথে ভিন্নমত উল্টো আরো বাড়তে থাকে। বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে '৭০ এর দশকে ব্যাপক বামপন্থী এবং উদারপন্থী ভাবাদর্শ লক্ষ্য করা যায়।
এরই মাঝে ১৯৭৩ সালে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে যায়। জনপ্রিয় এক ছাত্রনেতাকে গ্রেফতারের প্রতিবাদে রাস্তায় নেমে আসলো কয়েক লাখ শিক্ষার্থী। আর শিক্ষার্থীদের এই বিশাল স্রোত দেখে ঘাবড়ে গিয়ে সেনাবাহিনীকে গুলি চালানোর নির্দেশ দিয়েছিলেন থানোম। সাধারণ মানুষ ও শিক্ষার্থী সহ অন্তত শতাধিক মানুষ নিহত হয় সেদিন। আহতের সংখ্যা অজানা। ভূমিবল তার প্রাসাদের দরজা খুলে দিয়ে আটকে পড়া কয়েক হাজার শিক্ষার্থীকে আশ্রয় না দিলে মৃতের সংখ্যা আরো বাড়তে পারতো। এ ঘটনায় দেশ জুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি হয়। ভূমিবল থানোমকে স্বেচ্ছা নির্বাসনে পাঠিয়ে দেন পরিস্থিতি শান্ত করবার জন্য।
তিন বছর পর, ১৯৭৬ সালের ৩রা অক্টোবর দেশে ফেরেন থানোম। ততদিনে থাইল্যান্ডে গণতন্ত্রের দাবি জোরালো হয়েছে, স্বৈরাচার বিরোধী আওয়াজ আরো উচ্চকণ্ঠ হয়েছে। দেশে ফিরে থানোম যখন ভূমিবলের সাথে দেখা করতে যান, তখন ক্ষিপ্ত শিক্ষার্থীরা পুনরায় রাস্তায় নেমে আসে। অথচ থানোম রেডিওতে ঘোষণা করেন যে শিক্ষার্থীরা রাজার বিরুদ্ধে মাঠে নেমেছে। থানোমের মিথ্যাচারে সেনাবাহিনী আর শিক্ষার্থীরা আবারো মুখোমুখি হয়ে পড়ে। এবার প্রাণ যায় জনাবিশেক শিক্ষার্থীর। অথচ তাদের জন্য পূর্ণ সহানুভূতি থাকলেও সেনাবাহিনীর উপর ভূমিবলের কর্তৃত্ব ছিল সামান্যই।
এ ঘটনার পর পদত্যাগে বাধ্য হন থানোম। ক্ষমতা গ্রহণ করেন আরো একজন সামরিক ব্যক্তি, অ্যাডমিরাল চালোরিউ। চালোরিউ হিমালয়ের পাদদেশের নিকটে গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গেল অঞ্চলে আফিম উৎপাদনকারী পাহাড়িদের কঠোর হস্তে দমনের উদ্যোগ নেন। কিন্তু ভূমিবল ছিলেন সামরিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে। তিনি সেসব অঞ্চলে যান, পাহাড়িদের সাথে কথা বলেন এবং তাদেরকে শাকসবজি, ধান, গমের মতো খাদ্যদ্রব্য উৎপাদনে উৎসাহ প্রদানের পাশাপাশি সহযোগিতা করার আশ্বাস দেন।
“পশ্চিমারা প্রায়ই বিস্ময় প্রকাশ করতো যে আমি রাজা হয়ে গণতন্ত্র কেন সমর্থন করি। আমি তাদের বলতাম, থাইল্যান্ডে রাজাই হচ্ছেন গণতন্ত্রের নিশ্চয়তা প্রদানকারী।”- ভূমিবল আদুলাদেজ
ভূমিবলের জনপ্রিয়তার সাথে পাল্লা দিয়ে তার সম্পদের পরিমাণ বাড়তে থাকে। রাজপরিবার রাষ্ট্রীয় করের আওতায় না থাকায় তার সম্পদ বৃদ্ধির হারও ছিল বেশি। চাকরি রাজপরিবারের যা-ই হোক না কেন, ভূমিবলের ব্যক্তিগত সম্পত্তি ছিল আকাশছোঁয়া। ২০১১ সালে ব্রুনাইয়ের সুলতানকে হারিয়ে বিশ্বের শীর্ষ ধনী রাজা হন ভূমিবল। ফোর্বসের প্রাক্কলন অনুযায়ী, সেবছর তার সম্পদের পরিমাণ ছিল ৩০ বিলিয়ন ডলার! থাইল্যান্ডের সাধারণ জনগণের সাথে তুলনা করলে তা অকল্পনীয়। থাইল্যান্ডের মাথাপিছু আয় মাত্র ৫ হাজার ডলার (২০১১ সালের হিসাব)। অতএব রাজা ভূমিবল তার প্রজাদের তুলনায় ৫০ লক্ষ গুণ ধনী ছিলেন!
'৯০ এর দশকে নাটকীয়ভাবে ভুমিবলের জনপ্রিয়তা দেবতার পর্যায়ে পৌঁছে যাবার আরেকটি বড় কারণ হচ্ছে একটি টিভি ফুটেজ। ১৯৯২ সালে থাইল্যান্ডের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে একটি সংক্ষিপ্ত ফুটেজে দেখা যায় যে, দুজন লোক মাথা নত করে আছেন ভূমিবলের সামনে এবং ভুমিবল তাদের খুব করে তিরস্কার করছেন। সেই দুজনের একজন ছিলেন সুচিন্দা ক্রাপ্রায়ু, যিনি আগের বছরও থাইল্যান্ডের সামরিক সরকারের প্রধান নেতা ছিলেন! এই ফুটেজ সাধারণ জনগণের কাছে ভূমিবলকে উচ্চাসনে প্রতিষ্ঠা করে। প্রাথমিক সম্প্রচারের পর পরবর্তী ২ দশক এই ফুটেজটি থাইল্যান্ডের রাষ্ট্রীয় টিভি চ্যানেল থেকে হারিয়ে যায়নি কখনো।
যদিও ১৯৩২ সালেই থাইল্যান্ডে পূর্ণ রাজতন্ত্রের অবসান ঘটে, তথাপি থাইল্যান্ডবাসী গণতন্ত্রের স্বাদ গ্রহণ করতে পারেনি খুব একটা। থাইল্যান্ডের রাজনীতি সর্বদাই নানামুখী বিতর্ক আর সামরিক নেতাদের ক্ষমতার খেলায় কলঙ্কিত। তবে সেসব কলঙ্ক গায়ে মাখতে দেননি ভূমিবল। তবুও ২১ শতকে এসে থাকসিন সিনাওয়াত্রার ক্ষমতাচ্যুতিতে তাকে জড়ানো হয়েছে নানাভাবে। কিন্তু নিজের ৭৮তম জন্মদিনে ভূমিবল বক্তৃতায় তার বিরুদ্ধে সকল সমালোচনা আর অভিযোগকে স্বাগত জানান। তিনি বলেন, “আমি সমালোচনাকে ভয় পাই না, বরং ভালোবাসি।”
তবে ২১ শতকের শুরু থেকে ভূমিবলের কার্যকারিতা ধীরে ধীরে হ্রাস পেতে শুরু করে। রাজনৈতিক আর রাষ্ট্রকাঠামোয় নানান পরিবর্তনের সাথে সাথে সামাজিক প্রেক্ষাপটেরও এর পেছনে কার্যকরী ভূমিকা ছিল। ভূমিবল যখন অভিষিক্ত হন, তখন থাইল্যান্ডের ৮০ ভাগ মানুষ ছিল নিরক্ষর, কৃষক শ্রেণীর। অথচ ২০০৫ সালের জরিপে দেখা যায় দেশটির ৬০ ভাগের বেশি মানুষ শিক্ষিত। তাছাড়া অর্ধেক জনগোষ্ঠীই গ্রাম ছেড়ে শহরকেন্দ্রিক হয়ে পড়ে। শহুরে জনগণ স্বাভাবিকভাবেই রাজার চেয়ে রাষ্ট্রীয় প্রশাসন আর রাষ্ট্রযন্ত্রের উপর নির্ভর করতে অধিক পছন্দ করে। তথাপি, ভূমিবলের প্রতি সর্বসাধারণের শ্রদ্ধার জায়গাটুকু কখনোই হারিয়ে যায়নি।
২০০৯ সাল থেকেই রাজা ভূমিবল আদুলাদেজ রাজসভায় কম, হাসপাতালে বেশি ছিলেন। বুকের ব্যথা আর হাইড্রোসেফালাসের সমস্যায় ভুগতে হয় তাকে। ২০১২ সালে ভূমিবলের সাথে রানী সিরিকিতেরও বড় ধরনের স্ট্রোক হয়। ২০১৬ সালে তিনি যখন পরপারে পাড়ি জমালেন, তখন তার প্রিয় দেশ ও দেশের মানুষগুলো খুব বেশি ভালো নেই। নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের আশা সুদূর পরাহত, মানবাধিকার লঙ্ঘন পৌনঃপুনিক, জান্তা সরকারে শাসন আরো সুদৃঢ়ভাবে প্রোথিত। সংবিধানে এসেছে নতুন সংশোধনী, যা সেনাবাহিনী দ্বারা নির্বাচিত ‘অনির্বাচিত’ প্রধানমন্ত্রীকে বৈধতা দেয়।
অবশ্য এসব ভূমিবলের মৃত্যুর সময় ঘটছে বলে ষোলোকলা পূর্ণ হয়েছে বললেই অধিক যৌক্তিক শোনাবে। ৭০ বছর সময়ব্যাপ্তিতে পৃথিবীর যেকোনো দেশের চেয়ে থাইল্যান্ডে সর্বোচ্চ ১৫ বার বড় ধরনের সামরিক অভ্যুত্থান হয়েছে, যার ১০টিই হয়েছে সফল, উত্থান ঘটেছে বাঘা বাঘা সব সামরিক নেতার, সিংহাসনের জন্য বাঘে-মহিষে চলেছে জম্পেশ লড়াই। কিন্তু এই দীর্ঘ সময়ের ‘গেম অব থ্রোনস’ চলাকালে সকলের মাঝে সকলের চেয়ে প্রজ্ঞায়, বুদ্ধিতে, নীতিতে আর দেশপ্রেমে শ্রেষ্ঠ লোকটি ছিলেন ধ্রুব। তিনি রাজা ভূমিবল আদুলাদেজ।
This article is written in Bangla language. It's about the longest reigning king in the world, the late king of Thailand, Bhumibol Adulyadej.
For References, please check the hyperlinks inside the article.
Featured Image: ft.com