Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

লর্ড ক্লাইভ: একজন স্বাধীনতার সূর্য হরণকারী, নেপথ্যে পলাশীর যুদ্ধ

“বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার মহান অধিপতি, তোমার শেষ উপদেশ আমি ভুলিনি জনাব। তুমি বলেছিলে, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মচারীদের প্রশ্রয় দিও না, তুমি বলেছিলে সুযোগ পেলেই তারা এ দেশ কেড়ে নেবে, আমি তাদের প্রশ্রয় দেবো না…” 

মনে পড়ে প্রয়াত অভিনেতা আনোয়ার হোসেনের অভিনীত বাংলার শেষ ‘স্বাধীন’ নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার কথা? মনে পড়ে ছোটবেলার সমাজ বইতে ইতিহাসের পাতায় নবাবের পরাজয়ের কাহিনী? ১৭৫৭ সালের পলাশীর যুদ্ধ? আর সেই সাথে যে নামটি ডুবিয়ে দেয় এ উপমহাদেশের স্বাধীনতার সূর্য প্রায় দু’শতাব্দীর জন্য, সেই লর্ড ক্লাইভের কথা?

ক্লাইভ এ উপমহাদেশে আসেন কেবলই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির এক পুঁচকে এজেন্ট হিসেবে, ব্রিটিশ সরকারের কেউ হিসেবে না, কিন্তু চলে যাবার সময় ছিলেন একজন মাল্টি-মিলিয়নিয়ার! তারই একক কৌশলে ডিভাইড-অ্যান্ড-রুল নীতিতে ভারতবর্ষই জয় করে নেয় ব্রিটিশরা, দক্ষিণ এশিয়ার বিশাল একটা অংশ অর্থাৎ বাংলাদেশ, ভারত আর পাকিস্তান অঞ্চল ‘অধিকার’ করবার জন্য তাকেই কৃতিত্ব দেয় ব্রিটিশরা। দাবার ঘুঁটির মতো একের পর এক চাল দিয়ে ভারতবর্ষের ধনীতম রাজ্য বাংলার দখল কীভাবে নিলেন ক্লাইভ, যে বাংলা তখন ব্রিটেনের চেয়েও ধনী ছিল? চলুন জেনে আসি সোনার চামচ মুখে দিয়ে জন্ম নেয়া রবার্ট ক্লাইভের উত্থানের কাহিনী, কিন্তু পতন কি হয়েছিল তার? হলেও কীভাবে?

নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার দৃষ্টিকোণ থেকে কাহিনীটা তো আমরা সকলেই জানি, কিন্তু মুদ্রার ওপিঠে ক্লাইভের দিক থেকে ঘটনাটা কেমন ছিল?

রবার্ট ক্লাইভ; Source: Wikimedia Commons

রবার্ট ক্লাইভের জন্ম ১৭২৫ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর, ইংল্যান্ডের শ্রপশায়ারে। রিচার্ড আর রেবেকা ক্লাইভের তের সন্তানের মাঝে সবচেয়ে বড় ছেলে এই রবার্ট, তবে তার ছয় ভাই-বোন মারা যায় শিশু অবস্থাতেই। রাজা সপ্তম হেনরির সময়কাল থেকেই সে অঞ্চলের জমিদার ছিলেন তারা। বাবা রিচার্ড ছিলেন পার্লামেন্টের উকিল।

বাবার রগচটা স্বভাবটা ভালোই পেয়েছিলেন রবার্ট ক্লাইভ। শিশুকালে তাকে তার খালার সাথে ম্যানচেস্টারে থাকতে হয়েছিল। তার খালুর মতে, শিশু রবার্টের প্রিয় একটা কাজ ছিল মারামারি করা। আর যে স্কুলের পড়ুক না কেন, গণ্ডগোল তার বাধাতেই হবে। বড় হয়ে এলাকার মাস্তান গ্যাং গঠন করেন রবার্ট, মাঝে মাঝে গিয়ে চাঁদা না দেয়া দোকানদারদের বারোটা বাজিয়ে আসতেন। লোকে তাকে চিনত সেই ছেলেটি হিসেবে যে সেন্ট মেরিজ প্যারিশ চার্চের টাওয়ার বেয়ে উঠেছিল, আর নিচে অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে লোকে দেখেছিল।

যে টাওয়ারে উঠেছিলেন ক্লাইভ; Source: Wikimedia Commons

বাজে ব্যবহারের কারণে তাকে বারংবার পরিবর্তন করতে হয়েছিল স্কুল, অবশ্য কখনো কখনো আভিজাত্যের কারণেও। আরেকটু বড় হবার পর তিনি বুঝতে পারলেন পড়াশোনাটা ঠিকভাবে না করলে আসলে লোকে ঠিক পাত্তা দিচ্ছে না। তাই তিনি মন দিলেন ডিগ্রি অর্জনে। ধীরে ধীরে লেখালেখিতেও মনোযোগ দিলেন তিনি। হাউজ অফ কমন্সে তিনি একটি বক্তৃতা দিয়েছিলেন যেটার জন্য তিনি অনেক প্রশংসিত হয়েছিলেন। 

১৭৪৪ সালের কিছু আগে, যখন ক্লাইভের বয়স ১৮, তখন তার বাবা তার জন্য চাকরি যোগাড় করে দিলেন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিতে একজন এজেন্ট হিসেবে, তার পোস্টিং হলো বোম্বেতে, অর্থাৎ বর্তমান মুম্বাইতে।

জাহাজে করে ব্রাজিল হয়ে আসবার সময় নয় মাস জাহাজ থামিয়ে রাখতে হয়েছিল মেরামতের জন্য, তখন তিনি হালকা পাতলা পর্তুগিজ ভাষা শিখে নেন। এটা তার জন্য বেশ কাজে দিয়েছিল, কারণ ভারতের গোয়াতে তখন পর্তুগিজদের ঘাঁটি ছিল। আর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ঘাঁটি ছিল মাদ্রাজ (চেন্নাই), বোম্বে, কলকাতা ইত্যাদি জায়গায়। মাদ্রাসপাটনাম গ্রাম অর্থাৎ মাদ্রাজের সেইন্ট জর্জ দুর্গঘাঁটিতে ক্লাইভ ১৭৪৪ সালের জুনে পৌঁছালেন। পরের দু’বছর তিনি এক দোকানদারের সহকারীর কাজ ছাড়া আর কিছু করবার সুযোগ পাননি। তবে সে সময় তিনি গভর্নরের লাইব্রেরির প্রবেশাধিকার পান, আর তখন প্রচুর বই পড়া শুরু করলেন তিনি।

১৭০৭ সালে সম্রাট আওরঙ্গজেব মারা যাবার পর থেকে ক্ষমতা আসলে সুবেদারদের হাতে ছিল। যে সময়ের কথা বলা হচ্ছে তখন প্রধানত ক্ষমতা দুজনের হাতে ছিল, একজন হায়দারাবাদের নিজাম আর আরেকজন কর্ণাটকের নবাব আনোয়ার উদ্দিন মুহাম্মাদ খান। নামকওয়াস্তে অবশ্য নবাব নিজামের অনুগতই দেখাতেন, কিন্তু কাজেকর্মে স্বাধীন ছিলেন। 

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ক্লাইভ যেখানে ছিলেন অর্থাৎ সেইন্ট জর্জ দুর্গখানা নবাবের এলাকাতেই পড়েছিল। স্থানীয় ব্যবসাধিকার নিয়ে তখন ফরাসি, ওলন্দাজ (ডাচ), পর্তুগিজ আর ইংলিশদের মধ্যে রেশারেশি চলত। ব্যবসায় লাভের জন্য তাই যেটি দরকার ছিল, সেটি হলো মিলিটারি ক্ষমতা, সেনাসামন্ত। কোনোভাবে যদি স্থানীয় শাসকদের দলে টানা যায়, তবেই সোনায় সোহাগা।

সেন্ট জর্জ দুর্গে ক্লাইভ হাউজ; Source: Wikimedia Commons

১৭৪৫ সালে শুরু হলো প্রথম কর্ণাটক যুদ্ধ। ব্রিটিশ নৌবাহিনী ফরাসি নৌবহরকে আক্রমণ করে বসে। পরের বছর ফরাসিরা মাদ্রাজ আক্রমণ করে বসে, যেখানে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সেইন্ট জর্জ দুর্গ। ব্রিটিশ নেতাদের গ্রেফতার করে পন্ডিচেরির ফরাসি দুর্গে পাঠানো হয়। বাকিদের শপথ করানো হয় যে তারা ফরাসিদের বিরুদ্ধে কখনো অস্ত্র ধরবে না। 

কিন্তু ক্লাইভ আর হাতে গোণা কয়েকজন অস্বীকার করে বসেন এ শপথ নিতে। দুর্গ ধ্বংস করে দেবার সময় তাদের চোখে চোখে রাখা হয়। কিন্তু চতুর ক্লাইভ আর তার তিন সঙ্গী তখন ভারতীয় সেজে প্রহরীর চোখে ধোঁকা দিয়ে দুর্গ থেকে পালিয়ে যান ৫০ মাইল দক্ষিণে সেইন্ট ডেভিড ব্রিটিশ দুর্গে।

এবার আর হেনতেন এজেন্ট নন, একেবারে কোম্পানির আর্মিতে নাম লিখিয়ে ফেললেন ক্লাইভ। তবে কোম্পানির পদবী ক্রমানুসারে একজন সেনার অবস্থান এজেন্টের নিচে, তাই এটি কোনো পদোন্নতি ছিল না তার জন্য, পদাবনতি ছিল।

পরের বছর ফরাসিরা যখন এ দুর্গেও আক্রমণ চালালো, তখন নবাবের সহায়তায় ব্রিটিশরা রুখে দেয় তাদের, সে যুদ্ধে বিশেষ অবদান রাখার জন্য ক্লাইভ জনপ্রিয় হয়ে যান। ১৭৪৯ সালের শান্তিচুক্তিতে মাদ্রাজ ঘাঁটি ব্রিটিশদের কাছে ফিরিয়ে দেবার আগপর্যন্ত হয়ে যাওয়া নানা যুদ্ধে ক্লাইভের নিপুণতা উচ্চপদস্থদের দৃষ্টি এড়ায়নি। ক্লাইভ তখন সেনাবাহিনীর লেফটেন্যান্ট পদে উন্নীত হলেন। মেজর লরেন্সের মতে, “তার মাঝে আমি যে সাহস আর জ্ঞানবুদ্ধি দেখেছি সেটা তার বয়সের কারো মাঝে আমি আশাই করিনি।”

তার যখন ক্যাপ্টেন পদে উন্নীত হবার সময় এলো, তখন বাজেটের ঝামেলার কারণে করা হলো না। কিন্তু তাকে আবার সেইন্ট জর্জ দুর্গে পোস্টিং দেয়া হলো, কারণ সেটি ছিল সবচেয়ে আকর্ষণীয় জায়গা। তাছাড়া তার বেতনও বাড়ল, আর বিভিন্ন কেনাকাটায় অনেক ছাড় পেতেন তিনি।

এ সময় মানসিক ভারাক্রান্ত হয়ে পড়ায় ক্লাইভ ছুটিতে গেলেন বঙ্গে। এক বছর বাদে তিনি মাদ্রাজে ফিরে এলেন। এসেই দ্বিতীয় কর্ণাটক যুদ্ধে অসীম বীরত্ব দেখিয়ে দিলেন, বিশেষ করে আর্কট অভিযানে তিনি তার বাহিনীর একজনেরও প্রাণ হারানো ব্যতীত জয় ছিনিয়ে আনেন। তাই ১৭৫৩ সালে তিনি যখন লন্ডনে গেলেন তখন তাকে বীরের সংবর্ধনা দেয়া হলো। প্রধানমন্ত্রী তাকে স্বর্গ থেকে আসা এক জেনারেল হিসেবে অভিহিত করলেন, যদিও তার কোনোই ট্রেনিং ছিল না। ৭০০ পাউন্ড অর্থমূল্যের জহরতের তরবারি তাকে উপহার দেয়া হয়। লর্ড ক্লাইভ সে তরবারি নিতে অস্বীকার করলেন, যদি না তার ঊর্ধ্বতন মেজর লরেন্সও একই সম্মান পান। তাছাড়া তিনি মেম্বার অফ পার্লামেন্টও হয়ে যান! উল্লেখ্য, লন্ডনে ফিরবার আগে তিনি মার্গারেট মাস্কেলাইন নামের এক নারীকে বিয়ে করেন।

আর্কট অভিযানে; Source: Wikimedia Commons

১৭৫৫ সালে ক্লাইভ ভারতে চলে গেলেন আবার। এবার তার দায়িত্ব সেইন্ট ডেভিড দুর্গের ডেপুটি গভর্নর। তিনি জাহাজে আসার সময় তেত্রিশ হাজার পাউন্ড মূল্যের সোনার মুদ্রা হারান সমুদ্রগর্ভে। আড়াইশ বছর বাদে ১৯৯৮ সালে সে মুদ্রাগুলো উদ্ধার করে বিক্রি করা হয়।

ব্রিটিশ আর্মির লেফটেন্যান্ট কর্নেল হিসেবে পদোন্নীত হন ক্লাইভ। ঘেরিয়া দুর্গ জয়ের সময় খুব কম ক্ষয়ক্ষতির মধ্য দিয়েই জিতে যান ক্লাইভ। তবে তিনি যুদ্ধ জয়ের পর অধিকৃত সম্পদের ভাগাভাগিতে অংশ নিতেনই না একদম।

এরপর ক্লাইভ ফিরে এলেন আবার তার ডেপুটি গভর্নরের কাজে, সেইন্ট ডেভিড দুর্গে। এখানে এসে দুটো খারাপ খবর শুনলেন। প্রথমত জানতে পারলেন, আলীবর্দি খানের পর তার নাতি সিরাজ-উদ-দৌলা বাংলার নবাব হয়েছেন ১৭৫৬ সালে। পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদের হুগলি নদীর তীরের কাশিমবাজারে ইংরেজদের আক্রমণ করেছেন সিরাজ-উদ-দৌলা, আর কিছুদিন বাদে ২০ জুন তারিখে কলকাতার দুর্গও দখল করে নিয়েছেন। আর দ্বিতীয়ত আর্থিক ক্ষতি, কলকাতার পতনে ২০ লাখ পাউন্ড ক্ষতি হয়েছে ইংরেজদের। শুনতে পেলেন, বন্দি ব্রিটিশদের নাকি রাখা হয়েছে কলকাতার কুখ্যাত কৃষ্ণগহ্বরে। বলা হয়, অতি গরমে ১৪৬ বন্দির মাঝে ১২৩ জনই মারা যান। তবে এই ব্ল্যাক হোল বা কৃষ্ণ গহ্বরের কাহিনী নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা আদৌ জানতেন কি না সন্দেহ আছে।

ক্লাইভের মনে তখন প্রতিশোধ চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে। ১৭৫৬ সালের বড়দিন পর্যন্ত তিনি নবাবের কাছে পাঠানো কোনো চিঠির উত্তর পেলেন না। তখন অ্যাডমিরাল ওয়াটসন এবং ক্লাইভের উপর নির্দেশ এলো জোর-জবরদস্তি করে হলেও নবাব সিরাজ-উদ-দৌলাকে কলকাতা থেকে সরাতে নবাবের সেনাবাহিনীকে আক্রমণ করতে।

প্রথমে, চব্বিশ পরগনার বাজবাজ দুর্গ ক্লাইভ স্থলপথে আক্রমণ করলেন, আর ওয়াটসন বোমা মারতে লাগলেন সমুদ্র থেকে। ব্রিটিশ ক্ষয়ক্ষতি ছাড়াই দুর্গ দখল করে ফেললেন ক্লাইভ। ঠিক এত সহজেই জানুয়ারি মাসের দুই তারিখে কলকাতাও একইভাবে অধিকার করে নেন ক্লাইভ।

এক মাস পর, ১৭৫৭ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি, ক্লাইভের সাথে মুখোমুখি হলো নবাবের নিজের সেনাবাহিনী। নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার সেনাবাহিনীতে চল্লিশ হাজার অশ্বারোহী, ষাট হাজার পদাতিক এবং ত্রিশটি কামান ছিল। আর ওদিকে ক্লাইভের বাহিনীতে ছিল মাত্র ৫৪০ জন ব্রিটিশ পদাতিক, ৬০০ নেভি নাবিক, ৮০০ স্থানীয় সেপাহী; কোনো অশ্বারোহী ছিল না।

৫ ফেব্রুয়ারি ভোরে, নবাবের শিবিরে ঝটিকা আক্রমণ করেন ক্লাইভ। আক্রমণ করেই তিনি বাহিনীসহ চলে আসলেন উইলিয়াম দুর্গে। এ আক্রমণ করতে গিয়ে সেনাবাহিনীর পাঁচ ভাগের এক ভাগ হারান তিনি। তবে নবাবের জন্য সুখকর কিছুও ছিল না এটা।তিনি ক্লাইভের সাথে সমঝোতায় আসতে চান। নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা কলকাতার নিয়ন্ত্রণ ৯ ফেব্রুয়ারি ক্লাইভের হাতে দিয়ে দেন, আর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির যা ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তা পূরণ করে দিতে রাজি হন, এবং হারিয়ে যাওয়া অধিকার ফিরিয়ে দেবার অঙ্গীকার করেন।  

ওদিকে ক্লাইভের জন্য যেন কাটা ঘায়ে নুনের ছিটার মতো ফরাসি আক্রমণ আবার ছুটে এল। নবাব এবার চাইলেন ফরাসিদের সাহায্য করতে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে। কিন্তু নবাবের সভাসদরা ষড়যন্ত্র করতে থাকেন যেন নবাবের এ পরিকল্পনা ভেস্তে যায়।

নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার সেনাপতি ‘মীর জাফর’ নামে পরিচিত জাফর আলী খান ছিলেন ষড়যন্ত্রকারীদের নেতা। ক্লাইভ অলিখিত অঙ্গীকার করেন যে, তিনি মীর জাফরকে বাংলা বিহার উড়িষ্যার সুবেদার (ভাইসরয়) বানাবেন; মীর জাফর কলকাতার ক্ষতিপূরণ হিসেবে ১০ লক্ষ পাউন্ড দেবেন কোম্পানিকে, ৫ লক্ষ দেবেন স্থানীয় ব্রিটিশদের আর ৭০০০০ পাউন্ড দেবেন আর্মেনীয় বণিকদের।

মীর জাফর আর ব্রিটিশদের মাঝে এজেন্ট হিসেবে কাজ করেন উমিচাঁদ নামের এক ধনী বাঙালি ব্যবসায়ী। উমিচাঁদ অবশ্য চোরের উপর বাটপারি করতে চাইলেন। তাকে ৩ লক্ষ পাউন্ড দিতে হবে। বিবেকবর্জিত ক্লাইভ তাকে নকল ডকুমেন্ট দেখিয়ে স্বাক্ষর করিয়ে নিতে চাইলেন, কিন্তু অ্যাডমিরাল ওয়াটসন এতে সায় বা স্বাক্ষর দিতে রাজি হলেন না।

১৭৫৭ সালের পুরো গ্রীষ্ম জুড়ে আলাপ চলল। কিন্তু অবশেষে ২১ জুন তারিখে বর্ষার প্রথম বর্ষণে পলাশীর আম্রকাননে হাজির হলেন ক্লাইভ। তার বাহিনীতে ১১০০ ইউরোপীয় আর ২১০০ স্থানীয় সিপাহী। আর নবাবের বাহিনীতে ১৮০০০ অশ্বারোহী, ৫০০০০ পদাতিক আর আরো অনেক কিছু।

পলাশীর আম্রকাননে স্মৃতিস্তম্ভ; Source: My Vacation on Roads

জীবনে প্রথমবারের মতো ইতস্তত করলেন ক্লাইভ। ১৬ জন অফিসারের মিটিং ডাকলেন তিনি। প্রস্তাব দিলেন, যদি কোনো মিত্র এসে যোগদান না করে, বা স্থানীয় বাড়তি সাহায্য না আসে তবে নবাব সিরাজ-উদ-দৌলাকে আক্রমণের ফলাফল ভালো হবে না। নিশ্চিত হার।

শিল্পীর তুলিতে পলাশীর যুদ্ধ; Source: Probashi

ক্লাইভসহ নয় জন বিলম্ব করার পক্ষে ভোট দিলেন। কথিত আছে, তিনি গাছের ছায়ায় এক ঘণ্টা একাকি দাঁড়িয়ে ভেবেছিলেন কী করবেন, তখনো তিনি জানতেন না পলাশীর যুদ্ধ ইতিহাসবিখ্যাত এক যুদ্ধ হতে চলেছে। কিন্তু কোনো এক কারণে, কিংবা হয়ত মীর জাফরের কাছ থেকে পত্র পাবার পরপর, তিনি মতামত পরিবর্তন করলেন, এবং সাথে সাথে আক্রমণের সিদ্ধান্ত নিলেন।

ভারী বর্ষণে নবাবের সেনাবাহিনীর বারুদ ভালোভাবে রক্ষিত হয়নি। ফলে ব্রিটিশ গোলাবারুদের কাছে নস্যি হয়ে পড়ল প্রায় বারুদবিহীন নবাব সেনাবাহিনী, ৫০০ সেনা হারায় তারা। ২৩ জুন যুদ্ধ অনুষ্ঠিত হলো সারা দিন। কিন্তু অবাক করা ব্যাপার হলো, সত্যিকারের ‘সম্মুখ’ কোনো যুদ্ধ বলতে গেলে হয়ইনি, হলেও খুব কম।

ক্লাইভ ইতোমধ্যে জগতশেঠ আর মীর জাফরের সাথে গোপন চুক্তি করে ফেলেছিলেন। নবাবের সেনাবাহিনীর বিশাল অংশ যুদ্ধক্ষেত্র থেকে সরিয়ে ফেললেন মীর জাফর, যেন নবাব হেরে যান। 

পলাশীতে দেখা করছেন ক্লাইভ মীর জাফরের সাথে; Source: Wikimedia Commons

ক্লাইভের পক্ষে মাত্র ২২ জন সিপাহী মারা যায়, আর ৫০ জন আহত হয়। এতই কম ছিল তার ক্ষয়ক্ষতি। এটা সত্যি যে, এ যুদ্ধের ফলে ব্রিটিশ সেনাবাহিনী তার আধিপত্য বিস্তার করে ভারতবর্ষে। কিন্তু তার মানে এই না যে, সাথে সাথেই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির জয়জয়কার শুরু হয়ে যায়। সেটা হয়েছিল আরো পরে, সাত বছর পর বক্সারের যুদ্ধে, তবে সে অন্য কাহিনী।

সিরাজ-উদ-দৌলা উটের পিঠে করে যুদ্ধক্ষেত্র ত্যাগ করেন। তবে মীর জাফরের অধীনস্থরা শীঘ্রই তাকে ধরে ফেলে এবং পরে গুপ্তঘাতক মোহাম্মদী বেগ তাকে হত্যা করে।

ক্লাইভ মুর্শিদাবাদে গিয়ে যেমনটা কথা দিয়েছিলেন মীর জাফরকে নবাব বানিয়ে দিলেন। ক্লাইভকে নিয়ে যাওয়া হলো কোষাগারে। সেখানে লাখ লাখ সোনা রুপার পাত্র, জহরত ছিল। ক্লাইভকে জিজ্ঞেস করা হলো তিনি কী নিতে চান। তিনি তৎকালীন সময়ের এক লাখ ষাট হাজার পাউন্ডের জিনিস নিলেন। পাঁচ লাখ পাউন্ড সেনাবাহিনীর আর ইস্ট ইন্ডিয়া নেভির মাঝে বিলিয়ে দেয়া হয়। কোম্পানির কমিটির প্রত্যেককে ২৪ হাজার পাউন্ড করে উপহার দেয়া হয়। কোম্পানির বাৎসরিক আয় এক লাখ পাউন্ডে দাঁড়ায়।

মীর জাফরকে হটাতে যখন মুঘল যুবরাজ আলি গওহর এগিয়ে আসেন বিশাল সেনাবাহিনী নিয়ে, তখন মীর জাফরের আত্মারাম খাঁচা ছেড়ে যাবার উপক্রম হয়। তিনি ক্লাইভের সাহায্য চাইলেন। ক্লাইভ সাহায্য করলেন না। করলেন মেজর জন ক্যাইলড, তিনি গওহরের সেনাবাহিনীকে পরাজিত করলেন।

১৭৬০ সালে অবসর নিয়ে ক্লাইভ ফিরে এলেন ব্রিটেনে। অশেষ সম্পদের অধিকারী তিনি তখন। তিনি বাবা-মা আর বোনদের আর্থিক সহায়তা করতে থাকলেন। তাকে নেপোলিয়নের সাথেও তুলনা করা হয়।

ব্রিটেনে তিনি রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হবার চেষ্টা করলেন। তাকে পলাশীর ব্যারন ক্লাইভ বানানো হয়। ১৭৬১ সাল থেকে মৃত্যুর আগপর্যন্ত তিনি পার্লামেন্টের সদস্য ছিলেন। ১৭৬২ সালে দু’বছরের জন্য মেয়রও হয়েছিলেন তিনি। অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি তাকে সম্মানসূচক সিভিল ল’য়ের ডক্টরেট ডিগ্রি প্রদান করে ১৭৬০ সালেই। ১৭৬৪ সালে তাকে একজন ‘নাইট অফ দ্য বাথ’ করা হয়।

সুখের সময় তার বেশিদিন থাকল না। ব্রিটেনে বসে তিনি শুনতে লাগলেন সব খবর, মীর জাফরের পতন, তার জামাতার ক্ষমতা লাভ, আর এরপর যা যা হলো। ক্লাইভের কীর্তির কারণে দুর্নীতিতে ছেয়ে গেছে পুরো কোম্পানি। তাই কোম্পানির নীতিনির্ধারকরা তাকে জোর করে আবার বঙ্গে পাঠালেন, সব ঠিকঠাক করতে, এবার তার দায়িত্ব একইসাথে গভর্নর ও সেনাপতি।

১৭৬৫ সালে কলকাতায় এসেই ক্লাইভ শুনলেন মীর জাফর মারা গেছেন, তবে তার জন্য ৭০০০০ পাউন্ড উপহার রেখে গেছেন। জানতে পারলেন, বঙ্গের সেনাবাহিনীতে হালকা বিদ্রোহ হয়েছে। ক্লাইভের সামনে তখন এক সুবর্ণ সুযোগ, বাংলায় তিনি যা করে যেতে পেরেছেন সেই একই জিনিস তিনি উত্তর প্রদেশেও করতে পারেন। উত্তর প্রদেশ তার হাতের মুঠোয় চলে আসতে পারে। তিনি করবেন কি সেটা? না, করেননি। তিনি বরং মনোযোগ দিলেন কিভাবে বাংলা থেকেই আয় বাড়ানো যায়।

ভারতবর্ষে সরকারি চাকরি যারা করতেন তাদের বেতন বৃদ্ধি করলেন ক্লাইভ। ভারতীয়দের থেকে ‘উপহার’ গ্রহণ নিষিদ্ধ করলেন। তিনি সেনাবাহিনীতে যা করে গিয়েছিলেন সেটা ছিল আরো কার্যকরী। তবে তার পূর্ব কীর্তি এতটাই সুদূরপ্রসারী প্রভাব রেখেছিল যে, বাংলা থেকে আয় ২০% বেশি আশা করা হত এরপর থেকে। এর খারাপ প্রভাব পরে পরবর্তী বছরগুলোতে, বিশেষ করে, ১৭৭০ সালের দুর্ভিক্ষের সময়।

১৭৬৭ সালে ক্লাইভ ভারত ত্যাগ করেন, আর কোনো দিন ফেরত আসেননি। পরের বছর তাকে রয়াল সোসাইটির ফেলো করা হয়। মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলম (আলি গওহর) তাকে দিলার জং (যুদ্ধে সাহসী), সাইফ জং (যুদ্ধের তরবারি) ইত্যাদি নানা উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন।

মুঘল সম্রাটের সাথে ক্লাইভ; Source: Wikimedia Commons

১৭৭২ সালে পার্লামেন্টে ভারতবর্ষে কোম্পানির অনিয়ম নিয়ে প্রশ্ন ওঠে, আর সেখানে ক্লাইভকে তুলোধুনো করা হয়। ক্লাইভ অবশ্য নিজের পক্ষে সাফাই গান। এরপরও তার নানা উপাধি পাওয়া থেমে থাকেনি।

ছিয়াত্তরের মন্বন্তরে বাংলার জনসংখ্যার ৬৬% মারা যায়। কোম্পানির অতি লোভই এই দুর্ভিক্ষের কারণ ছিল বলে ধারণা করা হয়। আর এর মানে পরোক্ষ দোষ আসলে ক্লাইভেরই। ফলে, ক্লাইভের প্রভাব ইংল্যান্ডে কমে যায়। দুর্ভিক্ষ শেষে কোম্পানির নিয়ন্ত্রণের জন্য নতুন আইন পাশ হয় পার্লামেন্টে। ক্লাইভ এমনটাও বলেছিলেন, “আমার ধন সম্পদ নিয়ে যাও, তবুও আমার সম্মান কেড়ে নিও না।”

১৭৭৪ সালের ২২ নভেম্বর ক্লাইভ মাত্র ৪৯ বছর বয়সে লন্ডনে নিজের বাসায় প্রাণ হারান। কিন্তু কীভাবে? কথিত আছে, তিনি নিজেই নিজেকে ছোড়া মারেন, কিংবা ছুরি দিয়ে নিজের গলা কেটে ফেলেন। কেউ বলেন, তিনি ব্রেন স্ট্রোকে মারা যান। আবার এটাও বলা হয়েছে, তিনি আসলে হার্ট অ্যাটাকে মারা গিয়েছিলেন, যা হয়েছিল বেশি ড্রাগ নেবার কারণে। তিনি আফিমখোর ছিলেন। 

স্কুলে তাণ্ডব সৃষ্টিকারী ক্লাইভের ডেস্কখানা এখনো সংরক্ষণ করা আছে। তার পোষা কচ্ছপ ‘অদ্বিতীয়’র বয়স ১৫০-২৫০ বছর ছিল ২০০৬ সালে কলকাতা চিড়িয়াখানায় মারা যাবার সময়। 

পলাশীর যুদ্ধের সময় ইতিহাসের মোড় ঘুরিয়ে দেয়া রবার্ট ক্লাইভের বয়স ছিল মাত্র ৩২ বছর। ত্রিশের দরজায় পা রাখা মানুষটি ১৯০ বছরের জন্য স্বাধীনতার সূর্য হরণ করে নেন বাংলার তথা ভারতবর্ষের। এক দেশের খলনায়ক যেমন অন্য দেশের নায়ক, এখানে সন্ত্রাসী তো যেমন ওখানে বীর- তেমনই ক্লাইভ এই কাজের জন্য ব্রিটেনে হয়েছিলেন সমাদৃত। কারণ আর যা-ই হোক, তার স্বার্থ পূরণ হোক আর যা-ই উদ্দেশ্য থাকুক না কেন, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তথা ব্রিটিশদের লাভই হয়েছিল। তবে তাকে অপমানের গ্লানি নিয়েই মরতে হয়েছিল শেষ পর্যন্ত।

নিরপেক্ষ ইতিহাসে তাই রবার্ট ক্লাইভ তাই এক বিতর্কিত চরিত্র। আর উপমহাদেশের বুকে একজন খলনায়ক। বিশাল এক খলনায়ক।

ফিচার ইমেজ: Art UK

Related Articles