Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

হোরেশিও নেলসন || পর্ব ১ || নেপোলিয়নকে পরাজিত করেছিলেন যে ব্রিটিশ নৌসেনাপতি

ভাইস অ্যাডমিরাল অফ দ্য হোয়াইট হোরেশিও নেলসন, ফার্স্ট ভিসকাউন্ট নেলসন, ফার্স্ট ডিউক অফ ব্রোন্তে, কেবি। এটিই ছিল লর্ড নেলসনের ‘সংক্ষিপ্ত’ উপাধি। তবে এটিই তার একমাত্র পরিচিতি নয়। অনন্যসাধারণ সমরনায়ক, কুশলী নৌ–কৌশলবিদ, ইংল্যান্ডের প্রখর দেশপ্রেমিক, ব্রিটেনের রক্ষাকর্তা– নানান ধরনের পরিচিতি তার। বিবিসির জরিপ অনুযায়ী, তিনি ইতিহাসের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ১০ ব্রিটিশ নাগরিকের মধ্যে একজন।

তিনি সবচেয়ে বেশি খ্যাতি অর্জন করেছেন ফরাসি মহাবীর নেপোলিয়নকে পরাজিত করার মধ্য দিয়ে। লর্ড নেলসন হলেন সেই ব্যক্তি, যিনি প্রাচ্যে ও পাশ্চাত্যে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তারে নেপোলিয়নীয় পরিকল্পনাকে নস্যাৎ করে দিয়েছিলেন।

হোরেশিও নেলসন ১৭৫৮ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর ব্রিটেনের নরফোক কাউন্টির বার্নহ্যাম থোর্প গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম ছিল এডমুন্ড নেলসন এবং মায়ের নাম ছিল ক্যাথেরিন সাকলিং। পেশাগত দিক থেকে নেলসনের বাবা ছিলেন একজন গ্রাম্য পাদ্রি। ১১ ভাইবোনের মধ্যে নেলসন ছিলেন ষষ্ঠ। স্বাভাবিকভাবেই নেলসনের শৈশব ও কৈশোর অতিবাহিত হয় দারিদ্রের মধ্যে। ১২ বছর বয়স পর্যন্ত নরফোক কাউন্টির নর্থ ওয়ালশাম শহরে অবস্থিত ‘প্যাস্টন গ্রামার স্কুলে’ পড়াশোনা করেন এবং পরবর্তীতে নরউইচ শহরে অবস্থিত ‘কিং এডওয়ার্ড দ্য সিক্সথ গ্রামার স্কুলে’ অধ্যয়ন করেন।

১৭৭১ সালের ১ জানুয়ারি নেলসন ব্রিটিশ নৌবাহিনীর (আনুষ্ঠানিকভাবে ‘রাজকীয় নৌবাহিনী’ বা ‘Royal Navy’) যুদ্ধজাহাজ ‘এইচএমএস রেইজোনেবল’–এ একজন সাধারণ নাবিক হিসেবে যোগদান করেন। জাহাজটির অধিকর্তা ছিলেন তার মামা ক্যাপ্টেন মরিস সাকলিং। নেলসনের জীবনে তার এই মামার ভূমিকা ছিল বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ, কারণ তার বদৌলতেই নেলসনের জীবনের অগ্রগতির সূচনা ঘটে। শীঘ্রই ক্যাপ্টেন সাকলিং তার ভাগ্নেকে জাহাজটির মিডশিপম্যান নিযুক্ত করেন এবং নেলসনকে একজন নৌ কর্মকর্তা হিসেবে গড়ে তোলার জন্য প্রশিক্ষণ দিতে শুরু করেন। এ সময় নেলসন আবিষ্কার করেন, তিনি ‘সি সিকনেস’ (sea sickness) তথা সামুদ্রিক গতিজনিত অসুস্থতার রোগী। আজীবন নেলসনকে এই সমস্যায় ভুগতে হয়েছে। এটি আশ্চর্যের বিষয় যে, আজীবন সি সিকনেসে আক্রান্ত একজন ব্যক্তিই কিনা ব্রিটেনের সবচেয়ে খ্যাতিমান নৌসেনাপতিতে পরিণত হন!

উষ্ণ ক্যারিবিয়ান থেকে বরফাচ্ছন্ন আর্কটিক

১৭৭১ সালের জুলাইয়ে ক্যাপ্টেন সাকলিংকে ‘এইচএমএস ট্রায়াম্ফ’ নামক অপর একটি যুদ্ধজাহাজে বদলি করা হয়, আর নেলসনকে সমুদ্রযাত্রার অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য ‘মেরি অ্যান’ নামক একটি বাণিজ্যিক জাহাজে প্রেরণ করা হয়। ১৭৭১ সালের ২৫ জুলাই নেলসন এই জাহাজে চড়ে ব্রিটেনের কেন্ট থেকে ক্যারিবিয়ান অঞ্চলের উদ্দেশ্যে রওনা হন। তিনি জ্যামাইকা ও টোবাগো সফর করেন এবং ১৭৭২ সালের ৭ জুলাই ব্রিটেনের প্লাইমাউথে প্রত্যাবর্তন করেন। এরপর তিনি তার মামা ক্যাপ্টেন সাকলিংয়ের যুদ্ধজাহাজের একটি লংবোটের কমান্ডার নিযুক্ত হন।

একটি চিত্রকর্মে নেলসনের মামা ও পৃষ্ঠপোষক কম্পট্রোলার অফ দ্য নেভি মরিস সাকলিং; Source: history.com

কিছুদিন এ দায়িত্ব পালনের পর নেলসন কনস্ট্যান্টাইন ফিপসের নৌ অভিযানে যোগ দেন। ফিপস ছিলেন একজন ব্রিটিশ অভিযাত্রী এবং ব্রিটিশ নৌবাহিনীর একজন কর্মকর্তা। সেসময় ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতীয় উপমহাদেশের আধিপত্য বিস্তার করতে শুরু করেছিল। তখন কোম্পানিটির অধীনে ছিল বাংলা (বর্তমান বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গ প্রদেশ), বিহার (বর্তমান ভারতের বিহার ও ঝাড়খণ্ড প্রদেশ) উড়িষ্যা, সুরাট, বোম্বাই (বর্তমান মুম্বাই) ও মাদ্রাজ (বর্তমান চেন্নাই)। সেসময় ভারতবর্ষে পৌঁছানোর স্থলপথ ব্রিটিশদের নিয়ন্ত্রণে ছিল না। তাদেরকে তখন দক্ষিণ আফ্রিকার নিকটবর্তী উত্তমাশা অন্তরীপ (Cape of Good Hope) ঘুরে সমুদ্রপথে ভারতবর্ষে আসতে হতো। এই পথটি ছিল খুবই দীর্ঘ এবং তখনো সুয়েজ খাল তৈরি হয়নি।

এজন্য ব্রিটিশরা আর্কটিক বা উত্তর মেরুর মধ্য দিয়ে ভারতীয় উপমহাদেশে পৌঁছানোর পথ খুঁজছিল, কারণ তাদের ধারণা ছিল, এই পথটি অন্য পথগুলোর তুলনায় সংক্ষিপ্ত হবে। ফিপস এই পথ আবিষ্কার করার জন্য একটি অভিযান পরিচালনা করেন এবং ক্যাপ্টেন সাকলিং এই অভিযানে তার ভাগ্নে নেলসনকে অন্তর্ভুক্ত করে দেন। ফিপসের নৌবহর আর্কটিকের সন্নিকটে পৌঁছায়, কিন্তু বরফাচ্ছন্ন আর্কটিক মহাসাগর অতিক্রম করা তাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। এজন্য ব্রিটিশরা তাদের উদ্দেশ্য পূরণ ব্যতিরেকেই প্রত্যাবর্তন করতে বাধ্য হয়। ১৭৭৩ সালের সেপ্টেম্বরে নেলসন ব্রিটেনে ফিরে আসেন এবং এইচএমএস ট্রায়াম্ফে পুনরায় দায়িত্ব লাভ করেন।

ভারতীয় উপমহাদেশে নেলসন: মহীশূর ও মারাঠাদের সঙ্গে সংঘর্ষ

এরপর নেলসন ভারতবর্ষে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন এবং ‘এইচএমএস সিহর্স’ জাহাজে চড়ে ১৭৭৩ সালের ১৯ নভেম্বর তদানীন্তন মাদ্রাজে পৌঁছান। উল্লেখ্য, সেসময় মাদ্রাজ ছিল ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘাঁটি। জাহাজটি ১৭৭৪ সালের ২৫ মে পর্যন্ত মাদ্রাজের উপকূলে অবস্থান করে। এ সময় বস্তুত সমুদ্রে প্রমোদভ্রমণ করে বেড়ানো আর বাণিজ্যিক জাহাজগুলোকে সুরক্ষা দেয়া ছাড়া এইচএমএস সিহর্সের (এবং নেলসনের) কোনো কাজ ছিল না। কিন্তু এরপর শুরু হয়ে যায় প্রথম ইঙ্গ–মারাঠা যুদ্ধ (১৭৭৫–১৭৮২)। যুদ্ধটি সংঘটিত হচ্ছিল মূলত ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এবং মারাঠা সাম্রাজ্যের মধ্যে, কিন্তু ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ছিল ব্রিটিশ সরকারের সক্রিয় সমর্থনপুষ্ট এবং এজন্য ব্রিটিশ নৌবহর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পক্ষে যুদ্ধ করতে শুরু করে।

মানচিত্রে আর্কটিক অতিক্রমকারী ‘উত্তরাঞ্চলীয় সমুদ্রপথ’। ব্রিটিশরা ভারতে পৌঁছানোর জন্য এই পথের সন্ধান করছিল; Source: Wikimedia Commons

যুদ্ধ শুরুর পর ১৭৭৫ সালের প্রথম দিকে এইচএমএস সিহর্সকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কোষাগার মাদ্রাজ থেকে বোম্বেতে (বর্তমান মুম্বাই) স্থানান্তরিত করার দায়িত্ব প্রদান করা হয়। নেলসনও এই অভিযানে অংশ নিয়েছিলেন। পথিমধ্যে ১৯ ফেব্রুয়ারি মহীশূরের সুলতান হায়দার আলীর নৌবাহিনী ব্রিটিশ জাহাজটির ওপর আক্রমণ চালায়। কিন্তু একটি সংক্ষিপ্ত লড়াইয়ের পর ব্রিটিশ নাবিকরা এই আক্রমণ প্রতিহত করতে সক্ষম হয়। এটি ছিল নেলসনের জীবনের প্রথম নৌযুদ্ধের অভিজ্ঞতা। বছরের বাকি সময় জুড়ে এইচএমএস সিহর্স ভারত মহাসাগরে ব্রিটিশ বাণিজ্যিক জাহাজগুলোকে সুরক্ষা প্রদানের কাজে নিয়োজিত ছিল। এ সময় নেলসন জাহাজ চালনায় পারদর্শী হয়ে ওঠেন।

কিন্তু ১৭৭৬ সালের প্রথমদিকে তিনি ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হন এবং গুরুতরভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন। ১৪ মার্চ তাকে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেয়া হয় এবং তিনি ‘এইচএমএস ডলফিনে’ চড়ে ব্রিটেনের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। যাত্রাপথে তিনি প্রায় সুস্থ হয়ে ওঠেন। ১৭৭৬ সালের সেপ্টেম্বরে তিনি ব্রিটেনে পৌঁছান। ইতোমধ্যে তার মামা মরিস সাকলিং পদোন্নতি পেয়ে ‘কম্পট্রোলার অফ দ্য নেভি’ পদে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন। তিনি পুনরায় তার ভাগ্নেকে সহায়তা করেন। নেলসনকে ভারপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট হিসেবে ‘এইচএমএস ওরসেস্টার’ নামক একটি যুদ্ধজাহাজে দায়িত্ব প্রদান করা হয়। জাহাজটি ১৭৭৬ সালের ৩ ডিসেম্বর একটি বাণিজ্যিক জাহাজবহরের সঙ্গে তাদের সুরক্ষা প্রদানের উদ্দেশ্যে যাত্রা করে এবং ১৭৭৭ সালের এপ্রিলে আরেকটি বাণিজ্যিক জাহাজবহরের সঙ্গে প্রত্যাবর্তন করে।

উত্তর আমেরিকায় নেলসন: মার্কিন, ফরাসি, ও স্প্যানিশদের বিরুদ্ধে লড়াই

১৭৭৭ সালের ৯ এপ্রিল নেলসন আনুষ্ঠানিকভাবে লেফটেন্যান্ট পদমর্যাদা লাভের জন্য পরীক্ষা দেন। তার তিনজন পরীক্ষকের মধ্যে একজন ছিলেন তার মাতুল মহোদয়। সুতরাং পরীক্ষাটিতে কৃতকার্য হতে নেলসনকে বিশেষ বেগ পেতে হয়নি। লেফটেন্যান্ট পদ প্রদানের পর নেলসনকে ক্যারিবিয়ান অঞ্চলে প্রেরণ করা হয়। এ সময় উত্তর আমেরিকার ১৩টি ব্রিটিশ উপনিবেশ (পরবর্তীতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র) ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিল এবং ক্যারিবিয়ান অঞ্চল ছিল এই যুদ্ধের সবচেয়ে সক্রিয় যুদ্ধক্ষেত্র। ‘মার্কিন বিপ্লবী যুদ্ধ’ (American Revolutionary War) নামে পরিচিত এই যুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। ১৭৭৯ সালে তিনি ক্যাপ্টেন পদে উন্নীত হন এবং একটি ফ্রিগেটের কমান্ডার নিযুক্ত হন।

এরপর নেলসন নিকারাগুয়ায় স্প্যানিশ উপনিবেশগুলোর ওপর আক্রমণ পরিচালনায় অংশ নেন, কারণ স্পেন মার্কিন বিদ্রোহী/স্বাধীনতাকামীদের সহায়তা প্রদান করছিল। ১৭৮০ সালের মার্চে ব্রিটিশ সৈন্যরা নিকারাগুয়ার উপকূলে অবতরণ করে। তাদের উদ্দেশ্য ছিল সান হুয়ান নদী অতিক্রম করে কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ গ্রানাদা ও লিয়ন শহরদ্বয় অধিকার করা। এই শহরদ্বয় দখল করতে পারলে ব্রিটিশরা স্প্যানিশ আমেরিকাকে (অর্থাৎ উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকায় বিদ্যমান স্প্যানিশ ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যকে) দ্বিখণ্ডিত করে ফেলতে পারত এবং ব্রিটেন প্রশান্ত মহাসাগরে প্রবেশাধিকার পেত। এই অভিযানে নেলসন অংশগ্রহণ করেন, কিন্তু এপ্রিলে তিনি গুরুতরভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং আগস্টে তাকে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়। ব্রিটিশরা সান হুয়ান নদীর তীরে অবস্থিত স্প্যানিশ দুর্গটি দখল করতে সক্ষম হয়, কিন্তু এ সময় ব্রিটিশ বাহিনীতে পীতজ্বর (yellow fever) ছড়িয়ে পড়ে এবং প্রায় পুরো ব্রিটিশ বাহিনীই এর ফলে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। ১৭৮০ সালের নভেম্বরে অভিযানটি পরিত্যক্ত হয়। আড়াই হাজারের বেশি ব্রিটিশ সৈন্য এই অভিযানে প্রাণ হারায়।

একটি চিত্রকর্মে নেলসন এবং সান হুয়ান নদীর তীরবর্তী দুর্গ; Source: Wikimedia Commons

১৭৮১ সালের ১৫ আগস্ট নেলসনকে ‘এইচএমএস অ্যালবেমার্ল’ নামক একটি ফ্রিগেটের অধিনায়কত্ব প্রদান করা হয়। ২৩ অক্টোবর তাকে ডেনমার্কের এলসিনোর বন্দরে অবস্থানরত ‘মাস্কোভি কোম্পানি’র একটি বাণিজ্যিক জাহাজের বহরকে সুরক্ষা দিয়ে ব্রিটিশ জলসীমায় পৌঁছে দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়। উল্লেখ্য, মাস্কোভি কোম্পানি ছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অনুরূপ একটি ব্রিটিশ বাণিজ্যিক কোম্পানি, যেটি রাশিয়ায় বাণিজ্য করত। এই অভিযানের জন্য নেলসনের অধীনে তার নিজের জাহাজের পাশাপাশি ‘এইচএমএস আর্গো’ ও ‘এইচএমএস এন্টারপ্রাইজ’ নামক আরো দুইটি ফ্রিগেট দেয়া হয়। নেলসন সাফল্যের সঙ্গে এই দায়িত্ব সম্পাদন করেন, কিন্তু বন্দরে প্রত্যাবর্তনের সময় ঝড়ের কবলে পড়ে তার জাহাজ এইচএমএস অ্যালবেমার্ল প্রায় ডুবে যাওয়ার উপক্রম হয়। ১৭৮২ সালের ফেব্রুয়ারিতে নেলসন কোনোক্রমে জাহাজটিকে ব্রিটেনের পোর্টসমাউথ বন্দরে পৌঁছাতে সক্ষম হন।

এরপর জাহাজটির সংস্কার করা হয় এবং নেলসনকে আরেকটি ব্রিটিশ বাণিজ্যিক জাহাজ বহরের সুরক্ষা প্রদান করে ব্রিটিশ–অধিকৃত কানাডার কুইবেকে পৌঁছে দেয়ার জন্য নির্দেশ দেয়া হয়। ১৭৮২ সালের মে মাসে নেলসন নিউফাউন্ডল্যান্ডে (বর্তমানে কানাডার অংশ) পৌঁছান এবং সেখানে তিনি বাণিজ্য জাহাজ বহরটি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে মার্কিন জাহাজগুলোর বিরুদ্ধে অভিযান চালাতে শুরু করেন। কিন্তু তিনি কোনো মার্কিন জাহাজ দখল করতে পারেননি। অবশ্য তিনি মার্কিনিদের দখলকৃত বেশ কয়েকটি ব্রিটিশ বাণিজ্য জাহাজ উদ্ধার করতে সমর্থ হন এবং বেশকিছু ক্ষুদ্র মার্কিন মাছ ধরার নৌকা ও অনুরূপ নৌযান দখল করেন।

১৭৮৩ সালের মার্চে নেলসন ফরাসিদের কাছ থেকে গ্র্যান্ড টার্ক দ্বীপ দখল করার চেষ্টা করেন, কিন্তু এই উদ্দেশ্যে তার পরিচালিত অভিযানটি ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। পরবর্তী মাসগুলোতে তিনি শত্রুপক্ষের বেশ কয়েকটি জাহাজ দখল করতে সক্ষম হন। ইতোমধ্যে মার্কিন বিপ্লবী যুদ্ধের আনুষ্ঠানিক অবসান ঘটে এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ব্রিটেনের কাছ থেকে স্বাধীনতা অর্জন করে। ১৭৮৩ সালের জুনে তিনি ব্রিটেনে প্রত্যাবর্তন করেন।

কর্মবিরতি: বিয়ে এবং বেকারত্ব

১৭৮৪ সালে নেলসনকে ক্যারিবিয়ানগামী একটি ব্রিটিশ ফ্রিগেটের দায়িত্ব প্রদান করা হয়। তিনি মার্কিন বাণিজ্য জাহাজগুলোর বিরুদ্ধে ব্রিটিশ ‘নেভিগেশন অ্যাক্ট’ কঠোরভাবে বাস্তবায়নের প্রচেষ্টা চালান। নেভিগেশন অ্যাক্ট অনুসারে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জাহাজগুলো ইতিপূর্বে ব্রিটিশ জাহাজ হিসেবে যেসব বাণিজ্যিক সুযোগ–সুবিধা ভোগ করত, সেগুলো থেকে বঞ্চিত হয়। কিন্তু এই আইন সত্ত্বেও তারা অনুরূপ সুযোগ–সুবিধা আদায় করে আসছিল। নেলসন এই ব্যবস্থা বন্ধ করার চেষ্টা করেন। কিন্তু এর ফলে কেবল বণিক ও জাহাজের মালিকরাই নয়, স্থানীয় ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষও নেলসনের ওপরে ক্ষিপ্ত হয়, কারণ তারা নিজস্ব স্বার্থে মার্কিন জাহাজগুলোর আইন ভঙ্গ করাকে সমর্থন করছিল। এমতাবস্থায় নেলসনের পক্ষে তার দায়িত্ব পালন করা কঠিন হয়ে পড়ে।

লেডি নেলসন ওরফে ফ্রান্সেস নিসবেটের চিত্রকর্ম; Source: Wikimedia Commons

১৭৮৫ সালের মার্চে নেলসন নেভিস দ্বীপ সফর করেন এবং সেখানে ফ্রান্সেস নিসবেট নামক এক তরুণীর সাক্ষাৎ পান। নিসবেট ছিলেন বিধবা এবং তার পাঁচ বছরের একটি সন্তান ছিল। কিন্তু নেলসন ও নিসবেটের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে এবং ১৭৮৭ সালের ১১ মার্চ তারা বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। ১৭৮৮ সালে তারা স্থায়ীভাবে ব্রিটেনে ফিরে আসেন এবং নেলসনের জন্মস্থান বার্নহ্যাম থোর্পে বসতি স্থাপন করেন।

পরবর্তী পাঁচ বছর নেলসন ছিলেন কার্যত বেকার। তাকে ব্রিটিশ নৌবাহিনীর ‘রিজার্ভে’ রাখা হয় এবং অর্ধেক বেতন প্রদান করা হয়। এ সময় নেলসন কোনো একটি জাহাজের কমান্ড পাওয়ার জন্য চেষ্টা করেন, কিন্তু ধারণা করা হয়, নেলসন কর্তৃক ‘নেভিগেশন অ্যাক্ট’ কঠোরভাবে বাস্তবায়নের কারণে ব্রিটিশ নৌবাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা তার ওপর ক্ষুব্ধ ছিলেন। ফলে নেলসনকে এ সময় কোনো জাহাজের কমান্ড দেয়া হয়নি। এই বছরগুলোতে নেলসন তার অধীনস্থ যেসব নাবিককে ছাঁটাই করা হয়েছিল, তাদের কাজ খুঁজে দেয়ার চেষ্টা করেন, পারিবারিক বিষয়াদি নিয়ে ব্যস্ত থাকেন এবং নৌবাহিনীতে প্রত্যাবর্তনের জন্য সবরকম প্রচেষ্টা চালাতে থাকেন।

ভূমধ্যসাগরে নেলসন: ফরাসি ও স্প্যানিশদের বিরুদ্ধে লড়াই

এদিকে ইউরোপের রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে তখন সংঘটিত হচ্ছিল তাৎপর্যপূর্ণ পরিবর্তন। ১৭৮৯ সালে সূচনা ঘটে ফরাসি বিপ্লবের, যার ফলে ফ্রান্সে রাজতন্ত্রের পতন ঘটে এবং প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। অন্যান্য ইউরোপীয় রাষ্ট্র ফরাসি বিপ্লবের তীব্র বিরোধিতা করে। ১৭৯২ সালে বিপ্লবী ফরাসি সরকার অস্ট্রীয় নেদারল্যান্ডস (বর্তমান বেলজিয়াম) দখল করে নেয়, যেটিকে ঐতিহ্যগতভাবে ‘নিরপেক্ষ ভূমি’ হিসেবে বিবেচনা করা হতো। এমতাবস্থায় ব্রিটেন যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হতে শুরু করে। ১৭৯৩ সালের জানুয়ারিতে নেলসনকে তলব করা হয় এবং তাকে ৬৪টি কামানবিশিষ্ট যুদ্ধজাহাজ ‘এইচএমএস আগামেমনন’–এর অধিনায়কত্ব প্রদান করা হয়। পরবর্তী মাসেই ফ্রান্স ও ব্রিটেনের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়।

চিত্রকর্মে জেনোয়ার নৌযুদ্ধ; Source: Wikimedia Commons

১৭৯৩ সালের মে মাসে নেলসন ও তার অধীনস্থ যুদ্ধজাহাজ ‘এইচএমএস আগামেমনন’ ব্রিটিশ নৌবহরের সঙ্গে ভূমধ্যসাগরে পৌঁছে। তাদের উদ্দেশ্য ছিল ভূমধ্যসাগরে ব্রিটিশ আধিপত্য স্থাপন করা। এ উদ্দেশ্যে তারা ফ্রান্সের ভূমধ্যসাগরীয় বন্দরনগরী তুলোঁর নিকটে পৌঁছে। এ সময় শহরটি ফরাসি রাজতন্ত্রী ও মধ্যপন্থী প্রজাতন্ত্রীদের কর্তৃত্বে ছিল, কিন্তু ফরাসি বিপ্লবী সরকারের সৈন্যরা শহরটির দিকে অগ্রসর হচ্ছিল। শহরটির কর্তৃপক্ষ ব্রিটিশদের সহায়তা প্রার্থনা করে এবং ব্রিটিশরা তাদেরকে সাহায্য করতে রাজি হয়। কিন্তু শহর রক্ষার জন্য পর্যাপ্ত সৈন্য তাদের ছিল না। এমতাবস্থায় শহরটি রক্ষার উদ্দেশ্যে অতিরিক্ত সৈন্য সংগ্রহের জন্য নেলসনকে সার্ডিনিয়া ও নেপলসে (বর্তমান ইতালীয় ভূমিতে অবস্থিত তদানীন্তন দুইটি ক্ষুদ্র স্বাধীন রাষ্ট্র) প্রেরণ করা হয়। নেলসন তার কূটনৈতিক দায়িত্বে সাফল্য অর্জন করেন এবং ২,০০০ সৈন্যসহ ৫ অক্টোবর ফিরে আসেন।

২৬ অক্টোবর নেলসনকে কমোডর রবার্ট লিঞ্জির অধীনস্থ একটি নৌবহরের অন্তর্ভুক্ত করা হয় এবং এরপর তাকে ফরাসি–নিয়ন্ত্রিত কর্সিকা অবরোধ করার নির্দেশ দেয়া হয়। নেলসন ‘এইচএমএস আগামেমনন’, ৩টি ফ্রিগেট ও ১টি স্লুপের সমন্বয়ে গঠিত একটি ক্ষুদ্র নৌবহর নিয়ে কর্সিকা অবরোধ করেন। কর্সিকা অবরোধকালে নেলসন আহত হন এবং তার ডান চোখ প্রায় অকেজো হয়ে যায়। এদিকে ১৭৯৩ সালের ডিসেম্বরে ফরাসি প্রজাতন্ত্রী সৈন্যরা তুলোঁ দখল করে নেয় এবং এর ফলে কর্সিকা অধিকার করা ব্রিটিশদের জন্য আরো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে, কারণ ফ্রান্সের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার জন্য ফরাসি উপকূলের কাছে তাদের একটি নৌঘাঁটির প্রয়োজন ছিল। ১৭৯৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে কর্সিকা ব্রিটিশদের হস্তগত হয়।

এরপর নেলসন ভূমধ্যসাগরে ফরাসি উপকূলীয় অঞ্চলগুলোতে আক্রমণ চালানো এবং সমুদ্রে চলমান ফরাসি জাহাজগুলোতে আক্রমণ পরিচালনার কাজে নিয়োজিত হন। এ সময় তাকে জেনোয়ার (বর্তমান ইতালীয় ভূখণ্ডে অবস্থিত তদানীন্তন স্বাধীন রাষ্ট্র) সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের নির্দেশ দেয়া হয় এবং তিনি সাফল্যের সঙ্গে সেটি সম্পাদন করেন। ১৭৯৫ সালের ১৩ থেকে ১৪ মার্চ জেনোয়া উপসাগরে ব্রিটিশ ও ফরাসি নৌবহরের মধ্যে একটি যুদ্ধ অনুষ্ঠিত হয় এবং নেলসন এই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। যুদ্ধে ফরাসি নৌবহর পরাজিত হয় এবং পশ্চাৎপসরণে বাধ্য হয়।

চিত্রকর্মে সেন্ট ভিনসেন্ট অন্তরীপের নৌযুদ্ধ; Source: Wikimedia Commons

কিন্তু সামগ্রিকভাবে এ সময় যুদ্ধের গতিপ্রকৃতি ফ্রান্সের অনুকূলে যাচ্ছিল। স্থলে ফরাসিরা একের পর এক সাফল্য লাভ করছিল এবং ব্রিটিশ নৌবহরের পক্ষে এই অগ্রযাত্রা প্রতিহত করা সম্ভবপর ছিল না। ১৭৯৬ সাল জুড়ে নেলসন ব্রিটিশ মিত্রদের সমর্থন প্রদান এবং ফরাসি অগ্রযাত্রা প্রতিহত করার প্রচেষ্টা করেন, কিন্তু ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কিছু সাফল্য সত্ত্বেও পরিস্থিতি ব্রিটিশদের অনুকূলে আসেনি। এজন্য ব্রিটিশরা ভূমধ্যসাগরে তাদের ঘাঁটিগুলো পরিত্যাগ করতে বাধ্য হয় এবং জিব্রাল্টারে পশ্চাৎপসরণ করার সিদ্ধান্ত নেয়। ১৭৯৬ সালের ডিসেম্বরে নেলসন জিব্রাল্টারের উদ্দেশ্য রওনা হন।

এদিকে ১৭৯৬ সালে ফ্রান্স ও স্পেন ব্রিটেনের বিরুদ্ধে মৈত্রী স্থাপন করেছিল এবং এজন্য ব্রিটেন ও স্পেনের মধ্যে যুদ্ধাবস্থা বিরাজ করছিল। ১৭৯৭ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি অ্যাডমিরাল স্যার রবার্ট জার্ভিসের নেতৃত্বাধীন ব্রিটিশ নৌবহর পর্তুগালের নিকটবর্তী সেন্ট ভিনসেন্ট অন্তরীপের কাছে স্প্যানিশ নৌবহরকে আক্রমণ করে। নেলসন এই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন এবং বিশেষ কৃতিত্ব প্রদর্শন করেন। এই যুদ্ধের সময় নেলসন ‘সান নিকোলাস’ নামক একটি স্প্যানিশ যুদ্ধজাহাজে সসৈন্যে আরোহণ করেন এবং এসময় তিনি চিৎকার করে বলেছিলেন, “ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবে অথবা গৌরবময় বিজয়!” উল্লেখ্য, ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবে হচ্ছে লন্ডনে অবস্থিত একটি সমাধিক্ষেত্র, যেখানে কীর্তিমান ব্রিটিশদের সমাহিত করা হয়।

স্প্যানিশ নৌবহরটি ছিল অপেক্ষাকৃত বড়, কিন্তু এই যুদ্ধে ব্রিটিশরা জয়ী হয় এবং স্প্যানিশদের প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয়। এই যুদ্ধে ব্রিটিশরা কোনো যুদ্ধজাহাজ হারায়নি, অন্যদিকে স্প্যানিশদের ৪টি যুদ্ধজাহাজ ব্রিটিশদের হস্তগত হয়। এই যুদ্ধের পর নেলসনকে তার কৃতিত্বের জন্য ‘নাইট’ মর্যাদা প্রদান করা হয়। একইসময়ে তিনি ‘রিয়ার অ্যাডমিরাল অফ দ্য ব্লু’ পদে উন্নীত হন। অবশ্য তার এই পদোন্নতির সঙ্গে এই যুদ্ধে তার কৃতিত্বের কোনো সম্পর্ক ছিল না, বরং জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে তিনি এই পদোন্নতি লাভ করেছিলেন। এর মধ্য দিয়ে নেলসনের উত্থানের সূচনা ঘটে।

(এরপর দেখুন ২য় পর্ব- হোরেশিও নেলসন || পর্ব ২ || নেপোলিয়নকে পরাজিত করেছিলেন যে ব্রিটিশ নৌসেনাপতি)

Related Articles