Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

জাতি, ধর্ম, বর্ণ ও মৃত্যুর গণ্ডি পেরিয়ে যে প্রেম: মির্চা এলিয়াদ ও মৈত্রেয়ী দেবী

ইতিহাস আর সাহিত্যে অসমাপ্ত প্রেমের গল্প বরাবরই মানুষের মনে সবচেয়ে বেশি দাগ কেটেছে। এমনকি যেসব প্রেমের পরিণতিতে মধুর মিলন হয়েছে, সেসবের চাইতেও বেশি আবেদন যেন ব্যর্থ প্রেমেই লুকিয়ে থাকে। বিরহে কাতর দুটো মনুষ্য-হৃদয়ের ব্যাকুলতা মানু্ষের অন্তরকে সবসময় ছুঁয়ে যায়।

এমনই এক অসম্পূর্ণ প্রেমের উপাখ্যানের সাক্ষী হয়েছিল সত্তরের দশকের বাঙালিরা। এই প্রেমের শুরুটা কলকাতাকেন্দ্রিক হলেও পুরো ঘটনা ও এর রেশ ছড়িয়ে ছিল পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত জুড়ে।

বিবাহিতা মৈত্রেয়ী দেবী; Image Source: womeneye24

তৎকালীন বাংলার অন্যতম শিক্ষাবিদ, গবেষক ও দার্শনিক সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত ছিলেন কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ডক্টরেট। অবিভক্ত পূর্ব বাংলার রাজশাহী কলেজ, চট্টগ্রাম কলেজসহ পরবর্তীকালে কলকাতার সংস্কৃত কলেজ, প্রেসিডেন্সি কলেজের মতো প্রতিষ্ঠানে অধ্যাপনা করেছিলেন তিনি।

সুরেন্দ্রনাথের যাতায়াত ছিল পশ্চিমবঙ্গের সবচেয়ে শিক্ষিত ও প্রগতিশীল বলয়ের ভেতর, যার নেতৃত্বে ছিলেন স্বয়ং বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তিন ছেলে ও তিন মেয়ের মধ্যে সবার বড় মৈত্রেয়ী দেবী ছিল তার সবচেয়ে কাছের।

মৈত্রেয়ী একে ছিল ভীষণ সুন্দরী – তার বড় বড় কাজল-আঁকা চোখ, ছিপছিপে বাঙালি আদলে গড়া মাটির মূর্তির মতো চেহারা অনেককেই মুগ্ধ করতো। একইসাথে বয়সের তুলনায় তার বুদ্ধি, স্বভাব, গাম্ভীর্য ও বিদ্যানুরাগ তাকে তার সমসাময়িক কিশোরীদের চেয়ে আলাদা করে তুলেছিল। বাবার কাছে বাংলা, ইংরেজি, সাহিত্য, সংস্কৃতির শিক্ষা নিতে নিতে অচিরেই মৈত্রেয়ী সাহিত্যানুরাগী এক কিশোরীতে পরিণত হয়।

এরপর মৈত্রেয়ীর জীবনে আসেন রবীন্দ্রনাথ। রবীন্দ্রনাথকে সে গুরু বলে শ্রদ্ধা করতো, ভালোবাসতো। কবিগুরুও অল্পবয়েসী সেই ভক্তটিকে অগাধ স্নেহ করতেন। এভাবেই এক অসাধারণ পরিবেশে বিদ্বান বাবা, স্নেহময়ী মা, ভাইবোন, লেখাপড়া, সংস্কৃতিচর্চা ও তার হৃদয়ের খুব কাছের রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে বেড়ে উঠতে থাকেন মৈত্রেয়ী।

কৈশোরের মৈত্রেয়ী; Image Source: The Bettar India

১৯২৮ সালে ২১ বছর বয়েসী রোমানিয়ান শ্বেতাঙ্গ যুবক মির্চা এলিয়াদ, সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্তের অধীনে ভারতীয় দর্শন সম্পর্কে গবেষণা করার উদ্দেশে কলকাতায় আসে। পেয়িং গেস্ট হিসেবে অধ্যাপক দাশগুপ্তের ভবানীপুরের বাড়িতেই একটি কক্ষ নিয়ে থাকার ব্যবস্থা হয় মির্চার।

মির্চা বহু আগে থেকেই ভারতীয় সংস্কৃতির প্রতি অনুরক্ত ছিল। কলকাতায় এসে সেই অনুরাগ যেন এক অব্যক্ত ভালোবাসায় পরিণত হলো। মির্চা ভারতবর্ষ ও বিশেষ করে বাংলাকে এক কথায় ভালোবেসে ফেললো।

বাংলাকে আরও গভীরভাবে জানতে হলে বাংলা ভাষা শেখা প্রয়োজন। এই ভাবনা থেকেই প্রথম, মৈত্রেয়ীর সঙ্গে বন্ধুত্ব করার চিন্তা করে মির্চা। ওদিকে যথেষ্ট উদার ও প্রগতিশীল সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত তার কন্যাকে নিয়ে উচ্চাভিলাষী ছিলেন। তিনিও চাইলেন, মির্চার সঙ্গে বন্ধুত্ব করে তার কাছ থেকে রোমানিয়ান ভাষা শিখুক মৈত্রেয়ী, জানুক সাহিত্য ও দর্শন সম্পর্কেও।

মৈত্রেয়ী তখন ১৪ বছর বয়েসী এক উঠতি কিশোরী। কিন্তু তার ব্যক্তিত্ব ছিল বয়েসের তুলনায় অসাধারণ। পরিচয়ের ক’দিনের মধ্যেই মির্চা টের পেলো, এই বাচ্চা মেয়েটি চিন্তায় ও ব্যক্তিত্বে অত্যন্ত পরিণত। মৈত্রেয়ীর লেখা কবিতা, তার গভীর জীবনবোধ, সবকিছুই মির্চাকে বিস্মিত করত। সে মৈত্রেয়ীর কাছে একটু একটু করে বাংলা শিখছিল কিন্তু তার চেয়েও বেশি শিখছিলো বাংলা ভাষা আর সংস্কৃতির প্রতি মৈত্রেয়ীর অতুলনীয় প্রেম।

তাদের দুজনের এই বন্ধুত্ব কিছু মাসের মধ্যেই বেশ শক্তপোক্ত হয়ে উঠলো। এর মধ্যেই মৈত্রেয়ীর মাধ্যমে মির্চা জানতে পারলো রবীন্দ্রনাথকে। তাঁর প্রতি মৈত্রেয়ীর অদ্ভুত ভক্তি দেখে মির্চা অবাক হলো, সঙ্গে যেন খানিক ঈর্ষাও হলো তার।

যদিও বন্ধুত্বে এমন ঈর্ষা হওয়ার কথা নয়, কিন্তু মির্চা সত্যিই রবীন্দ্রনাথকে হিংসে করতে লাগলো। মৈত্রেয়ী তখন তাকে শেখালো, ভালোবাসা আর প্রেমের সীমানা এই বাংলার ভূমিতে কত বিস্তৃত। কবিগুরুর প্রতি তার যে প্রেম, সে প্রেম হলো সূর্য আর আকাশের মধ্যকার প্রেমের মতো। ঈশ্বর আর তার সৃষ্টির মধ্যকার প্রেমের মতো।

রোমানিয়ান যুবক মির্চা বাঙালি নারীর হৃদয়ের এই অজস্র রহস্যময় দরজাগুলোর এপারে দাঁড়িয়ে ছিল – কখন যে তার ভেতর সেই দরজার ভেতর প্রবেশের এক গোপন ইচ্ছে জন্মে গিয়েছিল, তা হয়তো মির্চা নিজেও জানতো না।

তরুণ বয়সে মির্চা এলিয়াদ, ১৯৩৩ সাল; Image Source: Wikimedia Commons

মির্চা ও মৈত্রেয়ীর গায়ের রঙ, ভাষা, ধর্ম, জাতি, সংস্কৃতি সবই আলাদা। মির্চা ছিল শ্বেতাঙ্গ, মৈত্রেয়ী গাঢ় বাদামী বর্ণের। রোমানিয়ান মির্চা ধর্ম পালন না করলেও জন্মেছিল খ্রিস্টান পরিবারে, মৈত্রেয়ীর বাবা যুক্তিবাদী দার্শনিক হলেও তাদের পরিবারটি ছিল মূলত রক্ষণশীল হিন্দু পরিবার।

তারা দুজন কথা বলতো ইংরেজিতে। প্রায়ই শব্দ খুঁজে না পেয়ে মৈত্রেয়ীকে ডিকশনারি ঘাঁটতে হতো। তবুও এই সমস্ত বাধাকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে মির্চা এলিয়াদ ও মৈত্রেয়ী দেবী পরস্পরের কাছে আসতে লাগলো। কবিতা, দর্শন, গানের আদান-প্রদানের ভেতর অনেকটা অজান্তেই, তারা হৃদয়ের আদান-প্রদান করে ফেললো।

একদিন হঠাৎ করেই বাড়ির লাইব্রেরি ঘরে বসে মির্চা মৈত্রেয়ীকে বলে বসেছিল,

“আমাকে বিয়ে করবে?’’

ভবানীপুরের বাড়ির সেই লাইব্রেরি ঘরে বসেই মির্চা আর মৈত্রেয়ী একে অন্যের কাছাকাছি এসেছিল। বাড়ির সবার চোখকে ধুলো দিয়ে তাদের বন্ধুত্ব থেকে জেগে ওঠা প্রেম সময়ের সাথে সাথে গভীর হতে লাগলো।

মির্চা ও মৈত্রেয়ী একইসাথে দিনের অধিকাংশ সময় কাটাতো। একসাথে লেখাপড়া করতো, ঘুরতে যেতো। মির্চা যেন মৈত্রেয়ীর ভেতর সমগ্র বাংলাকে দেখতে পেতো। তার কাছে বাংলার বুকে কাটানো একেকটি মুহূর্ত মৈত্রেয়ীর নামে উৎসর্গ করা ছিল।

সহজ সরল মির্চা ধরেই নিয়েছিল, সে অধ্যাপক সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্তের কাছে মৈত্রেয়ীর হাত চাওয়া মাত্রই পেয়ে যাবে, কারণ ছাত্র হিসেবে মির্চাকে খুব ভালোবাসতেন অধ্যাপক দাশগুপ্ত। রক্ষণশীল হিন্দু পরিবারের গোঁড়ামি সম্পর্কে সেভাবে কোনো ধারণাই ছিল না মির্চার।

অন্যদিকে ষোড়শী হতে চলা মৈত্রেয়ী জীবনে প্রথম প্রেমের স্বাদ পেয়েছিল। ভবিষ্যতের দুশ্চিন্তা তার হৃদয়ে সুখের সেই ফোয়ারাটিকে রোধ করতে পারতো না। বাড়িতে অনেক চাকর ও নানা লোকের যাতায়াত থাকলেও সকলেই মৈত্রেয়ীকে এত বিশ্বাস করতো ও বুদ্ধিমান বলে জানতো যে, এই সম্পর্ক নিয়ে কারোর মধ্যে কোনো সন্দেহ তৈরি হলো না।

বার্ধক্যের মির্চা; Image Source: omiedesemne.ro

মৈত্রেয়ী দেবীর ছোট বোন চিত্রিতা দেবী। ১৯৩০ সালে চিত্রিতা দেবীর বয়েস ছিল এগারো বছর। সেসময় পুরো পরিবার চিত্রিতাকে নিয়ে চিন্তিত ছিল। বয়ঃসন্ধির সময় চিত্রিতা হঠাৎ মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ে। তার কথাবার্তা, চলাফেরা সবই অস্বাভাবিক হয়ে যায়।

নানা চিকিৎসা চললেও চিত্রিতার অবস্থার তেমন পরিবর্তন হচ্ছিল না। এই সময় মৈত্রেয়ী আর মির্চা ছোট বোন চিত্রিতাকে নিয়ে বিকেলবেলা প্রায় ঘুরতে বেরোতো। এরকমই এক বিকেলে মৈত্রেয়ী আর মির্চা, চিত্রিতার হাওয়া বদলের জন্য তাকে নিয়ে ঘুরতে বেরোলো।

সেদিন মির্চা আর মৈত্রেয়ী যেন নিজেরাই নিজেদের দুর্ভাগ্যকে আমন্ত্রণ জানালো। চিত্রিতার সামনেই দুজন হঠাৎ অসাবধান হয়ে গেলো। মানসিকভাবে অস্থিতিশীল চিত্রিতার চোখে তার মির্চা দাদা আর বড় দিদির আচরণ কেমন অদ্ভুত ঠেকলো।

সন্ধ্যাবেলা বাড়ি ফিরে চিত্রিতা তার মায়ের কাছে সবটা বলে দিলো। মির্চা বা মৈত্রেয়ী তখনও জানে না, ভালোবাসার কী পরিণাম অপেক্ষা করে আছে তাদের জন্য। রাতের দিকে মৈত্রেয়ী নিজের ঘর থেকে নিচতলা থেকে ভেসে আসা বাবা-মায়ের চিৎকার চেঁচামেচি শুনতে পেলো। এ বাড়িতে সাধারণত কোনো ঝগড়াঝাঁটি হয় না। তাই মৈত্রেয়ীর কেমন জানি খুব অস্থির লাগছিল।

কিছুক্ষণ পর মা হিমানী মাধুরী দাশগুপ্ত মৈত্রেয়ীর ঘরে আসেন এক গ্লাস দুধ নিয়ে। মায়ের প্রশ্নের মুখে ক্ষতবিক্ষত হয়ে ভেঙে পড়ে কিশোরী মৈত্রেয়ী। মৈত্রেয়ীর মা সেদিন তাকে তিরস্কার করার পরিবর্তে জানতে চেয়েছিলেন, “তুমি কি মির্চাকে বিয়ে করতে চাও?”

মৈত্রেয়ী কান্না জর্জরিত কণ্ঠে তার মাকে বলেছিল, “হ্যাঁ, চাই, আমি ওকে ভালোবাসি।” কিন্তু মায়ের মুখের দিকে তাকিয়েই মৈত্রেয়ী বুঝতে পেরেছিল মির্চা আর তার বিয়ে কখনো সম্ভব নয়। অন্তত এই পরিবারের কেউ এই বিয়েতে কোনোদিন সম্মতি দেবে না।

পরদিন সকাল হতেই সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত যে ভালোবাসা আর সম্মান নিয়ে মির্চাকে এ বাড়িতে এনেছিলেন, ঠিক ততটাই অসম্মান আর ঘৃণা নিয়ে তাকে বাড়ি থেকে বের করে দিলেন।

যাওয়ার সময় বাড়ির উঠোনে দাঁড়িয়ে মির্চা একবার শেষ দেখা পেয়েছিল মৈত্রেয়ীর। মৈত্রেয়ীর দিকে তাকিয়ে দু’হাত জোর করে ‘নমস্কার’ জানিয়েছিল সে। মৈত্রেয়ীর দু’চোখ ভেঙে তখন জল গড়িয়ে পড়ছে। সেটাই ছিল মির্চা ও মৈত্রেয়ীর এক প্রকার শেষ দেখা।

বার্ধক্যেও স্নিগ্ধ মৈত্রেয়ী; Image Source: Goodreads

জীবনের প্রথম হৃদয় উথালপাথাল করা এই ব্যর্থ প্রেম ভুলতে মৈত্রেয়ী ও মির্চা, দুজনকেই প্রচুর বেগ পেতে হয়েছিল। অনেকদিন প্রায় অস্বাভাবিক হয়ে গিয়েছিল মৈত্রেয়ী।

সেসময় আবার রবীন্দ্রনাথের শরণাপন্ন হয়েছিল সে। গুরুর দেখানো পথে হাঁটতে শুরু করে ধীরে ধীরে আবার লেখাপড়ায় মনোযোগ দেয়। সঙ্গে যুক্ত হয় ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের উদ্দীপনা। পরবর্তী সময়ে যোগমায়া দেবী কলেজ থেকে দর্শনে স্নাতক হয় মৈত্রেয়ী।

ওদিকে মির্চা কিছুদিন পর ভারতবর্ষ ত্যাগ করে দেশে ফিরে যায়। কয়েক বছর পর, পারিবারিকভাবে মৈত্রেয়ী দেবীর বিয়ে হয় তার চেয়ে চৌদ্দ বছরের বড় বিজ্ঞানী মনমোহন সেনের সঙ্গে, মৈত্রেয়ীর বয়স তখন বিশ।

স্বামীর সঙ্গে মৈত্রেয়ী দেবীর জীবন কাটে মংপুর পাহাড়ি অঞ্চলে। মানুষ হিসেবে মৈত্রেয়ীর স্বামী এত সহজ সরল ও বন্ধুত্বপূর্ণ ছিলেন যে, মৈত্রেয়ী জীবনকে আবার ভালোবাসতে শিখে গেলেন। তার দুটো সন্তানও হলো।

কলকাতা শহর থেকে দূরে থাকলেও রবীন্দ্রনাথের সান্নিধ্যেই ছিলেন মৈত্রেয়ী। বিবাহিত জীবনে সাহিত্যচর্চা ও সমাজসেবা করে সমাজে একজন প্রতিষ্ঠিত মানুষ হয়ে উঠেছিলেন তিনি। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ভারতে শরণার্থী শিবিরে মৈত্রেয়ী সর্বাত্মকভাবে সেবা ও সাহায্য করেন।

ওদিকে ভারতবর্ষ ত্যাগ করার পর মির্চা এলিয়াদ তার গবেষণা, লেখাপড়ার মধ্যেই নিজেকে সঁপে দিয়েছিলেন। ভালোবাসা, সংসার যেন মির্চার ভাগ্যে কখনো স্থায়ী হতেই চাইতো না। তাইতো মৈত্রেয়ীর সাথে ব্যর্থ প্রেমের পর অভিনেত্রী সোরানা টোপার ভেতর প্রেম খুঁজতে গিয়ে আবার ব্যর্থতার স্বাদ পান তিনি। এরপর নিনা মার্সের কাছে আবারও ভালোবাসার আশ্রয় খোঁজেন মির্চা। আগে থেকেই বিবাহিত ও এক কন্যার মা নিনাকে শেষ পর্যন্ত বিয়ে করেন ও এই সংসারে থিতু হন।

তবে জীবনের মধ্য বয়সে এসে মির্চা একদম একাই ছিলেন। মৈত্রেয়ীর সাথে সম্পর্কের যে দুঃখজনক পরিণতি মির্চার হয়েছিল, সেই গভীর বেদনা আর ক্ষতকে একা বয়ে নিতে পারছিলেন না বলেই হয়তো, এই সত্য ঘটনাকে উপজীব্য করে ১৯৩৩ সালে, অর্থাৎ কলকাতা ছাড়ার ৩ বছর পর, রোমান ভাষায় উপন্যাস লা নুই বেঙ্গলি লেখেন। যাকে বাংলা করলে হয় ‘বাংলার রাত্রি’।

এই একটি উপন্যাস মির্চা এলিয়াদকে তার দেশে ঔপন্যাসিক হিসেবে রাতারাতি খ্যাতি এনে দেয়। এটি ছিল সেসময়ের রোমানিয়ান ভাষায় লেখা বেস্ট সেলার বই। সমস্ত দেশ মির্চা ও মৈত্রেয়ীর ভালোবাসার গল্প পড়ে কেঁদেছিল। ধর্ম, বর্ণ, ভাষা ও জাতীয়তার ভেদাভেদ কিভাবে মানুষের হৃদয়ের পথ আলাদা করে দেয়, তা জেনে অনেকের মনই ভারাক্রান্ত হয়েছিল।

লা নুই বেঙ্গলি বইয়ের প্রচ্ছদ; Image Source: press.uchicago.edu

লা নুই বেঙ্গলী উপন্যাসটি নিখাঁদ আত্মজীবনী ছিল না। বরং তাতে সত্যের সাথে ঘটেছিল কল্পনার মিশ্রণ। আর সেই কল্পনার অনেকটা জুড়েই ছিল যৌনতা, শারীরিক ভালোবাসা। পশ্চিমা সংস্কৃতিতে শরীরকে খুব সহজভাবেই প্রেমের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে দেখা হলেও, ভারতীয় সংস্কৃতিতে এগুলো তখন ‘স্ক্যান্ডাল’ ছাড়া কিছুই নয়।

অদ্ভুত বিষয় হলো, মির্চা যে মৈত্রেয়ীকে তার উপন্যাসে স্বপ্নের নায়িকা বানিয়েছে, সেই খবর স্বয়ং মৈত্রেয়ী জানতেন না। অনেক বছর পর সত্তরের দশকে, মধ্যবয়েসে এসে মৈত্রেয়ী যখন এই বইয়ের কথা জানতে পারেন, তখন তার ছেলে মেয়েরও বিয়ে হয়ে গিয়েছে ও তাদের নিজেদের সন্তান আছে।

মৈত্রেয়ী জানতে পারলেন, বইয়ে তার নাম স্পষ্ট অক্ষরে প্রকাশ করা হয়েছে এবং তাকে আঁকা হয়েছে নায়িকার রূপে। উপন্যাসে মির্চা লেখেন যে, কিশোরী মৈত্রেয়ী তার ঘরে রোজ রাতে আসতো এবং তাদের মধ্যে শারীরিক প্রেমও হতো। এই সমস্ত ঘটনাকে মৈত্রেয়ী ‘মিথ্যে অভিযোগ’ হিসেবে নাকচ করে দেন।

চল্লিশ বছর পর জীবনের প্রথম প্রেম আবার মৈত্রেয়ীর জীবনে ঝড় তোলে। পুরনো প্রেম তাকে নতুন করে কষ্ট দিতে থাকে। এরই মধ্যে মৈত্রেয়ীর সুযোগ আসে আমেরিকা সফরের। শিকাগো থেকে তাকে আমন্ত্রণ জানানো হয় রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে বক্তৃতা দেওয়ার জন্য। মির্চা এলিয়াদ তখন শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শনের অধ্যাপক।

লোকলজ্জার ভয় তুচ্ছ করে মৈত্রেয়ী তার স্বামীর অনুমতি নিয়েই দেখা করতে যান, তার জীবনের প্রথম ভালোবাসার সাথে। শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশাল লাইব্রেরির এক কোণায়, দীর্ঘ চল্লিশ বছর পর আবার দেখা হয় মির্চা আর মৈত্রেয়ীর।

সেই ষোলো বছর বয়েসী কিশোরী মৈত্রেয়ী কিংবা একুশ বছরের যুবক মির্চা এত দীর্ঘ সময় পরেও মহাকালের কোনো এক অংশে যেন আটকে গিয়েছিল। তাদের এই দেখা হয়তো ‘পুনর্মিলন’ ছিল না, কিন্তু এই দেখার ভেতর তারা একে অপরের হৃদয় দেখতে পেয়েছিল। বুঝতে পেরেছিল, এ জীবনে না হলেও অন্য কোনো জীবনে, অন্য কোনো জন্মে তারা এক হবেই।

জীবন সায়াহ্নে এসে ভালোবাসার কাছে এমন আত্মসমর্পণের ঘটনা হয়তো পৃথিবীতে খুব বেশি নেই, বিশেষ করে একজন বাঙালি বিবাহিত নারীর জন্য তার শৈশবের ভালোবাসার সাথে আবার দেখা করতে সুদূর শিকাগো যাওয়া তখনকার সময়ে ভাবা যেতো না।

১৯৭৪ সালে প্রকাশিত মৈত্রেয়ী দেবীর ন হন্যতে; Image Source: amazon.in

শিকাগো থেকে ফিরে লা নুই বেঙ্গলির সমস্ত অসত্য ঘটনার উত্তরে ও একইসাথে নিজের মনের গভীরে এত বছর ধরে গোপন করে রাখা এই ব্যথা থেকে মুক্তি পেতে মৈত্রেয়ী লেখেন ন হন্যতে

১৯৭৪ সালে প্রকাশিত ন হন্যতে, মৈত্রেয়ী দেবীর এতদিনের সাজানো গোছানো জীবনে তীব্র বিতর্ক ও সমালোচনার সঞ্চার করে। তার আত্মীয়স্বজন ও অনেক বন্ধুবান্ধবই এই বই প্রকাশের পর তার সাথে সম্পর্ক রাখতে পর্যন্ত অস্বীকৃতি জানায়।

সেসময়ের রক্ষণশীল সমাজে একজন বিবাহিত বৃদ্ধ নারীর তার অল্প বয়েসের প্রেমের পুঙ্খানুপুঙ্খ ঘটনা লেখাকে কোনোভাবেই ভালো চোখে দেখা হতো না। কিন্তু মৈত্রেয়ী দেবী তার ইচ্ছে ও সিদ্ধান্তে অটল ছিলেন। ‘ন হন্যতে’ এর অর্থ, যার মৃত্যু নেই। প্রেম ও আত্মার অবিনশ্বরতাকে এক করে মৈত্রেয়ী তার ও মির্চার ভালোবাসার সত্যকে নির্ভীকভাবে মানুষের সামনে তুলে আনেন। এই সত্যভাষণ তাঁকে এনে দেয় সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার।

শিকাগোতে মির্চার সাথে দেখা হওয়ার পর মৈত্রেয়ী তার কাছে জানতে চেয়েছিলেন, কেন ওরকম মিথ্যে লিখেছিলেন তার ব্যাপারে। উত্তরে মির্চা বলেছিলেন, ভেতর ভেতর নিদারুণ কষ্টে গুমরে মরছিলেন তিনি; কল্পনার কাছে আশ্রয় নেওয়া ছাড়া আর কোনো পথ-ই অবশিষ্ট ছিল না তার। সঙ্গে মৈত্রেয়ীকে কথাও দিয়েছিলেন, মৈত্রেয়ীর জীবনকালে এই বই কোনোদিন ইংরেজিতে প্রকাশ করা হবে না। ১৯৯০ সালে মৈত্রেয়ী দেবী মারা গেলে তার ৪ বছর পর ১৯৯৪ সালে ন হন্যতে ও লা নুই বেঙ্গলি দুটো বই ই একসাথে শিকাগো প্রেস থেকে ইংরেজিতে প্রকাশ করা হয়।

মির্চা ও মৈত্রেয়ীর এই অভূতপূর্ব প্রেম নিয়ে ১৯৮৮ সালে দ্য বেঙ্গলী নাইট নামের চলচ্চিত্র তৈরি করেন নিকোলাস ক্লতজ। মৈত্রেয়ীর চরিত্রে অভিনয় করেন সুপ্রিয়া পাঠক। এছাড়া বলিউডে সঞ্জয় লীলা ভনসালির হাম দিল দে চুকে সানাম চলচ্চিত্রের সাথে তাদের কাহিনীর খানিকটা মিল থাকলেও ভনসালি চলচ্চিত্রে কোনো ঋণ স্বীকার করেননি।

দ্য বেঙ্গলী নাইট সিনেমার পোস্টার; Image Source: listal.com

১৯২৮ সালে কলকাতার ভবানীপুরে শুরু হওয়া এই হৃদয় ভাসানো প্রেমের উপাখ্যানের শাখা ছড়িয়ে গেছে সুদূর ইউরোপ, আমেরিকাতেও। মির্চা এলিয়াদ ও মৈত্রেয়ী দেবীর অনিঃশেষ ভালোবাসা সে যুগের ধর্ম বর্ণ ও জাতের ভেদাভেদের কাছেও হার মানেনি। তারা তাদের ভালোবাসার মাঝেই বেঁচে আছেন। নিজেদের প্রেমকে এই ঐশ্বরিক মর্যাদা দেয়ার ক্ষমতা হয়তো সকলের হয় না, কিন্তু মৃত্যুকে অতিক্রম করা অসমাপ্ত প্রেমের এমন উপাখ্যান ভালোবাসার প্রতি মানুষের বিশ্বাসকে বাঁচিয়ে রাখে।

This article is in Bangla language. It is about the love affair of Bengali writer, poet Maitreyi Devi and Romanian philosopher Mircea Eliade.

References:

1. Eliade, M. (1995). Bengal Nights: A Novel. Chicago: University Of Chicago Press.
2. ন হন্যতে: মৈত্রেয়ী দেবী, রাধাকৃষ্ণ পাবলিকেশন

Featured Image: iván BRAVE

Related Articles