Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

মার্টিন লরেলো: যিনি নিজের মাথা ১৮০ ডিগ্রি কোণে ঘুরাতে পারতেন

আপনারা হয়তো বর্তমানে বিভিন্ন হরর সিনেমা বা টেলিভিশন সিরিজে ভূতের মাথা ঘুরিয়ে পেছনের দিকে আনাটা দেখে থাকবেন। এজন্য হয়তো আপনাদের মনে হয়ে থাকতে পারে, মাথা পেছনের দিকে আনাটা শুধু সিনেমাতে বা ফটোশপের মাধ্যমেই সম্ভব! কিন্তু আজ আপনাদের এমন এক ব্যক্তির কথা বলা হবে, যিনি সত্যিকার অর্থে নিজেই নিজের মাথা ঘুরিয়ে পেছনের দিকে আনতে পারতেন। যেটা পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব হয়েছে এ ধরনের টেলিভিশন সিরিজ বা সিনেমা প্রচার হবার বহু আগেই! তার নাম মার্টিন জো লরেলো, জন্মগ্রহণ করেছিলেন ১৮৮৫ সালে, জার্মানির নুরেমবার্গে। তিনি পুরো ১৮০ ডিগ্রি কোণে নিজের মাথা পেছনে ঘুরাতে পারতেন।

মাথা পেছনে রাখা অবস্থায় পানীয় নিচ্ছেন লরেলো; Source: thehumanmarvels.com

পূর্বে লরেলোর সময়ে মানুষের বিনোদনের অন্যতম উৎস ছিল বিভিন্ন ধরনের সার্কাস। সেসব সার্কাসের অন্যতম আকর্ষণ হিসেবে থাকতো বিভিন্ন ধরনের সার্কাস খেলোয়াড়। তাদের মধ্যে থাকতো অদ্ভুত ও ব্যতিক্রমী কিছু করে দেখানোর ক্ষমতা। পাশাপাশি আরো কিছু মানুষ থাকতেন, যারা তাদের দৈহিক বিকলাঙ্গতার কারণে অদ্ভুত সব শারীরিক দক্ষতা দেখাতে পারতেন। তাদের এই সার্কাসগুলোকে বলা হত ‘সাইড-শো’। অর্থাৎ প্রধান সার্কাস প্রদর্শনীর পাশাপাশি বিকলাঙ্গ ব্যক্তিদের অদ্ভুত সব শারীরিক দক্ষতা দেখানোরও ব্যবস্থা থাকতো।

মার্টিন লরেলো; Source: vignette.wikia.nocookie.net

এসব দৈহিক বিকলাঙ্গ ব্যক্তিরা যে শুধু জীবিকার জন্য সার্কাসে অংশগ্রহণ করতো, তা নয়। তারা ছিলেন সমাজে উপেক্ষিত ব্যক্তি। তখনকার সমাজে এ ধরনের ব্যক্তিদের কদাকার হিসেবেই বিবেচনা করা হতো, যার ফলে তারা বিভিন্ন সার্কাসের সংগঠনেই নিজেদের ঠিকানা খুঁজে নিতেন। সার্কাসই একমাত্র আশ্রয়স্থল ছিল তাদের জন্য যেখানে তারা তাদের এই দৈহিক বিকলাঙ্গতাকে লাভজনক প্রদর্শনীতে পরিণত করতে পারতেন। পাশাপাশি সার্কাসই একমাত্র স্থান ছিল তাদের জন্য, যেখানে কেউ তাদেরকে কুৎসিতরূপে দেখতো না, বরং তাদের সেসব অদ্ভুত বিকলাঙ্গতার দক্ষতা দেখে আনন্দ পেতো।  মার্টিন লরেলোও ছিলেন ঠিক এমন একজন ব্যক্তি।

বর্তমানের বিভিন্ন অ্যাকশন সিনেমায় দেখা যায়, নায়ক শুধু শত্রুর মাথায় একটা পাক দিয়ে, অর্থাৎ ঘাড় মটকিয়েই মেরে ফেলছেন। এতে আপনাদের মনে হতে পারে মাথা স্বাভাবিকের তুলনায় ঘোরানোটা অনেক বেশি কষ্টকর এবং অতিরিক্ত ঘোরানোর চেষ্টা করলে ঘাড় মটকে হয়তো মানুষের মৃত্যুও হতে পারে! হ্যাঁ, স্বাভাবিক মানুষের ক্ষেত্রে কথাটি সঠিক। আপনি চর্চা ব্যতীত নিজের মাথা বেশি দূর ঘোরাতে পারবেন না।

লরেলো তার দু’জন সহকর্মীর সাথে; Source: potd.pdnonline.com

কিন্তু লরেলোর তার নিজের মাথা ১৮০ ডিগ্রি ঘোরাতে মৃত্যু তো দূরে থাক, কোনো কষ্টই হতো না। তার ঘাড়ের বিশেষ নমনীয়তার কারণে পুরো মাথা পেছনে ঘুরিয়ে আনতে খুব একটা বেগ পেতে হতো না তাকে। তার এমন অদ্ভুত শারীরিক সক্ষমতার কারণে এটাকেই তিনি নিজের জীবিকা অর্জনের অন্যতম উপায় হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। সার্কাসে অংশগ্রহণ করার পর তিনি আমেরিকার সর্বত্র তার এই শারীরিক দক্ষতা দেখিয়ে বেড়াতেন। প্রথমদিকে তিনি ছিলেন একটি জার্মান-আমেরিকান সার্কাসের কৌশল-প্রদর্শক। অন্যান্য আরো পারফর্মারদের সাথে তিনি ১৯২১ সালে জার্মানি থেকে আমেরিকায় চলে আসেন এবং বিভিন্ন সার্কাসপার্টিতে অংশগ্রহণ করা শুরু করেন। তবে স্বাভাবিক অবস্থায় তাকে দেখতে একজন ফিটফাট মানুষই মনে হতো। কোনোভাবেই বোঝার উপায় ছিলো না যে লরেলোর এমন অঙ্গবিকৃতি থাকতে পারে।

তারা সবাই একসাথে; Source: sideshows

এভাবে নিজের এই অদ্ভুত দক্ষতা প্রদর্শনের মাধ্যমে তিনি বেশ কিছু উপাধিতে ভূষিত হোন। তাকে বলা হতো ‘চরকি মাথার বালক’, ‘পেঁচামানব‘ এবং ‘ববি’। তার এই নামগুলো এসেছে বিভিন্ন স্থানে সার্কাস করার মাধ্যমে। যেমন, বেইলি সার্কাসে পারফর্ম করার সময় তার নাম দেয়া হয়েছিল ‘ববি, চরকি মাথার বালক’! (সেসময় বয়স যতই হোক না কেন, পুরুষদের ‘বয়’ বা বালক এবং মহিলাদের ‘গার্ল’ বা বালিকা বলেই ডাকা হত)। লরেলো কনি আইল্যান্ডের সার্কাস সংগঠন ‘রিংলিং ব্রাদারস’ এবং ‘বারনাম এন্ড বেইলি সার্কাস এমিউজমেন্ট পার্ক’য়েও কাজ করেছেন। পুরো শীতকাল জুড়ে তিনি কাজ করতেন নিউ ইয়র্ক সিটির ‘হুবার্ট মিউজিয়াম’ এ। তিনি ছিলেন ‘রিপলি’স বিলিভ ইট অর নট’ এর অডিটোরিয়ামের (Odditorium) প্রথম পারফর্মারদের মধ্যেও একজন। এখানে যুক্ত থাকা অবস্থায় ১৯৩৩-৩৪ সালে শিকাগোর ‘ওয়ার্ল্ড ফেয়ারে’ পারফর্ম করার কারণেই তিনি সকলের কাছে পরিচিত হয়ে উঠেন এবং প্রচুর জনপ্রিয়তা লাভ করেন।

তাহলে তার এই যে শারীরিক দক্ষতা বা বিকলাঙ্গতা যা-ই বলা হোক, সেটা কীভাবে পেলেন তিনি? এর উত্তর হলো, তিনি জন্মগ্রহণই করেছিলেন তার স্পাইনাল কর্ডে একধরনের ত্রুটি নিয়ে। জন্মের পর দেখা যায় তার স্পাইনাল কর্ড অনেকখানি বাঁকা, যা তাকে অত্যধিক পরিমাণে ঘাড়ে নমনীয়তা প্রদান করে। এটা বলা হয়ে থাকে যে, তার স্পাইনাল কর্ড দেখতে প্রশ্নবোধক চিহ্নের (?) মত হয়ে থাকতো, যখন তিনি তার মাথা ঘুরিয়ে পেছনের দিকে আনতেন।

মার্টিন লরেলোর স্পাইনাল কর্ড; Source: Ripley’s Believe It or Not

তবে জন্মের পর থেকেই তিনি কিন্তু মাথা ঘুরিয়ে পুরোটা পেছনের দিকে আনতে পারতেন না। পুরোপুরি পেছনে আনতে তাকে অনেক পরিশ্রম এবং চর্চা করতে হয়েছে। তার এই অস্বাভাবিকতাকে কাজে লাগানোর জন্য লরেলো প্রায় তিন বছর বিভিন্ন ধরনের চর্চা করে গেছেন। তার মধ্যে কিছু চর্চা ছিল শুধু তার ঘাড়ের মেরুদণ্ডের কিছু হাড়কে স্থানচ্যুত করা, যাতে তিনি তার মাথাটা সম্পূর্ণ পেছনের দিকে আনতে পারেন! এতে তিনি সফলও হয়েছেন।

তবে কিছুটা অদ্ভুত ব্যাপার হলো মাথা পেছনে থাকা অবস্থায় তিনি মুখ দিয়ে যেকোনো তরল যেমন পানি, এলকোহল, জ্যুস পান করতে পারতেন। কিন্তু কোনোভাবেই নিঃশ্বাস নিতে পারতেন না। এমনকি তিনি ধূমপানও করতে পারতেন সে অবস্থায়। তার সবচেয়ে প্রচলিত যে ছবিটি তোলা হয়েছিল ১৯৪০ সালে, যেখানে দেখা যায় লরেলো একটি সিগার দিয়ে ধূমপান করছেন যেখানে তার মাথা ছিল পেছনের দিকে ১৮০ ডিগ্রি কোণে ঘোরানো।

‘মানবপেঁচা’; Source: pix.avaxnews.com

জানা যায়, তিনি পারফর্ম করার সময় সর্বদা সাদা শার্ট পরতেন। কেন তিনি এই বিশেষ রঙের শার্টই পরতেন, সে সম্পর্কে জানা সম্ভব হয়নি। এমনকি তিনি বিভিন্ন কুকুরদের মাথা ঘোরানোর প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন বলেও জানা যায়। সেসব কুকুর লরেলোর সাথে সাথে নিজেদের মাথাও পেছনে ঘুরাতে পারতো। এসবের পাশাপাশি তিনি একজন ‘ভেন্ট্রিলোকুইস্ট’ হিসেবেও পরিচিত ছিলেন।

সেসময়ের একটি পোস্টার; Source: Sideshows

তবে এত জনপ্রিয়তা সত্ত্বেও তাকে নিয়ে ছিল কিছু বিতর্ক। যদিও তার জীবনী নিয়ে খুব বেশি তথ্য সংগ্রহ করা নেই, তাকে ধরা হতো নাৎসি সমর্থক হিসেবে। তিনি নাকি আমেরিকার পতাকাকে মোটেও পছন্দ করতেন না! এ সম্পর্কে তার একজন সঙ্গী সার্কাস প্রদর্শক পারসিলা বারজানো বলেন, “মার্টিন এমারলিং থেকে নাম বদলিয়ে মার্টিন লরেলো করার কারণে এবং তার কিছু কর্মকাণ্ডের কারণে সবাই তাকে একজন জার্মান সমর্থক হিসেবেই ধরতো। যার কারণে তিনি তার নিকটাত্মীয় এবং আশেপাশে থাকা কারো কাছেই অতটা প্রিয়মুখ ছিলেন না”। শেষের দিকে তিনি তাই একরকম একাই হয়ে গিয়েছিলেন। এমনকি ১৯৩১ সালে তাকে পুলিশ গ্রেফতারও করেছিলো তার স্ত্রী অ্যামেলিয়া এমারলিংকে পরিত্যাগ করার জন্য। অ্যামেলিয়া নিজে একটি টেলিগ্রামের মাধ্যমে বাল্টিমোর পুলিশ ডিপার্টমেন্টে এই অভিযোগ দায়ের করেছিলেন।

তার শেষ সার্কাস প্রদর্শনী; Source: vignette.wikia.nocookie.net

তার সর্বশেষ যে সার্কাস প্রদর্শনী রেকর্ড করা হয়েছিলো, তা হচ্ছে ১৯৫২ সালের ২৪ মার্চ। প্রদর্শনীর নাম ছিল ‘ইউ আস্কড ফর ইট’। লরেলোর সার্কাস প্রদর্শনীগুলো ছাড়া তার সম্পর্কে তেমন বেশি কিছু আর জানাও যায় নি। ১৯৫৫ সালে ৭০ বছর বয়সে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে গেলে তিনি মারা যান।

ফিচার ইমেজ: mixanitouxronou.gr

Related Articles