Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

মনোজ বাজপেয়ী: এক জ্বলে ওঠা তারার গল্প

জগতে যারা সফল হয়েছেন তাদের প্রত্যেকের সাফল্যের নেপথ্যে ছিলো অনেক ত্যাগ, পরিশ্রম এবং অধ্যবসায়।ব্যর্থতার গ্লানি মুছে ফেলে সফলতার ইতিহাস রচনা করতে তাদের পাড়ি দিতে হয়েছে অনেক বন্ধুর পথ। জীবনের হতাশাগ্রস্থ মুহুর্তে তারা নিজেদেরকে হারিয়ে ফেলেছিলেন। তারা এতটাই বিষন্ন ছিলেন যে, কেউ মাদকাসক্ত ছিলেন, আবার কেউ আত্মহত্যার মতো পথ বেছে নিয়েছিলেন। বলিউড পাড়ায় এমন অনেক তারকা আছেন, যাদের সফল হবার পেছনে এরকম অসংখ্য গল্প রয়েছে। এসব তারকার মাঝেও কেউ কেউ আজ মহাতারকা বনে গিয়েছেন।তাদেরই একজন মনোজ বাজপেয়ী।

বলিউড সিনেমাপ্রেমীদের কাছে মনোজ বেশ জনপ্রিয়। তার বাবা অভিনেতা মানোজ কুমারের বড় ভক্ত ছিলেন।তার নাম থেকে অনুপ্রাণিত হয়েই তিনি তার ২য় পুত্র সন্তানের নাম রাখেন মানোজ বাজপেয়ী।মানোজ শব্দের অর্থ হল ‘বর্ন অফ মাইন্ড’ অর্থাৎ বন্ধুত্বপূর্ণ,সৃষ্টিশীল,আনন্দদায়ক এবং ভাগ্যবান।কে জানত তার বাবার রাখা নামটিই একদিন সার্থক হয়ে উঠবে!আজ তিনি তার অভিনয়ের বিচিত্রতার মাধ্যমেই দর্শকদের হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছেন।বিংশ শতাব্দীর শেষ সময়ে বলিউডের প্রথাগত মারদাঙ্গা-মাসালা চরিত্রের অভিনেতাদের বিপরীতে গল্পভিত্তিক ছবিতে অভিনয় করে নিজেকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছেন।মানুষের সাথে খুব সহজেই মিশতে পারেন তাইতো ছোট- বড় সকল সহকর্মীর সাথেই তার গভীর বন্ধুত্ব রয়েছে।চলুন জেনে আসি তার জীবন সম্পর্কে।

জন্মস্থান ও শৈশব

১৯৬৯ সালের ২৩ এপ্রিল বিহারের বেলোয়া গ্রামের এক সাধারণ কৃষক পরিবারে তার জন্ম। পাঁচ ভাই-বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন দ্বিতীয়।লেখাপড়ায় তিনি ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী। তবে দরিদ্র পরিবারের সন্তান হওয়ায় লেখাপড়ার জন্য তাকে যথেষ্ঠ সংগ্রাম করতে হয়েছে। স্কুল শেষ করেই বিকেলবেলা বাবার সাথে মাঠে কৃষিকাজ করতেন।

৫ম শ্রেণীতে পড়াকালে একবার তার গ্রামে যাত্রাদল আসে। যাত্রাদলের অভিনয় দেখেই তার অভিনেতা হবার ইচ্ছা জাগে। হাই স্কুলে পড়ার সময় স্কুলে একটি মঞ্চ নাটকের সিলেকশন হয়। তখন তার পরনের কাপড়ে ময়লা থাকায় তাকে স্টেজে উঠতে দেওয়া হয়নি। তবে রামজস কলেজে পড়া অবস্থায় তিনি কলেজের বিভিন্ন মঞ্চ নাটকে অংশ নিতেন। আর তখন থেকেই এলাকায় মঞ্চ অভিনেতা হিসেবে বেশ প্রশংসা কুড়াতে থাকেন।

আইএ পাশ করার পর দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন সময়ে তার নাট্যশিল্পের প্রতি আকর্ষণ আরো বাড়তে থাকে।একবার দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ে নাসিরুদ্দিন শাহ তার একটি ছবির প্রচারণায় এসেছিলেন। তিনি সেই অনুষ্ঠানে তার একটি সিনেমার চরিত্রের অনুকরণ করে দেখান। নাসিরুদ্দিন শাহ এতে মুগ্ধ হয়ে তাকে কিছু বখশিশ দেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালে তিনি নাসিরুদ্দিন শাহ এবং ওম পুরিকে দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে ভারতের বিখ্যাত অভিনয় প্রতিষ্ঠান ন্যাশনাল স্কুল অব ড্রামাতে ভর্তির জন্য আবেদন করেন। কিন্তু প্রথমবার লিখিত পরীক্ষাতেই অনুত্তীর্ণ হন। এভাবে চারবার ব্যর্থ হবার পর প্রচন্ড হতাশায় ডুবে যান, এমনকি আত্মহত্যার মতো সিদ্ধান্তও নিয়েছিলেন।তবে এমন কঠিন পরিস্থিতিতে অভিনেতা রঘুবির তার পাশে এসে দাঁড়ান।

তরুণ মনোজ বাজপেয়ী; Source: mid-day

ব্যারি জনের সাথে পরিচয়

রঘুবিরের পরামর্শে মানোজ বিখ্যাত ব্রিটিশ মঞ্চ পরিচালক ব্যারি জনের কর্মশালায় অংশ নেন। জন তার থিয়েটার অ্যাকশন গ্রুপ থেকে বাগদাদের গোলাম নামে একটি নাটক মঞ্চায়িত করতে চেয়ছিলেন। রঘুবিরকে মুখ্য চরিত্রের জন্য রাখা হলেও বাকি চরিত্রগুলোকে কর্মশালায় অংশগ্রহণকারীদের মধ্য থেকে বাছাই করে নেওয়া হয়। সেখানে মনোজের অভিনয়ে মুগ্ধ হয়ে জন তাকে রহমতউল্লাহ চরিত্রের জন্য নির্বাচিত করেন এবং ১,২০০ রুপি পারশ্রমিকের বিনিময়ে তাকে তার থিয়েটার দলে ভেড়ান।

বছর দুয়েক তিনি ব্যারি জনের সহকারী হিসেবে কাজ করেন। এরপর পঞ্চমবারের মতো ন্যাশনাল স্কুল অব ড্রামাতে আবেদন করলে তাকে সরাসরি ফ্যাকাল্টি শিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত করা হয়। মনোজ মনে করেন, জনের সাথে পরিচয় তার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে।

পারিবারিক অনুষ্ঠানে ব্যারি জনের সাথে মনোজ; Source: Deccan Chronicle

শাহরুখ খানের সাথে ঘনিষ্ঠতা

ব্যারি জনের থিয়েটার অ্যাকশন গ্রুপে যুক্ত হবার সময় থেকে শাহরুখ খানের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে ওঠে মনোজের। দীর্ঘ সময় একসাথে মঞ্চে কাজ করেছেন তারা। শাহরুখ মনে করেন, মনোজ সময়ের সেরা অভিনেতা। তার কাছ থেকে তরুণদের অনেক কিছু শেখার আছে।

ট্রাফিক ছবির প্রচারণায় শাহরুখ খান ও মনোজ বাজপেয়ী; Source: NDTV Movies

ক্যারিয়ার জীবন

১৯৯৪ সালে গোভিন্দ নেহালানীর দ্রোকাল সিনেমায় অভিনয়ের মধ্য দিয়ে বড় পর্দায় পা রাখেন। একই বছর শেখর কাপুরের বন্ডিত কুইন ছবিতে মান সিং চরিত্রে অভিনয় করে বলিউড মহলে প্রশংসা কুড়ান। তবে ১৯৯৭ সালে রাম গোপাল ভার্মার সত্য ছবিতে বিঘু মাহত্রে চরিত্রে অভিনয় তাকে আলোচনার শীর্ষে  নিয়ে যায়।

এছাড়াও তার ক্যারিয়ারের সেরা ছবিগুলোর মধ্যে রয়েছে রাকেশ ওম প্রকাশের এ কে এস, প্রকাশ ঝা পরিচালিত রাজনীতি, অনুরাগ কাশ্যপ পরিচালিত গ্যাংস অব ওয়াসিপুর এবং হানশাল মেথার আলীগড়গ্যাংস অব ওয়াসপুর ছবিতে অভিনয় তাকে পুনরায় আলোচনায় নিয়ে আসে। রাজনীতি ছবিতে লোভী রাজনীতিবিদের চরিত্রে অসাধারণ অভিনয় করে সমালোচকদের কড়া জবাব দেন। সিনেমা বিশ্লেষকদের মতে, এই ছবিতে তার অভিনয়কে অনেকের কাছেই বলিউডের ইতিহাসের সেরা অভিনয় বলে মনে হয়।     

সত্য ছবির একটি দৃশ্যে; Source: mayankshekhar.com

প্রযোজক হিসেবে আত্মপ্রকাশ

এ বছরেই মিসিং নামের সাইকো-থ্রিলার এই মুভির মধ্য দিয়ে তার সহ-প্রযোজক হিসেবে আবির্ভাব ঘটে। তবে প্রযোজক হিসেবে তার যাত্রা মোটেও সফল নয়। সিনেমাটি বক্স-অফিসে সাড়া জাগাতে ব্যর্থ হয়েছে। ছবিটির মুখ্য চরিত্রে তিনি এবং টাবু অভিনয় করেছিলেন।   

মিসিং ছবির প্রচারণায় মনোজ বাজপেয়ী ও টাবু; Source: IANS

পারিবারিক জীবন

১৯৯৬ সালে প্রথম বিয়ে করেন তিনি। কিন্তু ক্যারিয়ারের বাজে সময় চলাকালে তার সেই বৈবাহিক সম্পর্ক বেশিদিন টেকেনি। ১৯৯৮ সালে কারিব ছবিতে কাজ করার সময় নেহা বাজপেয়ীর সাথে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। ২০০৬ সালে তাদের দীর্ঘদিনের প্রেম বিয়েতে রূপ নেয়।দীর্ঘ ১২ বছরের সাংসারিক জীবনে তাদের একটি কন্যাসন্তান রয়েছে। মনোজ অবসর সময় তার পরিবারের সাথেই কাটান। সাধারণত তারকারা তাদের অবসর সময় কাটাতে পরিবার নিয়ে বিভিন্ন দেশে ঘুরতে যান, কিন্তু কর্মব্যস্ত জীবনে কিছুটা সময় পেলেই মনোজ ছুটে যান তার মাটির ঠিকানায়।

    

স্ত্রী ও সন্তানের সাথে মনোজ; Source:IndiaWords.com

অর্জন এবং সম্মাননা

এই শক্তিমান অভিনেতার অর্জনের ঝুলিতে রয়েছে ২টি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরষ্কার এবং ৪টি ফিল্ম ফেয়ার অ্যাওয়ার্ড। সত্য এবং পিঞ্জর ছবিতে পার্শ্বচরিত্রে অভিনয়ের জন্য জাতীয় চলচ্চিত্র পুরষ্কার অর্জন করেন। ২০১১ এবং ২০১৩ সালে যথাক্রমে রাজনীতি এবং গ্যাংস অব ওয়াসিপুর ছবির জন্য মুখ্য চরিত্রের সেরা অভিনেতার নমিনেশন পেয়েছিলেন। শোলে, সত্য, আলীগড় ছবিতে এবং তান্ডব স্বল্পদৈর্ঘ্য ছবিতে অভিনয়ের জন্য সেরা সমালোচিত অভিনেতা হিসেবে ফিল্মফেয়ার অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন। আলীগড় ছবিতে অসাধারণ অভিনয়ের জন্য ২০১৭ সালে এশিয়া স্পেসিফিক স্ক্রিন অ্যাওয়ার্ড অর্জন করেছেন। সম্প্রতি গালি গুলিয়ান ছবিতে অভিনয়ের জন্য নিউ ইয়র্ক-ইন্ডিয়ান ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে শ্রেষ্ঠ অভিনেতার পুরষ্কার অর্জন করেছেন।

Source: The Indian Express

মনোজ বাজপেয়ী সম্পর্কে জানা-অজানা কিছু তথ্য

  • ছোটবেলা থেকেই মনোজ অভিনেতা হতে চেয়েছিলেন, কিন্তু তার বাবা তাকে ডাক্তার বানাতে চেয়েছিলেন।
  • মনোজ ছোটবেলায় অত্যন্ত লাজুক ছিলেন, তাই স্কুলে তার শিক্ষক তাকে সবার সামনে প্রতিদিন হরিভংশ রায় বচ্চনের কীর্তন পাঠ করাতেন।
  • তিনি ইংরেজিতে অনেক দুর্বল ছিলেন। কিন্তু ব্যারি জনের সহায়তায় ইংরেজি ভাষা রপ্ত করেন। শুধু তা-ই নয়, হিন্দি ও ইংরেজির পাশাপাশি তিনি ফরাসি, তামিল এবং তেলেগু ভাষা রপ্ত করেন। ১৯৯৫ সালে তিনি জনের সাথে প্যারিসে ভ্রমণে যান এবং প্যারিসের একটি থিয়েটারে ফরাসি ভাষায় মঞ্চ নাটকে অভিনয় করেন।
  • সিনেমায় অভিনয়ের তুলনায় মঞ্চে বেশি কাজ করেছেন তিনি ।
  • বেশ কিছু সিনেমায় তিনি বিনা পারিশ্রমিকে কাজ করেছেন।
  • তিনি সত্য ছবিতে পার্শ্বচরিত্রে অভিনয়ের জন্য জাতীয় চলচ্চিত্র পুরষ্কার পেয়েছিলেন, অথচ এই চরিত্রে তিনি কোনোভাবেই অভিনয় করতে চাননি।
  • বাবাকে জীবনের সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা হিসেবে মানেন মনোজ।
  • তিনি গল্পকে প্রাধান্য দিয়ে কাজ করেন, তাই অনেক বিগ বাজেটের ফিল্মে কাজের প্রস্তাব পাওয়ার পরও সেগুলো ফিরিয়ে দিয়েছেন।
  • মনোজ প্রচন্ড ভোজনরসিক। দিল্লির বিরিয়ানি এবং পানি-পুরি তার খুবই পছন্দের। এছাড়া বিদেশি খাবারের মধ্যে ইতালিয়ান পাস্তা তার খুবই পছন্দের।

Featured image: NewsX

Related Articles