পুরো সমাজকে কমিউনিস্ট শাসন ব্যবস্থায় রূপান্তরের মাধ্যমেই কেবল লিঙ্গের সমতা প্রকৃতপক্ষে উপলব্ধি করা সম্ভব। - মাও সে তুং
বিপ্লবী নেতা মাও সে তুং আধুনিক চীনের প্রতিষ্ঠাতা। স্মরণীয় হয়ে আছেন চীনা সমাজ ও সংস্কৃতিতে তার প্রভাবের জন্য। ১৯৪৯ সাল থেকে ১৯৫৯ সাল পর্যন্ত গণপ্রজাতন্ত্রী চীন সরকারের চেয়ারম্যান এবং আমৃত্যু কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে ছিলেন তিনি। বিবেচিত হন একজন বিশিষ্ট কমিউনিস্ট তাত্ত্বিক হিসেবেও। এছাড়া তিনি বেশ কিছু বইয়ের লেখক ও কবি হিসেবেও বিখ্যাত ছিলেন। তার দর্শন মাওবাদ হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায়। তবে বিপ্লবী নেতা হিসেবে তিনি যতটা দক্ষ ছিলেন, রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে সে পরিমাণ সাফল্য দেখাতে পারেননি।
মাও সে তুং ১৮৯৩ সালের ২৬ ডিসেম্বর চীনের হুনান প্রদেশের শাওশান গ্রামে সম্ভ্রান্ত কৃষক ‘মাও পরিবারে’ জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা মাও ইচ্যাং ছিলেন ধনী শস্য ব্যবসায়ী। মা ওয়েন কুইমেই সন্তানদের দেখাশোনা করতেন বাড়িতে।
চীনে তখন চলছিল কিং রাজবংশের খুবই দুর্দশাগ্রস্থ শাসন। জনগণের জীবনযাপন তখন ছিল খুব করুণ। তবে মাও পরিবার অন্যান্যদের চেয়ে স্বচ্ছল ছিল। তাদের তিন একর জমিতে কয়েক প্রজন্ম চাষাবাদ করে জীবিকা নির্বাহ করছিল।
মাও সে তুং আট বছর বয়সে তার গ্রামের স্কুলে ভর্তি হন। এরপর প্রায় পাঁচ বছর কনফুসীয় মতবাদ নিয়ে পড়াশোনা করেন। তবে ১৩ বছর বয়সে আর্থিকভাবে পরিবারকে সাহায্য করার জন্য স্কুলে পড়াশোনা করা ছেড়ে দেন। পুরোদমে শুরু করেন কৃষিকাজ।
বিদ্রোহী মনোভাবের কারণে মাও বেশ কয়েকটি স্কুল থেকে বহিষ্কৃত হন। এমনকি বাড়ি থেকেও অনেকবার পালিয়ে যান। ১৯০৭ সালে ১৪ বছর বয়সী মাও এর বাবা তাকে বিয়ে দেয়ার জন্য ২০ বছর বয়সী মেয়ে ঠিক করেন। মেয়ে তাদের বাড়িতে চলে আসলেও মাও সে তুং কখনো সেই বিয়ে মেনে নেননি।
মাও এর কিছুদিন পর হুনান প্রদেশের রাজধানী চাংশায় চলে যান পুনরায় তার শিক্ষা জীবন শুরু করার জন্য। এসময় চীনে কিং রাজবংশ বিরোধী আন্দোলন শুরু হয়। তিনি ১৯১১ ও ১৯১২ সালের ছয় মাস এই আন্দোলনের সেনা হিসেবে অংশগ্রহণ করেন। ১৯১৩-১৮ সাল পর্যন্ত তিনি টিচার্স ট্রেনিং স্কুলে পড়াশোনা করেন। এই সময়ে তিনি বিপ্লবী আন্দোলন সম্পর্কে আরো অনেক কিছু জানতে পারেন। ১৯১৭ সালের রুশ বিপ্লব তাকে খুব আকর্ষণ করে।
১৯১৮ সালে তিনি স্নাতক সম্পন্ন করেন। একই বছর তার মা মারা যান। ফলে তিনি আর বাড়ি ফিরে যাওয়ার কোনো আগ্রহ খুঁজে পান না। চলে যান বেইজিংয়ে। সেখানে গিয়ে চাকরি পেতেও বেশ বেগ পেতে হয় তাকে। শেষ পর্যন্ত বেইজিং বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী লাইব্রেরিয়ান হিসেবে কাজ করা শুরু করেন। তার অধীক্ষক কর্মকর্তা লি দাজাও ছিলেন চায়না কমিউনিস্ট পার্টির একজন সহ-প্রতিষ্ঠাতা। তার দ্বারাও মাও বিপ্লবী চিন্তায় প্রভাবিত হন। এসময় সোভিয়েত ইউনিয়ন সফলভাবে কমিউনিস্ট শাসনব্যবস্থা চালু করলে তিনি আরো অনুপ্রাণিত হন।
১৯২০ সালে মাও তার অধ্যাপকের মেয়ে ইয়াং কাইহুইকে বিয়ে করেন। তিনি এসময় কার্ল মার্ক্সের কমিউনিস্ট মেনিফেস্টোর অনুবাদও পড়ে ফেলেন। ১৯২১ সালে তিনি চীনের কমিউনিস্ট পার্টির উদ্বোধনী সদস্যদের একজন হিসেবে যোগদান করেন।
এদিকে কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যসংখ্যাও ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পেতে থাকে, হতে থাকে শক্তিশালী ও সংঘবদ্ধ। ১৯২৩ সালে তৎকালীন ক্ষমতাসীন দল কুওমিনট্যাং তথা চীনের প্রেসিডেন্ট সান ইয়াৎ-সেন কমিউনিস্ট পার্টিকে সহায়তা করে একসাথে কাজ করার অঙ্গীকার নিয়ে নীতিমালা প্রণয়ন করেন।
মাও সে তুং শুরুর দিকে কমিউনিস্ট পার্টি ও কুওমিনট্যাং দুই দলকেই সমর্থন করতেন। কিন্তু পরবর্তীতে লেনিনীয় মতবাদের দিকেই তিনি বেশি ঝুঁকে পড়েন। তিনি বিশ্বাস করতেন, এশিয়ায় সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হলে কৃষক শ্রেণিকে আকৃষ্ট করতে হবে। তিনি খুব দ্রুতই পার্টিতে পদোন্নতি পেতে থাকেন। একসময় সাংহাই অঞ্চলের নির্বাহী পদ পেয়ে যান।
১৯২৫ সালে সান ইয়াৎ-সেন মারা যান। তখন কুওমিনট্যাং এর চেয়ারম্যান ও চীনের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন চিয়াং কাই-শেক। তিনি সান ইয়াৎ-সেনের তুলনায় অনেক রক্ষণশীল নেতা ছিলেন। ১৯২৭ সালের এপ্রিলে তিনি কমিউনিস্ট পার্টির সাথে মিত্রতা ছিন্ন করেন এবং তাদের প্রতি সহিংস হয়ে ওঠেন। তার নির্দেশে বেইজিংয়ে প্রায় পাঁচ হাজার কমিউনিস্ট সদস্যকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। বন্দী হন আরো অনেকে। চীনের গৃহযুদ্ধের সূত্রপাত সেখানেই।
মাও তখন চাংশায় কৃষকদের নিয়ে কুওমিনট্যাং বিরোধী সৈন্যদল গড়ে তুলেন। কিন্তু কুওমিনট্যাং মাওয়ের নব্বই শতাংশ কৃষক সেনাকেই হত্যা করে। ১৯২৮ সালে চিয়াং কাই-শেক বেইজিং দখল করেন। বিশ্ববাসীর কাছে কুওমিনট্যাংই চীনের ক্ষমতাসীন দল হিসেবে স্বীকৃতি পায়।
এদিকে মাও সে তুং দক্ষিণ হুনান ও জিয়ানজি প্রদেশে কৃষক সেনাদের নিয়ে নিজের বাহিনী শক্তিশালী করতে থাকেন। একইসাথে তিনি নিজের মাওবাদ দর্শনের ভিত্তি স্থাপন করতে থাকেন।
এদিকে ১৯৩০ সালের অক্টোবরে চাংশায় একজন স্থানীয় সেনাপতি মাওয়ের স্ত্রী ইয়াং কাইহুই ও তাদের এক পুত্র সন্তানকে আটক করে। ইয়াং কমিউনিস্ট পার্টি নিয়ে নেতিবাচক কিছু বলতে রাজি না হওয়ায় তাকে আট বছর বয়সী ছেলের সামনেই হত্যা করা হয়। মাও ওই বছরের মে মাসে তার তৃতীয় বিয়ে করেন হে জিঝেনকে।
তিনি পার্বত্য অঞ্চলে তার গেরিলা সৈন্যদের নিয়ে রেড আর্মি প্রতিষ্ঠা করেন, যার সদস্য সংখ্যা ছিল প্রায় ৪৫ হাজার। তাদের উন্নত মানের অস্ত্র ছিল না, কিন্তু তারা ছিল বেশ উগ্র। মাও সোভিয়েত রিপাবলিক অব চায়না সরকার গঠন করেন এবং ১৯৩১ সালে এর চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন।
মাও-এর গেরিলা সৈন্যদের নির্দেশ দেয়া হয় দলের নীতিমালার কেউ সাথে ভিন্নমত প্রকাশ করলে তাদের নির্যাতন করে মেরে ফেলার জন্য। মাও স্থানীয় জমিদারদের আটক ও হত্যা করার নির্দেশ দেন। এসময় আনুমানিক দুই লক্ষ জমিদারকে নির্যাতন ও হত্যা করা হয়।
১৯৩৪ সালে জিয়াংজি প্রদেশের দশটিরও বেশি অঞ্চল কমিউনিস্টদের অধীনে চলে আসে। কুওমিনট্যাং নেতা চিয়াং কাই-শেক কমিউনিস্টদের সাফল্য দেখে ভীত হয়ে পড়েন। ওই বছরের অক্টোবরে তিনি প্রায় দশ লক্ষ সরকার দলীয় বাহিনীকে পাঠান জিয়াংজি প্রদেশে। ফলে কুওমিনট্যাং সেনারা পার্বত্য অঞ্চলে কমিউনিস্ট রেড আর্মিকে ঘিরে ফেলে।
তখন মাওয়ের সাথে অন্যান্য কমিউনিস্ট নেতাদের বিরোধ দেখা যায়। তারা চাইছিলেন কুওমিনট্যাং এর সাথে শেষবারের মতো লড়ে যেতে। কিন্তু মাও তাদের বোঝাতে সক্ষম হন, তখন পালিয়ে যাওয়াটাই উত্তম পন্থা। শেষ পর্যন্ত কমিউনিস্টরা পালিয়ে যায় সেখান থেকে।
পরবর্তীতে মাও জিয়ানজিতে প্রায় ৮৫ হাজার রেড আর্মি সেনা ও কমিউনিস্ট সমর্থকদের জড়ো করেন। তাদের নিয়ে শানঝি প্রদেশ পর্যন্ত প্রায় সাত হাজার কিলোমিটার হেঁটে আসেন। একে বলা হয় ‘দ্য লং মার্চ’। বৈরী আবহাওয়া, বিপজ্জনক পাহাড়ি রাস্তা, সেতু ছাড়া নদী পার হওয়া, স্থানীয় কুওমিনট্যাং সেনাদের আক্রমণ এসব প্রতিকূলতা মোকাবেলা করে মাত্র সাত হাজার কমিউনিস্ট সদস্য জীবিত ছিলেন!
এই লং মার্চ মাও সে তুং-কে পার্টির নেতা হিসেবে শক্ত ভিত এনে দেয়। কারণ, তীব্র প্রতিকূল সময়ে তিনিই কমিউনিস্ট সেনাদের উজ্জীবিত করছিলেন লং মার্চ চলমান রাখার জন্য।
১৯৩৭ সালে জাপান এসে চীন আক্রমণ করে। ফলে চিয়াং কাই-শেক চীনের উপকূলীয় অঞ্চল ও কিছু শহরের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেন, বেইজিং তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য। চিয়াং তখন একইসাথে কমিউনিস্ট ও জাপানিজদের সাথে যুদ্ধে পেরে উঠছিলেন না। তাই তিনি কমিউনিস্টদের সাথে সন্ধি স্থাপন করেন। তিনি জাপানকে প্রতিহত করার জন্য কমিউনিস্টদের সাহায্য চান।
জাপান পুরো চীন দখল করতে না পারলেও ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত চীনে তাদের উপস্থিতি বজায় রাখে। এসময় কমিউনিস্ট ও কুওমিনট্যাং একত্রে জাপানের বিরুদ্ধে লড়াই করে। মাও সে তুং তখন এই মিত্রবাহিনীর সামরিক নেতা হিসেবে কাজ করেন। কুওমিনট্যাং এর সেনাদের চেয়ে মাওয়ের গেরিলা বাহিনীই জাপানিদের বিরুদ্ধে বেশি উপযোগী ছিল।
এদিকে ১৯৩৮ সালে মাও তার তৃতীয় স্ত্রীর সাথে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটান এবং অভিনেত্রী জিয়াং কিংকে বিয়ে করেন। জিয়াং কিং পরবর্তীতে ‘ম্যাডাম মাও’ হিসেবে পরিচিত ছিলেন।
মাও জাপানিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করলেও একইসাথে তিনি কুওমিনট্যাং এর কাছ থেকে চীনের নিয়ন্ত্রন নিজের হাতে তুলে নেয়ার জন্যও কাজ করে যাচ্ছিলেন। ১৯৪৪ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে চীনের মিত্র যুক্তরাষ্ট্র তাদের সেনাবাহিনী পর্যবেক্ষণ দল ডিক্সি মিশনকে চীনে পাঠায়। তারা দেখতে পায় কুওমিনট্যাংদের তুলনায় কমিউনিস্ট পার্টি অধিকতর সংঘবদ্ধ ও কম দুর্নীতি পরায়ন। ফলে কমিউনিস্টরা তখন পশ্চিমাদের কাছ থেকে বেশি সমর্থন পায়।
১৯৪৫ সালে জাপানের পরাজয় হলে তারা চীনের কাছে তাদের দখলকৃত স্থানগুলো ফেরত দেয়। তখন চীনে আবার রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। ১৯৪৮ সালে জিলিন প্রদেশের চ্যানচুং শহর ঘিরে ফেলে রেড আর্মি, যা বর্তমানে পিপল’স লিবারেশন আর্মি নামে পরিচিত।
১৯৪৯ সালের ১ অক্টোবর মাও সে তুং বেইজিংয়ের তিয়ান আনমেন চত্বরে পিপল’স রিপাবলিক অব চায়না প্রতিষ্ঠা করে কমিউনিস্ট শাসনের ঘোষণা দেন। ১০ ডিসেম্বর কুওমিনট্যাং-এর সর্বশেষ শক্তিশালী ঘাঁটি সিচুয়ান প্রদেশের চ্যাংডু শহরও কমিউনিস্ট রেড আর্মি ঘিরে ফেলে। ফলে কুওমিনট্যাং নেতা চিয়ান কাই-শেক তার সৈন্যদল নিয়ে চীনের মূল ভূখণ্ড থেকে পালিয়ে দ্বীপ অঞ্চলে চলে যান, যা বর্তমানে তাইওয়ান নামে পরিচিত।
তখন সমগ্র চীনের নিয়ন্ত্রণ মাওয়ের অধীনে চলে আসে। প্রথমেই তিনি প্রায় ২০ থেকে ৫০ লক্ষ জমিদারদের হত্যা করে তাদের জমিগুলো দরিদ্র কৃষকদের মাঝে বণ্টন করে দেন। এছাড়া তিনি সাবেক কুওমিনট্যাংপন্থি বিরোধী দলের প্রায় আট লক্ষ লোক হত্যা করেন। তাদের মধ্যে ছিল সাবেক কুওমিনট্যাং সদস্য, ব্যবসায়ী, বুদ্ধিজীবী ইত্যাদি।
১৯৫১-৫২ সালের বিভিন্ন সময়ে তিনি পাঁচটি ক্যাম্পেইন পরিচালনা করেন। এতে ধনী ব্যক্তিদের ও সন্দেহজনক পুঁজিবাদী ব্যক্তিদের প্রকাশ্যে জনসম্মুখে অপমান করা হতো। পরবর্তীতে এদের অনেকে আত্মহত্যা করেন। ১৯৫৩-৫৮ সালের জন্য তিনি প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা করেন চীনকে একটি শিল্পোন্নত রাষ্ট্রে পরিণত করার জন্য।
প্রথম পঞ্চবার্ষিকীর সাফল্যে উজ্জীবিত হয়ে ১৯৫৮ সালের জানুয়ারিতে মাও দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা করেন, যা ‘গ্রেট লিপ ফরোয়ার্ড’ নামে পরিচিত ছিল। কিন্তু তার এই পরিকল্পনা নির্মমভাবে ব্যর্থ হয়। তিনি কৃষকদের তাদের জমিতে ফসল ফলানোর চেয়ে লোহার আকরিক গলানোর নির্দেশ দেন। ফলাফল ছিল ভয়াবহ।
১৯৫৮-৬০ সাল জুড়ে চীনে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষে প্রায় চার কোটি চীনা মারা যায়। তখন এটি পরিষ্কার হয়ে যায় যে, মাও সে তুং বিপ্লবী নেতা হিসেবে সফল হলেও দেশ পরিচালনায় ব্যর্থ। যদিও এই দুর্ভিক্ষের কথা চীনা শহরের জনগণ ও বিশ্ববাসীর কাছে গোপন রাখা হয়।
১৯৬২ সালের জানুয়ারিতে চাইনিজ কমিউনিস্ট পার্টি বা সিসিপি বেইজিংয়ে একটি সম্মেলন আয়োজন করে। এতে সভাপতিত্ব করেন কমিউনিস্ট নেতা লিউ শাও চি। তিনি মাওয়ের গ্রেট লিপ ফরোয়ার্ডের তীব্র সমালোচনা করেন। এরপর মাওকে পার্টির অভ্যন্তরীণ ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেয়া হয়। পরবর্তী কয়েক বছর মাও সে তুং শুধুমাত্র নামেই চীন সরকারের প্রধান ছিলেন।
তখন কমিউনিস্ট নেতা লিউ শাও চি ও ডেং জিয়াওপিং কৃষকদের সমাজতান্ত্রিক ধারা থেকে আলাদা করে দেন। তারা অস্ট্রেলিয়া ও কানাডা থেকে গম আমদানি করেন দুর্ভিক্ষে আক্রান্ত জনগণের জন্য। তারা ছিলেন অনেকটা মধ্যমপন্থী সমাজতান্ত্রিক ধারার।
এদিকে ২৫ বছরের মধ্যে প্রথমবারের মতো মাও ক্ষমতাহীন হয়ে পড়েন। তবে তিনি সুযোগ খুঁজছিলেন হারানো 'সাম্রাজ্য' ফিরে পাওয়ার। এসময় তার একনিষ্ঠ ভক্ত লিন বিয়াও বিভিন্ন সময়ে মাওয়ের লেখাগুলো সংকলিত করে একটি বই লেখেন ‘চেয়ারম্যান মাওয়ের উক্তি’ নামে। সমগ্র চীনাদের কাছে এটি ‘লাল বই’ নামে পরিচিত ছিল।
মাও পার্টির নেতাদের পুঁজিবাদী মনোভাব ও তরুণ প্রজন্মের সহজে বিশ্বাস করার প্রবণতাকে ব্যবহার করেন পুনরায় ক্ষমতা লাভের জন্য। ১৯৬৬ সালের মে মাসে ৭৩ বছর বয়সী মাও ইয়াংজি নদীতে কয়েক মিনিট সাঁতার কাটেন। এতে তাকে অনেক প্রাণবন্ত দেখাচ্ছিল। তিনি প্রতিপক্ষদের এই বার্তা দিতে চেয়েছিলেন, “দেখো আমি ফিরে এসেছি!”
তরুণ প্রজন্ম গ্রেট লিপের ব্যর্থতা বা দুর্ভিক্ষ সম্পর্কে কিছু মনে করতে পারবে না। তিনি এই সুযোগটিই নিলেন। তখন তিনি ঘোষণা দেন সাংস্কৃতিক বিপ্লবের। তরুণদের উদ্দেশ্যে আহ্বান জানালেন পুরনো প্রথা ভেঙে দিতে। ডানপন্থীদের সরিয়ে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা শক্তিশালী করার জন্য উজ্জীবীত করলেন তাদের। এতে বিপুল সাড়া পেলেন তিনি। তার অনুগত তরুণ প্রজন্ম ‘লাল বাহিনী’ গঠন করে।
মাওয়ের লাল বাহিনী তখন প্রাচীন শিল্পকর্ম, ছবি, লেখা ধ্বংস করে। মন্দির পুড়িয়ে দেয়, বুদ্ধিজীবী ও শিক্ষকদের পিটিয়ে হত্যা করে। তারা পরিবারের সদস্যদের ওপরও নজরদারি করত কেউ পুঁজিবাদী মনোভাব দেখায় কিনা জানার জন্য। তারা যখন এসবে ব্যস্ত ছিল, মাও সে তুং তখন তার প্রতিপক্ষ নেতা লিউ ও ডেং এর কাছ থেকে পার্টির নেতৃত্ব পুনরোদ্ধার করেন।
লিউ শাও চিকে মাও কারাগারে প্রেরণ করেন। লিউ কারাগারেই ভয়ংকর পরিস্থিতিতে মারা যান। ডেং জিয়াওপিংকে প্রত্যন্ত অঞ্চলের একটি ট্র্যাক্টর কারখানায় নির্বাসনে পাঠানো হয়। তার ছেলেকে মাওয়ের লাল বাহিনী চার তলা ভবনের জানালা থেকে নিচে ফেলে দেয়। এতে সে পঙ্গু হয়ে যায়।
১৯৬৯ সালে মাও ঘোষণা দেন সাংস্কৃতিক বিপ্লব সম্পূর্ণ হয়েছে। যদিও এটি ১৯৭৬ সালে তার মৃত্যু পর্যন্ত চলতে থাকে। সেই সময়টা সাংস্কৃতিক বিপ্লব পরিচালনা করেন তার স্ত্রী ও ঘনিষ্ঠ লোকরা।
সত্তরের দশকে এসে মাওয়ের স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটে। অ্যামায়োট্রফিক লেটেরাল স্ক্লেরোসিস বা এএলএস নামক রোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন। এতে তিনি হাত পা নড়াচড়ার ক্ষমতা ধীরে ধীরে হারিয়ে ফেলছিলেন। তার কথাবার্তাও অস্পষ্ট হয়ে যাচ্ছিল। এছাড়া আজীবন ধূমপানের অভ্যাস থাকায় ফুসফুস ও হৃদরোগের সমস্যাও ছিল।
১৯৭৬ সালের জুনে ভয়াবহ তাংশান ভূমিকম্পের ফলে সমগ্র চীন জুড়ে সংকট চলছিল। ৮২ বছর বয়সী মাও তখন হাসপাতালের বিছানায় শয্যাশায়ী ছিলেন। সেই বছরের সেপ্টেম্বরে তার দুটি বড় হার্ট অ্যাটাক হয়। অবশেষে ১৯৭৬ সালের ৯ সেপ্টেম্বর তিনি মারা যান।
মাওয়ের মৃত্যুর পর কমিউনিস্ট পার্টির মধ্যপন্থী নেতারা ক্ষমতা দখল করেন। তখন চীনের প্রেসিডেন্ট হন ডেং জিয়াওপিং। সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সময় মাওয়ের ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিদের শাস্তি দেয়া হয়। চীনের অর্থনীতি তখন অনেকটা পুঁজিবাদী ঘরানায় পরিচালনা করা হয়।
মাও সে তুংকে আধুনিক চীনের জনক মনে করা হয়, যদিও তার আদর্শ অনেকটা জটিল। তার মাওবাদী আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে একবিংশ শতাব্দীতেও নেপাল ও চীনে মাওবাদী আন্দোলন সংঘটিত হয়েছে। অন্যদিকে তিনি হিটলার ও স্টালিনের সম্মিলিত সংখ্যার চেয়েও বেশি নিজের দেশের মানুষকে হত্যা করেছেন। মাওবাদী চিন্তাধারা আজও চীনে গ্রহণ করা হয়।
This is a Bangla article written about chinese great leader Mao Tse Tung.
References:
1. Thought Co
2. Biography
Featured Image: South China Morning Post