Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

মার্শাল টিটো: স্বৈরাচারী শাসক নাকি স্বাধীনতার নায়ক?

সাবেক যুগোস্লাভিয়ার রাজনৈতিক নেতা জোসিপ ব্রজ টিটো, যিনি মার্শাল টিটো নামেও পরিচিত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় অক্ষশক্তির পক্ষে নাৎসিদের বিপক্ষে ইউরোপে সবচেয়ে কার্যকর প্রতিরোধ ‘যুগোস্ল্যাভ পার্টিজান’ এর নেতৃত্ব দিয়েই তিনি বিশ্বব্যাপী পরিচিতি এবং প্রশংসা পান। যুদ্ধ শেষে যুগোস্লাভিয়ার সর্বময় কর্তৃত্ব লাভ করেন এবং প্রথম থেকেই স্বৈরাচারী হিসেবে পরিচিতি পান। তথাপি তার সরকারের সাফল্যময় কূটনীতিক এবং অর্থনৈতিক নীতিমালার কারণে প্রশংসাও কম পাননি। যুগোস্লাভিয়ায় সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হওয়ায় অনেকে তাকে ‘দ্বিতীয় যুগোস্লাভিয়া’র স্থপতিও বলে থাকেন। তার ঘটনাবহুল জীবনের আরেকটি আলোচিত অধ্যায় হচ্ছে জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের নেতৃত্ব দেয়া। ন্যামের প্রতিষ্ঠাকালীন প্রধান ৫ নেতার মধ্যে তিনি ছিলেন অন্যতম।

জোসিপ ব্রজ টিটো ১৮৯২ সালের ৭ মে ক্রোয়েশিয়ার কুমরোভেচ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। এ অঞ্চল সে সময় অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। পারিবারিক সূত্রে তিনি ক্রোয়েশীয় আর স্লাভিক, দুটোই ছিলেন। কারণ, তার বাবা ক্রোয়েশীয় হলেও মা ছিলেন স্লোভেনীয়। ফলে শৈশব থেকেই স্লোভেনীয় আর ক্রোয়েশীয়, দুটি ভাষা যুগপৎ শিখতে থাকেন টিটো। তার বাবা মোটামুটি ভালো পরিমাণের কৃষি জমির মালিক হওয়া সত্ত্বেও আলস্যের কারণে সেগুলোর যথার্থ ব্যবহার করতে পারছিলেন না। অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা আনতে তো তিনি পরিবারশুদ্ধ খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিতও হয়েছিলেন, যদিও তাতে কিছুই পরিবর্তন হয়নি। অর্থাভাবে স্বাস্থ্য জটিলতায় ভোগা শিশু টিটোর যথার্থ পরিচর্যা হবে না ভেবে তাকে পাঠিয়ে দেয়া হয় নানা বাড়িতে। স্কুলে ভর্তি হবার বয়সে উপনীত হওয়া পর্যন্ত সেখানেই ছিলেন তিনি।

মার্শাল টিটো (১৮৯২-১৯৮০ সাল); image source: thefamouspeople.com

৮ বছর বয়সে স্কুলে ভর্তি হন টিটো। কিন্তু আর্থিক সমস্যা আর পড়ালেখার প্রতি প্রচণ্ড অনীহায় তার শিক্ষাজীবন শেষ হয়ে যায় মাত্র ৪ বছর পরই। ফলে ঠিকমতো পড়তে শিখলেও, লেখাটা পুরোপুরি রপ্ত করতে পারেননি তিনি। বানান নিয়ে তার সমস্যা থেকে যায় আমৃত্যুই। পড়ালেখা ছাড়ার পর প্রাথমিকভাবে বাবার কৃষিজমিতে কাজ শুরু করলেও তাতে পরিবারের তেমন কোনো উপকারই হচ্ছিল না। পরে তিনি ক্রোয়েশিয়ার সিসাক শহরে চলে যান তার চাচাতো ভাইয়ের নিকট। সেখানে গিয়ে একজন ১৫ বছরের বালকের পক্ষে যা যা করা সম্ভব, তার সবই করেন তিনি। রেস্টুরেন্টে ঝাড়ু দেয়া, দারোয়ানের কাজ, প্রধান বাবুর্চির রান্নার সহযোগী, গাড়ি মেরামতের কারখানায়, সংবাদপত্র বিক্রয় সহ আরো বহুবিধ কাজ করেছেন তিনি। সংবাদপত্র বিক্রয় করতে গিয়ে ‘ফ্রি ওয়ার্ল্ড’ নামক একটি সমাজতান্ত্রিক পত্রিকার সাথে তার পরিচয় ঘটে। এ পত্রিকা পড়ে তিনি সমাজতন্ত্রের প্রতি ভীষণভাবে আকৃষ্ট হয়ে পড়েন। ১৯১০ সালে শ্রমিক ইউনিয়নে যোগ দেয়ার মাধ্যমে প্রথম সাংগঠনিক রাজনীতির জগতে প্রবেশ করেন টিটো।

পরবর্তী ৩ বছরে টিটো অন্তত ১০ বার চাকরি এবং বাসস্থান পরিবর্তন করেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তার প্রতিবাদী কণ্ঠের ভয়ে মালিকরা তাকে ছাঁটাই করে দিত। প্রথম প্রথম কিছুটা ভীত হলেও, ধীরে ধীরে সাহস সঞ্চার করেন টিটো। প্রায় সকল প্রকার শ্রমিক আন্দোলনে প্রথম সারিতে তাকে দেখা যেত তাকে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ২ বছর পূর্বে তাকে বাধ্যতামূলক সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে হয়। তিনি অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। নিজের দক্ষতা আর সাহসিকতার কল্যাণে খুব দ্রুতই ক্রোয়েশীয় হোম গার্ড রেজিমেন্টের সার্জেন্ট মেজর পদে উন্নীত হন। ১৯১৪ সালের জুলাই মাসে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে হোম গার্ড রেজিমেন্ট সার্বিয়ান সীমান্তে চলে যায় যুদ্ধ করতে। নিজের রেজিমেন্টের অন্যান্য সার্জেন্টদের চেয়ে অনেক বেশি সাহসিকতার সহিত যুদ্ধ করেন টিটো। তার প্লাটুন নিয়ে তিনি ৮০ জনের অধিক রাশিয়ান সৈন্য বন্দী করতে সমর্থ হন। তবে কিছুকাল পরই রোমানিয়া ও ইউক্রেনের সীমান্তবর্তী বুকোভিনার যুদ্ধে আহত হয়ে রাশিয়ানদের হাতে ধরা পড়েন তিনি। তাকে যুদ্ধবন্দী হিসেবে কাজানে প্রেরণ করা হয়, যেখানে তিনি প্রায় ১৩ মাস হাসপাতালে ছিলেন। এ সময় তৃতীয় ভাষা হিসেবে রাশিয়ান ভাষা আয়ত্ত করেন টিটো, যা পরবর্তীতে তার প্রাণ রক্ষা করে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় পার্টিজান যোদ্ধাদের সাথে টিটো; image source: thefamouspeople.com

পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠলে টিটোকে রাশিয়ার কুঙ্গার নামক স্থানে যুদ্ধবন্দীদের ক্যাম্পে পাঠানো হয়। এই ক্যাম্পের বন্দীদের দিয়ে সদ্য সমাপ্ত ট্রান্স-সাইবেরিয়ান রেলওয়ের রক্ষণাবেক্ষণের কাজ করানো হতো। টিটোর জীবনের কুঙ্গার ক্যাম্প পর্ব অনেকটা সিনেমার মতো হয়ে ওঠে। নিজের নেতৃত্ব গুণের জন্য ক্যাম্পের অন্যান্য বন্দীদের রক্ষণাবেক্ষণ কাজের নেতৃত্ব দেয়ার দায়িত্ব পান। কিন্তু রেডক্রস থেকে আসা ত্রাণসামগ্রী ক্যাম্পের কর্মকর্তারা আত্মসাৎ করছে বলে অভিযোগ করে তাবৎ সুযোগ সুবিধা হারান এবং জেলে বন্দী হন। মাসাধিককাল শারীরিক অত্যাচারের শিকার হবার পর তাকে ক্ষমা করা হয়। এ সময় তার কছে সুযোগ আসে পালিয়ে যাবার। ক্যাম্পের এক বলশেভিক আন্দোলনকারীর সাথে তার বন্ধুত্ব হয়, যার ছেলে পেট্রোগার্ডে পড়ালেখার জন্য অবস্থান করছিল। টিটো এ সুযোগ কাজে লাগান। নিয়মমাফিক কাজে বেরিয়ে কয়লার ট্রেনে চড়ে বসে পেট্রোগার্ডের উদ্দেশ্যে চম্পট দেন দুজনে।

ক্যাম্প থেকে পলায়নের পরের অংশটা আরো নাটকীয়। টিটো তার বলশেভিক বন্ধুকে নিয়ে ফিনল্যান্ডের উদ্দেশ্যে রওনা দেন। ভাগ্যের সহায়তায় সীমান্তে পৌঁছেও গিয়েছিলেন তারা। কিন্তু সেখান থেকে দুজন পুনরায় ধরা পড়েন। তাদেরকে পুলিশি হেফাজতে ক্যাম্পে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়। মাঝপথে দ্বিতীয়বারের মতো পুলিশের ভ্যান থেকে বেড়িয়ে দুজন দুদিকে রওনা দেন। টিটোর গন্তব্য ছিল সাইবেরিয়া। ট্রান্স সাইবেরিয়ান রেলওয়ের একটি ট্রেনে চেপে বসেন তিনি। পথে পুলিশ ট্রেন সার্চ করতে এলেও টিটোর অনর্গল রাশিয়ান ভাষা বলতে পারা দেখে তারা আর সন্দেহ করেনি। এবার ধরা পড়লে নিশ্চিত মৃত্যু ছিল। স্বদেশে ফিরে ‘কমিউনিস্ট পার্টি অব যুগোস্লাভ’ তথা সিপিওয়াইতে যোগ দেন তিনি। কিন্তু কমিউনিস্ট পার্টির এক সদস্যের হাতে তৎকালীন সরকারের এক মন্ত্রীর মৃত্যু হলে সিপিওয়াইকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। আর নিষিদ্ধ দলের সাথে সম্পর্ক থাকায় টিটোকেও চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়।

গ্রেফতারের পর তোলা টিটোর মাগশট; image source: deadideas.net

এ সময়টা টিটোর জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। সিপিওয়াইয়ের সর্বোচ্চ পর্যায়ের নেতাদের গ্রেফতার করা হলে নতুন নেতৃত্ব দু’ভাগে ভাগ হয়ে যায়। একাংশের ইচ্ছা ছিল শান্তিপূর্ণ উপায়ে প্রতিবাদ জানানো। কিন্তু অন্য ভাগটি সহিংস আন্দোলনের পক্ষপাতী ছিল। এই উগ্রবাদী অংশের নেতারা শ্রমিকদের মাঝে জনপ্রিয় টিটোর সাথে যোগাযোগ করেন। টিটোও তাদের জন্য কাজ করতে সানন্দে রাজি হন। আর এখান থেকেই শুরু হয় টিটোর দ্বিতীয় জীবন। প্রতিনিয়ত বিদ্বেষপূর্ণ লিফলেট বিতরণ, সরকারের বিরুদ্ধে শ্রমিকদের সংগঠিত করা সহ নানাবিধ উগ্রপন্থী কাজে জড়িয়ে যান তিনি, একাধিকবার গ্রেফতার হন। তবে প্রতিবারই আদালতে মুক্তি পেয়ে যান তিনি। শেষপর্যন্ত পুলিশ তার বাড়িতে বোমা রাখার নাটক সাজিয়ে তাকে গ্রেফতার করে। আদালতে তোলার পূর্বে প্রায় ৩ মাস তাকে জেলে রেখে শারীরিক নির্যাতন করা হয়। আদালতে তার ৫ বছরের সাজা হয়। অসুস্থ টিটোর এই সাজা পাওয়া তাকে সাধারণের কাছে নায়কে পরিণত করে!

জেলখানায় অলস সময় পার করার মতো মানুষ টিটো ছিলেন না। জেলে ঘুরে ঘুরে সিপিওয়াইয়ের জন্য লোক জোগাড় করছিলেন তিনি। জেল থেকে পালানোর চেষ্টার অভিযোগে দুবার তার জেলখানা পরিবর্তন করা হয়, তাকে রাখা হয় একাকী কারাগারে। মাঝে দুবার তাকে জেল থেকে মুক্তি দিয়ে জেলগেট থেকেই আবার গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠানো হয়। অবশেষে ১৯৩৪ সালে তিনি পুরোপুরি মুক্তি পান। কিছুকাল তাকে নজরদারিতে রাখা হলে তিনি নিজের গ্রাম কুমরোভিচেই স্থির হয়ে রইলেন। নজরদারি উঠতেই যোগ দিলেন সিপিওয়াইয়ের ক্রোয়েশীয় শাখায়। একাধিক নকল পাসপোর্ট বানিয়ে ফিনল্যান্ড, ভিয়েনা, সার্বিয়া, জাগরেবে ভ্রমণ করে লোক জোগাড় করতে শুরু করেন। এ সময় তিনি একাধিক ছদ্মনাম ব্যবহার করতেন, যার একটি ছিল টিটো। মূলত জোসিপ ব্রজের সাথে টিটোর সংযোজন ঘটে তার ৪৫ বছর বয়সে। কোনো কারণে এ নামটি তার এতটাই পছন্দ হয়েছিল যে পরবর্তীকালে তিনি একে স্থায়ী করে নেন।

বেলগ্রেডে গঠিত হয় সিপিওয়াই; image source: fr.wikipedia.org

সিপিওয়াইয়ের উপরের সারির নেতাদের একের পর এক ধরপাকড় আর গ্রেফতারের মাঝে টিটো এই সংগঠনের ভারপ্রাপ্ত প্রধান সম্পাদকের দায়িত্ব পান। শুরু হয় তার সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং সময়। ১৯৪১ সালের এপ্রিল মাসে নাৎসিরা যুগোস্লাভিয়া আক্রমণ করলে রাজা দ্বিতীয় পিটার পালিয়ে যান। প্রশাসন এবং সরকারের কর্তাব্যক্তিরাও নাৎসিদের কাছে নতি স্বীকার করে। কিন্তু কমিউনিস্ট পার্টি, আরো নির্দিষ্ট করে বললে টিটো নতি স্বীকার করেননি। তিনি সাধারণ জনগণকে যুদ্ধক্ষেত্রে মিলিত হবার আহ্বান জানিয়ে একটি ছোট পুস্তিকা প্রকাশ করে ছড়িয়ে দেন। শুরু হয় নাৎসিদের বিরুদ্ধে তার সশস্ত্র প্রতিরোধ। শোনা যায়, সার্বিয়ার কোনো এক গ্রামের একটি ছোট ক্যাম্পের কয়েক হাজার ইহুদিকে মুক্ত করেন টিটো। এজন্য তার বাহিনীর হয়ে ২ হাজার ইহুদিও নাকি যুদ্ধ করেছিল। তবে এ তথ্য নিশ্চিত করতে পারেননি অধিকাংশ ইতিহাসবিদই।

জেনার‍্যাল পপোভিচের সাথে প্রধান সেনাপতি টিটো; image source: ww2db.com

ডিসেম্বরের দিকে টিটো একটি ‘প্রোলেতারিয়ান ব্রিগেড’ গঠন করেন। তার জনপ্রিয়তা তখন আকাশছোঁয়া। পরের বছর যুগোস্লাভিয়ায় ৬৭ সদস্যের ‘ন্যাশনাল কমিটি অব লিবারেশন’ গঠিত হয়, যার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন টিটো। যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে এটি ছিল আক্ষরিক অর্থে যুগোস্লাভিয়ার সরকার। এরপর থেকে যুগোস্লাভিয়া ও আশেপাশের অঞ্চলে অক্ষশক্তির প্রধান লক্ষ্য হয়ে ওঠে টিটোকে হত্যা করা। তবে টিটোর নেতৃত্বে পার্টিজান সাফল্যের সহিত অক্ষশক্তির বিপক্ষে লড়াই করতে থাকে। এমতাবস্থায় ১৯৪৩ সালের মাঝামাঝি সময়ে তেহরান সম্মেলনে টিটোর সাফল্য এবং উদ্যমকে একযোগে স্বীকৃতি দেয় রাশিয়া, আমেরিকা এবং ব্রিটেন। এই সম্মেলনে টিটোর সরকারের সাথে নির্বাসিত রাজা দ্বিতীয় পিটারের সরকারকে একীভূত করার প্রস্তাবও রাখা হয়। এতে করে টিটোর অবস্থান আরো শক্ত হয়, মিত্রশক্তির সহায়তা পাবার রাস্তাও প্রশস্ত হয়।

তেহরান সম্মেলনে স্টালিন, রুজভেল্ট এবং চার্চিল। এ সম্মেলনেই টিটোকে স্বীকৃতি দেয়া হয়; image source: ekspresas.co.uk

১৯৪৪ সালের সেপ্টেম্বরে রাজা দ্বিতীয় পিটারের আহ্বানে যুগোস্লাভিয়ার সমস্ত রাজনৈতিক সংগঠন ও দলগুলো একযোগে টিটোর নেতৃত্ব মেনে নেয়। টিটোকে ততদিনে পুরো মিত্রশক্তিই যুগোস্লাভিয়ার প্রধান সেনাপতি এবং প্রধানমন্ত্রী হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। সবকিছু ঠিকঠাকই চলছিল। কিন্তু, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ সময়ে গিয়ে সমালোচনা মুখোমুখি হন টিটো। যুদ্ধবন্দিদের অ্যামনেস্টি প্রদানে ব্যর্থ হন তিনি। উচ্ছৃঙ্খল এনসিএল বাহিনীর নৃশংস হত্যাকাণ্ড থেকে অধিকাংশ বন্দীকেই বাঁচাতে ব্যর্থ হন টিটো। তবে এই সমালোচনা তার স্বাধীন যুগোস্লাভিয়ার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেয়ার পথে বাঁধা হয়নি। এ সময় যুগোস্লাভিয়ার স্বাধীনতার প্রধান নেতা হিসেবে তার নামই উচ্চারিত হয়। তিনি যুদ্ধে অংশ নেয়াদের সমন্বয়ে যুগোস্লাভিয়ার ‘পিপল’স আর্মি’ গঠন করেন, যা কি না তৎকালীন সময়ে ইউরোপের চতুর্থ শক্তিশালী সেনাবাহিনীতে পরিণত হয়।

বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে দুই মেরুতে ভাগ হওয়া বিশ্বে প্রাথমিকভাবে সোভিয়েত ব্লকের একজন একনিষ্ঠ সমর্থক হিসেবেই পরিচিত ছিলেন টিটো, যদিও স্টালিনের সাথে তার সম্পর্ক খুব একটা উষ্ণ ছিল না। প্রথম থেকেই টিটোর সরকারের মাঝে গোঁড়া মার্ক্সিস্ট বিশ্বাস দৃঢ়ভাবে বদ্ধমূল ছিল। এ বিশ্বাসের বিরুদ্ধমতকে একেবারে শুরু থেকেই দমন করতে শুরু করেন টিটো। তবে খুব দ্রুতই তিনি সোভিয়েত ব্লক থেকে বেরিয়ে গিয়ে স্বাধীনভাবে যুগোস্লাভিয়া পরিচালনা করার সিদ্ধান্ত নেন। এতে করে স্টালিনের সাথে তার সম্পর্কের অবসান ঘটে, যা বিশ্ব রাজনীতিতে বেশ তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা বলে বিবেচিত হয়। কমিউনিস্ট ব্লক থেকে বেরিয়ে গিয়েও সমাজতান্ত্রিক কাঠামোতে রাষ্ট্র পরিচালনা সম্ভব, এ ধারণা প্রতিষ্ঠিত করে তার সিদ্ধান্ত। আর সোভিয়েত ব্লক থেকে বেরিয়ে যাওয়ায়, মার্কিন ব্লকের দেশগুলোর সাথেও অর্থনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তোলার সুযোগ হয় যুগোস্লাভিয়ার, যা দেশটিকে অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিকভাবে লাভবান করে। টিটোর এই সাহসী সিদ্ধান্তে নিজ দেশে তার জনপ্রিয়তা আরো বৃদ্ধি পায়, যদিও একটি শ্রেণীর নিকট তিনি ছিলেন বর্বর স্বৈরাচারী।

জাগরেবে মার্শাল টিটো স্কয়ার, যার বর্তমান নাম রিপাবলিক অব ক্রোয়েশিয়া স্কয়ার; image source: 123RF.com

স্নায়ুযুদ্ধ ধীরে ধীরে তীব্র রূপ ধারণ করতে থাকলে সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত ছোট দেশগুলো নিজেদের রাজনৈতিক অবস্থান নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়ে। এ সময় তারা সোভিয়েত আর মার্কিন ব্লকের বাইরে নিজেদের মধ্যে পৃথক জোট নিরপেক্ষ পরিচয় গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে। এই চেষ্টা টিটো সহ আরো ৪ জন্য রাষ্ট্রনেতার অবদানে সফলতার মুখ দেখে, গড়ে ওঠে ন্যাম। ১৯৬০-৮০’র দশকের শেষদিক পর্যন্তও ন্যামের যথেষ্টই প্রভাব ছিল। এই আন্দোলনের প্রথম সেক্রেটারি জেনারেল হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিলেন টিটো। ন্যামের কল্যাণে বহির্বিশ্বে টিটোর জনপ্রিয়তা আরো বৃদ্ধি পায়, বিভিন্ন দেশের সাথে তিনি যুগোস্লাভিয়ার অর্থনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তুলতে সক্ষম হন। নেহেরু, ক্রুশ্চেভ, চার্চিল, নাসের আর কার্টারদের মতো বিশ্বনেতাদের সাথে শক্ত কূটনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তোলেন তিনি।

১৯৬৩ সালের ৭ এপ্রিল যুগোস্লাভিয়ার সরকারি নাম দেয়া হয় ‘সোশ্যালিস্ট ফেডারেল রিপাবলিক অব যুগোস্লাভিয়া’। তখন থেকেই বিভিন্ন বিষয়ে সুর নরম করতে থাকেন টিটো। ধর্মীয় ব্যাপারে সাধারণ জনগণকে দেয়া হয় স্বাধীনতা, ব্যক্তিগত উদ্যোগকেও স্বাগত জানানো হয়। দু’বছরের মাথায় তিনি ক্যাথলিক চার্চের সকল প্রকার কার্যক্রম স্বতন্ত্রভাবে পরিচালনার অনুমতি দেন। ইতিহাসের প্রথম দেশ হিসেবে যুগোস্লাভিয়া বিশ্বের যেকোনো দেশের পর্যটকদের জন্য ভিসামুক্ত ঘোষণা করেন টিটো। তার একটি বড় সাফল্য ছিল দেশের প্রশাসনিক এবং অর্থনৈতিক কাঠামো বিকেন্দ্রীকরণ করে পুরো দেশে ছড়িয়ে দেয়া, যেন সর্বস্তরের মানুষ তাতে যোগ দিতে পারে। শিক্ষা ও স্বাস্থ্যখাতকে যতদূর পারা যায় সরকারিকরণ করে দরিদ্রশ্রেণীর জন্য বিনাখরচে পড়ালেখা এবং চিকিৎসার ব্যবস্থাও প্রশংসার দাবিদার। তবে বেসরকারি উদ্যোগের অনুমতি দেয়ায় মার্ক্সবাদীরা একপর্যায়ে তার বিরুদ্ধে মার্ক্সবাদ থেকে সরে যাবার অভিযোগ তোলে। এর জবাবে টিটো জানিয়ে দেন, গোঁড়া মার্ক্সবাদ নয়, যুগোস্লাভিয়ার সাথে মানানসই মার্ক্সবাদই তিনি অনুসরণ করবেন।

ন্যাম গঠনের প্রাথমিক ধাপ বান্দুং সম্মেলনে অন্যান্য রাষ্ট্রনেতাদের সাথে জোসিপ ব্রজ টিটো; image source: twitter.com

জোসিপ ব্রজ টিটোর সাফল্য হিসাব করতে গেলে ক্যালকুলেটরের প্রয়োজন হতে পারে। কিন্তু তাতে তার স্বৈরাচারী, একনায়কীয় আর বিরুদ্ধমতের প্রতি প্রচণ্ড মাত্রায় অত্যাচারী আচরণ ঢেকে যায় না। প্রশাসনিক কাঠামোর কেন্দ্রে নিজেকে এমনভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন তিনি যে সর্বময় ক্ষমতা তার কুক্ষিগত হয়। ১৯৭৪ সালে তো নতুন সংবিধান প্রণয়ন করে নিজেকে আজীবন প্রেসিডেন্ট পদে অধিষ্টিত করেন। তার বিরুদ্ধে যেকোনো ধরনের সমালোচনাকে রাষ্ট্রদ্রোহের শামিল ধরা হতো। মামলা, জেল-জুলুম থেকে রেহাই পাননি দেশের সেরা সেরা লেখক, সাংবাদিক আর বুদ্ধিজীবীরাও। বিভিন্ন ক্ষেত্রে যখন থেকে তার সরকার কিছুটা উদার নীতি অবলম্বন করতে শুরু করে, তখনও বিরুদ্ধমতের প্রতি অত্যাচার কমেনি একটুও। আর বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড তো ছিল নিত্যকার ঘটনা। টিটো সবচেয়ে বেশি যে বিষয়টি উচ্চকণ্ঠে প্রচার করতেন, তা হলো যুগোস্লাভিয়ার জিডিপি। তার অপরিণামদর্শী অর্থনৈতিক কাঠামোতে প্রচুর পরিমাণে শিল্পায়নে অর্থ আর জমি বরাদ্দ করা হয়, কৃষিজমিতে গড়ে তোলা হয় বৈদেশিক সহায়তার কলকারখানা। ফলে তরতর করে ফুলে-ফেঁপে ওঠে জিডিপি। কিন্তু তাতে দেশের সুদূরপ্রাসী ক্ষতি হয়।

বসনিয়ায় মার্শাল টিটোর একটি মূর্তি; image source: balkaninsight.com

আমৃত্যু প্রেসিডেন্ট থাকার সংবিধান পাস করানোর পর বেশি দিন সে সুবিধা ভোগ করতে পারেননি টিটো। সত্তরের দশকের শেষ দিকে তার স্বাস্থ্য ক্রমাগত খারাপ হতে থাকে। রাষ্ট্রীয় কার্যক্রম থেকে তিনি ধীরে ধীরে নিজেকে গুটিয়ে নিতে শুরু করেন এবং কেবল সর্বোচ্চ পর্যায়ের সরকারি কাজগুলোই করতেন। ১৯৮০ সালের পয়লা জানুয়ারিতেই হাসপাতালে ভর্তি হন তিনি। তার শরীরে রক্ত সঞ্চালন ঠিকমতো হচ্ছিল না। ৩ দিন পর হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেলেও এক সপ্তাহের মধ্যে আবার হাসপাতালের বেডে শুতে হয় তাকে। এই শয্যাই ছিল তার মৃত্যুশয্যা। মে মাসের ৪ তারিখ শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন জোসিপ ব্রজ টিটো। তার মৃত্যুতে যুগোস্লাভিয়া সহ পুরো বিশ্ব রাজনীতিতেই নেমে এসেছিল শোকের ছায়া। ৪ জন রাজা, ৩১ জন প্রেসিডেন্ট, ৬ জন প্রিন্স, ২২ জন প্রধানমন্ত্রী সহ মোট ১৫৮টি দেশের প্রতিনিধির উপস্থিতিতে তার শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়, যা ছিল তৎকালীন সময়ের সর্ববৃহৎ শেষকৃত্যানুষ্ঠান।

সার্বিয়ার রাজধানী বেলগ্রেডের এই সমাধিতেই চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন মার্শাল জোসিপ ব্রজ টিটো; image source: europebetweeneastandwest.wordpress.com

টিটোর মৃত্যুর পর যুগোস্লাভিয়ার অসংখ্য স্থান আর রাস্তার নামকরণ করা হয় তার নামে, নির্মাণ করা হয় তার মূর্তি ও স্মারক। কিন্তু বর্তমানকালে সেগুলোর অধিকাংশেরই নাম পরিবর্তন করে ফেলা হয়েছে, ভেঙে ফেলা হয়েছে তার অনেক মূর্তি। রাজনৈতিক জীবনে কঠোর টিটো ব্যক্তিগত জীবনে ছিলেন ভীষণ রকমের প্রেমিক পুরুষ। একাধিক নারীর সাথে তার প্রণয় সংঘটিত হয় এবং তাদের প্রায় সবাইকেই তিনি বিয়ে করেন।

তার দুঃসাহসিক সামরিক ক্যারিয়ার আর দীর্ঘ ও সফল রাজনৈতিক ক্যারিয়ারে তিনি নিজ দেশ সহ ৬০টি দেশ থেকে সর্বমোট ১১৯টি পদক ও সম্মাননা লাভ করেন। এর মাঝে লিজিয়ন অব অনার, অর্ডার অব বাথ, অর্ডার অব মেরিট, অর্ডার অব লেনিন, ফেডার‍্যাল ক্রস অব মেরিট সহ ৯২টিই ছিল আন্তর্জাতিক। এত সমালোচনা থাকার পরও এত সম্মাননা প্রাপ্তিই বলে দেয় টিটোর প্রভাব কতটা সুদূরপ্রসারী ছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর স্বাধীনতা পাওয়া অধিকাংশ দেশই কোনো না কোনো একনায়ক পেয়েছিল। তাদের মাঝে টিটো অবশ্যই অনন্য ছিলেন, যিনি সমাজতান্ত্রিক ধ্যান ধারণায় দেশ পরিচালনা করলেও সোভিয়েত ব্লকের রাজনৈতিক উপনিবেশ থেকে দেশকে বের করে আনতে পেরেছিলেন। তাই শত সমালোচনা স্বত্বেও ইতিহাসের পাতায় অমর হয়েছেন মার্শাল জোসিপ ব্রজ টিটো।

ফিচার ছবি: total-croatia-news.com

Related Articles