Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

ম্যারি অ্যানিং: জীবাশ্মবিদ্যার এক উপেক্ষিত নাম

“She sells sea-shells by the sea-shore.”

অনেকেই হয়তো এই ইংরেজি টাং-টুইস্টারটি শুনেছি, বন্ধুদের সাথে এটা নিয়ে মজাও করেছি, কিন্তু যে নারীকে নিয়ে এই বাক্যটি কথিত, তার গল্প আমরা ক’জনই বা জানি?

তার নাম ছিল ম্যারি অ্যানিং। সমুদ্রের ধারে ঝিনুক বিক্রি থেকে শুরু করে আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ ও ইতিহাসের মোড় ঘুরিয়ে দেওয়া কাজ তিনি তার ক্ষুদ্র জীবনে করে গিয়েছিলেন। জীবাশ্ম সংগ্রহের জগতের তিনি ছিলেন একজন পথিকৃৎ এবং বিজ্ঞানের একটি বড় ক্ষেত্র প্যালিওন্টোলজি বা জীবাশ্মবিজ্ঞানের শুরু হয়েছিল অনেকটা তারই হাত ধরে।

ম্যারি অ্যানিং; source: wikimedia commons

ম্যারি অ্যানিংয়ের জন্ম হয়েছিল ১৭৯৯ সালে, ব্রিটিশ প্রদেশ ডরসেটের দক্ষিণ-পশ্চিমের লাইম রেজিসে। সেই লাইম রেজিসকে এখন জুরাসিক কোস্টের অংশ বলা হয়, যেখানে এখনো নতুন নতুন জীবাশ্ম পাওয়া যাচ্ছে।

ম্যারির জীবনের শুরুটা কঠিন ছিল বললে আসলে কমই বলা হয়। অ্যানিং পরিবার ছিল খুবই দরিদ্র। তাদের দশ সন্তানের মধ্যে পূর্ণবয়স্ক হওয়া পর্যন্ত বেঁচে থাকার সৌভাগ্য হয়েছিল শুধু ম্যারি আর তার বড় ভাই জোসেফের। ম্যারির নামটাও প্রকৃতপক্ষে তার এক বড় বোনের নামে যিনি আগুনে পুড়ে মারা গিয়েছিলেন। পরে সেই বোনের নামেই ম্যারির নামকরণ করা হয়।

ম্যারির বাবা রিচার্ড অ্যানিং ছিলেন একজন আসবাব নির্মাতা এবং শখের জীবাশ্ম সংগ্রাহক। ম্যারির বয়স যখন পাঁচ বা ছয় তখন থেকেই তিনি ছিলেন বাবার জীবাশ্ম খোঁজার সঙ্গী। সমুদ্রের ধারে ঘুরে ঘুরে তারা শামুক-ঝিনুক আর কুমিরের দাঁত ভেবে জীবাশ্ম কুড়িয়ে বেড়াতেন আর সেগুলো পর্যটকদের বিক্রি করতেন।

১৮১০ সালে রিচার্ড হঠাৎ পৃথিবী থেকে বিদায় নেন, তখন ম্যারির বয়স এগারো। তখন ম্যারির বড় ভাই জোসেফ তাদের বাবার পেশাগত বিদ্যায় নিজেকে দীক্ষিত করতে শুরু করেন আর ম্যারির মা মলি অ্যানিং ম্যারিকে বলেন তাদের জীবাশ্ম সংগ্রহ বিক্রি করে পারিবারিক ধারদেনাগুলো শোধ করতে।

যে সমুদ্রপারে ম্যারি জীবাশ্ম খুঁজে বেড়াতেন; source: nhm.co.uk

উল্লেখ্য যে, লাইম রেজিস জায়গাটি সবসময়ই ছিল জীবাশ্মের আধার। সে সময় অ্যামোনাইট এবং বেলেম্নাইট জাতীয় জীবাশ্ম সেখানে পাওয়া যেত অহরহ। আর ম্যারির শৈশবের সময়টায় নেপোলিয়নের ফ্রান্স আর ইংল্যান্ডদের মধ্যে তুমুল যুদ্ধ চলছে। তাই সাধারণ মানুষ ছুটিতে দেশের বাইরে কেউ যেতে চাইতো না। সবাই দেখা যেত লাইম রেজিসের মতো সমুদ্রের ধারের শহরগুলোয় ঘুরতে আসছে। আর তাই জীবাশ্ম সংগ্রহ করে বিক্রির ব্যবসা দেখা গেল বেশ লাভজনক হয়ে দাঁড়াচ্ছে। অ্যানিং পরিবার তখন সমুদ্রের পাড়ে রীতিমত জীবাশ্মের স্টল খুলে বসলো। জোসেফের সহায়তায় ম্যারি জীবাশ্ম সংগ্রহ করতেন, আর মলি অ্যানিং স্টলে বসতেন বিক্রেতা হিসেবে।  

তার পরের বছর অর্থাৎ ১৮১১ সালে, এই জীবাশ্মের ব্যবসা চালাতে গিয়েই একটি অসাধারণ ব্যাপার ঘটে যায়। ম্যারির বয়স তখন মাত্র বারো। জোসেফ একদিন হঠাৎ সমুদ্রধারে নতুন ধরনের একটি জীবাশ্মের খুলি খুঁজে পেলেন, এমনটা কখনো কেউ দেখেনি। কৌতুহলী ম্যারি সেই জীবাশ্মের পুরো দেহটাই বের করে ফেললেন খুঁড়ে খুঁড়ে। ৫.২ মিটার লম্বা একটি দেহের অবয়ব তৈরি হয়ে গেল! সারা শহর জেনে গেল, বারো বছরের বালিকা মাটি খুঁড়ে এক দানবের দেহ বের করে এনেছে।

ম্যারি অ্যানিংয়ের পাওয়া ইকথিওসর-এর খুলি; source: wikimedia commons

 তখনো প্রজাতি বিলুপ্ত হবার ধারণাটি সাধারণের মাঝে পরিচিত হয়ে ওঠেনি। বিজ্ঞানীরা ভাবলেন এটা কোনো কুমিরের জীবাশ্ম। বেশিরভাগেরা ভাবলেন কোনো অজানা প্রজাতি যা হয়তো অনেক অতীতে এখানে ছিল, এখন পৃথিবীর অন্য কোথাও গিয়ে বসতি গড়েছে। 

ম্যারির এই রহস্যময় সন্ধান নিয়ে বিতর্ক চললো বছরের পর বছর। শেষ পর্যন্ত এর নাম দেওয়া হলো ইকথিওসরাস, বাংলা করলে দাঁড়ায় মেছো-গিরগিটি। তবে এখন আমরা জানি এই প্রজাতি মাছও নয় গিরগিটিও নয়, এক সামুদ্রিক সরীসৃপ। পৃথিবীতে যার বসবাস ছিল প্রায় ২০ কোটি বছর আগে। কিন্তু দুঃখজনক ব্যাপার হচ্ছে এই জীবাশ্ম নিয়ে বিতর্কের মধ্যে এর আবিষ্কর্তা বারো বছরের বালিকা ম্যারির নাম কখনো আসতো না।

সে সময় থেকেই ম্যারি তার প্রতি বিজ্ঞানীমহলের উপেক্ষার মানসিকতা টের পেতে শুরু করেন। যদিও তৎকালীন লাইম রেজিসের অন্যান্য সব নারীদের মতো ম্যারিও কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সুযোগ পাননি, কিন্তু যেহেতু তিনি লিখতে পড়তে জানতেন, তাই বিজ্ঞানীমহলে নিজের অবস্থান বুঝে নিতে তিনি নিজেকেই নিজে ভূতত্ত্ব এবং শারীরবিদ্যা শিখিয়ে নেন।

ম্যারি অ্যানিংয়ের পাওয়া প্লেসিওসর; source: nhm.co.uk

এরপর ১৮২৩ সালে ম্যারি একটি প্লেসিওসরাসের সম্পূর্ণ কঙ্কাল আবিষ্কার করেন, যা ছিল ইতিহাসের প্রথম প্লেসিওরাস। এই জীবাশ্মটা এতটাই নতুন এবং অদ্ভূত ছিল যে গুজব ছড়ায় এই জীবাশ্মটি আসল নয়, বানানো। প্যালিওন্টোলজির জনক হিসেবে পরিচিত জর্জ কুভিয়েও সেই আবিষ্কারের সত্যতা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করলেন। জিওলজিক্যাল সোসাইটি অব লন্ডনের একটা বৈঠকও বসলো ব্যাপারটি নিয়ে, যেখানে ম্যারিকে আমন্ত্রণ জানানো হলো না। সেখানে লম্বা বিতর্কের পর দেখা গেল, জীবাশ্মটিতে আসলে ছিটেফোঁটাও ভেজাল নেই।

এভাবে জীবাশ্ম খোঁজা এবং তাকে চেনায় ম্যারির খ্যাতি চারদিকে ছড়িয়ে যেতে থাকে। কিন্তু বিজ্ঞানীদের জগতে তাকে কেউ মর্যাদা দিতে চাইতেন না।

অনেক বিজ্ঞানী ম্যারির কাছ থেকে তার আবিষ্কৃত জীবাশ্মকে কিনে নিয়ে, সেগুলোকে নিজের নামে চালিয়ে দিতেন। তার ইতিহাস ঘুরিয়ে দেওয়া ইকথিওসরের আবিষ্কার নিয়ে গবেষণাপত্রগুলোতেও তার নামকে উপেক্ষা করে যাওয়া হয়েছে। তাকে কখনো জিওলজিক্যাল সোসাইটি অব লন্ডনের অংশ হতে দেওয়া হয়নি। প্রকৃতপক্ষে ১৯০৪ সালের আগে কোনো নারীই জায়গা পাননি সেখানে।

ম্যারি অ্যানিংয়ের পাওয়া টেরোসর; source: nhm.co.uk

১৮২৮ সালে ম্যারি লম্বা লেজ এবং পাখাযুক্ত এক জীবাশ্ম আবিষ্কার করেন, যার নাম দেওয়া হয় টেরোসর। প্রথম পাখাযুক্ত ডাইনোসরের সন্ধান ছিল এটি, যাকে আমরা এখন টেরোডাক্টাইল নামে চিনি।

এ সময় ম্যারি আরেকটি ব্যাপার নিয়েও গবেষণা শুরু করেন, কপ্রোলাইটস বা জীবাশ্মে পরিণত হওয়া বিষ্ঠা। শুনতে তেমন আকর্ষণীয় মনে না হলেও তার এই কাজটি বেশ গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কারণ বিষ্ঠা থেকেই বুঝা যেত প্রাচীন প্রাণীদের খাদ্যাভ্যাস, আর খাদ্যাভ্যাস থেকে একটি প্রাণীর অনেক কিছু বুঝে ফেলা যেত।

ম্যারি অ্যানিংয়ের আঁকা প্লেসিওসর; source:nhm.co.uk

ত্রিশ বছর বয়স হবার আগেই ম্যারি নিজের আবিষ্কারের ঝুলি অনেক বড় করে ফেলেছিলেন। তার আবিষ্কৃত জীবাশ্মগুলোকে নিয়ে বিখ্যাত ভূতত্ত্ববিদ হেনরি ডে লা বেচে ‘ডুরিয়া এন্টিকুইয়র’ নামের এক বিখ্যাত চিত্রকর্ম তৈরি করেন। সেখান থেকে আগত অর্থ সম্পূর্ণটাই তিনি ম্যারিকে দেন, কারণ এত সফল একজন জীবাশ্মবিদ হওয়া সত্ত্বেও আর্থিক কষ্ট ম্যারির পিছু ছাড়েনি।

ম্যারি অ্যানিং ১৮৪৭ সালে স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মাত্র ৪৭ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন।  

বর্তমানে লন্ডনের ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়ামে ম্যারির আবিষ্কৃত জীবাশ্মগুলো সংরক্ষিত আছে। দুই শতাব্দী আগে মানুষকে যেমন বিস্মিত করেছে সেসব জীবাশ্মগুলো, এখনকার দর্শকরাও ঠিক একইভাবে বিস্মিত হন এগুলোর বিশালতা এবং আদিমত্ব দেখে। অথচ সাধারণ মানুষের কাছে এই ম্যারি অ্যানিং এখনো খুবই অপরিচিত নাম হয়ে রয়েছে। স্রোতের বিপরীতে থেকে একের পর এক জীবাশ্ম আবিষ্কার করে পৃথিবীর ইতিহাসকে নতুন করে লিখতে বাধ্য করা উনিশ শতকের এই নারীকে আমরা মনে রাখিনি, শুধু মনে রেখেছি এক নামহীন বালিকাকে, যে কীনা সমুদ্রের ধারে ঝিনুক বিক্রি করতো।

This article is written in Bengali language. References are hyperlinked in the article.

Featured Image: a-dinosaur-a-day.com (Artist: Lindsay Leigh)

Related Articles